ধা রা বা হি ক আত্মজীবনী: মায়াপারাবার

পাপড়ি রহমান

 পর্ব-১

মলিনও হয়েছে ঘুমে চোখের কাজল

রাতের অন্ধকার ছিল তুমুল। আর ছিল উষ্ণতা। মাঘের শীতে নরম লেপের তলায় যে উষ্ণতা থাকে,তেমন উষ্ণতা। এই উষ্ণতা আমি চিনেছিলাম আব্বার দুটি হাত থেকে। তাঁর হাত ও বুক জুড়ে ছিল উপচে ওঠা স্নেহ। আমার একেবার ধোঁয়া ধোঁয়া স্মৃতি থেকে এর চাইতে বেশি কিছু আমি তুলে আনতে পারিনা। দিনের লাজহীন আলোতে যে মানুষটি বেশ কঠিন, দায়িত্ববান, কখনো বদরাগী অথচ রাত এলেই এই মানুষ, অন্য মানুষ! আমি জানিনা ঐ মানুষটির এই স্নেহময় হৃদয়ের সাক্ষী আর কেউ আছে কিনা? আমিও তখন ঘুমে বা আধো জাগরণে-নেতিয়ে পড়া লাউ ডগাটির মতো আব্বার কাঁধে। আব্বার ঘাড় ঘেষে আমার মুখ। আব্বাকে দেখছি ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছেন।আর প্রায় জড়ানো গলায় বলছেন–‘তোমার আম্মা মারা গেলে আমি আর কি নিয়া বাঁচবো!’

একই বাক্য বারংবার বলে চলেছেন। আর হাউমাউ করে কাঁদছেন। আমাকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন। কাঁধে ফেলে ঘর থেকে দেউড়ি পর্যন্ত পায়চারি করছেন। সামান্য দম নয়ে একই কথা বলছেন! আমি তখন এতটাই ছোট যে আব্বার এমন কান্নার রহস্য বা কারণ কিছুই ধরতে পারছি না। কিন্তু তীরের মতো মগজে ঢুকে যাচ্ছে তাঁর কান্না! আমিও চোখ বুঁজে আছি, শুনছি আব্বার কাঁদছেন-সিংহের মতো শক্ত মানুষটি ভেঙ্গে একেবারে চৌচির হয়ে যাচ্ছেন! একজন পুরুষ তাঁর স্ত্রীর জন্য আকুল হয়ে কাঁদছেন এমন দেখেই আমি বড় হতে লাগলাম। আমার আব্বার মতো অমন তুখোড় প্রেমিক স্বামী আমার এত জীবনে আর দেখিনি! আমার নিজের স্বামী বা অন্য বন্ধুদের স্বামীদের দেখেছি রুদ্র, কঠিন, ভয়াল রূপ। এই সময়ে হয়তো বেশির ভাগ স্বামীরাই তাই। ব্যাতিক্রম যে নেই তাও বলছি না।

আমার শিশুবেলা জুড়ে র‍্য়েছে আব্বার অঝোর কান্না। আর আম্মার জন্য ব্যাকুলতা। তখন মনে হতো ‘আরে তাইতো! আম্মা কই? আম্মাকে দেখছি না যে!’

অনেক পরে বড় হয়ে জেনেছিলাম তখন কী এক ভয়াবহ অসুখে আম্মা হাসপাতালে ছিলেন। আমার শিশুবেলা হলো আম্মার অসুস্থতা আর আব্বার কান্না। ওইসব রাতে আমার মনে হতো জগতে কান্না ছাড়া আর কিছুই নাই।

দাদীর শুষ্ক বুকে দুধের নহর

তখন বুঝি আমি বেশ বুঝদার! বুঝদারই। নইলে এতকিছু স্মরণে রয়েছে কীভাবে? স্মরণ মানে স্মরণ-যেন বা সবুজ ঘাসের চাঙরের উপর ঝরে পড়ছে সকালের তরতাজা শিশির! তেজগাঁওয়ে ছোট্ট একটা বাসায় আমরা থাকি। আম্মা অনুপস্থিত দীর্ঘদিন। আব্বা, বাসা-হাসপাতাল-অফিস করে করে ক্লান্ত। আর আমি দিদির পিছে পিছে ঘুরি। ‘দাদীকে’ আমরা দিদি বলি। আব্বা ঘেমেনেয়ে এসেই আমাকে কোলে নিয়ে চুমু খেয়ে বলেন- ‘রোববার আসলে তোমাকে আম্মার কাছে নিয়ে যাবো’

