অনুবাদ নাটক: মরণ হ’তে জাগি (২)

মূল: হেনরিক ইবসেন
অনুবাদ: কল্যাণী রমা

দ্বিতীয় অঙ্ক                                    মরণ হ’তে জাগি (১)

পাহাড়ের কোলে এক স্যানাটোরিয়াম। ভূমিরূপ–এক বিস্তীর্ণ বৃক্ষহীন মালভূমি যা এক পাহাড়ি হ্রদের দিকে প্রসারিত। হ্রদের পিছনে সারি সারি পাহাড়ের চূড়া, ফাটলে তাদের নীলচে বরফ। স্টেজের সামনের দিকে, বামে একটি ছোট নদী। ছোট ছোট শাখা নদীতে বিভক্ত হয়ে তা গড়িয়ে পড়ছে খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে, তারপর মালভূমি পেরিয়ে বয়ে গেছে ডানদিকে, নদীর দু’পাশে ছোট ছোট ঝোপঝাড়, লতাপাতা, জলের আঘাতে ক্ষয়ে যাওয়া বড় বড় শিলাখণ্ড। সামনে ডানে এক ছোট টিলা, যার উপরে পাথরের বেঞ্চ পাতা। গ্রীষ্মের সন্ধ্যা, ঠিক সূর্যাস্তের আগে।

দূরে, নদীর ধারে বেশ কিছু ছেলেমেয়ে খেলছে, গান করছে, নাচছে। কারও পরনে গ্রামের পোষাক, কারও বা শহরের। সমস্ত দৃশ্য জুড়ে তাদের হাসি ও হৈ হুল্লোড়ের মৃদু শব্দ শোনা যাচ্ছে।

প্রফেসর রুবেক বেঞ্চে বসে আছেন, কাঁধে স্কটিশ প্লেইড। নীচে বাচ্চাদের খেলা দেখছেন। কয়েক মুহূর্ত পর বামদিক থেকে মায়া কতগুলো ঝোপঝাড় পেরিয়ে এসে উপস্থিত হয়, চোখের উপর হাত তুলে স্থির দৃষ্টিতে কিছু দেখে। মাথায় তার ট্যুরিষ্টদের চ্যাপটা বনেট, পরনে একটা ছোট স্কার্ট। লম্বা, শক্ত, লেস লাগানো বুট পায়ে, হাতে একটা লম্বা ছড়ি।

মায়া: (অবশেষে রুবেককে দ্যাখে ও ডাকে) এই যে! (সে সামনে এগিয়ে যায়, লাঠির সাহায্য নিয়ে ছোট নদীটা লাফিয়ে লাফিয়ে ডিঙ্গিয়ে গিয়ে টিলা বেয়ে উপরে ওঠে।)

(হাঁপিয়ে গিয়ে) –ওহ্‌ রুবেক, সব জায়গায় তোমাকে খুঁজে মরছি।
রুবেক: (উদাসীনভাবে মাথা নাড়ায়) হোটেল থেকে এলে বুঝি?
মায়া: হ্যাঁ, এইতো কিছুক্ষণ আগেই। উহ্‌, হোটেল তো নয়, মাছি ধরবার ফাঁদ আর কি।
রুবেক: কই, তুমি তো দুপুরে খাওয়ার জন্য নীচে এলে না।
মায়া: আমরা বাইরে খেয়েছি, খোলা আকাশের নীচে।
রুবেক: আমরা? আমরা কারা?
মায়া: আমি আর.. আর ঐ ভয়ঙ্কর ভালুক শিকারি।
রুবেক: ও, আচ্ছা।
মায়া: ও হ্যাঁ, কাল কিন্তু আমরা আবার বাইরে যাচ্ছি। ভোরবেলা।
রুবেক: ভালুক শিকারে বুঝি?
মায়া: হ্যাঁ, রূপকথার সেই ভালুক শিকার করতে।
রুবেক: পায়ের ছাপটাপ কিছু পেয়েছ?
মায়া: এত উঁচুতে যে ভালুক পাওয়া যায় না, তা জানো না?
রুবেক: তবে কোথায় পাওয়া যায়?
মায়া: অনেক নীচে। নীচের উপত্যকায়, যেখানে শহুরে মানুষের আনাগোনা নেই।
রুবেক: তোমরা দু’জন কাল সেখানেই যাচ্ছ বুঝি?
