নভেরা হোসেনের একগুচ্ছ কবিতা

গোপন নির্বেদ

রাত ঘন হয়ে এলে দরজায় এসে কড়া নাড়েনা কেউ
পিনপতন নিস্তব্ধতায় মগজে গোপন শ্লাঘা এসে জমে,
বুদবুদের ফেনা হয়ে মিশে থাকে গোপন নির্বেদ,
চোখ খুলে ঘুমায় সে ডিভানের কোণে
সারারাত ছটফট, কে যেন রক্তে মিশিয়ে দিয়েছে জ্বলন্ত কয়লা
তার আঁচে পুড়তে পুড়তে চকিতে হায়েনার হাসি–
দূর থেকে ভেসে আসা সন্তুরের সুর
নিঃশব্দে কেটে নেয় চোখের ঘুম,
ছায়ার মতো চলে ফেরে–
ঝুপ করে মিলিয়ে যায় পশ্চিমা বাতাসে
রাতের সিম্ফনি ঘন রাত হয়ে আসে।

 

একটি টিকটিকির মৃত্যু

রোজ তুমি আসো-যাও
ঘরের দেয়ালে আটকে থাকো
উড়ন্ত মশা আর মাছিদের খোঁজে,
পিঁপড়া, উইপোকা, সুদর্শন মৌমাছি
তাদের খোঁজেও আসো তুমি
কার্পেটে ঘুমাও শিশুর কোমলতায়–
কোনো মনুষ্যখাদ্য তুমি স্পর্শ করো না,
ছুঁয়ে দাও না কারো চোখ অথবা চিবুকের খাঁজ
বারান্দার রেলিঙে ঝোলানো অপরাজিতার নীল আলো
তোমাকে স্পর্শ করে না,
বেয়ে চলো দেয়ালের মসৃণতায়
আমরাও সুযোগ খুঁজি
ওৎ পেতে থাকি দরজার আড়ালে
তুমি বুদ্ধিমান অতি
জানো কীভারে বাঁচতে হয়
আমরাও জানি মারতে
আমাদের ইঁদুর-বিড়াল খেলায়
হার হয় তোমার
এরোসলের তীব্র ঝাঁজে দম আটকে
সত্যি এবার আটকে যাও দেয়ালের ভাঁজে।

 

তুমি কোথাও নাই

হাসপাতালের করিডোরে তুমি নাই
রক্ত, তুলো আর ডেটলের গন্ধেও তুমি নাই,
মিছিলে, প্লাকার্ডে, এক্সিবিশন হলের শীতলতায়
কোথাও তুমি নাই,
কোমরের মাঝ বরাবর যে হাড়
সেখানেও তুমি নাই
নখের ডগায়, চুলের জটে
হৃদপিণ্ডের ডান অলিন্দ
কোথাও তুমি নাই,
রাত্রির অমানিশায়,
চাঁদের বিচূর্ণ আলোয়
কোথাও তোমাকে পেলাম না,
তুমি কি তবে ছিলে না কোথাও
অথবা থাকবে না কোনোকালে–
কোনো হারানো আঙটির উজ্জ্বলতায়
কোনো নাস্তিকের গলার ক্রসে?

 

মহিষাসুর

তুই বাড়িয়ে দে দুই হাত আমার অস্থিমূলে,
শুষে নে স্তনের সকল রস
বিদ্ধ কর ত্রিশুল দিয়ে
আমারই যোনিপথ,
আয় তুই এবার মহিষাসুর রূপে
খুলে নে মস্তিষ্কের সকল ব্যথা
আর যা যা ভাঙবার
টুকরো কর কব্জির চাপে,
গোলাপি ঠোঁটজোড়াও কেটে চারভাগ কর
তোকে যে বধিবে
গোকূলে বাড়িছে সে!

 

বিষন্নতা অথবা চামেলির গন্ধ

আজকাল আর কেউ বলে না
তুমি এতো বিষণ্ন কেন–
আগে অনেকেই বলত;
তোমার কি মন খারাপ?
কী হয়েছে এতো বিমর্ষ কেন দিনরাত?
এখন কেউ জানতে চায় না নৌকার গলুইয়ে বসে চাঁদ দেখতে কেমন লাগে,
প্রেমিকের আকস্মিক চুম্বনে হৃদস্পন্দন বন্ধ হয় নাকি!
দিনরাত কলম পিষছো,
পত্রিকার পাতায় লেখা নয়তো ফটোগ্রাফ–
ফটোগ্রাফ দেখেও কেউ বলে না চোখের নিচে কালি জমেছে কেন?
আর বিপি ১০০/১৪০ কী করে হলো?
এখন বিষণ্নতা একটি রোগ,
চামেলির গন্ধ তোমার সহ্য হয় না!

 

অসহ্য বিকেল

বিকেলের মিষ্টি রোদ ঝরছে
কৃষ্ণচূড়ার লালে!
একটা বুলবুলি ঠুকরে চলেছে
নারকেলের সোনালি ফুল,
নিস্তব্ধ তেতলার ঘর
তোমার মন আজ বিমর্ষ হয়ে আছে
তুমি প্রথমে নামছ সিঁড়ি দিয়ে
একটু পরেই উঠছ আবার
নামছ তারও পরে।
কিচেনে চায়ের লিকার ফুটছে
বিস্কিটে নোনা স্বাদ
বর্ষার অসহ্য বিকেল তোমাকে ছুঁড়ে দিল
ছাদের দেয়ালে!

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top