গ্যোব্রিয়েলা মিস্ত্রাল-এর কবিতা

অনুবাদ:কামাল রাহমান 

গ্যোব্রিয়েলা মিস্ত্রাল (১৮৮৯-১৯৫৭): প্রথম, এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র কবি, যিনি নারী হিসেবে ল্যাটিন আমেরিকা থেকে সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কার পান, ১৯৪৫ সালে। একজন শিক্ষাবিদ, কূটনীতিবিদ ও নারীবাদী হিসেবে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেন এই কবি। তাঁর কবিতার মূল সুর প্রকৃতি, বিদ্রোহ, প্রেম, মায়ের ভালোবাসা, দুঃখ, ও দুঃখ থেকে পরিত্রাণ, ভ্রমণ, ল্যাটিন আমেরিকার পরিচিতি প্রভৃতি। আদিবাসী আমেরিকান ও ইউরোপীয় ঘরানার মিশেল রয়েছে তাঁর কবিতায়। চিলির ৫০০০ পেসো মূল্যমানের মুদ্রায় রয়েছে তাঁর ছবি। মিস্ত্রালের একটা বাণী বিশ্বব্যাপী মূল্যায়িত হয়েছে: ওর নাম হল আজ। ‘অনেক ভুলের জন্য আমরা দোষী এবং অনেক ত্র“টির জন্য, কিন্তু আমাদের সবচেয়ে বড় অপরাধ হচ্ছে শিশুদের পরিত্যক্ত করা, জীবনের ঝরনা প্রবাহকে অবহেলা করা। আমাদের জীবনের অনেক প্রয়োজন অপেক্ষমান থাকতে পারে। কোনোভাবেই শিশুরা না। এটাই হচ্ছে সঠিক সময় যখন গড়ে উঠে ওর অস্থি, তৈরি হয় রক্ত, এবং ওর ধারণাগুলো আকার পায়। ওর কাছে আমরা জবাব দিতে পারি না ‘আগামীকাল, ওর নাম হল আজ।’’

 

একা নই আমি

রাত্রি, পরিত্যক্ত
পর্বত হতে সমুদ্র পর্যন্ত।
কিন্তু আমি, যে তোমাকে দোলা দেয়,
একা নই!

আকাশ, পরিত্যক্ত
সমুদ্রে ছুঁড়ে দেয়া চাঁদের জন্য।
কিন্তু আমি, যে ধারণ করে তোমাকে,
একা নই!

পৃথিবী, পরিত্যক্ত
দেখো, শরীরে সব অভীপ্সা নুয়ে আছে দুঃখে।
কিন্তু আমি, যে আলিঙ্গনে বাঁধে তোমাকে,
একা নই!

 

ওকে আবার দেখার জন্য

কখনো না, আর কখনোই না?
শিহরণ জাগানো তারাভরা ঐ রাতগুলোয়ও না,
অথবা পূরবীর মসৃণ রূপালি আলোতে,
অথবা বিকেলের উৎসর্গকালেও না?

অথবা, ক্ষয়ে যাওয়া এক পথের প্রান্তে,
জড়িয়ে রেখেছে যা ঐ কৃষিজমিগুলো,
অথবা ঝিরঝিরে কাঁপা ঝরনার শরীর ছুঁয়ে
উজ্জ্বল চাঁদের আলোয় ঝলকিত এক রাতেও না?

অথবা সুন্দরী বনের ভেতর
অলঙ্কৃত, জড়ানো সংরক্ষিত পথে
যেখানে রাতপাখিরা ডেকে যায় ওর নাম!
আচ্ছাদিত ঐ উদ্যানের তন্দ্রালস রাতের দ্বারা
অতিক্রান্ত আমি? যা ফিরিয়ে দেয়
শুধুই আমার চিৎকারের প্রতিধ্বনি?

