পাট্টাশ

মাহবুব আলী

রাত দুটোয় সুঁই খুঁজে পাওয়া বেশ মুস্কিল। খাতা সেলাই করা সুঁই। এখন আমার খাতা লাগে না। কোনোকিছু লিখি না। সুঁই দরকার অন্য কাজে। এ মুহূর্তে ভীষণ দরকার। কেননা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কোনোকিছু তুলে ফেলবার মতো এরচেয়ে ভালো অস্ত্রের খবর জানা নেই। মাথায় আসছে না।

মিলা ঘুমিয়ে আছে। আমার ঘুম হয় না। দিন শেষে শরীরের যতটুকু ক্লান্তি, সেই সময় মাত্র নিঃসাড় পড়ে থাকি। মিলা ঘুমোয়। তাকে ডেকে তোলা যায় না। সারা দিন এটা ওটা নানান কাজে নিজেকে ছড়িয়ে রাখে। মেয়েদের অনেক কাজ, বাসন মাজামাজি, রান্না, সকলকে খাওয়ানো, কাপড় ধোয়া, ঘর মোছা, বিছানা ঠিক করা কত কী! সে কাজের কোনো হিসাব নেই, থাকে না। সে রাতে মোষের মতো ঘুমোয়। আমি তাকে ডাকি না। সকালে অন্তত পঁচিশবার অভিযোগ করবে। ‘মাঝরাতে ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছ…এখন মাথা ব্যথা করছে। ইত্যাদি ইত্যাদি।’

তারপর হাই তুলবে। মেয়েরা যে ঘুম কাতুরে কে না জানে! এসব ভালো লাগে না। এখন আমার একটি মজবুত সুঁই দরকার। আমার চারপাশে শুধু অভিযোগ। অসহ্য! নিজের কাছেও আমার শত নালিশ। তাই এই নির্জন নিস্তব্ধতায় সুঁই দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সকল অভিযোগ রক্তাক্ত করা যায়। মুখ আর গালের যন্ত্রণা কমে। এ ছাড়া আমার কোনো পথ নেই। কেননা ফেস ইজ দ্য ইনডেক্স অব মাইন্ড। আমার চেহারায় এক নিরত্যয় বিমর্ষতা। এক বিষণ্ন মুখ। চেহারায় শত শত অভিযোগ আর হতাশার বিবর্ণ তৈলচিত্র মাত্র। মানুষ বিষণ্ন মুখায়বব পছন্দ করে না। আমি তেমন একজন কেউ পছন্দ করে না। যেখানে দাঁড়াই গাছের পাতা শুকিয়ে যায়। ছায়া ছায়া চমৎকার দিন কালো মেঘে মেঘে আচ্ছন্ন হয়। আমি তাই ঘরের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে থাকি। আমার কোনো দিন বা রাত নেই। শুধু অন্ধকার। একসময়ে আলোয় ছিলাম। আলোকিত করার চেষ্টা ছিল। এখন শুধু যন্ত্রণা। এ কষ্টের শেষ হওয়া দরকার। একটি সুঁই দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। কলজের কষ্ট এড়িয়ে কষ্ট গেঁথে গেঁথে বুকের রক্ত ঝরালে মাথা হাল্কা হবে। চেহারা গাল মুখের যন্ত্রণা কমে যাবে। আমি নিশ্চিত। এ ছাড়া আপাতত কোনো পথ নেই।

