রবীন্দ্রনাথের জন্মের দেড়শো বছর স্মরণ: পারস্যে রবীন্দ্রনাথ ১

অনুবাদ: মাসুদ খান

‘ইস্পাহান’ পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে আলাপ
২৫ এপ্রিল, ১৯৩২

প্রশ্ন: স্বাগতম, মহাশয়, এই দেশে আপনাকে স্বাগতম। এ ভূমি আপনাকে দিচ্ছে সমুচ্চ সম্মানের স্থান। এ যাবৎ কেমন উপভোগ করলেন এ দেশে আপনার সফর, জানতে পারি কি?

কবি: সুন্দর আপনাদের এই দেশ আর অভিভূতকর আপনাদের মেহমানদারি। যেখানেই গেছি, দারুণ উপভোগ্য সময় কেটেছে আমার।

প্রশ্ন: এই সৌন্দর্য আর এই যে আপনি মেহেরবানি করে বললেন আমাদের মানুষদের অতিথিপরায়ণ স্বভাবের কথা, এগুলোর কোনো প্রভাব পড়ছে কি আপনার চিন্তা ও লেখালেখির ওপর?

কবি: অনুপ্রেরণা পাচ্ছি; পারস্য ছেড়ে চলে যাব যেদিন, অন্তরের ভেতর সেদিন নিশ্চিত বয়ে নিয়ে যাব এই সব অভিজ্ঞতা; আমার কাছে এদের মূল্য হবে দীর্ঘস্থায়ী। এ পর্যন্ত মাত্র কয়েকটি জায়গা দেখেছি আপনাদের দেশের-বুশায়ের একটি বন্দরনগর, এটি কার্যত মরুভূমির মধ্যে অবস্থিত, তা সত্ত্বেও এর ভেতর আপনারা পরম যত্নে সংরক্ষণ করেছেন বেশ কয়েকটি বাগিচা। সিরাজ নগর তো ফুল, পাখি, গাছগাছালি আর বাসন্তী আবহাওয়ায় অত্যন্ত মনোরম; বেশ উপভোগ করলাম। খলিলাবাদ বাগিচায়, পশ্চাৎভূমিজুড়ে কী সুন্দর রক্তাভ পর্বতরেখা, বসে বসে দেখতাম তা-ই আর বিশ্রাম নিতাম ছায়াময় সুশীতল গাছপালার তলায়।

প্রশ্ন: আমরা জেনেছি, সাদি ও হাফিজের মাজার পরিদর্শনে গিয়েছিলেন আপনি।

কবি: আহা, সে অভিজ্ঞতা ঢুকে গেছে আমার একেবারে অন্তরের অন্তঃস্থলে। জানেন, হাফিজের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় আমার বাবার মাধ্যমে। বাবা আমাকে আবৃত্তি করে শোনাতেন হাফিজের কবিতা। কবিতাগুলোকে মনে হতো দূরের অথচ কত কাছের এক কবির কাছ থেকে ভেসে আসা একগুচ্ছ সম্ভাষণ।

কয়েকজন শিক্ষাবিদের সঙ্গে আলাপ
তেহরান ৩ মে, ১৯৩২

কবি: আজ এখানে আপনাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমি খুব খুশি। আমি আরও খুশি হয়েছি, শিক্ষার কিছু মৌলিক নীতি নিয়ে আপনাদের সঙ্গে আলাপের সুযোগ পেয়ে; আমাদের বিদ্যাপীঠগুলোতে যে-নীতিমালা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আমরা ঋণী আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে হয়, শিক্ষার্থীদের মানসদিগন্তপ্রসারিত করার কাজকে, শিক্ষার সঙ্গে আন্তর্জাতিকতাবাদের পটভূমি যুক্ত করার কাজকে, যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা উপলব্ধি করতে পারবে আমাদের এই আন্তঃসম্পর্কিত মানবতার প্রকৃত চরিত্রকে, বুঝতে পারবে আমাদের প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের এক সভ্যতা থেকে আরেক সভ্যতার মধ্যকার গভীরতর ঐক্যগুলোকে।

প্রথম শিক্ষাবিদ: আন্তর্জাতিকতাবাদের এই যে চেতনা, যা কিনা এশিয়ারই চেতনা, আপনি তার পুনরুজ্জীবন ঘটিয়েছেন আপনার বিদ্যাপীঠে। এ জন্য আমার ও আমার সহকর্মীদের তরফ থেকে আপনাকে জানাই গভীর কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।

