শিবলি সাদিক-এর কবিতা

গাছ


গাছকে সম্পূর্ণ দেখা কখনো সম্ভব নয়
দৃশ্যের আড়ালে আরো দৃশ্য, গান থেকে যায়
কেউ কেউ বলেন অনেক যাদুঘর, প্রত্নযুগ আছে
সূর্যের চুম্বন, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ঘোড়ার কংকাল
রং, রেখা দিয়ে আঁকা সবুজ রহস্যময় ক্যানভাসে
সময় তো হারায় না, তার নথিপত্র বাতাসে পাতায় দোলে
সব জ্ঞান বিষ কাঠে স্তব্ধ হয়ে আছে, চুপ করে আছে
যদি কোনো দিন গাছ কথা বলে, তাহলে হয়তো
জানা যাবে প্রকৃত ইতিহাস সময়ের, আগুনের
তার আগে আমাদের সব জানা অপ্রকৃত, অসম্পূর্ণ
আগুনের যত পাখি রূপ নিয়ে এসে সাজাল পৃথিবী
মেঘ হতে ঝরে যত লাবণ্যের সৃষ্টি হল অদ্যাবধি
তার একমাত্র সাক্ষী হয়ে গাছ স্তব্ধ হয়ে আছে


কয়েক কোটি বছর যদি রৌদ্র-কুয়াশায়
আকাশ ও মৃত্তিকার রঙিন ঘর্ষণে
রূপ-অরূপের সব ধূলিঝড়ে শুয়ে থাকতাম
সরল বীণার কাঠ হয়ে,
গাছের জীবনী লিখে বিখ্যাত হতাম,
উন্মাদশালায় সন্ধ্যা কাটাতাম
সবুজ হাইকু বলে মুগ্ধ শ্রোতাদের কাছে

গাছের নিকটে যাওয়া সম্ভব হয়নি আজও,
পৃথিবীর আত্মজীবনীর পাতা খুলে
ভাবসমাধি, বালিপুস্তক, মৌমাছির ভাষা
এইসব শব্দ শিখে ভাষায় আটকে আছি,
‘সবুজ হাইকু’ আর জানা হবে না আমার,
কোনোদিন জানা হবে না গাছ আর পাখির আলাপ।

 

রাখাল


কৃষির সকল গল্পে রাখাল সৃজনকর্তা
মনোহর বাঁশি তার বাতাসের গান করে
প্রান্তরের সব সুর হাহাকার করে গানে
সে অলস বসে থাকে নিরিবিলি বটতলে
সামনে ছড়ানো তার রাজ্য আর শস্য
তার গরু শান্ত চরে দূরে রোদে
দেহে তার বসে গেছে রোদ জল ধূলাবালি
জনপদের সমস্ত গল্প ঘাসে জমে আছে মাঠে
তাকে দেখে মনে হয় তার দেহখানাই হালট
আর মাঠে ঘাসে শুলে মনে হয় নদী বইছে
আর ফুল ফল পাতা তাকে ছুঁয়ে গান গাইছে
তার বাঁশি যদি আজ পাই, বাজাব অনেক
হলুদ নদীর জলে যতক্ষণ না উঠবে চাঁদ
যতক্ষণ না আমার দেহ সুরে লুপ্ত হয়
তখন নদীর জলে বাঁশি ফেলে ফিরে যাব
কোথাও তো গানেরও শেষ থাকে
যার পরে মাঠের ভালবাসার গল্প শুরু হয়


মেষপালকের গল্প সভ্যতাকে তাড়া করে যায়
প্রান্তরের রোদ, শস্য আর মেঘ তার চেয়ে
কারা কবে বেশি জেনেছিল, তার জ্ঞান ভিক্ষা
করি আমি মৃত্তিকার বিদ্যালয়ে


নদীজলে ভেসে আসে চিঠি
পশুচর্মে রক্ত দিয়ে লিখেছিলে কবে
তোমাদের গ্রাম পাহাড়তলীর কাছে
প্রথম ফুলের জন্ম দেখে তুমি
বিস্ময়ে আহত হয়ে মেঘে রক্ত দেখেছিলে
জলে ফুটে উঠে আজ পূর্বদিকের ভাষা সকাল বেলায়

 

ডুমুর গাছের তলে বসে লেখা কবিতা

আরেকটা জন্ম পেলে আমি হরিণকুন্ডুর দিকে চলে যাব
চলে যাব নদীর উজানে সোজা বোঙা দেবতার কাছে
যাবার সময় আমি সব দেখে যাব, চট করে দেখব না
গাছ থেকে ফল পেড়ে তার শাঁস ভাল করে দেখে নিব
সাপের গোপন চলাচল, মদ, গোপন চোরাচালান
সবই কী করে ফল ও নারীর সাথে যোগাযোগ রাখে
তার সব ভাল করে জেনে নিব কমলা বাগানে গিয়ে

