রবীন্দ্রনাথের জন্মের দেড়শো বছর স্মরণ: পারস্যে রবীন্দ্রনাথ ২

                                                        আগের কিস্তি: পারস্যে রবীন্দ্রনাথ ১

অনুবাদ: মাসুদ খান

ইরানের জনৈক সাংসদের সঙ্গে কবির আলোচনা

রবীন্দ্রনাথ: পারস্য ছেড়ে চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছে আমার। বেশি দিন থাকিনি এখানে, তবু নিজেকে ভিনদেশি বলে বোধ হচ্ছে না। অবাক ব্যাপার, যদিও আপনাদের ভাষা জানি না, তবু কোনো না কোনোভাবে আমি আপনাদের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি, অনায়াসেই যোগাযোগ করতে পারছি আপনাদের সঙ্গে আর অনুভব করছি আপনাদের সখ্যের উষ্ণতা। আপনাদের আর আমাদের জনগোষ্ঠির মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। উভয়েরই জীবনদৃষ্টি ও মেজাজমর্জি অনেকটা সমজাতীয় বলে মনে হয়।

দশতি: ভাষারা এ ক্ষেত্রে, যা হোক, গৌণ; প্রধান গুরুত্বের বিষয় হলো আমাদের মনস্তাত্ত্বিক গড়ন যা নিজেকে ব্যক্ত করে সরাসরি ইঙ্গিত আর অভিব্যক্তির মাধ্যমে।

বুশায়েরে থাকতে আপনি আমাকে বলেছিলেন, পারস্যে আমাদের কাছে আপনি এসেছেন প্রাচীন ভারতকে আবিষ্কারের লক্ষ্যে। একদম খাঁটি কথা, আমাদের আসল চেতনাটা হচ্ছে প্রাচীন ভারতীয়; এটা এসেছে অতীত থেকে, যখন আমরা ছিলাম একই অভিন্ন সংস্কৃতির অংশভাক। এমনকি এখনো বিরাজ করে এক অন্তর্নিহিত আসক্তি, আর সে কারণেই আপনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন আমাদের সঙ্গে।

রবীন্দ্রনাথ: হ্যাঁ, আমার জন্য পথটি খোলা ছিল আমার জন্মের আগে থেকেই। প্রকৃতপক্ষে, আমি যখন ছোট ছিলাম, বঙ্গদেশে আমাদের বাড়িতে ছিল ইরানি চেতনার এক প্রাণবন্ত প্রভাব। আমার পরম পূজনীয় পিতা আর বড় দাদারা গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন ফারসি মরমি সাহিত্য ও শিল্পকলার সঙ্গে।

আরও পেছনে গেলে আবিষ্কার করা যাবে, বাংলাভাষা একসময় আপনাদের শব্দভাণ্ডার থেকে শব্দ নিয়েছে অবাধে, যেগুলো আমরা এখন ব্যবহার করি তাদের ব্যুৎপত্তি না জেনেই। এটা যখন আপনি লক্ষ করবেন তখন নিশ্চয়ই জানবেন, আপনাদের সংস্কৃতির কিছু জিনিশ বয়ে চলেছে আমাদের রোজকার জীবনের ভেতর দিয়ে। কারণ, শব্দরা হলো চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের প্রতীক। এমনকি ভারতে মুসলিম শাসনের আগেও ভারত আর ইরানের মধ্যে ছিল সক্রিয় সাংস্কৃতিক বিনিময়। আমাদের ধ্রুপদী শিল্পকলায় ও সাহিত্যে খুঁজে বের করতে হবে তাদের সরাসরি চিহ্নগুলো। আপনাদের জীবনযাপন আর আচার-অভ্যাস আমাদের কাছে মোটেও অচেনা ঠেকেনি। আপনাদের রীতিনীতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া ও আপনাদের চেতনাকে উপলব্ধি করা আমার পক্ষে বেশ সহজ।

দশতি: আশা করি আপনাকে আমরা খুব বেশি বিরক্ত করছি না। আমরা সবাই চেয়েছি আপনার সাথে মোলাকাত করতে, কথা বলতে, আর পেতে চেয়েছি অনুপ্রেরণা আপনার ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে। আপনাকে যতটা পাওয়া উচিত ছিল ততটা সম্ভব হয়নি আমাদের পক্ষে।

