শিবলি সাদিকের দীর্ঘ কবিতা

পদ্মপুকুর

 

যদি পদ্মপুকুরে নামতে পারি
তুলে নেব সব রং আর বর্ণলিপি
পদ্ম হয়ে তাবৎ বিকাশ সেথা জ্বলে
তার রং আর রূপ তাই এত অপরূপ
দেশ-কাল জলে থর থর কাঁপে

শোভায় মরণ হলে এই ঘাটে স্তব্ধ হয়ে
অন্ধ হয়ে সব বাক্য ধরে বাকহীন হয়ে
বসে থাকা, আর বসে থাকতে থাকতে
পদ্ম নিয়ে সব ভাব শূন্য হয়ে আসে

কি আছে ওখানে রসিক ভোমরা, কেন দিনমান পদ্মে ঘোরাঘুরি কর?
তোমারও কি হল নেশা, মধু মিলবে না জেনে তবু রূপের চারপাশে
ঘুরে মরা, বার বার রূপের আগুনে মরে গিয়ে তারপর ছায়া হয়ে ওড়া?

জল তবে জল নয়, আগুনের চেয়ে আরও ষড়যন্ত্রময়, নেশাময়
একবার মোহমুগ্ধ হলে আর রক্ষা নেই, জলের কিনারে শুধু বসে থাকা
যুগ যুগ বসে থেকে ধীরে ধীরে অঙ্গ রূপ বদলায়, ইন্দ্রিয় বদলে যায়
লোকে ভাবে জলমগ্ন গাছ, আসলে এ যে বহু যুগ আগেকার রূপমুগ্ধ
এক কবি, এখনও পুকুরে জলে একঠাঁয় দাঁড়িয়ে পদ্মের শোভা দেখে
তারও আগে কেউ জলধির পাড়ে বসে শোভা দেখে মরে গেছে
তার ভূত সারা রাত জলে জ্বলে, তার উপকথা শুধু লোকালয়ে শোনা যায়

 

বিকালের আলো এসে জলে মরে যায়
বিরহের নাম আমি সকল বানানে লিখি
বিষন্নতা এখন শুধু আমার অদ্ভুত মদ
মদের দেবতা জানে জল প্রকৃতপক্ষেই মদ
এই মদ নিয়ে আমি সব দেশ-কাল ছুঁয়ে
বিরহের কথা পদ্মে লিখে যাই
আমার মরণ নিয়ে আলো যাও
জগতের সব পদ্মে তার কথা লেখ
পদ্মপুকুরে ফুটুক তবে একে একে
বস্তু আর চেতনার কোটি বর্ষ ধরে
বিরহের রক্তরাঙা পদাবলি

 

কী এমন বলা যায়, জলের স্বরূপ নিয়ে, পদ্ম নিয়ে
আমি নিজেই তো জলে ভেসে অজানার দেশ হতে
এই বালু তীরে এসে নিজ ও অপর ভেদাভেদ করে
জল আর মাছ নিয়ে ঘোর বিভ্রমের ঘোরে পড়ে আছি
নিজেকেই ভয় হয়, জ্ঞান আর নির্মাণের মোহে
নানা ভেদাভেদ করে ভুল আভিজ্ঞান নিয়ে ভুল পথে আছি
মনে হয় জলের স্বরূপ বলে কিছু নেই, আমার স্বরূপ নেই
আজ সাধ হয় শুধু ভাসি, বিকাশের রূপ হয়ে ভেসে যাই
জলেস্থলে সর্বভূতে পদ্ম হয়ে শুধু যাই ভেসে