দিন কয়েক আগে সেই লোকের কাছে গেলাম। তার এসিস্ট্যান্ট একটি স্পাইরেল নোটবুকে নাম লিখছিল। নামের তালিকা। সিরিয়াল নম্বর। আমার সিরিয়াল হলো সাতাশ। বেশ অদ্ভুত সংখ্যা। সাতাশ, সাতাশের যুবক, এখন সাতাশ দ্বিগুণে চুয়ান্ন; চুয়ান্নের বৃদ্ধ। নিজেকে বৃদ্ধ ভাবতে সকলের কষ্ট লাগে। কেননা যুবাকালের সোনালি দিন আর মধুময় স্মৃতি মনের গভীরের বড়শি বা আঁকশিতে লটকে থাকে। ছাড়তে চায় না। ইচ্ছে করে না। তবু দিনে দিনে ধীরে ধীরে বয়স বাড়ে, কেউ বলে কমে; যেহেতু অন্ত্যেষ্টেক্রিয়ার দিন ঘনিয়ে আসে। মানুষের জীবন ওয়ানটাইম বলপয়েন্ট কলম। এক কিলোমিটার, আসলে তেমন দূরত্বের সত্যি কি না প্রমাণিত নয়, যেটুকু পথ পেরোন যাক; শেষ তো আয়ুর সমাপ্তি। এত দীর্ঘ পথ পেরিয়ে শেষে তীরে এসে মনে হয়, এই তো সেদিন কি সুন্দর দিনগুলো চলে গেল! আহা এত দ্রুত ফুরিয়ে গেল সবকিছু! জীবন কত ছোট! লোকটিকে বলি, –

‘নাম তালিকায় একটু সামনে এগিয়ে নেয়া যায় না?’

সে এমনভাবে তাকাল যে, ব্যাটা দুদকের চেয়ারম্যান; সে একাই যুধিষ্ঠির! তার বিস্ময় আবর্তিত জিজ্ঞাসা, –

‘আপনার সিরিয়াল?’
‘সাতাশ।’
‘সাতাশ, মাহবুব আলী; এতগুলো লোককে টপকিয়ে আপনাকে নেব?’
‘একটু দেখেন না, কিছু করা যায় কি না। সময় কম আর যন্ত্রণাও হচ্ছে।’
‘এদের বলেন, তারা যদি বলে।’

এরপর আর কোনো কথা থাকতে পারে না। সকলের তাড়া আছে। স্বার্থ আছে। যেমনভাবে খুব অনায়াসে যন্ত্রণার ওজর দিয়ে গেলাম। যন্ত্রণা ছিল এখনো আছে। তেমন যন্ত্রণা থাকলে কোনোকিছু করার নেই। দুটো প্যারাসিটামল সে যন্ত্রণার কিছু দমিয়ে রেখেছে মাত্র। এ যন্ত্রণা খুব সহজে যায় না। তখন গোধূলির আকাশে এক বিশাল সূর্য, ডিমের কুসুম হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ঝিলমিল করছে। হাসপাতাল রোডে প্রচুর ধুলো, রিকশা আর নানান রেস মানুষের ভিড়। জোড়া ব্রিজের পার্শ্বে ক্লিনিকের ফার্স্ট ফ্লোরে দাঁড়িয়ে বেশ দেখা যায়। অনুভব করা সহজ। আমার সিরিয়াল সাতাশ। আমার সেলফোনের শেষ দুই ডিজিট তেরো, আনলাকি থার্টিন। সবকিছুতে আনলাকি। ব্যাংকে গেলাম, হিসাব নম্বরের শেষ ডিজিট হলো সাত। সাত নাকি লাকি নম্বর। সেই লাকে দেখা গেল, হিসাব নম্বরে কোনো টাকা বাড়ে না; শুধু চার্জ দিতে হয়। এভাবে একদিন আরব্য উপন্যাস শেষ। শাহারজাদির গল্পের যবনিকা। উপসংহার যা সে শুধু এক ভীষণ ভারী দৈত্য জীবনের কাঁধে খুব শক্ত করে গেঁথে বসে গেছে। সে একাউন্ট একদিন বন্ধ হয়ে গেল, তা যাক; এসব নিয়ে আর তেমন ভাবনা নেই।