রবীন্দ্রনাথ: জানেন, এটাই চেয়েছিলাম আমি। আমার ইচ্ছে, আপনাদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর লোকজনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করার। ইচ্ছে ছিল, পেশা ও সামাজিক স্তর নির্বিশেষে ব্যক্তিকে জানার। মানছি, এনগেজমেন্টের ধকল মাঝেমধ্যে আমার শরীর-স্বাস্থ্যের ক্ষতি করেছে বটে, তবে সেটাকে আমি কখনো কিছু মনেই করিনি। আপনাদের লোকজনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ, তাদের সঙ্গে পারস্যের হালফিল ঘটনাবলি নিয়ে আলাপ-আলোচনা যার ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী আমরা— এ সবই আমার জন্য এক বিরাট অনুপ্রেরণা।

জনৈক ভদ্রলোক: বঙ্গদেশে, আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে পারস্য সংস্কৃতির কোনো বিভাগ কি চালু করেছেন ইতোমধ্যেই?

রবীন্দ্রনাথ: হ্যাঁ। কারণ, আমি সব সময় অনুভব করি, আমাদের উভয়ের জন্যই দরকার পরস্পরকে জানা। শুধু এই জন্য নয় যে আমরা একই বংশের, বরং এই জন্য যে আপনাদের সাহিত্য ও শিল্পকলায় এমন কিছু আছে যা আমাদের কাছে জাগিয়ে তোলে এক গভীর আবেদন। পারসিক মেজাজ হচ্ছে কাব্যিক মেজাজ, আপনারা ভালোবাসেন সংগীত আর খোশগল্প। প্রকৃতির সৌন্দর্যের প্রতি আমাদের মতো আপনাদেরও রয়েছে গভীর ভালবাসা।

যদি আপনারা কট্টর ধর্মীয় ‘মোল্লা’ হতেন আমাদের হিন্দু পুরুতদের মতো, তাহলে আমরা আপনাদের আমন্ত্রণ জানাতে সাহস করতাম না। দুর্ভাগ্যবশত ভারতবর্ষে আমাদের বড় বড় সম্প্রদায়ের মধ্যে দুটো সম্প্রদায়ে রয়েছে এই ধরনের গোঁড়া প্রতিনিধি আর এই কারণেই আমরা পারছি না একত্রিত হতে। আমি সহযোগিতা দাবি করছি আপনাদের পণ্ডিতদের, আপনাদের শিল্পীদের কাছ থেকে, যাঁদের প্রভাব আমাদেরকে একত্রিত করবে সাংস্কৃতিকভাবে আর শুধরে নেবে আমাদের পার্থক্যগুলোকে, যেগুলো আদৌ মৌলিক কোনো পার্থক্যই নয়।

দশতি: পারসিক সংগীত আপনার কেমন লাগে?

রবীন্দ্রনাথ: সত্যিই খুব ভালো লাগে। আপনাদের সাম্প্রতিক রীতি বা ধারাগুলোর কিছু কিছু বুঝি না পুরোপুরি। আমার কাছে মনে হয়েছে, আপনাদের দেশজ সংগীত ঘরানার মধ্যে ওগুলো আত্তীকৃত হয়নি পুরোপুরি। ওগুলো ইউরোপকে মনে করিয়ে দেয় বেশি করে। যা হোক, আপনাদের ধ্রুপদী সংগীতের মতো ওগুলো আমাকে অতটা নাড়া দেয় না।

দশতি: আমাদেরও ওই একই মত। হারমোনি বা স্বরসঙ্গতির প্রবর্তন এতই সাম্প্রতিক যে, তা আমাদের সংগীতকে সমৃদ্ধ করতে পারেনি সার্থকভাবে। তবে এমন হতে পারে, আমরা হয়তো ধীরে ধীরে বিকশিত করে তুলব এমন এক সংগীত, যা এইসব নবরীতি, নবধারার সুবাদে হয়ে উঠবে খুবই নান্দনিক।

