ভিসেন্তে আলেইহান্দ্রে’র পাঁচটি কবিতা

অনুবাদ: আজফার হোসেন

 

বন্ধ

উদোম পৃথিবী। নিরাপত্তাহীন রাত
নিরিবিলি। বাতাস তার ঝালরের
বিপরীতে ইঙ্গিত দেয়
কানহীন ধুকধুক ধুকধুক।

সিসা ছায়া ঢালে, হিম,
ভারি সিল্কে জড়িয়ে রাখে
তোমার বুক, কালো,
রুদ্ধ। অতএব সবকিছু

চাপে থাকে রাত্রির
ধাতবে। প্রসিদ্ধ, শান্ত,
রাতের স্বচ্ছ পুরনো
সমতলের ওপর।

দেউলিয়া নক্ষত্রেরা থাকে।
ঘষামাজায় মসৃণ কবজা। বরফ
ভেসে চলে উচ্চতায় উচ্চতায়
শৈত্যের ধীর প্রবহ।

নির্বাক নিবিড় বিন্যাসের ওপর
ভেসে-চলা ছায়া
আঘাত হানে, কঠোর সংযমী
তার গোপন চাবুক।

বেতের প্রহার। রক্তের কিংবা আলোর
কিংবা আগুনের প্রবাল দিব্য উদঘাটিত হয়
পাতলা স্বচ্ছ রেশমি বসনের নিচে,
তারপর সে কর্বুর হয়ে পথ ছেড়ে দেয়।

গভীরভাবে প্রবেশ কর মাংসে কিংবা মাংসের
আলোতে। বাতাস বেঁচে থাকে কেননা সে
অপেক্ষা করে ঝাপটানির,
পাল্টা-স্রোতের, যতির, নৈঃশব্দের।

 

জোছনা অথবা গিটার

জোছনার মতো এক গিটার।
ওটা কি জোছনা নাকি শুধু তার রক্ত?
একটি ছোটো হৃদয় পালিয়ে গেছে,
চলে গেছে বনের ওপর, তার নীল নির্ঘুম সঙ্গীত বাজিয়ে।

একটি কণ্ঠস্বর নাকি তার রক্ত
একটি তুমুল আবেগ নাকি তার সন্ত্রাস
একটি মাছ নাকি শুকিয়ে যাওয়া চাঁদ
যা ধপাস করে পিছলে পড়ে রাতে, পাহাড়ের গায়ে ছায়া ছিটিয়ে।

অদ্ভুত হাত নাকি হুমকি-দেয়া ক্রোধ।
জোছনা রক্তিম নাকি সে হলদে?
না, সে তো নয় আক্রোশে রক্তলাল হয়ে ওঠা
কোনো চোখ যা দেখে নিতে চায় ক্ষুদে পৃথিবীর কিনারা সব।

সেই হাত যা আকাশ জুড়ে জীবন খোঁজে
যা রক্তঝরা দিগন্তের হৃদস্পন্দন খোঁজে
যা আদিম গ্রহগুলোর মাঝখানে গভীরভাবে খোঁজে
সেই হাত অনুভব করে রাতে জ্বলজ্বল-করা গিটারের অনুপস্থিতি।

কষ্ট– বুকের কষ্ট– যা কোনো বয়ানে ধরা যায় না
যখন বুনো জন্তুরা অনুভব করে তাদের চুলের খোঁচা
যখন তারা অনুভব করে তারা ভিজে আছে সমাহিত আলোতে
যে আলো তাদের হাড় খুঁজতে থাকে একটি দুর্দান্ত বিশাল হাতের মতো।

 

স্বপ্নেরা

নিঃসঙ্গতার ওইসব মুহূর্ত আছে
যখন অবাক হৃদয় অনুভব করে, প্রেমের
কোনো অনুভূতি নেই তার। আমরা শুধু বসে থাকি,
ক্লান্ত, দিনমান উপচে পড়ে অন্ধকার।

কেউ একজন এখন ঘুমাচ্ছে ওই বিছানায়, শিশুর মতো।
কিন্তু আমরা হয়তো ঘুমিয়েই আছি…না, আমরা গতিময়।
এবং আমরা বিষণ্ণ, নিঃশব্দ। বাইরে অবিচলিত বৃষ্টি।
অলস অবিশ্বাসী কুয়াশার এক সকাল। এতো একা!
জানালার বাইরে চেয়ে থাকি। স্তুপ হয়ে থাকে বস্ত্র,
ভারি বাতাস; তবলার বোল তোলে বৃষ্টি। আর ঘরটা
বরফ হয়ে থাকে এই বর্বর শীতে যা বাহির থেকে ভিন্ন লাগে।