মায়া: (ঘাসের মাঝে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে)  – হ্যাঁ, তেমনই ঠিক করেছি। হয়ত আজ সন্ধ্যায়ও যেতে পারি; অবশ্য যদি তোমার কোন আপত্তি না থাকে।
রুবেক: আপত্তি? না না, আপত্তির প্রশ্নই ওঠে না।
মায়া:(তাড়াহুড়া করে) অবশ্য লার্‌স্‌ও আমাদের সাথে আসছে। কুকুরগুলো নিয়ে।
রুবেক: ওদের নিয়ে আমার কোনরকম মাথা ব্যথা নেই। (প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে) একটু পাশে এসে বসবে নাকি?
মায়া: (তন্দ্রাচ্ছন্নভাবে) না, তার আর দরকার নেই। এই নরম ঘাসের উপরই আমি বেশ আছি।
রুবেক: তোমাকে বড় ক্লান্ত দেখাচ্ছে।
মায়া: ( হাই তুলে) হ্যাঁ, তা ক্লান্ত হ’তে শুরু করেছি।
রুবেক: উত্তেজনা আস্তে আস্তে শেষ হ’য়ে গেলে এমনই সব সময় সবসময় হয়।
মায়া: (তন্দ্রাচ্ছন্নভাবে) ইচ্ছে হচ্ছে চোখ দু’টো বুজে থাকি।
[ক্ষণিক বিরতি]
(হঠাৎ অধৈর্য হ’য়ে) উফ্‌, কিভাবে যে এখানে বসে আছ। চারদিকে বাচ্চাদের চীৎকার, চেঁচামেচি আর লাফঝাঁপ।
রুবেক: ওদের চলাফেরায় বেশ একটা ছন্দ আছে, প্রায় সঙ্গীতের মত। ওই সমস্ত কোলাহলের মাঝেও হঠাৎ হঠাৎ কোন কোন মুহূর্তে তা এমন ধরা পড়ে! আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। আর তার জন্য অপেক্ষাও করে থাকি।
মায়া: তুমি সবসময়ই শিল্পী।
রুবেক: ঈশ্বরের কৃপায়।
মায়া: (রুবেকের দিকে পিছন ফিরে) কিন্তু ওর মধ্যে শিল্পীসুলভ কিছু নেই।
রুবেক: কার মধ্যে?
মায়া: (আবার ঘুম-ঘুমভাবে) এই, ওর মধ্যে আর কি।
রুবেক: ওই ভালুক-শিকারির কথা বলছ তো?
মায়া: হ্যাঁ, কিছুই শিল্পীসুলভ না। একেবারে কিছুই না।
রুবেক: (হেসে) তাতে কোন সন্দেহ নেই।
মায়া: আর লোকটা এত কুৎসিত! (এক মুঠি ঘাস তুলে নিয়ে তা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়) এত কুৎসিত, এত বিশ্রী কুৎসিত! উফ্‌!
রুবেক: এজন্যই বুঝি ওর সাথে বনে যাওয়ার জন্য তুমি এত উৎসুক হয়ে উঠেছ?
মায়া:(সংক্ষেপে, কাঠখোট্টাভাবে) জানি না। (তার দিকে ফিরে) তুমিও কুৎসিত, রুবেক।
রুবেক: তা কেবল এইমাত্র আবিষ্কার করলে নাকি?
মায়া: না, অনেক আগেই লক্ষ্য করেছি।
রুবেক:(কাঁধ ঝাঁকিয়ে) ধীরে ধীরে মানুষ বুড়ো হয়, তার বয়স বাড়ে, মায়া।
মায়া:(হাল ছেড়ে দিয়ে) আমি তা বলতে চাই নি। আসলে তোমার চোখে এমন একটা ক্লান্তভাব! হঠাৎ হঠাৎ দয়া করে যখনই আমার দিকে তাকাও, তখনই তা চোখে পড়ে।
রুবেক: তুমি লক্ষ্য করেছ?
মায়া:(মাথা নাড়িয়ে)দিনে দিনে এক ধরণের অশুভ অভিব্যক্তি তোমার চোখগুলোতে কেমন যেন হামাগুড়ি দিয়ে এসে জড়ো হয়েছে। যেন আমার বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র করছ তুমি।
রুবেক: তাই নাকি? (বন্ধুভাবাপন্ন, যদিও গম্ভীর) এদিকে এসে আমার পাশে বস, মায়া, চল গল্প করা যাক।
মায়া:(অর্ধেক উঠে) তাহলে তোমার হাঁটুর উপর এসে বসি? আগে যেমন বসতাম?