রবীন্দ্রনাথ: অবশ্যই তা হবে। বাইরের প্রভাব আত্তীকরণ এবং সেইসঙ্গে আপনাদের নিজেদের রয়েছে যে অনন্য সংস্কৃতি তার অভিব্যক্তি দিয়ে আরও পরিপূর্ণরূপে ব্যক্ত হওয়ার এক বিস্ময়কর সহজাত ক্ষমতা আগাগোড়াই রয়েছে আপনাদের মধ্যে। সংগীতেও আপনারা নিশ্চয়ই লাভবান হবেন ইউরোপীয় প্রভাবের দ্বারা। সবসময়ের জন্য আমার একটি দুঃখবোধ রয়েছে এ কারণে যে, ইউরোপীয় সংগীতের কোনো সরাসরি প্রভাব নেই আমাদের নিজস্ব সংগীতের ওপর; এ জন্য যে, মহৎ ইউরোপীয় সংগীতস্রষ্টারা, যেমন বিটোফেন, এঁরা কোনোই প্রভাব ফেলেননি প্রাচ্যের সাংস্কৃতিক আন্দোলনসমূহের ওপর, যেমনটা ফেলেছিলেন ইউরোপের মহৎ কবিরা, মহৎ দার্শনিকেরা; কিংবা এঁরা প্রভাব ফেললেও তা খুবই সামান্য। কারণ, ইউরোপীয় সংগীত প্রশ্নাতীতভাবে মহৎ এবং নিঃসন্দেহে আমাদের সংগীত হয়ে উঠবে আরও সমৃদ্ধ যদি তা তার নিজের প্রাণবন্ত বুনটের ভেতর শুষে নিতে পারে ইউরোপীয় সংগীতের সৃজনশীল প্রভাবগুলোকে।

দশতি: আমি তাদের একজন যারা বিশ্বাস করেন, পারস্যের উচিত মার্কিনী সংস্কৃতিকে শতভাগ আত্তীকরণ করা। বিদেশী প্রভাবের ভয়ে শঙ্কিত নই আমি। আমি সত্যিই বিশ্বাস করি, আমাদের স্বভাবধর্মকে, আমাদের মেজাজমর্জিকে কোনো কিছুই পারবে না আমূল বদলে দিতে। অতএব, আমরা নিশ্চিন্ত নিরাপদে নেমে পড়তে পারি মার্কিনায়নে।

তখন আমরা পদ্ধতিগতভাবে হব আমেরিকান, কিন্তু কৃষ্টিগতভাবে থাকব আগাগোড়া পারসিক। আমি বিশ্বাস করি, আপনারা এই একই নীতি অনুসরণ করেন শান্তিনিকেতনে।

রবীন্দ্রনাথ: সময় এসেছে মানবসভ্যতা সম্পর্কে আমাদের গভীরভাবে ভাববার। আপনি নিশ্চয়ই পড়ে থাকবেন স্পেংলারের বই, ইউরোপীয় সভ্যতার ওপর লেখা। বইটি পশ্চিমা আধুনিক সভ্যতার নিয়তি সম্পর্কে উত্থাপন করেছে নানা অনুসন্ধানী প্রশ্ন এবং আমাদের জন্য ইতিহাস থেকে তুলে ধরেছে এক বিপজ্জনক তুলনা।

আপনি যখন শতভাগ মার্কিনায়নের কথা বলছেন, তখন এ কথাও অবশ্যই মনে রাখবেন যে, খোদ আমেরিকা আজ এক আসন্ন সঙ্কটের মুখোমুখি এবং এখন পর্যন্ত সে অর্জন করেনি সেরকম কোনো স্থিতিশীলতা যা কিনা প্রমাণ দেবে তার সামাজিক ও রাজনৈতিক কলকব্জার অটুটত্বের।

আজ এক জার্মান বৈজ্ঞানিকের সঙ্গে কথা বলছিলাম, লিপজিগের ড. স্ট্রাটিল সৌয়ের, ভূতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের কাজে যিনি বার্লিন থেকে এসেছেন এখানে সারাটা পথ মোটরগাড়িতে চড়ে, তিনিও আমাকে বলছিলেন ইউরোপ সম্পর্কে সেই একই কথা। সমগ্র পশ্চিমা সভ্যতা চলেছে এক কঠোর পরীক্ষানিরীক্ষার ভেতর দিয়ে। পশ্চিমে জীবনযাত্রা যে ধরনের লাগামছাড়া যান্ত্রিকতায় মজে আছে, তাতে ইতিমধ্যেই দেখা দিচ্ছে মারাত্মক সব প্রতিক্রিয়া।