বিলের জলেতে নেমে পদ্ম হয়ে দেহ সাধনা করব
সারসের সব জন্ম পার হয়ে যাবে এই রূপ দেখে
মৌমাছির ভাষা জেনে মধু আর মোম নষ্ট করব না
গ্রীষ্মের নদীর জলে তারাদের তাঁতবোনা যাব দেখে
মাঠে গিয়ে বুঝে নিব দেহ জন্ম নিয়ে কেন এত উৎসাহী
কাকতাড়ুয়ার সাথে শস্যের আলাপ সব জেনে নিয়ে
কাঠের গোপন বাক্সে গান ভরে গোপন বৃষ্টির নিচে
হেঁটে পার হয়ে যাব আফিমের গল্প, সিংহের রতি

যেতে যেতে গাছের জীবনী লিখে খুব রোদন করব
যাকে তাকে মাতালের মত করে জড়িয়ে ধরব ভাই বলে
যখন পাগলা হাওয়া বয়ে যাবে সারা দিন ধরে
আর রাত হবে নীল পাহাড়ী গানের মত আর
যখন তখন খুব বৃষ্টি হবে ঝুপঝাপ করে মন-খুশী
কাগজের নৌকার মত ভেসে যাবে সকল অস্তিত্ব
যমুনার কূলে কদমের ডালে আঁকব রতির ফুল
পাহাড়ী গানের বুনো বিষণ্ন, উদ্যম আর শত সুর
উদিত ফুলের দেশে ঢুকে প্রজাপতিদের বিষণ্ন ভাষায়
অন্ধ ভিখারির বেশে ঘুরব অনেক স্বপ্ন ও উপকথায়
পাহাড়ি দুর্লভ ঈগলের পিছে, যাদুকথা, ডাইনিদের সুরে
পথে থেমে কয়েক বসন্ত আমি কথা বলব না কারও সাথে
শুধু রাজহাঁসের সাথে শুয়ে বসে থাকব নদীর চরে অন্ধকারে
তার সাদা পালক নদীর জলে অন্ধকারে ভেসে কোথা যায় আর
বুঝে নিব কেন চাঁদ আর রাজহাঁস জলে খেলা করা ভালবাসে

আর শেষে ক্লান্ত হলে আমি চাইব একটা সাধকজন্ম কোনো
নদীর কিনারে, সেই জন্মে দিনরাত জলের কিনারে বসেই থাকব
চুপ করে বসেই থাকব সারাবেলা, আমাকে তখন
কেউ ডাকবে না, জলমগ্ন গাছ মনে করে ডাকবে না,
অতলে মাছের খেলা দেখা বেলা যাবে, পরমের রূপ জলে দেখে
জলের অক্ষরে যত মাছের নিরব ভাষা পড়ে শুনে দিন যাবে,
রাত শুধু কাটবে না, রাতের ভাব যে আলাদা, সে যে জাল ফেলে
দূরের আকাশ থেকে পাতালের সবটুকু ধরা পড়ে তার জালে
তারার আলোতে ধীরে জলের সকল অলঙ্কার ফুটলে
তখন তো মাছের আকার জলের আকার মুছে গিয়ে
বিষয়ী ও বিষয়ের ব্যবধান ঘুচে আর যায় না স্ব-বশে থাকা
তারার আলোতে জলে মাছ হয়ে রাতভর দেখে-যাওয়া
জগতের আকার ও নিরাকার সব ঝরে যায় জলের উপরে
সাধকজন্ম পেলে জলের গোপনে ভাব হয়ে সারা জনম থাকব

 

বৃষ্টি ও দেহ


বৃষ্টি হয় চরাচরে, ফর্সা হয়ে যায় বোধ। ফলে বহু প্রশ্ন জাগে। ছন্দ জাগে। মন ভিজে যায়। আর এরকম ভিজে-যাওয়া আদৌ মামুলী ব্যাপার নয়। তাতে বহু অনুষঙ্গ আছে। দেহ বিষয়ক ঘোরতর ভাবনার কথা মনে হয়। এমন কি ঘরের কোণে যে ক্যাকটাস, বৃষ্টি নিয়ে অবজ্ঞার কথা ভুলে মনোবেদনায় ভিজে যায়।