লোকটির নাম মোকসেদ। কেউ ঠিক এমন অথবা তেমন নামে ডেকে উঠেছিল। এখন তেমন ডাকে সে সাড়া দেয়। অতএব মোকসেদ। অপেক্ষার ঘরে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছে কয়েকজন। একজন তরুণী উপস্থিত সকলের কমবেশি মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে। সে বোঝে কি বোঝে না নাকি কোনোকিছু জানে না, জেনেও না জানার ভাণ করে আছে কে জানে! এ পোড়া দুচোখ তার দিকে ঘুরে এলো বার কয়েক। তার পরনে লাল জমিনের উপর হলুদ কালো সবুজ বেগুনি রঙের ফুল আর ফার্ণের প্রিন্ট, সে লতাপাতা ফুল আর কী কী তেমন ঠিক বোঝা যায় না; তবে আশ্চর্যরকম এক আকর্ষণ আছে। অল্প হাল্কা চুল আর পেছনে পরচুলা দিয়ে তৈরি এক খোঁপা, সেখানে একটি জবা ফুল। আমার দৃষ্টি মেয়েটির চোখ মুখ ঠোঁট আর ডানদিকের স্ফীত গণ্ড ঘুরে এসে বারবার জবার লালে থমকে দাঁড়ায়। না এ ফুলের সঙ্গে কোনো পিরিত নেই। সত্যি বলতে অনেকদিন পর জবা ফুল দেখছি। যুগপৎ দুটো ভাবনার ঢেউ বয়ে যায় মস্তিষ্কের তন্ত্রীতে। সেগুলো ঘুরপাক খায়, একটি গ্রহের দুটি কক্ষপথে যেমন দুটি উপগ্রহ পরিক্রমণ করে; করতে থাকে। কখনো মনে হয়, জুয়ার আসরে চক্রের মতো কোনো মায়াজাল, হুইল অব ফরচুন। আমার কোনো ফরচুন নেই।

কোনো কোনো দিন একজন জবাকে দেখি বাসের ভেতর। প্রাইমারি স্কুলের টিচার। জোড়া ব্রিজ থেকে বগুড়া মেইলের ভেতর কখনো দাঁড়িয়ে কখনো ভাগ্য প্রসন্ন থাকলে বসে বসে হেলেদুলে আমবাড়ি গিয়ে নামে। তারপর হাঁটা পথ। একদিন কথা হয়, সে নাকি সতীশ বাবুর ভাগিনি। চারটি থার্ড ডিভিশন নিয়ে একেবারে আঠারো বছরের অভিজ্ঞ প্রভাষক সতীশ বাবু, অর্থশালী ভূস্বামী লোক; তারপরও মাইনরিটি কোটা। এ দেশে টাকায় কি না হয়! বাদরের গলায় মুক্তোর মালা ওঠে, দস্যু আর ক্যাডারেরা আইন তৈরির ঘরে বসে মাঝে মধ্যে তাশ পেটায়। এ সমাজে সবকিছু সম্ভব। এসব না জানলেই ভালো…বলতে গেলে শত বিছুটির দংশন। রিমান্ড আর টর্চার। আমার সাধের গণতন্ত্র!

জবার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে বেশ সুন্দর করে হাসে। মেয়েদের হাসিতে কি জাদু মাখা কে জানে, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি তার রহস্য খুঁজে গেছেন। আমার দৃষ্টি কোন্ ছার! অবাক হয়ে থাকি আর চুয়ান্ন বছরের ফেলে আসা দিনগুলো নিয়ে এক দুঃখের স্রোত বুকের শিরা উপশিরায় লাভার ঢেউ হয়ে বয়ে যায়। হায় জীবন! আজ হাসতে ভুলে গেছি, এখন এক অনন্ত পিপাসায় ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া খুলে কমেডি সার্কাস দেখতে হয়। এডাল্ট কথনের টুকরোতে হাসির গমকে গমকে কিম্ভুতকিমাকার কম্পন বাতাসে ঢেউ তুলে তুলে ঘরের দেয়াল থেকে আছড়ে বাইরে ছড়িয়ে পড়ে অবশেষে।