তাড়াহুড়ো করে পশ্চিমা জীবনযাত্রার অনুকরণে যাওয়ার আগে, প্রাচ্যে আমাদের অবশ্যই একান্তভাবে ভেবে দেখতে হবে বিষয়টাকে। ইউরোপীয় জীবনযাত্রার ভিত্তিমূলেই কোথায় যেন রয়েছে এক গভীর সমন্বয়হীনতা। চারদিকে আছে বস্তুগত সমৃদ্ধি, কিন্তু উধাও হয়েছে সুখ। আর কীভাবেই বা হতে পারত অন্য রকম? আধুনিকতার উপরি-প্রলেপ ভেদ করে ঢুকে যান, দেখবেন, এক আদিমপ্রায় বর্বরতা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে আপনার দিকে। নানা জৈবিক চাহিদা, যেমন ধরুন, জাঁকালো পোশাক-আশাক, দামি গাড়ি, অঢেল খানাদানা, অঢেল আবাসন, অর্থাৎ বলতে গেলে যেগুলো আমাদের জৈব-অস্তিত্বের প্রাথমিক প্রয়োজন মেটায়, সেসব সামগ্রীর জন্য এক বিরামহীন চিন্তাভাবনা, এক বিরামহীন খাই-খাই ভাব-জনসাধারণের কাছে এই হচ্ছে ক্ষিপ্র আধুনিক জীবন, এ ছাড়া আর কি? কোনো সময় নেই আত্মোপলব্ধির, কোনো সময় নেই মানবিক সখ্য গড়বার, সময় নেই সেসবের জন্য যা মানুষের বেঁচে থাকাকে করে তোলে অর্থবহ ও মূল্যবান।

এ হচ্ছে, নিশ্চিতভাবে, বর্বরতার এক আধুনিক রূপ যা কিনা তার সমস্ত সম্পদকে, সব ঐশ্বর্যকে নিঃশেষ করে ফেলে স্রেফ জীবনযাপনের, শূন্যতায় ঘেরা এক জীবনযাপনের খাড়া চূড়ায় বেয়ে ওঠার জন্য।

দশতি: আমাদের চৈতন্য তা-ই নেয়, যা সে পারে। ঠিক কতটুকু গ্রহণ বা বর্জন করতে হবে তা আমরা সচেতনভাবে ঠিক করতে পারি না। আত্তীকরণের পুরো প্রক্রিয়াটাই হচ্ছে একটি অবচেতনের প্রক্রিয়া। সুতরাং, শুধু যে বাইরের প্রভাবই আমাদের সভ্যতার মৌলিক চরিত্রকে পুরোপুরি ডোবাবে বা শেষ করে দেবে, সম্ভবত সেরকম ভয় নেই। যদি আমরা আমেরিকান যাপনপ্রণালীর দ্বারা লাভবান হওয়ার চেষ্টা করি, যদি ওগুলোকে আমাদের জনগণের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করি, তবে সেগুলোর মধ্য থেকে হয়তো আমরা বেছে নেব মাত্র কয়েকটাকে। ব্যস, আর ওটুকুই হবে আমাদের লাভ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভারতের বিখ্যাত স্থাপত্য ও ভাস্কর্যশিল্পের ওপর গ্রিক আইডিয়ালসমূহ রেখে গেছে তাদের উত্তরাধিকার। অথচ গ্রিক প্রভাবের গোড়ার দিকে আমরা হয়তো আশঙ্কা করতাম, ভারত তার ঐতিহ্যের ওপর রকমারি গ্রিক মোটিফ ও কলাকৌশল নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে গিয়ে হয়তো ক্ষতি করছে তার ঐতিহ্যেরই। পারস্যেও অতিবাহিত হয়েছে ওইরূপ বহিরাগত প্রভাবের কালপর্ব। তবে সে-প্রভাব কেবলই প্রাণিত করে গেছে আমাদের অন্তর্নিহিত পারসিক বৈশিষ্ট্যকে। আমরা দ্রুত ঝেড়ে ফেলেছি অনুকরণপর্বকে আর তা থেকে ধরে রেখেছি কিছু-কিছু উপকারী জিনিস।