জল তবে নীল হয় ভালবাসা পেলে, আকাশের ছায়া পেলে
তাতে ফোটে অভিজ্ঞান পদ্ম হয়ে, রক্তরাঙা চিহ্ন হয়ে
এসবই আবেগ আর অতিশয়োক্তি বলেই মনে হয়
জানি আজ জল বা পদ্মের কাছে কভু সম্ভব নয় পৌঁছে যাওয়া
প্রতীকের বাহাদুরি, শব্দ ছাড়া আমার তো কিছু নেই
সীমিত ইন্দ্রিয় নিয়ে দেশ-কালে এক কোণে পড়ে আছি, তদুপরি
সভ্যতার ভুলপথে এসে জল আর পদ্ম হতে দূরে সরে
বাজার ও নির্মাণের ভূত হয়ে দেহ মরে গেছে
আজ আর কিভাবে সম্ভব হবে দেহ জলে মুক্ত করে
দিয়ে বলা – হও, ফোট – প্রতীকের ভারমুক্ত হয়ে
চৌষট্টি পদ্ম হয়ে, আদি ও সহি কামের কলা হয়ে
শুধু ফুটে যাও

 

জল তাকে নীল মদ বিষ বলে জানি
তাতে ফোটে রক্তপদ্ম আমার সমাধিফুল
বার বার ডুব দিয়ে মরে তবু তল পাই না জলের
জলধির কাছে গেলে ছায়া জ্বলে যেন নীল বাতিঘর
কচুরীপানার ফুল কথা বলে, ভাব তবু অধরাই থেকে যায়

কী সাধন সাধলে আমার হবে জলের রহস্য জানা
তেমন সাধন হবে কি আমার যাতে জলে মাছ হয়ে
ডুবে রব এক ভাবসমাধিতে পদ্মের খানিক কাছে

 

আর জল নিজেই তো সমাধি ও সমাধিরহস্য এক
যত নিচে নামা যায় তত জল আর জলের সমাধি বাড়ে
নিরবতা বাড়ে, বাড়ে অতল শূন্যতা, নম্র নিরবতা
আমার শহরে এক বাতিস্তম্ভ আছে, যাতে আমি দেখি
আকুলতা নামে এক রহস্যময় বোধ, তার তীব্র তাপ
আমি জানি বস্তু তার স্বভাবে আদতে বরাবর জলময়
যে কোনো সময়ে ডুবে যেতে পারে অতলের জলে
যদি প্রেম এসে ডাকে, বলে এস, বহুদিন একা আছ
তোমার বিরহে দেখ নিরবতা কাঁদে, জল একা আছে
আমি ভাবি অস্তিত্ব কি কোনো এক নম্র মনোলগ
যাকে আজও হল না জানা, শুধু নিরবতা রয়ে গেল
যাতে ডুবে গেলে কোনো তলই যায় না পাওয়া
তখন তো কোন তলে আমি থাকি আর কোথা পদ্ম থাকে
মাঝখানে বাড়ে শুধু জল আর জলের সমাধি

 

আর অন্য গান নয়, জলই আমার গান, নম্র গান
তাই জল বোধ করি একা নয়, সব কিছু ছুঁয়ে আছে
তবু এই থাকা শুধু হাহাকার বাড়ায় আমার
আমি জানি সব কিছু সহজেই উড়ে যেতে পারে
যদি ডাকে দূরের আকাশ, ডাকে হাওয়া
বস্তুত সবই অতি বিস্ময়কর ও নম্র, মানুষ তা নয়
হাতিয়ার আর জ্ঞান তাকে অন্য পথে নিয়ে এল,
জল আর নম্রতার কাছে গান কাব্য যায় ছুটে
আমি হাহাকার করি, আমার হল না গান জানা
দেহ নষ্ট করে যে আমাকে বশীভূত করা হল
কী সহজে সব কিছু জলে ডুবে গান হয়ে যায়
যখন আষাঢ় নামে, প্রেমের ভেতরে সব ডুবে যায়
আমি সব পাখি বুকে নিয়ে হাহাকার করি, কাঁদি
গান জল পাখি সব একাকার করে আমি কাঁদি
পদ্ম শুধু সাক্ষী হয় নিরবতা হয়ে

 