ওহো, তা নয় কখনো। আবার দেখার জন্য ওকে–
কোনো বিষয়ই না কোথায়, অথবা কখন–
স্বর্গের নিস্তরঙ্গ জলে
অথবা নরকের টগবগে ঘূর্ণাবর্তে,
অথবা নির্মেঘ চাঁদের নিচে
অথবা রক্তপাতহীন শঙ্কার ভেতর!

কার সঙ্গে দেখা…
প্রতি বসন্ত ঋতুতে ও শীতে,
সুতোয় বাঁধা তীব্র এক মনোবেদনা
রয়েছে পেঁচিয়ে ওর রক্তাক্ত গলা।

 

গোধুলি

অনুভব করি গলে যাওয়া হৃদয় আমার
জ্বলতে থাকা এক মোমবাতির কোমলতায়:
ধমনীগুলোর ভেতর ধীরে বয়ে যায়, সুরা নয়,
তরল কালো সোনা।
অনুভব করি উড়ে যাওয়া এক জীবন
শান্ত ও অমায়িক, এক গজলা হরিণের মতো।

 

পাইন বন

চল এখন বনে যাই।
তোমার পাশ দিয়ে হেঁটে যায় গাছেরা,
ওদের থামাই, নিবেদন করি তোমাকে ওদের কাছে,
বেঁকে নিচু হতে পারে না ওরা তোমাকে পাওয়ার জন্য।
রাত দেখে তার সব সৃষ্টি
কেবল পাইন গাছগুলো ছাড়া, কখনো বদলায় না ওরা।
বয়ে যায় আহত ঝরনাগুলো, ওরা প্রাচীন, এবং
ঈশ্বরের বরপ্রাপ্ত ঐ সনাতনী বিকেলগুলো।
গাছগুলো তুলে নিতো তোমাকে, যদি পারতো,
বয়ে নিয়ে যেতো উপত্যকা থেকে উপত্যকায়,
ঘুরে বেড়াতে তুমি ওদের বাহু হতে বাহুতে,
এবং একটা শিশু দৌড়োয় অবশেষে:
পিতা হতে পিতায়।

 

গোলাপ

গোলাপের অন্তরে রয়েছে যে রত্নরাজি
তা হল তোমার আপন হৃদয়ের অলঙ্কার
ছড়িয়ে দাও ওটা, যেমন করে গোলাপেরা:
উজ্জ্বলতা পাবে তোমার ব্যথা, হয়ে উঠবে ঐ রত্নরাশি।

ছড়িয়ে দাও ওটা গানে,
অথবা মহৎ ভালোবাসার প্রত্যাশায়।
গোলাপকে বাঁধা দিও না
যেন না তুমি দগ্ধ হও ওটার আগুনে।

 

উজ্জ্বল নিমন্ত্রাতা

বৃথাই চেষ্টা করে চলেছো তুমি
থামিয়ে দিতে আমার গান:
এই সূর্যের নিচে
এক কোটি শিশু
গায় এটা, সমস্বরে!

বৃথাই চেষ্টা করে চলেছো তুমি
ভেঙ্গে দিতে কবিতার ছন্দ আমার,
বিদগ্ধ যন্ত্রণায়:
ঈশ্বরের ছায়াতলে
অলৌকিক শিশুদের খাবার এটা!

 

বার্ষিকী

এবং যেতে থাকো, ক্রমাগত
ঘুমিয়ে না, জেগেও না,
শুধু দেখা পাওয়ার জন্য, কোনো অজানায়,
যেখানে এখনো আছি আমরা।
নীরবতা হচ্ছে এক প্রকৃতাবস্থা,
শরীরী ঐ বাসনাটা নেই এখন।
এখনো শোনা হয়নি ঐ আহ্বান
এমনকি দেখাও হয়নি ওকে।
এটা হতে পারে, সম্ভবত
ঐ উপঢৌকনটা, প্রিয় আমার!
সনাতন ঐ মুখভঙ্গি
এবং স্বর্গের ঐ রাজ্যটা গড়ে ওঠা ছাড়া!