রবীন্দ্রনাথ: তাহলে কেন জোর দিচ্ছেন মার্কিন জীবনযাত্রা-প্রণালীর ওপর? আর কীভাবেই বা আলাদা করে, নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করছেন একটি বিশেষ দেশের কথা, যখন আপনারা চাইছেন বিজ্ঞানের সুস্থ ছোঁয়া? মার্কিনীও নয়, পশ্চিমাও নয়, বিজ্ঞান বরং তার সত্যের দিক থেকে বৈশ্বিক ও সর্বজনীন। আমেরিকা, বিশেষ ওই দেশটির আমি নিন্দা করছি না, শুধু এইটুকু তুলে ধরছি যে, আপনি যখন কোনো একটি বিশেষ দেশকে, একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীকে অনুকরণ করতে চাওয়ার কথা বলেন তখন আপনি কেবল তাদের জিনিসগুলোর, তাদের বাহ্যিক ঘটনাগুলোর নকল করতে পারবেন, কিন্তু মানবচরিত্রের ভিত্তিমূলে নিহিত যে সত্যসমূহ তাদেরকে পারবেন না আত্তীকরণ করতে। যদি একটি জাতি বা একটি জনগোষ্ঠী তার সেইসব আদর্শ রূপায়ণে সফল হয় যাদের মূল্য দীর্ঘস্থায়ী, তবে তাদের কাছ থেকে আমাদের যা শিখতে হবে তা হলো ওইসব আদর্শ আত্তীকরণ ও প্রতিষ্ঠিতকরণের সামর্থ্য; অন্যরা যা কিছু তৈরি করেছে, আমরা নিশ্চয়ই সেগুলো নকল করব না শুধুই। আমার
কথা এটাই, যেসব সত্যের রয়েছে সর্বজনীন মূল্য, সেগুলোকে আত্তীকরণের বিপক্ষে নই আমি; বাস্তবিকপক্ষে, ওগুলো আমাদের নিজেদের বলে দাবি করবার অধিকার আমাদের জন্মগত। তবে আমি তৈরি মডেল গ্রহণের বিপক্ষে, কোনো একটি নির্দিষ্ট জাতি বা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঘটে যাওয়া বিচ্ছিন্ন বাহ্যিক যে ঘটনাবলি, সেসব অনুকরণের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেবার বিপক্ষে আমি। আমাদের গুরুত্ব যেন পড়ে সত্যের ওপর, কোনো বিশেষ ঘটনাবলির ওপর নয়-যে ঘটনাবলি বিকশিত হয়েছে বিশেষ কোনো দেশের অনিবার্য স্থানিক পরিপাশর্্ব-পরিস্থিতির ভেতর।

দশতি: আমি পুরোপুরি একমত। আমেরিকাকে আমি উল্লেখ করেছি একটি উদাহরণ হিসেবে।

রবীন্দ্রনাথ: সেই জার্মান বিজ্ঞানী আমাকে বললেন, ইউরোপ ক্লান্ত, তার যান্ত্রিকীকৃত অতি বেগবান জীবনযাত্রায়-যে জীবনযাত্রা শুধু বাড়ায় উপকরণ, বাড়ায় বস্তুসামগ্রী, কিন্তু ব্যর্থ আত্মার তৃপ্তিবিধানে। ফলে অনেকে আছেন যারা খোঁজেন দূরের কোনো জায়গা, যেখানে গিয়ে ভুলে থাকতে পারবেন এই উদ্দেশ্যহীন বেঁচে থাকার তোড়জোড়, জ্বর ও উত্তেজনা; তারা চলে যান দক্ষিণ সাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে, তারা যান মাদাগাস্কারে, যেখানে গিয়ে তারা পশ্চিমা যাপনপদ্ধতি ধুয়ে ফেলে পরিষ্কার করে তুলতে পারবেন নিজেদের। তিনি আমাকে লিপজিগের এক বড়মাপের অধ্যাপকের কথা বললেন, যিনি অন্তরের শান্তি খুঁজতে ছেড়ে দিয়েছেন তাঁর সমস্ত বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম, ছেড়েছেন সবকিছু এমনকি যেগুলোকে তিনি তাঁর জীবনের অত্যন্ত প্রিয় বলে বিবেচনা করেছেন, সেগুলোকেও। তিনি তাঁর অন্তরের সেই শান্তি খুঁজে পেয়েছেন এক তিব্বতি আশ্রমে। হতে পারে এটা একটা প্রতিক্রিয়া। তবে এতে আভাস পাওয়া যাচ্ছে সেইসব অত্যন্ত গুরুতর সমস্যার যেগুলো আধুনিক যুগ আর বেশি দিন অগ্রাহ্য করে থাকতে পারবে না। ডার্মস্টাডে, যুদ্ধের পরে, জার্মান ছাত্ররা কাহিল ফ্যাকাশে মুখে আমাকে ঘিরে জমায়েত হতো, বলতো, ‘স্যার, আমরা আমাদের শিক্ষকদের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি, তাঁরা আমাদের চালিত করেছেন ভুল পথে। আমরা আমাদের এই জীবন নিয়ে কী করব? তারা প্রত্যাশা করেছিল একজন প্রাচ্যদেশীয় কবির, যিনি এমন কিছু দেবেন যা মেটাবে তাদের আত্মিক ক্ষুধা, দেবেন এমন কিছু জীবনদর্শন যা প্রয়োজন পশ্চিমা জগতের, তার পরিত্রাণের জন্য।