রুবেক: না না, ওমন কাণ্ড কর না। হোটেল থেকে লোকজন আমাদের দেখতে পাবে। (একটু সরে বসে) এখানে আমার পাশে এই বেঞ্চিতে এসে বস না।
মায়া: না থাক। তার চেয়ে আমি যেখানে আছি, সেখানে থাকাই ভাল। আর এখান থেকে তোমার কথা বেশ ভালোই শুনতে পাচ্ছি তো। তা কি যেন বলতে চেয়েছিলে?
রুবেক: আচ্ছা বল তো, এই যে এই জায়গায় আমাদের আসবার কথা বলেছিলাম, তার পিছনে ঠিক সত্যি সত্যি কি কারণ ছিল বলে তোমার মনে হয়?
মায়া: তা অনেক কিছুই বলেছিলে; বলেছিলে আমার খুবই ভালো লাগবে। কিন্তু-
রুবেক: কিন্তু?
মায়া: কিন্তু এখন সেটাই যে কারণ ছিল, তা আমার বিশ্বাস হয় না।
রুবেক: তবে কি কারণ ছিল?
মায়া: আমার মনে হয় ঐ নির্জীব, ফ্যাকাশে মহিলাটির জন্যই তুমি এ জায়গাটা ঠিক করেছিলে।
রুবেক: মিসেস ফন সাটো?
মায়া: হ্যাঁ, ও তো সবসময় আমাদের পিছু পিছু ঘুরছে। এমন কি কাল সন্ধ্যায় এখানে এসেও হাজির হয়েছিল।
রুবেক: কিন্তু কেন এমন – ?
মায়া: আর দেখ, তুমিও তো ওকে খুব ভাল করেই চেন। চেন না? আমার সাথে পরিচয় হবার আরও অনেক আগে থেকে?
রুবেক: আমি ওকে ভুলেও গিয়েছিলাম, সেও তোমার সাথে পরিচয়ের আরো অনেক আগেই।
মায়া:(সোজা হয়ে উঠে বসে) তুমি কি এমন তাড়াতাড়িই সব ভুলে যাও, রুবেক?
রুবেক: (সংক্ষেপে, কাঠখোট্টাভাবে) খুবই তাড়াতাড়ি। (রূঢ়ভাবে যোগ করে) ঠিক যখনই আমি চাই।
মায়া: এমন কি তাকেও, যে কিনা একসময় তোমার মডেল ছিল?
রুবেক: হ্যাঁ, আমার কাছে যখন তার সব প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়।
মায়া: যে নারী তোমার জন্য নিজেকে নগ্ন পর্যন্ত করেছে, তাকেও?
রুবেক: ওতে কিছুই যায় আসে না। আমাদের মত শিল্পীদের কাছে এসব কিছুই নয়। (স্বর পরিবর্তন করে) তাছাড়া সে যে এখানে থাকবে তা আমি কিভাবে জানব?
মায়া: তুমি ওর নাম দর্শনার্থীদের তালিকায় পড়ে থাকতে পার, খবরের কাগজে।
রুবেক: হ্যাঁ, কিন্তু সে যে এখন এই নাম ব্যবহার করে, তা আমার জানার কথা নয়। কখনো কোন মিঃ ফন সাটোর কথা আমি শুনিনি।
মায়া:(বিরক্ত হওয়ার ভান করে) কি জানি হবে হয়ত, তোমার এখানে আসবার পিছনে অন্য কোন কারণই হয়ত আছে।
রুবেক: হ্যাঁ, মায়া। অন্য কারণ। বেশ আলাদা একটা কারণ। আর কোন একদিন সে বিষয়েই আমাদের কথা বলতে হবে।
মায়া:(হাসি চেপে) হা ঈশ্বর, কী গম্ভীরই না তোমাকে দেখাচ্ছে।
রুবেক: কোন কারণ ছাড়াই কি?
মায়া: কি বলতে চাও?
রুবেক: হয়ত আমাদের দু’জনের পক্ষেই এটা ভালো হবে।
মায়া: তুমি আমাকে কৌতূহলী করে তুলছ, রুবেক।
রুবেক: কেবল কৌতূহলী? একটু চিন্তিতও কি নয়?