কিন্তু রোববার কেন যে এত্তদুর! রোববার আসতে এত দেরী হয় কেন? রোববার ছাড়া হলি ফ্যামেলি হাসপাতাল বাচ্চাদের এলাও করে না। কোনো এক রোববারে আব্বা সত্যি সত্যি আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। আমি দেখি মাথার দিকটা উঁচু করে রাখা একটা সাদা খাটে আম্মা শুয়ে আছেন! শুয়েই শুয়েই হাত বাড়িয়ে দেন সাইড টেবিলে। আর আমার হাতে তুলে দেন সবুজ-গোলাপী ফুলফুল পেস্ট্রি। আমি পেস্ট্রি হাতে নিয়ে অবাক হয়ে থাকিয়ে থাকি। আম্মাকে কিরকম পানসে দেখায়? আম্মার হাতদুটো এত ছিপছিপে যেন মুলিবাঁশের টুকরো! আম্মার হলুদাভ ত্বক ফ্যাকাশে সাদা! একেবারে বেলেমাছের মতো রক্তহীন! আম্মা হাত নাড়েন, আমার
মনে হয় বেলেমাছ সামান্য নড়ছে-চড়ছে! বিছানায় পড়ে থেকেই আম্মা আমাকে ক্লান্ত চোখে দেখেন। কোলে নেননা! কাছেও ডাকেন না। আমি কি ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলবো?

আব্বা আমাকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বাসায় আসেন। বাসায় আছেন আমার ছোটফুফু আর দিদি। দিদির সংগ আমার জন্য চরম আনন্দের। আমি জানিনা কেন বা কীভাবে দিদির স্তন চোষার অভ্যাস আমার হয়েছিল। হয়তো আম্মার দীর্ঘকাল হাসপাতাল যাপন। আম্মা নেই, এদিকে আমি গরুর দুধ খেয়ে আর দিদির শুকনো স্তন চুষে বড় হচ্ছি! আমি প্রায় জোর করেই দিদির বুকে ঢুকে পরতাম, কিন্তু একফোঁটা দুধ বেরোতো না তা থেকে! দিদি হয়তো কেরোসিনের স্টোভে রান্নায় ব্যস্ত, আমি
দিদিকে চিৎ করে ফ্লোরে ফেলেই স্তন চুষতে শুরু করতাম। দিদিরতো আর ব্লাউজের বালাই ছিলনা! সে ব্লাউজ পরলেও ব্লাউজের বাইরে ঝুলে থাকতো সেই স্বর্গীয় স্তনবৃন্ত! ফলে আমার কোনো কষ্টই হতোনা! আমি দিব্যি তাতে ঠোঁট ডুবিয়ে দিতাম। আমার যে তখন মা ছিলনা। মা ছিল বহুদূরে-সাদা আলো ভরা এক ঘরের-সাদা বিছানায়।

আব্বা গরুর দুধ রোজ করে দিয়েছিলেন। গোয়ালা ঢাকনা দেয়া এ্যালুমিনিয়ামের পাত্রে দুধ নিয়ে আসতো। ভেতরে সবুজ সবুজ কলাপাতা। দিদির তরল বিহীন স্তন আর তামচিনির বাটিভরা দুধে ভরে রইলো আমার শিশুবেলা। কখনো বোতলে ভরেও দুধ খাওয়াতেন দিদি। এবং বেশ বড় হয়েও বোতলের দুধ খেয়ে আমার সামনের পাটির দাঁত ছিল পোকা খাওয়া। যাকে আজকাল ক্যাভিটি বলে। অতিরিক্ত শর্করায় ও ভালো করে দাঁত না মাজার কারণে আমার সামনের চারটে দাঁতের মৃত্যু হয়েছিল। ফলে আমি দাঁত বের করে হাসতাম না লজ্জায়।