তবু দেহ ভাবনাই মুখ্য। কারণ বর্ষার ছন্দ দেহ ছাড়া ধরা যায় না। যেমন কদম ফুলে বহু বর্ণ জাগরিত হয়, তাকে ভোগ করবার জন্য জীব ও পরমের লীলা চলে। আর এ তো পালনের ঋতু। কত ক্ষীর উৎপন্ন হয়। জীব চেটে পুটে খায় অমৃতের সব রান্নাবান্না। শস্য বাড়ে, মাছ বাড়ে। জলাশয় হতে বের হয় মাছ। মেঘের মধুর ডাক শুনে জীব বাহিরায়। সর্ব অঙ্গ তার জ্বলে যায়। কোথা আরও আগুন মিলবে। তবেই না জ্বলবে সব কামধেনু। বর্ষা বাড়ে। দেহের আগুনে কদমের বনে জীব ও পরমের লীলা চলে অবিরাম।


মন-ও জলে ভেসে যায়। জলাশয়ে নীত হয়ে এক লীলরত পদ্মের রক্তিম হর্ষে ঢুকে পড়ে। অবাক দেহায়তন। তার নাল থেকে সৌন্দর্যের রস জলাশয়ে, ক্রমে সমগ্র নিখিলে ছড়ায় বলেই বহু দেবী মাতা একে আসন করেন বলে ধর্মে বরাবর উল্লেখিত হয়ে আসছে স্মরণকাল ধরে। মন বৃষ্টি ও পদ্মের আলেখ্যের মধ্যে ঘুরে মাছের বাসনা নিয়ে। জীবমাত্রই বর্ষায় কিছুটা মৎস্যধর্মী হয়ে ওঠে, সকলের জাগে সদা সন্তরণের ইচ্ছা, প্রকৃতির সংগোপন জলাশয়ে, জন্মের আঁধারে পুচ্ছ ও কানকো নিয়ে অবাধ বিলাসী সাঁতারের ইচ্ছা। অবাধ সাঁতারে মন দেহ ছেড়ে অভিলাষে বের হয়, অসাধ্য এমন সব আয়তন, তাদের উৎসে সাঁতরায় কী প্ররোচনায়! কী যে অবাক অনুধাবনে!


পলায়নই ধর্ম। রূপ চুরি করে মেঘের রূপকথার দেশে জলের কণারা গোপনে পালায়। আর রংধনুর উল্লাসে আকাশে ওড়ে। নীচে ধরাতলে সব আকারে প্রকারে খুব অনটন। সারাৎসার যে চুরি গেছে! রম্য গৃহ থেকে পালিয়ে-যাওয়া ভৃত্য যেমন একদা ফিরে আসে চুরি করা সব অলঙ্কারসহ আরও অধিক তৃষ্ণারেখা নিয়ে গৃহিনীর সৌন্দর্যের কাছে, জলের অণুরা ততোধিক কাতরতা, সমর্পেণ নেমে আসে। জলাশয়ে কত ছন্দ মৃদমন্দ জাগে। তার রূপ সব অনায়ত্ত থেকে গেল। দেহী হয়ে কী করে জানব যে নিরাকারের সুর!

 

সম্পর্ক ও সম্ভাবনা

রূপালি বৃষ্টির সাথে হাঁসের সম্পর্ক নিয়ে কী কী ভাবি:

১. উভয়েই রহস্যময়, সাদা ও পালকবিশিষ্ট
পৃথিবী ডাকলে চরাচর ফর্সা করে তোলে

২. সকল সময় কিছু পালক হারায়, উড়ে যেতে থাকে
সর্বভূত থেকে, তাপে ও দহনে, সৌন্দর্যের রীতিনীতি থেকে।
সেইসব পালক ঝরতে দেখা যায়, বর্ষায়, প্রতিপালনের দিনে
আর হাঁসগণ ক্রীড়ারত, প্রতিপালকের জলে, রাতদিন, অবিরাম

৩. দুইই কর্মী, কর্তাহীন জগতের অনন্য প্রতিভু
শুধু স্বতঃস্ফূর্ত কর্মে, সব বস্তু ও রূপান্তরে
নিয়ত উৎপাদনশীল, হাঁসদের শিল্পরীতি থেকে
অবিরাম মুক্তাচাষের ধারণা উঠে আসে

৪. চিহ্ন-বিজ্ঞানের সাথে স্বতই বিরোধ, অভিধানে, ভাষায়, জগতে
যত অর্থ, তার নিষ্পত্তি করতে প্রতিবার বৃষ্টি হয় আর
চিহ্ন. চিহ্নায়কসহ অর্থ ভেসে যায়,
শুধু জলের উপরে হাঁসদের শেষে ভাসতে দেখা যায়

৫. অবাধ যৌনতার প্রতি পক্ষপাত উভয়ের । যে কোন কারণেই মেঘের
উত্তেজনা হয়, যার রতিরসে জগতের পুষ্টি। হাঁসের যৌনতা সংক্রামক।
তার সাদা রং, ডানার কিঞ্চিত নড়াচড়া হলেই জগত ও শিল্প কেঁপে উঠে।

 

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top