মায়া: না, একটুও না।
রুবেক: ভালো, তবে শোন। সেদিন স্পার নিচে তুমি বলেছিলে না যে, তোমার মনে হচ্ছে গত কয়েক মাস থেকে আমি মানসিকভাবে খুব দুর্বল হ’য়ে পড়েছি-
মায়া: হ্যাঁ, তাই।
রুবেক: কেন এমন হয়েছে ব’লে তোমার মনে হয়?
মায়া: তা আমি কিভাবে জানব? হয়ত তুমি আমার সাথে একটানা এতদিন থেকে ক্লান্ত হ’য়ে পড়েছ।
রুবেক: একটানা?
মায়া: নিশ্চয়ই। আমরা একসাথে সম্পূর্ণ পাঁচটি বছর কাটিয়েছি; শুধু আমরা দু’জন। এমন কি একটি ঘন্টার জন্যও একজন আর একজনকে ছেড়ে থাকি নি। কেবল আমরা দু’জন; তুমি আর আমি।
রুবেক: অতএব?
মায়া: লোকজনের সাথে থাকা তুমি তো একদম পছন্দই করনা, রুবেক। একা একা নিজের ভাবনাগুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকতেই ভালো লাগে তোমার। আর তোমার পছন্দের বিষয়গুলো নিয়ে আমি তো ঠিকমত কথাও বলতে পারিনা। ওইসব শিল্প, সাহিত্য আর কী কী সব। তাছাড়া, ঈশ্বর জানেন, ওসব ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহও নেই আমার।
রুবেক: হায়, মায়া! তাই তো আগুনের পাশে বসে বেশির ভাগ বেশিরভাগ সময় আমরা তোমার পছন্দের বিষয়গুলো নিয়েই কথা বলে কাটিয়েছি।
মায়া: রক্ষে করো! ঈশ্বর জানেন কথা বলবার মত আমার নিজের কোন পছন্দের বিষয়ই নেই।
রুবেক: কী জানি হয়তোবা। হয়তোবা সে সব নিতান্ত তুচ্ছ বিষয় ছিল। তবুও, সময় কেটে যায়, মায়া। সময় কেটেই যায়।
মায়া: তা ঠিক। সময় কেটে যায়। আসলে কী জান, রুবেক, সময় তোমার কাছ থেকে ছুটে চলে যাচ্ছে, আর তুমি কিছুতেই তার নাগাল পাচ্ছ না। আমার মনে হয়, সেজন্যই তোমার এত অস্বস্তি।
রুবেক:(জোরে মাথা নাড়িয়ে) আর এত অস্থিরতা। (বেঞ্চিতে নড়েচড়ে বসে) নাহ্‌, আমি এই দুর্বিষহ জীবন আর সহ্য করতে পারছি না।
মায়া:(উঠে দাঁড়িয়ে রুবেকের দিকে এক মুহুর্ত তাকিয়ে থেকে) তুমি যদি আমার কাছ থেকে নিষ্কৃতি পেতে চাও, তবে বলে ফেল।
রুবেক: কি সব আজে বাজে কথা বলছ? তোমার কাছ থেকে নিষ্কৃতি চাইব মানে?
মায়া: হ্যাঁ, যদি তুমি আমার সাথে সব সম্পর্ক শেষ করে ফেলতে চাও, তবে তা সরাসরি বলে দাও। দেখ সাথে সাথেই আমি চলে যাব।
রুবেক: (প্রায় অদৃশ্য এক হাসি দিয়ে) মায়া, ভয় দেখাচ্ছ নাকি?
মায়া: এর মধ্যে আবার তোমাকে ভয় দেখানোর মত কি পেলে?
রুবেক: (উঠে দাঁড়িয়ে) না, ঠিকই বলেছ। (এক মুহূর্ত পর) তুমি আর আমি খুব সম্ভবত এই ধরনের জীবন আর চালিয়ে যেতে পারব না।
মায়া: হ্যাঁ, তবে তো…তবে তো অবশ্যই-
রুবেক: এর ভিতর কোন ‘তবে তো অবশ্যই’ নেই। হতে পারে আমরা দু’জন আর এভাবে চালিয়ে নিতে পারছি না, কিন্তু তার মানেই এই নয় যে আমাদের এখন বিবাহ-বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
মায়া:(তিক্ত হাসি দিয়ে) তার মানে বলতে চাও কেবল আলাদা থাকা?