আমার দুচোখ ঘুরে ফিরে জবায় এসে হোঁচট খেতে থাকে। অনেকদিন জবা ফুল দেখি নি। বহু বছর তাকে। আর এ জনমে দেখা হবে এমন ভরসা বা বিশ্বাস নেই। দেখা হলে কী হবে, এমন উৎকট ভাবনায় শিহরণের কোনোকিছু নেই জেনেও ভাবতে বসি। জবা থেকে জোর করে দৃষ্টি সরিয়ে আকাশে চোখ রাখি। সন্ধ্যে নামছে। চারপাশে হাত পা ছড়িয়ে এক অন্ধকারের প্রস্তুতি। সিরিয়াল পাঁচ ভেতরে গেছে। একেকজন প্রায় কুড়ি থেকে ত্রিশ মিনিট। কেউ কেউ তারও বেশি। সিরিয়ালের কয়েকজন নেই। মোকসেদ ঘন ঘন বাইরে তাকায়। উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে তার কোনো রঙিন হাউজি খেলা চলে, কখনো নির্বিকার অথবা কৌতূহলি বোলচাল। এরমধ্যে সাতাশ আসতে অনেক দেরি। সেই দেরিতে অনুপস্থিত লোকজন ‘ইয়েস স্যার’ হয়ে যাবে নিশ্চিত। আমি আবার জবায় চোখ রেখে ফেলি। আমি আর জবা ফুল। জবা ফুল একুশ-বাইশ, আমি সাতাশ; চুয়ান্নকে গোলি মারো! আমি তাকে ভাবতে বসি। মহুয়াকে মনে পড়ে। ওদের বাসার পশ্চিম দেয়াল ঘেষে জবার এক গাছ ছিল। গন্ধহীন ফুল দেখতে দেখতে কত দিন অপরাহ্ণে তার সঙ্গে দৃষ্টির যোগ হয়েছে। কোনো কথা না বলেও দুজন কত কাছের আর দুজনের হয়ে গেছি। সে এক স্মৃতি, শত শত দৃষ্টির সংযোগ হলো; যোগফল হয় নি। সে এখন কোথায়?

আমি ড্রয়ার খুলে খুঁজতে বসি। সেখানে প্লাস্টিকের তিন চারটি কৌটা, সবগুলোই কোনো না কোনো কসমেটিক্সের; এর কোনো একটিতে সুঁই থাকতে পারে। কোথায় কোনটিতে? আমার ড্রয়ারে একটি এ্যন্টিকাটার রয়েছে। সুতীক্ষ্ণ ভয়ংকর! সেটি দিয়ে কাজ হবে না। নির্দিষ্ট কাজের জন্য বিশেষ টুল বা অস্ত্রের দরকার পড়ে। এটি লঘু অপরাধে গুরু দণ্ড। এর জন্য সুঁই সবচেয়ে উপযুক্ত। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করা যায় খুব সহজে। উপড়ে তুলে ফেলা যায় বা যেতে পারে যন্ত্রণার শিকড়।

মিলার দিকে তাকাই। তার নাকে আর ঠোঁটের উপরে মৃদু স্বেদবিন্দু। শুনেছি, এমন মেয়েরা নাকি স্বামি সোহাগি হয়, ছেলেরা বউ পিয়ারি। সে-সময় তারও এমন চেহারা ছিল। মহুয়া একদিন বলে, –

‘তোমার ভাগ্য ভালো…বউ পিয়ারি।’
‘সেতো এখন থেকেই দেখছি প্রিয়, আমিও তোমায় খুব ভালবাসি।’
‘কেমন?’
‘খুব মানে প্রচণ্ড!’

