বিরহ ও মিলন লইয়া এক পরস্তাব

গৌতম চৌধুরী

রশির উপর দিয়া হাঁট তুমি, আমি দেহি বেবাক আন্ধার
আমি দেহি, শূন্যে পাও ফালাইয়া ফালাইয়া তুমি চইলা যাও কুয়াসার দিকে
তুমি মৎস্যমুখী পট, গজবিড়ালির
তোমার মুখের হাস্য বান্ধাইয়া রাখে গোপবালিকারা
জোসনাধারা দিবা তুমি, তুমি দিবা করতোয়া দুধের ফোয়ারা
মাংসপিণ্ডে তুমি দিবা ফকফকা আলো
আলোরে বানাইবা মাংস গামলার ভিতরে
গামলার ভিতরে পানি, হংসযূথ কেলি করে দিন আর রাত্রির লাহান
দিনের রাত্রির ভিত্রে দেখা হয় কয় দণ্ড? তবু তারা কেলি করে
কেলি কইরা চইলা যায় উলটা উলটা পানে
সারা দিনরাত্রি ব্যাপী বিচিত্র রাগিনী রাগ বাইজা চলে প্রহরে প্রহরে
তবু সন্ধি হয়
কোমল রেখাবগুলা চিরবিরহের কথা কইয়া যায় উয়াদের মিলনপ্রস্তাবে
তবু সন্ধি হয়
গভীর কম্বল আইসা ঢাইকা দেয় প্রকৃতিপ্রত্যয়
চারিপাশ লুপ্ত, লুপ্ত – তুমি-আমি আত্মপরিচয়
সামান্য মুহূর্ত মাত্র, পুনরায় ছিটকাইয়া টুকরা হৈয়া যাওয়া
পুনরায় চইলা যাওয়া উলটা উলটা গগনের পানে
হা রে হংসযূথ, কী যে তগো বিচিত্র কারবার

উড়ন্ত কমল ছুটে আন্ধারের লহর কাইটা
পাপড়িগুলা বন্ধ, লম্বা নাল বাইয়া গড়ায়া পড়তাছে
নিভৃত মাংসের মতো আলো
তার ক্ষীণ আভা যেন্‌ আরও বিস্তারিত করে আন্ধারের দিগ্বিদিক সীমা
উড়ন্ত কমল ছুটে, আর সেই শূন্যের দইরা
কেবলই ছড়ায়া পড়ে আরও দূরে, ক্রমে আরও দূরে
ফলত, যতই ছুটে, কমলেরে মনে হয় স্থির
নিস্তব্ধ ঘুমন্ত এক মহাস্থবিরের ভাষা নিয়া
হক্কল ইশারাগুলা ভিত্রে গুটাইয়া রাইখ্যা, নাম দেয় আত্মস্থতা!
কোথা আত্মা, কোথায় বা স্থান
হাজার পাপড়ির ভিত্রে ফুইলা উঠে কান্দনের ঢেউ
এক দল চিল্লায় – আমাগোর আত্মা নাই, স্থান লইয়া আমরা কী করুম?
অন্যেরা চিক্‌খৈর তুলে – আমাগোর স্থান নাই, আত্মা লইয়া আমরা কী করুম?
কলরবে কলরবে শূন্যের দইরা মাঝে আচানক দেহা যায় ফাট
ফাটল হইতে ক্রমে মাথা তুলে কুন্‌ পরমাতামহী, কমলাসুন্দরী
কমলায় গায় আর সুরে সুরে কাঁইপা উঠে আধেক কমল
কমলায় নাচে আর তালে তালে  বাইজা উঠে আধেক কমল
একখান একখান কইরা পাপড়ি খুলবার লাগে তার
একখান একখান কইরা পাপড়ি খুলে দশ শত বার
শত দশ পাপড়িতে দোতারা বাইজা উঠে কৃষ্ণ দইরায়

গজবিড়ালির মুখে ধরা মাছখান ভাজাভুজা হয় নাই
ভাজা হৈলেও সে কি উল্টায়া খাবার পারত? সে পটের বিবি!
বিবিদের বাবুদের পটে ঘটে কত কিসিমের বিদ্যা কত রঙ্গরস
ফাল হৈয়া ঢুইকা তারা সূই হৈয়া ঘাপটি মাইরা থাকে
ঠোটটাবাজি বন্ধ করনের লাইগ্যা সময় বুইঝা সিলাই কইরা দেয় ঠোট
সময়ের লগে লগে ছুইটা যায় ঘৃতকুমারীর দেশে, হাস্য করে লাস্য করে
অইসব ট্যাটন পুলারে তুমি পরস্তাব শুনাইবার চাও!
ফালাইয়া থোও তোমার গল্পদাদুর আসর
তার থিকা আস, গোসল কইরা লও, ধর্ষণ ধর্ষণ খেলা খেলি
কেলাকেলি করি বিনা কারণেই ভাই দোস্তো মিলা
এইটা বিলকুল খেলা, চিন্তা কইর না, ইয়ার ভিত্রে কুন গুনাহ্‌ নাই
আমরা লায়েক হৈলে আসমানে অগ্নির উড়াল দিমু দইরার কূলে
মাছুয়ারা হাউকাউ করব, কইব –  আমাগোর দইরা আমাগোর পানি
হাঃ, আমরা কি শুনুম? আমরা দেখামু, বুদ্ধ হাসতাছে বালুর ভিত্রে
আমরা দেখামু, বুদ্ধ জ্বলতাছে পাহাড়তলিতে