রুবেক: তারও খুব একটা দরকার নেই।
মায়া: তবে? কি বলতে চাইছ বলে ফেল। আমাকে নিয়ে তাহলে কি করতে চাও তুমি?
রুবেক: (দ্বিধাগ্রস্তভাবে) ভয়ানক কষ্ট হচ্ছে – খুব তীব্রভাবে অনুভব করছি এখন আমার এমন কাউকে প্রয়োজন যে আমার খুব কাছের কেউ।
মায়া:(কথার মাঝে বাধা দিয়ে) রুবেক, আমি কি তা নই?
রুবেক: আমি যেভাবে চাই, ঠিক সেভাবে নয়। আমার এখন এমন কাউকে প্রয়োজন যে আমাকে সম্পূর্ণ করে তুলবে-আমার ভিতর যা কিছুর অভাব আছে তা পূরণ করবে-আর যা কিছুর জন্য আমি যুদ্ধ করে চলেছি তার সব কিছুতেই সে আমার সাথে একাত্ম হয়ে থাকবে।
মায়া:(ধীরে) হ্যাঁ, তা ঠিক। ওইসব বড় বড় কাজে আমি তোমার কোন সাহায্যেই আসব না। আর ঈশ্বর জানেন, সে ধরণের কোন ইচ্ছাও আসলে আমার নেই।
রুবেক: আমিও সেটা খুব ভালো করেই জানি। আসলে তোমাকে আমি এতসব ভেবে বিয়ে করিনি।
মায়া: দেখতে পাচ্ছি তুমি অন্য কারো কথা ভাবছ।
রুবেক: তাই নাকি? তোমার দৃষ্টি এত অন্তর্ভেদী তা তো জানতাম না।
মায়া: ওহ্‌, তোমাকে আমি খুব ভালো করে চিনি, রুবেক। খুব বেশি ভালো করে।
রুবেক: তাহলে হয়ত দেখতেও পাচ্ছ, কার কথা আমি ভাবছি।
মায়া: তা পারছি বটে।
রুবেক: বাহ্‌, খুব ভালো তো। তবে বলেই ফেল।
মায়া: তুমি তোমার সেই মডেলের কথা ভাবছ-(হঠাৎ হঠাৎ চিন্তার সূত্র বদলে ফেলে) জান, হোটেলের লোকেরা না ওকে পাগল ভাবে।
রুবেক: তাই নাকি? আর হোটেলের লোকেরা তোমার আর তোমার বন্ধু ঐ ভালুক-শিকারি সম্বন্ধে কি ভাবে?
মায়া: এর সাথে তার কি সম্পর্ক? (তার পুরানো চিন্তায় ফিরে এসে) তুমি ঐ নির্জীব, ফ্যাকাশে মহিলার কথা ভাবছিলে, তাই না?
রুবেক: ঠিক তাই; ওর কথাই ভাবছিলাম। যখন ওকে আমার আর কোন প্রয়োজনই থাকল না-ও আমাকে ছেড়ে চলে গেল-স্রেফ উধাও হয়ে গেল –
মায়া: আর তুমি সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে আমাকে দিয়ে কোনমতে কাজ চালিয়ে দিতে চেয়েছিলে?
রুবেক: স্পষ্টভাবে বলতে গেলে কম বেশি তাই, মায়া। বছরখানেক বা আঠারো মাস মত, আমি একা একা কাটিয়েছি, নিঃসঙ্গতায় ডুবে থেকে। আমার কাজের চূড়ান্ত রূপ দেয়া শেষ হয়েছে, ওই সৃষ্টিতে দিয়েছি আমার হাতের সর্বশেষ ছোঁয়া। তারপর ‘পুনরুত্থানের দিন’ সারা পৃথিবীতে প্রদর্শিত হ’ল। আমাকে সুনাম আর যা কিছু গৌরবের বলে আমি কল্পনা করতে পারি সব এনে দিল। কিন্তু আমি আর নিজের সৃষ্টিকে ভালোবাসতে পারলাম না। যে ফুল আর ধূপধুনা ঝরে পড়েছিল আমার উপর, সেই সবই ভয়ানক বিতৃষ্ণার সৃষ্টি করল। প্রচণ্ড হতাশায় আমি প্রায় উন্মাদ হ’য়ে উঠলাম। ভয়ানক ইচ্ছা হ’ল গভীর বনের ভিতর হারিয়ে যাই। কিন্তু…তুমি তো মনের কথা পড়তে পার, বলতে পার তখন হঠাৎ আমার কি মনে হ’ল?