মহুয়ার সঙ্গে শেষ অবধি কিছু হলো না। জানা গেল না, স্বামি পিয়ারি আর বউ পিয়ারির খাবনামা। এর সকল দায় আমার। কোনো কোনো রাতে ঘুম ভেঙে গেলে জানালা গলিয়ে দূর আকাশে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিই। রাতের আকাশ। তার পরতে পরতে এক অদ্ভুত সৌম্য শান্ত গভীরতা; এক অনাস্বাদিত রহস্যময়। তার পটভূমিকায় নক্ষত্রেরা হাতে হাত রেখে সখ্যতার ছায়াপথ তৈরি করেছে। আমার মনে আকস্মিক তার ছবি ভেসে ওঠে। সে ছবির কোনো বয়স বাড়ে না। সে মুখ রাতের আলোছায়া দেয়ালে ভেসে ভেসে চলচ্চিত্র হয়। এক অসম্ভব ফর্শা কিশোরী, তার প্রজাপতি বেণিতে লাল ফিতের দুটো ফুল। কলাপাতা সবুজ কামিজ আর অফহোয়াইট পাজামা। নাকের ডগায় সদ্য ছিদ্র করা একটি বিবর্ণ সুতোর রিং। আমার কৈশোর এক স্বপ্ন দোলা, মিথ্যে স্বপ্ন আর কল্পনার এক অসমাপ্ত গল্প। সে কাহিনী একান্ত আপনার, কারও প্রবেশ অধিকার নেই। মিলার দিকে তাকাই। আমার মহুয়া ঘুমিয়ে আছে। তার কপালে চুলে স্পর্শ করি। খুব ইচ্ছে করে একবার মহুয়া বলে ডাকি। একবার দুবার বারবার। না পারি না পারা যায় না। একজনকে দিয়ে আর একজনের শূন্যতা পূরণ হয় না। একজনকে সামনে রেখে অন্যজনের ভাবনা এক অদম্য বিকৃতি। আমি তা চাই না, করতে পারি না। মিলাকে জড়িয়ে ধরি। সে ঘুমের ঘোরে অথবা কোনো স্বপ্নের বালুকাবেলায় হেঁটে হেঁটে কাব্যবিভোর আমাকে তার বুকের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলে। জীবনের এইটুকু প্রাপ্তি স্বর্গের চেয়ে বেশি।

আনলাকি থার্টিন ছিল না। সে এলো। সে নয়, তিনি একজন মোটাসোটা মাঝবয়সী মহিলা। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কোনো চ্যানেলে শাড়ি গয়নায় সেজেগুজে আসা রেসিপির অনুষ্ঠানে দেখা কোনো রাধুনির মতো। তিনি এখন চকোলেট কেক তৈরি করা দেখাবেন। এ দেশের অনেক লোক দুবেলা ঠিকমতো ভাত জোগাড় করতে পারে না, তারা আধ পেটা কি না খেয়ে স্বপ্ন দেখে, দেখিস একদিন আমরাও…। তারা কেক খাবে। আমি চকোলেট কেকের বাহার দেখে ঘন ঘন ঢোক গিলে ফেলি। থার্টিন মনে হয়, কোনো পার্লার থেকে এসেছেন। দুচোখের পাতায় সবুজ রুপালি আভা আর ঘরের ভেতরে এক পারিজাত সৌরভ। তার কাছে জবা ফুল অতি ক্ষুদ্র এক জোনাক পোকা। যুগপৎ দুদিকে দৃষ্টি ফেলে আমি চেয়ারের দিকে তাকাই। প্লাস্টিকের চেয়ার ভেঙে যাবে নাতো? না তেমন কিছু হয় না। তিনি বেশ আয়েশে বসে গেলেন। সঙ্গে একটি মেয়ে এসেছে, আট দশ বছরের; এক হাতে প্যাকেট ধরে চিপস খাচ্ছে। বোম্বে সুইটস। অপেক্ষার ঘরটিতে শুধু তখন পাট্টাশ পাট্টাশ শব্দে ভরে যেতে থাকে।