 

দুঃখিনী মা

ঘুমোও, ঘুমোও, প্রিয় আমার
কোনো বেদনা ছাড়া, ভয়হীন।
যদিও কখনো ঘুমায় না
আমার আত্মা, নেয় না কোনো বিশ্রাম।

ঘুমোও, ঘুমোও, রাতের গভীরে
তোমার নিঃশ্বাস যেন হয় কোমলতর,
ঘাসের কোমলতার চেয়েও, অথবা
মসৃণ, ভেড়ার পশমের চেয়েও।

আমার শরীর মিশে যাক নিদ্রাঘন শরীরে তোমার
আমার ভাবনা, আমার কম্পমানতা আবদ্ধ হোক,
বন্ধ হোক আমার চোখদুটো
আর ঘুমোক আমার হৃদয়, তোমাতে।

 

আগন্তুক

নির্মম সমুদ্রের মতো কথা বলে সে
নিজস্ব ভঙ্গীতে, অজানা শৈবাল ও অচেনা বালু মিশিয়ে;
সে প্রার্থনা করে এক বায়বীয়, নিরাকার ঈশ্বরের কাছে,
যেন সে গেছে বুড়িয়ে, যেন সে মরে যাচ্ছে এখুনি।
কত বিস্ময় এখন আমাদের বাগানে!
রোপন করেছে সে ক্যাকটাস, ও
অন্য গ্রহ থেকে আনা অলৌকিক ঘাস।
মরু-বাতাস হালকা হয়ে উঠে ওর নিঃশ্বাসে
সবকিছু ভালোবাসে সে এক হিংস্রতা নিয়ে, সাদা এক অনুরাগে
কখনো বলে না সে, যদি বলতেই হতো ওকে:
ওটা হতে পারতো অজানা সব নক্ষত্রদের নিয়ে।
আমাদের ভেতর সে বেঁচে থাকতে পারে আশি বছর,
তবুও যেন  সে এক নবাগত, চিরকালের,
রোদনময়, এমন এক স্বরে কথা বলে সে
বুঝতে পারে যা কেবল ক্ষুদ্র কোনো প্রাণী, বা গোষ্ঠি।
এবং সে মারা যাবে এখানে, আমাদের মাঝে
কোনো এক রাতে, প্রচণ্ড ভোগান্তির ভেতর,
একটা মাত্র কোলবালিশের ভাগ্য নিয়ে,
এবং পেছনে রেখে মৃত্যু, নীরবতা, ও উৎকণ্ঠা।

 

আমাকে দাও তোমার করতল

আমাকে দাও তোমার করতল ও ভালোবাসা তোমার
আমাকে দাও তোমার করতলএবং নাচো আমার সঙ্গে।
একটা মাত্র ফুল এবং আর কিছুই না,
একটাই মাত্র ফুল হবো আমরা।

এক সঙ্গে নেচে কাটাবো সময় আমাদের,
তুমি গাইবে গান আমার সঙ্গে।
বাতাসের ভেতর ঘাসের আলিম্পন এবং আর কিছুই না,
বাতাসের ভেতর ঘাসের আলিম্পন শুধু হবো আমরা।

আমাকে ডাকা হবে আশা আর তোমাকে গোলাপ:
পুরোনো নাম হারিয়ে দুজনেই মুক্ত হয়ে যাবো আমরা
পাহাড়ের উপর একটা নাচ এবং আর কিছুই না,
পাহাড়ের উপর একটা নাচই কেবল হবো আমরা।

 

ধর্মবিশ্বাস

বিশ্বাস করি আমি, এক আহত হৃদয়
ডোবে যখন ঈশ্বরের প্রশান্তির গভীরে
জীবিত উঠে আসে ওটা তখন এক খাদ হতে
যেন এক নতুন জীবন পেয়েছে সে।

বিশ্বাস করি আমি, যা বাজে আমার বুকের ভেতর
ক্ষয়ে যাওয়া রক্ত-লাল চিৎকারে রাঙিয়ে দিতে
জীবনের ঐ ছবিগুলো, যেভাবে কর্কশ ডেকে
উঠে ওটা আলোকোজ্জ্বল লেবাসে।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top