মায়া: হ্যাঁ, তুমি ঠিক করলে যে নরনারীর বাস্ট তৈরী করবে।
রুবেক:(মাথা নেড়ে) কমিশন নিয়ে। মুখোশের পিছনে জন্তুজানোয়ারের মুখ। বিনা মূল্যে ওইসব জুড়ে দিয়েছিলাম। (হেসে) কিন্তু এই কথা বলতে চাই নি।
মায়া: তবে?
রুবেক: আসলে হঠাৎ করেই কেমন যেন মনে হয়েছিল যে শিল্পীর প্রেরণা আর সৃষ্টি নিয়ে এই যে এত সব কথাবার্তা, এর সবকিছুই শূন্য, মিথ্যা আর অর্থহীন।
মায়া: তবে এ সবের বদলে কি চাও তুমি?
রুবেক: জীবন, মায়া।
মায়া: জীবন?
রুবেক: হ্যাঁ, আলো আর সৌন্দর্যের মাঝে যে জীবন, তা কি মাটির নিচের স্যাঁতস্যাঁতে, বন্ধ ঘরে কতগুলো বছর নষ্ট করবার চেয়ে, মাটি আর পাথরের চাঁইগুলোর সাথে যুদ্ধ করে করে শ্রান্ত জীবনটাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান নয়?
মায়া:(দীর্ঘশ্বাস ফেলে) হ্যাঁ, আমারও সবসময় তেমনই মনে হয়।
রুবেক: যা হোক, তারপর আমি প্রাচুর্য আর আলস্যে জীবনটা কাটিয়ে দেওয়ার মত যথেষ্ট ধনী হয়ে উঠলাম। টনিৎজ হ্রদে নিজের জন্য একটা ভিলা, রাজধানীর বুকে বিশাল প্রাসাদ আর ওইসব বাদবাকি নানাকিছু।
মায়া: আর এইসব কিছুর সাথে অর্জন করলে আমাকে কিনে ফেলবার সামর্থ্য। আমাকে দিলে তোমার সাথী হয়ে এই ধন-সম্পদ উপভোগ করবার সম্মতি।
রুবেক: কিন্তু তোমাকে এক পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে গিয়ে পৃথিবীর সব সৌন্দর্য, সব ঐশ্বর্য দেখাব বলেও প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তো!
মায়া: হয়ত তুমি আমাকে এক উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় সত্যিই নিয়ে এসেছ, কিন্তু পৃথিবীর সব ঐশ্বর্য, সব সৌন্দর্য দেখাতে পারনি, রুবেক।
রুবেক:(বিরক্তির হাসি হেসে) মায়া, তোমাকে খুশি করা এক অসম্ভব ব্যাপার! একেবারেই অসম্ভব! (রেগে গিয়ে) কিন্তু কী যে আসলে আমাকে হতাশার মাঝে ঠেলে দিয়েছে, তুমি কি তা কল্পনাও করতে পার?
মায়া: হ্যাঁ, তা হচ্ছে এই সত্য যে তুমি সারা জীবনের মত তোমাকে আমার সাথে বেঁধে ফেলেছ।
রুবেক: আমি অতটা নির্দয়ভাবে কথাটা বলতে চাই নি।
মায়া: তাহলেই চিন্তাটা কিছু কম নির্দয় হয়ে যায় না।
রুবেক: একজন শিল্পীর মনে যে কী, কী হয়, তোমার তা সম্বন্ধে কোন ধারণাই নেই, মায়া।
মায়া: হা ঈশ্বর, নিজের মনের ভিতর যে কী হচ্ছে, তারই বলে সামান্যতম ধারণা নেই আমার!
রুবেক: আসলে বড় দ্রুত জীবন আমার, মায়া। আমাদের, শিল্পীদের জীবনটাই ওমন। তোমাকে জানবার পর থেকে, যে অল্প কয়েকটা বছর তোমার সাথে কাটিয়েছি, তাতেই মনে হয় যেন প্রায় পুরো একটা জীবন কাটিয়ে ফেলেছি। আর এখন বুঝতে পারছি, সহজ, সরল, অলস জীবনের মাঝে আনন্দ খুঁজে নেয়ার সামর্থ্য আমার নেই। আমার আর আমার মত মানুষের জন্য জীবনের রূপ তা নয়। আমাকে অক্লান্ত কাজ করে যেতে হবে। আমৃত্যু, অবিরাম সৃষ্টি করে যেতে হবে। (একটু যেন চেষ্টা করে কথাটা বলে) আর তাই তোমার সাথে আমার জীবন আর একটুও চলতে পারে না, মায়া। কেবল তোমার আর আমার।
মায়া:(শান্তভাবে) তার মানে কি, সোজা কথায়, তুমি আমাকে নিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছ?