দশতি: হ্যাঁ, আমাদের অবশ্যই কাজ করে যেতে হবে পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান-চেতনা আর প্রাচ্যের জীবনদর্শন—এই দুইকে একত্রে আনবার জন্য। আমাদের অবশ্যই বস্তুগতভাবে হতে হবে নিরুদ্বিগ্ন, নিরাপদ আর আত্মিকভাবে ঘটাতে হবে আমাদের মানবচরিত্র—সম্পদের উন্নয়ন।

রবীন্দ্রনাথ: আমি এটাই বলছি। জীবনের এক সুষম সামঞ্জস্য অর্জনের উদ্দেশ্যে আমাদের অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে মতবাদের জট থেকে, বেরিয়ে আসতে হবে বস্তুগত ফলাফলের সম্মোহ থেকে, যে সুসামঞ্জস্য, আপনি যেমন জানালেন, সম্যক অবহিত থাকে আমাদের পূর্ণাঙ্গ মানবব্যক্তিত্ব সম্পর্কে, আমাদের স্বভাবধর্মের দৈহিক ও আত্মিক বিষয়গুলোকে সমঝে নিয়ে। অবশ্য এই সুসামঞ্জস্য কখনোই প্রতিষ্ঠা করা যাবে না, যদি আমাদের না থাকে যথেষ্ট মানসিক নিরাসক্তি, নিজেদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে, অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন মেটানোর ক্ষেত্রে, আমাদের জাতীয় জীবনের ভিত্তি নির্মাণে যা কিছু স্বল্পায়ু ও ভ্রান্তিজনক সেগুলোকে প্রত্যাখ্যানের ক্ষেত্রে। একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার জন্য বাছবিচারহীন সাধ্যসাধনার যে মনোভাব, তার কাছে যদি আত্মসমর্পণ করে আমাদের বিচার-বিবেচনার ক্ষমতা, তবে তা হবে মারাত্মক। প্রাচ্যে আমরা এখন বস্তুগতভাবে যতই গরিব হই না কেন, আমাদের অবশ্যই সংরক্ষণ করতে হবে মানবতার জন্য কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ তা বিচার-বিবেচনার অধিকার, আমাদের অবশ্যই সংরক্ষণ করতে হবে আমাদের সভ্যতার বিকাশের পক্ষে মানানসই একটি পথ বেছে নেবার অধিকার। এই বিচার-বিবেচনার অধিকার চর্চার মাধ্যমে আমরা যে কেবল আমাদের স্বদেশের সেবা করে যাব তা নয়, বরং এর মাধ্যমে আমরা পালন করব বিশ্বমানবতার প্রতি আমাদের অপরিহার্য দায়িত্ব, যে বিশ্বমানবতার আমরাও একটি অংশ।

দশতি: জনাব, আমরা ধন্যবাদ জানাই আপনার প্রজ্ঞাপূর্ণ বাণীর জন্য, এবং আপনাকে নিশ্চিত করছি, আপনার এই বাণী ধনরত্নের মতো সঞ্চয় করে রাখব আমাদের জীবনের নানা স্তরে, নানা গভীরতায়।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top