তখন আবুল হাসিম আর ইদ্রিশালির কথা মনে পড়ে যায়। তাদের চেহারা আর কথকথা ভেসে ওঠে। ইদ্রিশালি অফিসে প্রতিদিন সকাল এগারোটায় আসে। অফিস মুখে বেশ জোরে আওয়াজ দেয় ‘পাট্টাশ’। ফিরে যাওয়ার সময় তখন বেলা আড়াই কিংবা তিন আর একবার ‘পাট্টাশ’। এক আবছা অন্ধকার ঘরের কোণায়, ল্যাট্রিন যাওয়া আসার পথে ধ্যানমগ্ন বসে থাকি। দেশ আর মানুষের পক্ষে সরকারের গুষ্টি উদ্ধার করে সম্পাদকীয় ভাবনায় কাতর। শব্দটি পটকার মতো ফেটে ফেটে ভেসে ভেসে সেখানে পৌঁছয়, কাঁপতে থাকে; চেয়ার টেবিল হাঁপায়। মনে মনে কোনো দিন বুকের ভেতর বেজে ওঠে সেই হাঁক। তার কোনো মানে জানি না, বুঝি না এর উচ্চারণে কীইবা মজা। একদিন দুপুরের শেষাশেষি অফিস থেকে ফিরে যেতে যেতে মুখ দিয়ে আকস্মিক দাঁড়কাকের মতো বেরিয়ে আসে ‘পাট্টাশ’। সবকিছু কি থমকে যায়? অফিসরুমের বাতাস, রাস্তার প্রান্ত বা আমি? আবুল হাসিম মৃদু হাসতে থাকে। সে হাসি কত কুটিল আর মতলববাজ কে না জানে! তার চেহারা থেকে সেই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে সবখানে রাস্তার গলি আর হাটবাজার। আসলে ‘পাট্টাশ’ কী?

মোকসেদ কাছে এসে দাঁড়ায়। হাতে ধরা স্পাইরেল নোটবুক সেখানে নাম তালিকার ক্রমানুসার, সেটিকে পাখা করে হাত ধরে ঝাঁকাতে থাকে। কিছুক্ষণ ঝাঁকানাকা নাকাঝাকা। স্বরাস্ট্র মন্ত্রীর ঝাঁকুনি তত্ত্ব। রানা প্লাজা এর কারণেই পড়ে গেছে। মরেছে এক হাজার এক শত বত্রিশ জন নারী পুরুষ। মূল্যহীন মানুষের ক্ষতিপূরণ তবু কয়েক হাজার টাকা!

‘স্যার আপনার কি খুব তাড়া?’
‘উঁ…একটু আগে করে দিতে পারলে খুব ভালো হয় আর কি!’
‘একটু এদিকে আসেন।’

মোকসেদ এখন সিরিয়াল পরিচালক, অবলম্বনহীনের অবলম্বন। প্যাসেজের ভেতরে আলোছায়া অন্ধকার। একটি পঁচিশ বা চল্লিশ ওয়াটের বাল্ব হাঁশ-ফাঁশ করে হাঁপায়। তার ম্লান আলোতে জীবনের শত বেদনা শত যন্ত্রণা।

‘বারো নম্বর আসে নি, আপনি যাবেন?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ খুব ভালো হয়।’
‘চা খাওয়ার একটু আবদার করি স্যার।’
‘আচ্ছা আচ্ছা সে হবে ক্ষণ।’

এখন দিনদুনিয়া এ রকমই। পূর্ণচন্দ্র রায় আর মুসার কাছে গিয়েছি। দুই ব্যাংকের দুই ক্রেডিট অফিসার। সোনালি মানুষ জনতার সেবক বা অগ্রণী সৈনিক। অনেক বড় আর দায়িত্বশীল পদ। নিঃস্বার্থ স্বার্থহীন। কথা বলতেই সাফ জানিয়ে দিল, –