রুবেক: (আবেগোদ্দীপ্ত হ’য়ে, অতিরিক্ত জোরের সাথে) হ্যাঁ, তাই। তোমার সঙ্গ আমার অসহ্য একঘেঁয়ে লাগছে। আমি ক্লান্ত হ’য়ে পড়েছি। আমার সমস্ত জীবনী শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। এখন বুঝতে পেরেছ! (নিজেকে নিয়ন্ত্রণে এনে) কথাগুলো খুব রূঢ় আর নোংরা শোনাচ্ছে, তা আমি ভালো করেই জানি। তোমার যে কোন দোষ নেই, সেও আমি স্বীকার করছি। কেবল আমার ভিতরই এই পরিবর্তন-যেন বিপ্লব ঘটেছে। (প্রায় স্বগতঃভাবে) এই পুনর্জাগরণ- এ শুধু আমারই।
মায়া: তবে কি ঈশ্বরের নামে আমরা আলাদা হয়ে যেতে পারি না?
রুবেক: তুমি তাই চাও?
মায়া:(কাঁধ ঝাঁকিয়ে) তা, যদি আর কোন উপায় না থাকে –
রুবেক: কিন্তু আর একটা উপায় আছে। আর একটা পথ –
মায়া: তুমি আবার ওই ফ্যাকাশে, নির্জীব মহিলার কথা ভাবছ।
রুবেক: হ্যাঁ, সত্যি বলতে কি আমার সব চিন্তা ঘুরে ফিরে সব সময় সবসময় ওর কাছেই ফিরে যাচ্ছে। সেই যখন থেকে ওর সাথে আবার দেখা হয়েছে। (মায়ার কাছে সরে এসে) আমি তোমাকে একটা কথা বলতে চাই, মায়া। গোপন কথা।
মায়া: বল।
রুবেক:(নিজ বুকে আঙ্গুল দিয়ে মৃদু আঘাত করে) এখানে, মায়া-আমার এখানে এক ছোট্ট কৌটা আছে, তালা দেওয়া, যা কখনো কেউ খুলতে পারবে না। তার ভিতর আছে আমার সমস্ত স্বপ্ন, সমস্ত কল্পনাশক্তি। কিন্তু যখন ও আমাকে ছেড়ে চলে গেল, মিলিয়ে গেল আমার জীবন থেকে, ওই কৌটাটার তালা হঠাৎ করেই বন্ধ হ’য়ে গেল। চাবি ছিল ওর কাছে, ও তা নিয়ে চলে গেল। হায় মায়া, তোমার কাছে সে চাবি তো ছিল না। তাই এর ভিতরের সবকিছু অব্যবহৃত থেকে গেল। বছরগুলো পেরিয়ে যাচ্ছে-আর সব ঐশ্বর্য সেখানেই পড়ে আছে-আমি তা ছুঁতেও পারছি না।
মায়া: তবে তালা খুলবার জন্য তাকে নিয়ে এস না!
রুবেক:(বিহ্বল হ’য়ে) মায়া-?
মায়া: এই তো, এখানেই তো ও আছে। কোন সন্দেহ নেই যে তোমার ওই কৌটাটার জন্যই সে আমাদের পিছন পিছন ঘুরছে।
রুবেক: আমি কখনও এসব ওকে বলিনি। কখনও, কোন দিনও না।
মায়া:(সহজ, সরলভাবে) কিন্তু রুবেক, এই এক সামান্য বিষয় নিয়ে অকারণ হৈ-চৈ করে আর এত মাথা ঘামিয়ে কি লাভ?
রুবেক: তুমি একে সামান্য ব্যাপার বলছ?
মায়া: নিশ্চয়ই, বলছিই তো। তোমার যাকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তুমি যাও না তার কাছে। আমি কোথাও না কোথাও নিজের জায়গা ঠিক খুঁজে নিতে পারব।
রুবেক: কোথায় যাবে?