মাথার উপ্রে শূন্য, তুমি হাঁট রশির উপরে
পাওয়ের নিচেও শূন্য, তুমি হাঁট রশির উপরে
রশিও ক্রমশ যেন্‌ লুপ্ত হয় আন্ধারের গভীর জানুতে
তবে কি শূন্যের বুকে হাঁট তুমি? নিরালম্ব? আশ্রয়বিহীন?
শূন্যে পাও ফালাইয়া ফালাইয়া চইলা যাও রশিহীন, যুক্তিহীন পথে?
এই কথা ভাইবাই রোমাঞ্চিত লাগে –
যুক্তির পথে বড় পেরেশানি, অযুক্তির পথ মায়াময়
যুক্তির পথে নাচে যন্ত্রবৎ জড়পুত্তলিকা
অযুক্তির পথে পথে কুচকাওয়াজ মৃগশিরা কৃত্তিকা ভরণী
প্রচণ্ড গর্জনে জাগিল একি ভুজঙ্গ
রশি ফোঁস কইরা উঠে – আমি আছি আমি আছি যত মোরে অদৃশ্য দেখাক

যেইখানে যে আছে, সে সেইখানে খাড়াক –
যুক্তি অযুক্তি শূন্যতা রশি বা দারাইশ
বিরান দুইনাখান আসলে কিছু না, শুদ্ধ তুমি আর আমি
কেবলই ছিটকায়া পড়ি দুইজনা দুইপ্রান্তে, অভিশপ্ত সেই হংসযূথ
শূন্য তোলপাড় কইরা চইলা যাই, যত যাই, শূন্যতাও ছুটে
কাজেই শূন্যের ভিত্রে দু’ দু’খান কেন্দ্র গইড়া উঠে – তুমি আর আমি
একে অপরের কুন হদিশ রাখে না  – কে তুমি কে আমি
তবু সন্ধিলগ্ন আসে
একাকার হৈয়া যায় সকল স্বতন্ত্র সত্তা – কে তুমি কে আমি
কে কমল পাপড়িবন্ধ, কে নাচন্ত কমলাসুন্দরী
কেবলই বদল হয় মালা আর হুলাহুলি পড়ে
উড়ে খই মহাশূন্যে, পয়দা হয় শত ধূলিনক্ষত্রের আলো
শত ধূলিনক্ষত্রের আলো আইসা স্পর্শ করে কৃষ্ণছায়াপথ
সন্ধিরাগমালাগুলি বাইজা উঠে ছুঁইয়া যায় কোমল রেখাব

কিতারে সত্য কই হে গজবিড়ালি
মুখ থিকা মৎস্য নামাও, আর কইয়া দাও প্রকৃত সত্য কিতা –
দূর? না নিকট? কিতা সত্য –
আলো-আঁধারির মিল, ক্ষণিকের? না কি চিরধাবমান বিপরীতগামিতা?
কারে আমি, আমি কই? কে আমার তুমি?
রুদ্ধকমলদল কার বুকে আন্ধার ঘনায়? কার বুক আলো করে কমলাসুন্দরী?
তুমি শুধু পটে লিখা, জানি কুন জবাব দিবা না
তবে শুন, এ হৈল এক সরল জ্যামিতি – প্রশ্ন মিলনের বিন্দু, সামান্য ক্ষমার
জবাবের খোঁজ ক্রমে বিরহরে দীর্ঘ দীর্ঘ করে
তবু সেই দীর্ঘতম পথ পাড়ি দেওনের লাইগ্যা আমাগোর চক্ষে ঘুম নাই
ঘুমাইব না আজ তয় সারা রাত্রি, কৈলাসের মানচিত্র দেখুম
কাল সুবেহসাদেকের আলো আইলে কোরবানি – আমি তুমি হক্কল প্রশ্নের
রক্তপাতহীন পথে এই এক শান্তি সম্ভাবনা দেখা দিলে, বুঝা যায়
হক্কল প্রলাপ সত্য, হক্কল সংলাপ আচাভুয়া

৩০ আশ্বিন ১৪১৯

গৌতম চৌধুরী ।। ২৬/৩১/২ কৈপুকুর লেন  শিবপুর  হাওড়া ৭১১ ১০২ ।। চলভাষ +৯১৯৪৩২৩২৩৮৬৫

 

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top