আম্মা বাসায় নাই। কবে আসবেন জানিনা। আমি দিদির পিছু পিছু ঘুর ঘুর করি। যদি দুধ খাওয়ার সামান্য সুযোগ পাই। দিদি আমাকে হাউজের পারে নিয়ে সাবান-পানি দিয়ে ডলে-মেজে গোসল করিয়ে দেন। এই গোসল করিয়ে দেওয়ার মাঝে অনেক স্নেহ-মায়া-মমতা-ভালবাসার মিশেল থাকে। আসলে ভালবাসা যা কিছু সবতো দেহকে ঘিরেই। দেহ ছাড়া আর কোথায়ই বা ভালবাসা রাখা যায়? দেহ ছাড়া কোথায় ভালবাসা বুঝা যায়? এই গোসল করিয়ে দেয়াটা আমাদের পরিবারে খুব
চালু ছিল। আম্মা কখনো সখনো আব্বাকে গোসল করিয়ে দিতেন। বড়চাচীমা আমাদের বাচ্চাদের, আম্মা আমাদের ছোট ছোট চাচাতো-ফুপাতো ভাইদের গোসল করিয়ে দিতেন। আমার দিদিকেও আম্মা, চাচীমারা গোসল করিয়ে দিতেন। দিদির ধবধবা ফর্সা পিঠে সুরমারঙা একটা মাস ছিল। আম্মা বা চাচীমারা গোসল করিয়ে দিলে দিদি গতরে তেল-পানি মেখে রোদ্দুরে পিঠ মেলে বসতেন। আমার মনে হতো বিশাল এক বকপাখি রোদে ডানা মেলে আছে। আমি আঙুল দিয়ে দিদির মাস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম…

 

ছোট্ট ইঁদুরছানা অথবা মিষ্টি আলুর মতো লালচে মানুষ!

আম্মা একদিন বাসায় ফিরলেন। ওমা! আম্মার কোলে তুলতুলে তোয়ালেতে প্যাঁচানো এক্কেবারে একটা ইঁদুরছানা! ভালো করে তাকিয়ে দেখি ইঁদুরছানা নয়, ইঁদুরছানার মতো দেখতে লালচে এত্তটুকুন একটা মানুষ! তার মাথা-কান-টান সব ঢাকা। শুধু নাক-চোখ বেরিয়ে আছে! আমি বেশ উৎফুল্ল। তাকে স্পর্শ করতে গেলেই আম্মা বেশ কঠিনভাবে বললেন–‘যাও আগে সাবান দিয়ে ভালো করে হাত-মুখ ধুয়ে এসো।‘

আরে এতো দেখছি মহা ফ্যাসাদ! ইঁদুরছানাকে ধরতে হলে সাবান দিয়ে হাত আবার মুখও ধুতে হবে? আম্মা সবুজ হতে হতে নীল কাগজে মোড়ানো একটা সাবান হাতে দিলেন। বড় হয়ে জেনেছিলাম অই সাবনের নাম ‘তিব্বত কসকো সাবান’। মোড়ক খুলতেই চকলেটরঙা ডিম্বাকৃতি এক সাবান পেলাম।আম্মার কথা শুনতে হয়। এবং এই আম্মার কথা শুনতে গিয়েই আমার নিজের জীবনটা তছনছ করে দিয়েছি! সে অন্য প্রসঙ্গ। অন্যখানেই বলতে হবে। হাউজের পারে টিপকলের পানি দিয়ে সাবান মেখে পরিস্কার হয়ে এলাম। দেখি এবার ইঁদুরছানার অবস্থা কি? আম্মা তাকে আমার কোলে দিলেন। আরে! এতো দেখি খালি ঘুমায়! খিদে লাগলে মোচড়ামোচড়ি করে আর ট্যাঁ ট্যাঁ করে কাঁদে! আম্মা ছানাটিকে শুইয়ে রেখে আমাকে কেক খেতে দিলেন। খুব সুন্দর উজ্জ্বল হলদে কাগজের ফুলে রাখা সেই কেক। এদিকে ইঁদুরছানা নিয়ে সবাই ব্যতিব্যস্ত। মায়ের পেট থেকে সে একটা নাড়ি নিয়ে এসেছে। দিদি তাতে রোজ আগুনের ছ্যাঁক দেন আর তক্কে তক্কে থাকেন। ছানার নাড়ি শুকোলে আব্বা সেটা নিয়ে খুব ভালো মাটিতে গেড়ে আসবেন। তা ছানার নাড়ির কি হলো আমি জানিনা। বড় হয়ে শুনেছি আব্বা সেটা হাইকোর্টের মাটিতে পুঁতে দিয়েছিলেন, ছেলে যাতে বড় বিদ্বান হয়,জজ-ব্যারিষ্টার হয়।