তাই তুমি চুপ করে থাকো, তোমার হাতে থাকে তোমার শির।
টেবিলে তোমার কনুই। চেয়ারটা শব্দহীন।
আর নিঃশ্বাসের পতন ছাড়া কোথাও কোনো আওয়াজ নেই,
সেই যে নারী, সমাহিত ও সুন্দর, ঘুমায় সেখানে–
সে স্বপ্ন দেখে, তুমি তাকে ভালোবাসো না
সে স্বপ্ন দেখে, তুমি তার স্বপ্ন।

 

বৃষ্টি হচ্ছে

এই সন্ধ্যায় বৃষ্টি হচ্ছে, আর তোমার যে ছবিটা
তুলেছিলাম তাও ঝরছে আজ বৃষ্টি হয়ে।
দিনটা হুট করে খুলে যায় আমার স্মৃতিতে।
ভেতরে হেঁটে আসো। অথচ আমি কোনো আওয়াজ পাই না।
স্মৃতি আমাকে তোমার ছবি ছাড়া দেয় না তো কিছুই।
সেখানে কেবল তোমার চুম্বন ঝরছে, অথবা ঝরছে বৃষ্টি।
তোমার কণ্ঠস্বর বৃষ্টি হয়ে ঝরছে
তোমার বিষণ্ণ চুম্বন বৃষ্টি হয়ে ঝরছে
গভীর চুম্বন, বৃষ্টিতে ভেজা চুম্বন। ভেজা ভেজা ঠোঁট।
স্মৃতিতে ভিজে ভিজে ফুঁপিয়ে কাঁদছে চুম্বন
কোনো এক ছাইরঙ মোলায়েম আকাশ থেকে।
তোমার প্রেম থেকে ঝরে বৃষ্টি, আমার স্মৃতিকে
ভিজিয়ে দিয়েই বৃষ্টি পড়তেই থাকে। অনেক নিচে
চুম্বন পড়ে। ধূসর বৃষ্টি
ঝরেই চলেছে।

 

তার দেওয়া হাত

আরো একবার আমি ছুঁয়ে যাই তোমার হাত,
তোমার ওমভরা হাত, নিকষিত ও শিষ্ট হাত
মাঝেমাঝে চোখ বন্ধ করে আমি তাকে আঘাত
করতে থাকি বিনম্র, তাকে আলতোভাবে স্পর্শ করি,
তার আকার অনুভব করার জন্য, তার আঙ্গিক ছুঁয়ে
যাওয়ার জন্য, পাখাসহ তার চামড়া যার নিচে থাকে
উৎকোচ-উপেক্ষা-করা পাথুরে দেহসার, বিষণ্ণ অস্থি
যা কখনো পায়নি প্রেম। আহা, কি দুর্দান্ত ভালোবাসায় ভিজে
থাকে মধুর মাংস।

সাক্ষাৎ উত্তাপ ছড়াতে থাকে তার কণ্ঠস্বর, তার বিনীত বাসনা
আওয়াজ তোলে তোমার গোপনীয়তায়, লুকিয়ে থাকা চামড়া খুলতে শুরু করে;
তার ভেতর দিয়ে তোমার বলকানো রক্তে পিছলে যায় আমার কণ্ঠস্বর
যেখানে সে এলোমেলো পথ হাঁটে, ভাসে তোমার গোপন সরোবরে,
যেন দ্বিতীয় রক্ত গেয়ে চলেছে ছায়া-ছায়া গান, অমৃতের মতো অন্ধকারময়
সে তোমায় ভেতর থেকে চুমু খায়, তোমার দেহে সে বয়ে যায় একটি স্বচ্ছ
টংকার হয়ে– সে এখন আমার দেহের প্রতিরব, যখন আমার দেহ ভরে যায়
রবরবা কণ্ঠস্বরে। আহা, তোমার প্রতিধ্বনিময় দেহকে জড়িয়ে নেয়
আমারই আওয়াজ।

তাই জেনে গেছি যখন আমি তোমার হাত ছুঁয়ে যাই
কেবল তোমার অস্থি আমার প্রেমকে প্রত্যাখ্যান করে–
সেই দীপ্তিমান মানব অস্থি। আর জানি তোমার ভেতরে
আছে এক বিষণ্ণ বিন্যাস, যা আমাকে গ্রহণ করে না,
যখন তোমার মাংস মুহূর্তের জন্য শাদা উষ্ণতায় দপ করে ওঠে,
তোমার হাতে অলস আঘাতে জেগে-ওঠা আগুনকে জড়িয়ে
তোমার সিল্কভরা ছিদ্রময় হাত শুরু করে তার বিলাপ,
তোমার নরম শান্ত হাত যেখানে আমি আসতে থাকি
ধীরে ধীরে, বেশ ধীরে, চুপে চুপে, তোমার জীবনে,
যেতে থাকি রক্তের সমস্ত গভীরতম প্রবহের দিকে
যেখানে আমি ভাসতে থাকি এবং বাস করি আর
তোমার ভেতরে আমি আমার গান গেয়ে তার ইতি টানি।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top