কেন বৃষ্টি হয়, কারো জানা নেই, পদ্মপুকুরে চিরকালের বৃষ্টি পড়ে
প্রতিবার বৃষ্টি শেষে আমি ভাবি, এবার কুড়িয়ে আনি হাঁসের পালক
হাঁসগুলো বিস্ময়ের মত সাদা, আমার  শৈশবে দেখা হত প্রায়
তারা ছিল ব্যক্তিগত, তাদের পালকে আমি ঘুমাতাম, স্বপ্ন দেখতাম
তখন আমার দেহ জলময়, জলে ভরা ছিল, যাকে পদ্মের পুকুর বলা যায়
আমার দেহের কোনও সীমারেখা ছিল না, পরিধি-প্রাকার ছিল না
তখন তো হাঁস বলে কোন ধারণার জন্ম হয় নাই, তবু হাঁস ছিল
বস্তু হয়ে, একদম খাঁটি সহি বস্তু হয়ে, বৃষ্টির মতন সাদা আর পাখাঅলা
হাঁস হাঁস খেলা নিয়ে সারাবেলা কেটে যেত, সব দিকে বৃষ্টি ছুটাছুটি ছিল
কত সাদা রং আর সাদা মেঘ যত খুশী যত দিকে কত দিকে ছুটে যেত
পালকের সাদা রঙে লোভ আজও খুব বেশী আছে, বৃষ্টি হলে আজও হাহাকার জাগে
হারানো দেহের কথা খুব মনে হয়, পদ্মপুকুরের রূপ মনে জাগে
পালক কুড়িয়ে আনবার জন্য চিরকালের বৃষ্টিবাদলে মনে হয় বার বার ছুটে যাই

 

১০

জানি এইসব হাঁস তোমার নিবিড় রূপ নিয়ে ওড়ে, যা আমার জানা নেই
কোনো দিন তো হবে না জানা পাখিদের সাথে তোমার আলাপ, নিরব ও নম্র কথা
আমি জানি তুমি পাখিদের সাথে নিরব কথোপকথনে নিয়ত নিরত থাকো
এইসব কথাবার্তা জলের মতন নম্র অথচ আমার নাই কোনো প্রবেশিধকার
যেমন জলের মাঝে নেমে আমি আব্রুহীন হয়েও আমার নগ্নতাকে খুঁজে পাই নাই
নগ্নতাকে তুমি জলে ঢেকে রাখো, আমি হাহাকার করি, ডুব দিই, খুঁজি
বস্তুত আমার স্নায়ু, ইন্দ্রিয় যথেষ্ট নয়, হাঁস আর পাখিদের জানবার জন্য বড়ই অনুপযোগী
হাঁস দেখলেই তবু আমি ইন্দ্রিয়কাতর হয়ে তার সাদা রং নিয়ে গানগুলি স্পর্শ করি
আজও পারি না, তাই শুধু হাহাকার করি, পদ্মপুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে পদ্মকে দেখি
কত সহজেই হাঁস ঠোঁটে তুলে নেয় ফল, মিষ্ট ও গোপন ফল, সাদা শাঁস তার
আমি রঙে ডুবে যাই, সাদা রং, তার শুভ্রতায় আর নিরবতায় নামতে থাকি তলহীন

 

১১
আমার অস্তিত্ব আর প্রতিটি বস্তুর সত্বা ভাববার উপযুক্ত আজও হই নাই
হাঁসের পালকসম সাদা বৃষ্টি নেমে এলে সব বস্তু স্নান করে, হয়তো জন্মের জন্য কাঁদে
তার ভাষা অনায়ত্ত রয়ে গেছে, আমি শুধু নগ্ন হয়ে, পোশাক-আশাক খুলে ভিজে যাই
যদি জানতাম গান, হ্বংসধ্বনি রাগের সুর শুধু গাইতাম আনন্দে ও প্রার্থনায় নতজানু হয়ে
প্রতিবার বৃষ্টির পরেই আমি পুনর্জাত হই, আর সব রং ও পালক ছুঁয়ে আমার মরণ হয়
এই সরোবর পাড়ে সব জন্ম বৃষ্টির মতন সাদা আর পালকের মতই দুর্বোধ্য

দেশ-কাল কেন আছে, কেন এক রহস্যময়ূর পাখা দিল মেলে
যার প্রতি পালকের রং হতে, নাচ হতে জন্ম নিল সবকিছু, তা হয়ত জানা যাবে
পদ্ম হয়ে ফোটা যায় যদি সেই সরোবরে যা নিত্যই খেলা করে সব অস্তিত্বের মাঝে