আপনি তো জানেন, এই চেতনা আমাদের পারস্য সভ্যতায় কোনো বহিরাগত বিষয় নয়। প্রাচীনকালে শাপুরের বিশ্ববিদ্যালয় ছিল রোমের শিক্ষার্থীদের আশ্রয়স্থল; যখন তারা জ্ঞানের জন্য জমায়েত হতো আমাদের শিক্ষাগুরুদের ঘিরে, তখন তাদের মুখোমুখি হতে হয়নি কোনো জাতিগত বৈষম্যের, কখনোই না। আরবদের দখলের পর, আমাদের নিজামীয় বিদ্যালয়ে ছিল ইহুদি, আরব ও অ্যাসিরীয় শিক্ষার্থী। আমাদের সেই শিক্ষা-ঐতিহ্য সত্যান্বেষণ-সম্পর্কিত সব ব্যাপারেই ধরে রেখেছে এই অতিজাতিক দৃষ্টিভঙ্গি, পূর্বাপর একই রকমভাবে। এই সেই ঐতিহ্য, যা আমরা বয়ে চলেছি আমাদের রক্তের ভেতর। এই সেই ঐতিহ্য, যার সুবাদে আপনার বার্তা, আপনার পয়গাম আমরা গ্রহণ করতে পারছি অত্যন্ত খোলা মনে।

কবি: নানা জাতি ও জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাংস্কৃতিক জোটের ব্যাপারে আপনাদের এই গভীর বিশ্বাস এই যে আমার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন এতে আমি খুব আনন্দিত। ভারতবর্ষে আমরা দেশজ ও বহিরাগত নানা সংস্কৃতির প্রতি দেখিয়ে এসেছি উদার আতিথেয়তা; কাছের দূরের নানা প্রভাবকে আত্তীকৃত করে আমরা বিকশিত করে তুলতে চেষ্টা করেছি আমাদের নিজস্ব সভ্যতা। শুধু এই এখন, এই যুগে এসে আমাদের মেকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমরা ঢুকে পড়েছি তোতাপাখিসুলভ পুনরাবৃত্তিতে, ঢুকে পড়েছি নির্বিচার অনুকরণে। আমাদের যে মানসোদ্যোগ, আমাদের যে বিচার-বিবেচনার সাহস, সেগুলো কোনো কাজে না লাগিয়ে আমরা ঢুকে পড়েছি মুখস্থ বিদ্যায়। ফলে বেরিয়ে আসছে শাশ্বত সব স্কুলবালক, যারা সংগ্রহ করে কেবলই তথ্য, যে তথ্য কখনোই পরিপক্ব হয় না, পরিণত হয় না জ্ঞানে ও প্রজ্ঞায়।

আমাদের শিক্ষার্থীদের কাছে মনীষার এক মহাদেশীয় পটভূমি তুলে ধরাই আমার স্বপ্ন; সেই পটভূমি, যার ভেতরে সমন্বিত হয়েছে যুগ-যুগান্তরের অভিজ্ঞতা; সেই পটভূমি, যার ভেতরে দীর্ঘ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ঘটে চলেছে বৌদ্ধিক ও আত্মিক নানা পরীক্ষানিরীক্ষা।