ইঁদুরছানা খালি ঘুমায় কিন্তু তার দেখি খরচাপাতির অন্ত নাই! আব্বা বেতের চেয়ার কিনে এনেছেন।চেয়ারের মাঝখানে গর্ত। এই গর্তে চিলুমচি রাখা। ইঁদুরের টয়লেট এটা! সে চেয়ারে বসে বসে হাগুমুতু করে। আমার জন্য রোজের দুধ পরিমাণে বাড়িয়ে রাখা হয়। ছানাও দুধ খায় আমার সাথে সাথে। আর ছানার জন্য আব্বা কিনে আনেন আলাদা করে তেল, সাবান, লোশন! আর আসে তার জন্য ছোট ছোট ফ্লানেলের কম্বল।

আরে এই ছানার জন্য দেখি ‘সরিষার বালিশ’ এলো! দাদাজান লাল লাল ছোট্ট দানার সর্ষে কিনে বালিশের খোলে ভরে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এই বালিশে অই মিষ্টি আলুটা নাকি ঘুমাবে! সর্ষের বালিশে ঘুমালে তার মাথা নাকি হবে গোলগাল। কিন্তু আমার জন্য তো সর্ষের বালিশ ছিলনা। খুব মন খারাপ লাগে আমার! এই লাল মানুষ আম্মার পেট কেটে সিজার করে বেরিয়েছে। আমিও তাই। কিন্তু আমার মাথা নিয়ে কারো কোনো চিন্তা নাই! আমার মাথা ছয়কোনা হলো না সাতকোনা তাতে কার কোনো মাথাব্যাথা নাই!

আরেকটু বড় হয়ে বুঝলাম এই লালচে ছানাটিই আমার একমাত্র ভাই। আব্বা তার নাম রাখতে চেয়েছিলেন নার্সিসাস। কিন্তু নার্সিসাসের মর্মান্তিক পরিণতির কথা ভেবে নামটা আর রাখেননি। নাম রাখলেন ‘প্রদীপ’। এই প্রদীপ ব্যারিষ্টার না হলেও বিদ্বান হয়েছে। বাংলাদেশ আর্মিতে লেঃ কর্ণেল হিসাবে কর্মরত আছে সে। আর সে আমার চীরকালের ঝগড়ার সংগী। আমার ভয়ানক বন্ধু আবার শত্রুও। আমার রান্নার খুঁত বের করে। আমার স্বভাব নিয়ে কটাক্ষ করতে পটু। সেই লালছানার দাপটে টেঁকাই দায়। আর তার ধর্মে খুব মতি। আমার যেমন বেমতি। সে গান করে, কবিতা লিখে আর ছবিও আঁকে। আব্বার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, সে যথেষ্ট বিদ্বান হয়েছে। তবে আম্মা আর কোনো লালমানুষ আনতে হাসপাতালে যাননি। আনতে চাইলেও আর আনতে পারতেন না। লালমানুষ বহন করার থলেটা আম্মার আর ছিল না। ডাক্তার তা অপারেশন করে কেটে ফেলেছে। আমার আব্বা আর আম্মা কোনোদিন আর কোনো ইঁদুরছানা হাসপাতাল থেকে আনতে পারেননি। তাদের এই অপারগতা ছিলেন তাদের জন্য ভয়াবহ শোকের…

(ক্রমশ)

 

 

Facebook Comments

2 Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top