সহসাই খুলে গেল

অদিতি ফাল্গুনী

 

ক. সহসাই খুলে গেল নিরুদ্ধ অর্গল
এই গোপন জানালা
প্রকাশিত হল নভোনীল
অন্তরীক্ষ; মহাবিশ্ব সংবাদ…

বলো, কীভাবে জেনেছিলে লুপ্ত অভিপ্রায়?
জেনেছিলে মোহন পাতার ঝড়…
আমার লুকনো বেদনা
সেসকল হারানো স্বরলিপি…
যা কিছু মাটির গভীরে পুঁতে রেখেছিল
এই ভীরু মেয়ে
তোমারই জন্য…

সেই অবরুদ্ধ প্রেম
কীভাবে জেনেছ ভৃগু?
কে-ই বা জানালো তোমাকে?
কোথা হতে পেয়েছ সঙ্কেত?

 

খ. সঙ্কেত দিয়েছে কি তোমায় দশদিগন্ত?
উনপঞ্চাশ বায়ু? যিনি পর্বতদিগের মাঝে সুমেরু
হস্তীগণের মাঝে ঐরাবত, অশ্বগণের মাঝে উচ্চৈঃশ্রবা,
বেদের ভেতরে সাম আর ছন্দের মাঝে গায়ত্রী…
হে জিতনিদ্র, বলো কোথা থেকে তবে পেয়েছ সঙ্কেত?

নও কি তুমিই দ্বাদশ আদিত্যের মাঝে বিষ্ণু?
প্রকাশকগণের মাঝে কিরণশালী সূর্য,
উনপঞ্চাশ বায়ুর মাঝে মরীচি,
অষ্ট বসুর মাঝে তুমি অগ্নি…
একাদশ রুদ্রের মাঝে তুমিই কি নও শঙ্কর?
(হে প্রেম, হে ঈশ্বর আমার…!)

জানিনি এতদিন কেন জানতে পারিনি
যে তুমিই প্রণব একাক্ষর?
তুমিই চিত্ররথ গন্ধর্ব, সিদ্ধগণের মাঝে কপিল
আর বৃক্ষমাঝে অশ্বত্থ?
জলপৃথিবীতে তুমি বরুণ পসেইদন,
বেগবান বায়ু তুমি, সংখ্যার মাঝে কাল
যদি তুমি আহা সেই তুমিই যদি হও…
তর্কশাস্ত্রের বাদ-জল্প-বিতণ্ডায় তুমি বাদ
যে তুমি শাসকের দণ্ড, নৈঃশব্দ্যের মৌনতা,
ছলনার মাঝে পাশাক্রিড়া
ঋতুদের মাঝে পুষ্পাকর বসন্ত

(হে প্রেম, হে ঈশ্বর আমার…!)

 

গ. বলো ভৃগু, আজ তবে
এত এত দিন পরে
ভীরু মেয়ের না বলা কথা কে জানালো তোমায়?
এক যুগ আগে মৃত্তিকার গহন তলদেশে,
পাতালের অনামা অন্ধকারে
যে বোবা অনুভূতি কবর চাপা দিয়েছিল
এক ভীতুর ডিম মেয়ে….তাই হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই
‘জ্যাক এন্ড দ্য বিনস্’-এর শিমগাছ যেন
সহসাই মেঘলোক ফুঁড়ে সোনালী পাতার মর্মরে উদ্ভাসিত হল…

সে এক অনবদ্য দীর্ঘকায় তরু…
এক যুগ পর অকস্মাৎ মাটি ফুঁড়ে মেলল সে ডালপালা…

তার পাতায় পাতায় আলোর অন্তর্দাহ
আর বহিঃস্থ সোনাটা
তার ডালে ডালে শরতের ভরত পাখির গান
উল্লসিত ‘ঔড টু জয়’ অথবা
পূরবীর বিষণ্ন সন্ধ্যা-বন্দিশ:

‘নেই রি লগন মোরি লাগি,
তে রে রঙ্গ মে নিশ দিনা
হো রহতে রঙ্গ পাগি…’

 

ঘ. তবে খুলে যাক
খুলে যেতে দাও এই
বহু বছরের নিরুদ্ধ অর্গল
তোমার সামান্য করাঘাতে,
খুলে যাক এই গোপন জানালা…
প্রকাশিত হোক নভোনীল
অন্তরীক্ষ; মহাবিশ্ব সংবাদ…
প্রকাশিত হোক
কবরখানার পাথরচাপা মেয়ের
আর্ত সঙ্গীত, মর্মরিত প্রেমগীতি
অভিসার বন্দনা…

যে তরুণী যৌবনে মৃত্যু অভিশাপে
বীণা সহ নিজেকেই উপত্যকার ঢাল থেকে
গড়িয়ে যেতে দিয়েছিল আর
মেষপালকেরা মৃত ভেবে তাকে জ্যান্তই কবর দ্যায়…
………………………………………
আজো তার গান
দূরশ্রুত পূরবী-বন্দিশ
শুনতে কি পাও?

 

২২-২৩ শে আগস্ট
ঢাকা

Facebook Comments

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top