ইউরোপ বিকশিত করে তুলেছে একটি অভিন্ন মহাদেশীয় সংস্কৃতি, যা এক এজমালি রত্নকোষের মতো; ইউরোপের বিভিন্ন জনগোষ্ঠী সেই কোষে দান করেছে তাদের মহোত্তম উপহারসামগ্রী। যৌথ এই সহযোগিতার সুবাদেই ইউরোপ হয়েছে মহান। ইউরোপ সার্থকরূপে কাজে লাগিয়েছে তার জনগোষ্ঠীর ঐশ্বর্যপূর্ণ নানা শক্তি ও সম্ভাবনাকে, আর চলে এসেছে জীবনের অগ্রযাত্রার ঠিক সামনের কাতারে। এশিয়াকেও সেটা করতে হবে, তাকে অবশ্যই পুনরায় সংগঠিত করতে হবে তার মহাদেশীয় জীবনকে; উজ্জীবিত করে তুলতে হবে তার ছড়ানো-ছিটানো নানা কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে, তাদের আসক্তি ও প্রবণতাগুলোকে চিনে নিয়ে, স্বীকৃতি দিয়ে এবং শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান ও নাগরিক জীবনে তাদের প্রকাশ ঘটিয়ে। এশিয়াকেও ভাঙতে হবে জাতিগত বিভাজনের সব প্রতিবন্ধকতা, লাগাতার কঠোরভাবে লড়ে যেতে হবে ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, লড়ে যেতে হবে সামাজিক অসংগতি-বিসংগতির বিরুদ্ধে। আমাদের এই অভিন্ন মানবতার গভীরতম প্রদেশে যা কিছু বিরাজ করে, তার এক দুঃসাহসী অন্বেষণে এশিয়াকে অবশ্যই হতে হবে ঐক্যবদ্ধ আর পশ্চিমের দিকে বাড়িয়ে দিতে হবে বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতার হাত।

দ্বিতীয় শিক্ষাবিদ: স্যার, আমরা নিশ্চিত, আপনার এই প্রত্যাশা একদিন হয়ে উঠবে ন্যায্য ও অনিবার্য। কারণ, একটি সভ্যতার গভীরতম চাহিদা আর তার মহত্তম পরিপূর্ণতার প্রকাশ ঘটে তার প্রতিভাকুলের মাধ্যমে। একজন পয়গম্বর আবির্ভূত হন পরিস্থিতির ফসল হিসেবে, দেশের এক সংকটাপন্ন কালপর্বে ঘটে তাঁর আবির্ভাব। এশিয়ার বড় বড় জাতিগুলো আজ ভাবছে তাদের অতীত গৌরব নিয়ে, জেগে উঠছে তাদের দায়িত্ব ও জাতিগত উত্তরাধিকারসহ। তারা পেতে চাইছে এক মহান পয়গাম, যা উদ্দীপিত করবে তাদের সুপ্ত চেতনাকে, এনে দেবে তাদের পরিপূর্ণতম ব্যক্তিত্বের দীপ্তি। জনাব, আপনি আবিভর্ূত হয়েছেন এশিয়ার সেই মহান স্বপ্নগুচ্ছের পয়গম্বর হিসেবে, মুখপাত্র হিসেবে। আপনার মধ্য দিয়ে আমরা শিক্ষকেরা উপলব্ধি করতে শুরু করেছি আমাদের সামনে পড়ে থাকা কাজের প্রকৃতিকে। যদিও আপনার বার্তা আমরা পাচ্ছি তর্জমা নামের এক অতুষ্টিকর মাধ্যমের ভেতর দিয়ে, তবুও আপনার মহৎ অভিব্যক্তি আর আপনার কথার গীতিময়তা আপনার বার্তাকে নিয়ে এসেছে আমাদের আত্মার একেবারে কাছাকাছি।