‘বাজেট নাই, দু সপ্তাহ পরে একবার খোঁজ করবেন; আরে ভাই যাদের দিয়েছি তারা বড় যন্ত্রণা করছে। পালিয়ে বেড়ায়। কালেকশন নাই। কোত্থেকে দেব বলেন!’
‘আমার দ্বারা এমন সমস্যা হবে না।’
‘নেয়ার সময় সকলেই এমন কথা বলে বুঝলেন। মানুষ চরিয়ে খাই, লোক চিনি না বলতে চান!’
‘আমাকেও কি সেই গোত্রে ফেলছেন নাকি দাদা?’
‘সে কথা নয়, বাজেট নাই; আসুক। অনেকে সিরিয়াল ধরে আছে। খরচপাতিও করতে চায় ষোলো আনা।’
‘খরচপাতি মানে?’
‘আরে ভাই আপনি তো নিয়মকানুন জানেন না দেখছি। এখন মাল ফেলবেন কাজ পাবেন। দেখেন না বিদ্যুতের সমস্যা হলে লোক আসে, ঠিক করে দেয়; তারপর চা খাওয়ার টাকা চায়।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ তাইতো! সে করা যাবে, করতে হবে। নিয়মকানুন আছে না!’
‘টাকা দিয়ে কী করবেন?’
‘এই ধরেন…।’
‘গৃহ সংস্কার। আর আমার দশ পার্সেন্ট, বুঝেছেন?’
‘একেবারে দশ পার্সেন্ট দাদা! একটু কমে…?’
‘দশই দিতে হবে। ডিড স্ট্যাম্প রেভিনিউ এসব আলাদা। বলেন তো এক সপ্তাহের মধ্যেই টাকা…হে হে হে!’

লোকটির হাসি বাতাসে ছড়াতে ছড়াতে দৃষ্টি ঘোলাটে হতে থাকে। তার ভেতর দিয়ে দেখা যায়, কোনো মানুষ নয় একটি শূকর চেয়ারে বসে পা দোলায় আর তার পান খাওয়া ঠোঁটের কশ বেয়ে রক্তের মতো লালা ছিটকে পড়ছে টেবিলময়। নাকি সারা দেশময়! কী আশ্চর্য স্বাধীনতা আর দেশ।

‘হাতে তো এই মুহূর্তে টাকা নেই ভাই।’
‘টাকা তুলে দেবেন। একাউন্ট আছে তো?’
‘হ্যাঁ তা আছে।’

সবখানে পাট্টাশ। আবুল হাসিম সেদিন শব্দটির মানে বলে, ‘বাইরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট’। এর মানেও তেমন বুঝি না। শেষে রাগ করে উপসংহার টানে।

‘আপনাকে দিয়ে হবে না, আস্ত এক বুরবাক।’
‘সেটা আবার কী?’
‘হা হা হা! সত্যি হাসালেন মাইরি!’

অবশেষে যা জানা গেল তা খুব নোংরা। মানুষের মুখ এত নোংরা! তারা নোংরা খায়, তাদের মুখে দুর্গন্ধ। দাঁত আর মাঢ়িতে ক্যাভিটি আর পালপাইটিস। তাদের শরীরে পরজীবি আর পচন। মৃত মানুষের দুর্গন্ধ। তাদের বিশ্বাস আর সততা মরে গেছে। আর এর জন্য সংক্রামক কিছু একটা তো আছে, উপায়হীনতার কাছে অসহায় সমর্পণ। মনে মনে কতবার থুতু ছিটিয়ে তাদের কাছেই পুনরায় যেতে হয়। একদল শূকর হামলে পড়ে সবকিছু চেটেপুটে খেয়ে চলে। তাদের কোনো যন্ত্রণা নেই, শুধু দুর্গন্ধ। ছড়িয়ে পড়ে তা চার দেয়ালের ভেতর থেকে বাইরে আকাশের দেয়ালে দেয়ালে। বাতাসের পরতে পরতে আর মাটির কোণায় অনু পরমাণুতে। কষ্টভোগা মানুষের রক্তের ভেতরে জেগে থাকে এক অসহায় বিবমিষা আর সেটি ছড়িয়ে পড়ে শুধু তার মনের গভীরে। খুব গভীরে একেবারে কলজের তলায়। উপায় কোথায়?