মায়া: এই তো, যদি দরকার হয় আমি না হয় আমাদের ভিলাটাতে চলে যাব। কিন্তু তা হয়ত করতে হবে না। আমাদের শহরের বাড়িটা তো বেশ বড়। অল্প কিছু অদল বদল করে, ওখানে আমাদের তিনজনেরই জায়গা হয়ে যাবে।
রুবেক: তোমার কি মনে হয় এই ব্যবস্থা কাজ করবে? শেষ পর্যন্ত?
মায়া: হা ঈশ্বর! কাজ না করলে না করবে। তাই বলে এ নিয়ে কথা বলবার তো আর মানে হয় না।
রুবেক: কিন্তু মায়া, যদি এতে কাজ না হয়, তবে আমরা কি করব?
মায়া:(উৎফুল্লভাবে) তখন থেকে আমরা দু’জন স্রেফ অন্য পথে চলব। আলাদা হয়ে যাব। আমি কোথাও নতুন কিছু খুঁজে নেব। এমন কোন জায়গা যেখানে আমি স্বাধীনভাবে থাকতে পারব। মুক্ত, স্বাধীন! প্রফেসর রুবেক, আমার জন্য তোমাকে দুঃশ্চিন্তা করতে হবে না। (হঠাৎ ডানদিকে দেখিয়ে) ওই দেখ! ওই যে ও ওখানে!
রুবেক:(ঘুরে) কোথায়?
মায়া: ওই তো ওখানে। এক মার্বেলের মূর্তির মত চলেছে। এই পথেই তো আসছে।
রুবেক:(উঠে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে) এই কি সেই ‘পুনুরুত্থানের জীবন্ত প্রতিমূর্তি’ নয়? (স্বগতঃ) কেন আমি ওকে যেতে দিয়েছিলাম? ঠেলে দিয়েছিলাম অন্ধকারে? ওকে পরিবর্তিত করেছিলাম এক-? উফ্‌, কি বোকা ছিলাম, কি ভয়ানক বোকা ছিলাম আমি!
মায়া: এই সবের মানে কি?
রুবেক: কিছু না। এমন কিছুই না যা তুমি বুঝতে পারবে।
[আইরিন ডান দিক থেকে মালভূমি পেরিয়ে আসে। যেসব বাচ্চা খেলছিল, তারা ওকে দেখে দৌড়ে কাছে যায়। এখন ওর চারপাশ ঘিরে সবাই; কেউ কেউ হাসিখুশি, কেউ লাজুক, কেউ ঘাবড়ে গেছে এমন। আইরিন ওদের সাথে শান্তভাবে কথা বলে, ওদের হোটেলে ফিরে যেতে বলে; সে নিজেও নদীটার পাশে একটু বিশ্রাম নিতে চায়। বাচ্চারা দৌড়ে বামে টিলা বেয়ে নেমে যায়। আইরিন নদীটার পাশে গিয়ে ঠাণ্ডা জলে হাত ডুবিয়ে বসে।]
মায়া:(কোমলভাবে) তুমি নিচে গিয়ে ওর সাথে কথা বল, রুবেক। একা।
রুবেক: আর তুমি?
মায়া: এখন থেকে আমি আমার নিজের পথে চলব।

[মায়া পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে নামতে থাকে, লাঠিতে ভর দিয়ে ছোট নদীটা লাফিয়ে পার হয়। তারপর আইরিনের পাশে এসে থামে।] ম্যাডাম, প্রফেসর রুবেক উপরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।
আইরিন: কী চান তিনি?
মায়া: একটা বন্ধ কৌটা খুলবার জন্য আপনার সাহায্য।
আইরিন: আমি কি তাঁকে কোন সাহায্য করতে পারব?
মায়া: উনি তো বলছেন যে একমাত্র আপনিই তা পারবেন।
আইরিন: তবে তো আমার চেষ্টা করে দেখাই ভাল।
মায়া: হ্যাঁ, ম্যাডাম, তাই করুন, দয়া করে তাই করুন।
[আইরিন হোটেলের দিকের পথটি ধরে চলতে শুরু করে। (কয়েক মুহূর্ত পর) প্রফেসর রুবেক আইরিনের দিকে নেমে আসতে শুরু করেন, কিন্তু ছোট নদীটিকে তাদের মাঝখানে রেখে দাঁড়িয়ে পড়েন।]

(চলবে)

Facebook Comments

One comment

  1. Pingback: মরণ হ’তে জাগি (৩) » সাহিত্য ক্যাফে

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top