কবি: বিচ্ছিন্ন সব প্রাদেশিক প্রদীপ নিয়ে আর সন্তুষ্ট থাকা চলবে না আমাদের। আমাদের অবশ্যই হবে, হতে হবে এক উজ্জ্বল আলোমালার উৎসব, যার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হবে এশিয়ায় আমাদের মানবতার সেই দীপ্তি, যা এই আধুনিক যুগের সামনে তুলে ধরবে আমাদের ন্যায্যতা। অন্যথায় আমার কখনোই আশা করতে পারব না এই উন্মুক্ত বিশ্বের স্বীকৃতি, আমরা পড়ে থাকব আড়ালে, অন্তরালে। আর এই অন্তরালের বাঁধন হচ্ছে দাসত্বের নিকৃষ্টতম রূপ, যা একটি জাতিকে করতে পারে শৃঙ্খলিত। মুক্তি অবশ্যই অর্জন করতে হবে আমাদের। মুক্তি, যা আত্ম-অভিব্যক্তির এক দানবিশেষ, যা সুযোগ নয় কোনো, বস্তুগত বিলাসব্যসনে নিজেদের ডুবিয়ে ফেলার। আমাদের মহান অতীতে আমাদের স্বাধীন সব জনগোষ্ঠী দেশে দেশে প্রেরণ করত তাদের বর্তিকাবাহকদের। তারা বয়ে নিয়ে যেত প্রেম আর মহোচ্চ সব চিন্তা ও কর্মের সমুজ্জ্বল বার্তা; তারা তাদের দ্রষ্টাদের, ঋষিদের উচ্চতম উপলব্ধিমালার সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দিত প্রতিবেশী জনগোষ্ঠীকে। সেই সব দিনে এশিয়ার ছিল আত্মার স্বাধীনতা; যা কিছু এশিয়ার কাছে বিবেচিত হতো মহৎ ও টেকসই হিসেবে, তাদের গ্রহণ ও আদান-প্রদানের ব্যাপারে এশিয়ার ছিল আত্মার স্বাধীনতা। এ হচ্ছে স্বাধীনতার সেই চূড়ান্ত রূপ, যা আজ আমাদের অবশ্যই অর্জন করতে হবে আগামী প্রজন্মের জন্য, যা খুলে দেবে তাদের চরিত্রের সবচেয়ে ঐশ্বর্যপূর্ণ শক্তি ও সম্ভাবনাকে, পূর্ণাঙ্গ জীবনের শিক্ষার মাধ্যমে। মানবের আত্মিক সত্যের আলোকে ইতিহাস, বিজ্ঞান ও শিল্পকলার সঠিক পাঠের মধ্য দিয়ে আমাদের এই অভিন্ন মানবতার ভেতরকার জ্ঞাতিত্বকে চেনার জন্য দরকার প্রশিক্ষণের; আর ওই পূর্ণাঙ্গ জীবনের শিক্ষা জড়িয়ে আছে এই প্রশিক্ষণের সঙ্গে।

প্রায়োগিক শিক্ষার মূল্য অবশ্যই আছে, তবে আমাদের ব্যক্তিত্বের সমগ্রতাকে অনুধাবন ও ধারণ করে যেসব আকাঙ্ক্ষা, তাদের সব মাহাত্ম্য থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ে এই শিক্ষা, যদি এটি তার সংকীর্ণ ও তাৎক্ষণিক লক্ষ্য হাসিলের খণ্ডিত কাজ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয় শিক্ষার্থীদের মনে বৃহত্তর লক্ষ্যের প্রণোদনা জাগিয়ে তুলতে। প্রাচ্যে আমাদের এই অখণ্ড আত্মিক জীবনের মৌলিক মূল্যবোধগুলোর সঙ্গে আমাদের বিদ্যায়তনগুলোকে যুক্ত করতে অবশ্যই ভুলব না আমরা। কারণ, আমাদের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর লক্ষ্য ছিল তা-ই। এই যেমন আপনি বললেন, রাজনৈতিক নানা উত্থানপতন সত্ত্বেও আমাদের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কখনোই অন্ধকারে আচ্ছন্ন হতে দেয়নি তাদের মানবতার দৃষ্টি। এশিয়া তার উদার সাংস্কৃতিক সহযোগিতার চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ঋণী ওই মানবতার কাছে। নিষ্ঠুর রাজনীতি আর বস্তুগত লালসা আজ কুরে কুরে খাচ্ছে সবকিছু, এমনকি শিক্ষার দুর্গকেও; এহেন রাজনীতি আর লালসায় বিভক্ত আধুনিক যুগের আর্ত জনগোষ্ঠীকে সুস্থ করে তোলার জন্যও এশিয়া ঋণী ওই মানবতার কাছেই।

এশিয়ার মনীষাগুলোর পরস্পরের মধ্যে মেশামেশি ঘটিয়ে তুলতে হলে আমাদের মনকে অবশ্যই মুক্ত করতে হবে সেসব জিনিস থেকে, যা অন্ধকারাচ্ছন্ন ও যুক্তিবিরুদ্ধ, মুক্ত করতে হবে স্থানিক ইতিহাসের সেইসব চ্যুতি-বিচ্যুতি থেকে, যা অন্যদের ঠেলে দেয় দূরে এবং এক বৌদ্ধিক নিরাসক্তির চেতনা নিয়ে খুঁজে বের করতে হবে সেই গুপ্তধনরাশি যাদের মূল্য শাশ্বত, সর্বজনীন।