বস্তুত বৃষ্টিপাতের শুরু আর শেষ নেই, ব্যাঙ ডাকে আর বর্ষা নামে সহজেই
বায়ু বয়, পাতা নড়ে, গান শুরু হয়,
মৃত্যুর রঙিন বাক্সে এই গান ভরে আমি সব পার হয়ে
যাব, সরোবর আর আফিমের উপাখ্যান পার হয়ে নিখিল বৃষ্টির নিচে শুধু হেঁটে যাব

 

১২

কখনও সম্ভব নয় বাস্তবতাকে সঠিক জানা, এমন কি শুধু ভাল করে দেখা,
বৃষ্টি আর রং অন্ধ করে দেয়, ফলে পদ্ম দেখবার জন্য শীঘ্র উন্মাদশালায় চলে যাব,
রং নিয়ে যারা ভাবে, তারা নাকি নিজ কন্ঠনালী ছিঁড়ে রক্ত দেখে মজা পায়,
সেই রক্তে পদ্ম ফোটে, নিরাপদ নয় বলে তাদের কপালে উল্কি মারা হয়,
সে উল্কিতে নক্ষত্রের জন্ম হয় বলে শোনা যায়,
শিবচক্ষু আমার কপালে নেই, কিভাবে শিবের জটা থেকে স্রোত জন্ম নেয়
আমার হবে না জানা, জানি রাত্রি সমগ্র মখলুকাতে মৃত্যুর মধুর ছবি আঁকে,
তার কিছু আসমানে তারা হয়ে মৃদু জ্বলে, কিছু ফুল হয়ে ভোরবেলা
জলের উপরে ভাসে, উন্মাদেরা শুধু তা দেখতে পায়

পদ্মের আসল রূপ আজও লোকচক্ষুর আড়ালে,
উন্মাদেরা সেই রূপ দেখে আর মৃত্যু নিয়ে গান করে

 

১৩

জল এক মায়ার আয়না, মোজেজায় ভরা
কত ছায়াফুল ফোটে জলে, সবই মায়াময় ছায়াময়
জগতের সব নক্সা কেমন খানিক তাতে আলভোলা হয়ে ফোটে
সামান্য ঢেউয়ে সব ছবি কথা একাকার হয়ে
আকার হারায়,
উদাসী গানের সুর এক জাগে

জলের মায়ায় ডুবে সব রূপ মরে যায়
তখন কেবল
দূরের পাহাড় হতে ভেসে-আসা গান হয়ে ভেসে যেতে মন চায়
পাখির, গাছের শান্ত রূপ হয়ে, চুপকথা হয়ে
বয়ে যেতে শুধু ইচ্ছা হয়
রাঙা মাছরাঙ্গার চোখের স্বপ্ন হয়ে বয়ে যেতে মন চায়

 

১৪

পুরাকালে এক সখী তরল আগুন ভরে নিতে ঘাটে আসে
তখন সাঁঝের বেলা, জলে আলো-ছায়া করে খেলা
কি যে প্ররোচনা জলে, ডাকে বড় মোহস্বরে
তরল আগুনে ঝাঁপ দিতে দেহে খুব তাপ জাগে
কলস ভাসিয়ে দিয়ে মেয়ে শেষে সোজা নামে জলে

তারপর লাবণ্যের স্রোতে মেয়ে চিরকাল আছে ডুবে
ঘাটে ঘাটে সোনার কলসীখানি শুধু যায় ভেসে
তাতে চিরকালের অতৃপ্ত তৃষ্ণা আজও খুব হাহাকার করে কাঁদে
মেয়ে পদ্ম হয়ে তবু থাকে জলে
তার মোহ নিয়ে কবি শুধু ঘাটে বসে থাকে
কোনো দিন মেয়ে জল ছেড়ে উঠবে না জেনেও বসে থাকে
আর হাহাকার নিয়ে সোনার কলসী আজও ভেসে যায় ঘাট হতে ঘাটে

 

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top