শিক্ষাবিদ: বস্তুগত প্রগতির দরকার আছে, তবে তাকে অবশ্যই জানতে হবে তার সীমা। শিক্ষার এক মহান লক্ষ্য হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে এরকম এক সঠিক মূল্যবোধে ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করার জন্য শিক্ষক হিসেবে আমাদের কী কাজ, তা চমৎকারভাবে আজ আপনি আমাদের কাছে স্পষ্ট করে তুললেন। ইতিহাসের প্রতিটি ছাত্র জানে, কীভাবে বস্তুগত চাহিদার নিদারুণ অভাবে কিংবা আতিশয্যে ধ্বংস হয়ে গেছে জাতির পর জাতি। মোটামুটিভাবে বললে, প্রাচ্য ও প্রতীচ্য আজ আমাদের সামনে তুলে ধরে এই দুই চরম অবস্থার দৃশ্যপট। বস্তুগত অর্জনের দিকে অতিমাত্রায় মনোযোগ দিতে গিয়ে ইউরোপ তার আত্মাকে বিকিয়ে দিয়ে শোষণ করেছে প্রকৃতি ও মানুষকে। ইউরোপের মহাদেশীয় জীবনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত যে অভিন্ন লক্ষ্য, তারই সুবাদে ইউরোপ বিকশিত করে তুলেছে সভ্যতার একটি ঐক্য। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। ফলাফল এত স্পষ্ট যে এর কোনো ব্যাখ্যার দরকার পড়ে না। এশিয়া এখনো ধরে রেখেছে তার সেই সংশ্লেষী সাংস্কৃতিক জীবনদৃষ্টি, যেখানে ‘ভালো’ বলতে সমগ্র প্রকৃতির, সব জনগোষ্ঠীর ‘ভালো’ বোঝায়। কিন্তু আপনি যেভাবে এখন স্পষ্ট করলেন আমাদের কাছে, একটি ঐক্যবদ্ধ মহাদেশীয় সভ্যতার ভিত্তিতে এশিয়া তার আদর্শ প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হওয়ায় আজ সে পড়ে আছে অকার্যকর হয়ে।
আপনি তুলে ধরেছেন এশিয়ার আত্ম-অভিব্যক্তির পতাকা, আপনার শিক্ষাভাবনা আধুনিক যুগের কাছে যেন এক নতুন প্রত্যাদেশ। আমরা গর্বিত, আপনার মাধ্যমে আমাদের এই মহাদেশ সমগ্র মানবজাতিকে দিচ্ছে একটি নতুন পথের প্রতিশ্রুতি, যে পথ আমাদেরকে বের করে আনবে বর্তমানের এই জঞ্জাল থেকে, বের করে আনবে সমস্ত বিভ্রম থেকে, বের করে আনবে সমস্ত নিপীড়ন থেকে, যা আমাদের অপমানিত করে, আমাদের নিয়ে যায় পারস্পরিক দ্বন্দ্বের ভেতর। আপনাকে নিশ্চিত করতে পারি, আপনার বার্তা আমরা ভুলব না কখনোই, আমাদের এই পুনর্জায়মান জাতি সর্বাত্মক চেষ্টা করবে আপনার ভাবনাকে কার্যকরী রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে।

কবি: আমি ধন্যবাদ জানাই আপনাদের সহানুভূতির জন্য, আপনাদের বিশ্বাসের জন্য, যা ভবিষ্যতের জন্য আমার আশাকে করবে আরও জোরদার, আরও মজবুত। বঙ্গদেশে আমাদের প্রতিষ্ঠানটি তার সাফল্যের জন্য নির্ভর করবে আপনাদের সহযোগিতার ওপর। আমরা অবশ্যই থাকব, থাকতে হবে, পরস্পরের সংস্পর্শে আর চালিত হব সেই অভিজ্ঞতার দ্বারা যা আমরা উভয়েই অর্জন করেছি আমাদের চেষ্টায়। আমরা তা অর্জন করেছি আমাদের যুবসম্প্রদায়ের মনমানসের অভিমুখকে সংস্কৃতির এমন এক ভ্রাতৃসংঘের দিকে চালিত করবার লক্ষ্যে যা মানবগোষ্ঠীকে একত্রিত করবে ভালোবাসায় ও পারস্পরিক জানা-বোঝায়।

Facebook Comments

2 Comments

  1. Pingback: রবীন্দ্রনাথের জন্মের দেড়শো বছর স্মরণ: পারস্যে রবীন্দ্রনাথ ২ » সাহিত্য ক্যাফে

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top