এই তো তিন দশক আগের কথা। ঘরের পশ্চিম দেয়াল সীমানা ঘেষে সাড়ে তিন ফুটের প্রশস্ত গলি। সে গলির শুরু উত্তর থেকে, চলে গেছে দক্ষিণে; তারপর বাঁক হয়ে একেবারে পুবে। তারামনি খুব সকালে গলিতে ঢোকে। তিন কোণায় তিন বাড়ির তিনটি সার্ভিস ল্যাট্রিন। সে-সবের কোনোটিতে জাহাজ মার্কা সরিষা তেলের লম্বা টিন আর কোনোটির নিচে মাটির তৈরি বড় বড় চাড়ি। বাড়ির লোকজন সেগুলো ব্যবহার করে। তারামনির হাতে এক বড় বালতি, সেটির গা ঘেষে কত বর্ণালী রংধনু। হলুদ খয়েরি লাল কালো মিলেমিশে একাকার ভূভাগের মানচিত্র। আমাদের খুব দ্রুত জানালা বন্ধ করতে হয়। তারামনি অন্য বালতি রেখে গেছে উত্তরের সীমানা প্রাচীরের কাছে। সেখানে ভনভন করে শত কিসিমের মাছি উড়ে, উড়তে থাকে; বসতে থাকে রংধনুর চারপাশে। তারামনি গলিতে খালি বালতি নিয়ে যায়, ফিরে আসে ভরপুর পরিপূর্ণ; টিন আর চাড়িতে যতটুকু জমা, সবটুকু ঢেলে নিয়ে বের হয়ে আসে। তারপর আবার গলির বাতাসে ধীরে ধীরে চম্পা বেলির মৌতাত ছড়াতে ছড়াতে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ায়। সেখানে একটি মহিষের গাড়ি একাডেমি স্কুলের গলিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। সে নির্বোধ প্রাণির চোখদুটো ভারি অসহায় আর করুণ মনে হয়। কোনোদিন আখের ছোবড়া চিবোয়, কোনোদিন নির্নিমেষ এক অসহায় চাহনি, বলো কী অপরাধ হে মানব সকল! তাকে দেখে খুব কষ্ট বাজে এ বুকে। মনে হয়, ঈশ্বরের মতো অসম্ভব ধৈর্যের এক ধ্যানী গম্ভীর চেহারা তার মুখে সেঁটে আছে। কখনো ভুল হয়ে যায় কোনো এক আদিম সময়ের দিনকাল ভেবে। আহা কি জীবন, কি সভ্যতা! দেখতে দেখতে কত আদিম দাহকাল আর পেরোতে হবে! এখন পূর্ণ বাবু আর মুসা ভাইয়েরা দু হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে বাজারে যায়। ঘরে ফিরে আসে নানান বাজার নিয়ে। সেই ব্যাগ কখনো তারামনির বালতি হয়ে যায়। ঘরের গৃহিনীরা উপর করে ঢেলে দেখে ব্যাগ ভর্তি পুরীষ। তাদের পকেট ভর্তি টাকা ব্যাগ ভর্তি গু। তারা খালি হাতে অফিসে যায়, ফিরে আসে পকেট ভর্তি করে।

মোকসেদকে গু খাওয়ার টাকা দিতে হলো। খুব যন্ত্রণা, মুখ দিয়ে থুতুর সঙ্গে রক্ত বেরোয়। কত মানুষের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন দেশ। এখন কার দোষ? কর্মদোষে দোষী মানুষ খোদারে দোষী বানাও, চিন্তা করে দেখ মানুষ কেন এমন হয়! এ দায় নিজের। পৃথিবীর সবখানে ফাঁদ পাতা। সর্বত্র এক সুঁচালো ফাঁদ মুখিয়ে আছে। উদোম ম্যানহোল। ‘এ্যয় ভাই জারা দেখকে চলো, আগে পিছে আর বায়ে ভি…।’ সে আপনার চোখ, এক অথবা দুই আর তৃতীয় নয়ন। তারপরও দৃষ্টিতে ভ্রম হয়ে যায়। মানুষ বড় বিচিত্র আর ক্যামলিয়নের মতো রূপ বদলায়।

লোকটি টাকা নিল। যন্ত্রণা শুধু নিজের। সেই ছোটবেলা থেকে দেখছি তাকে। ফায়ার ব্রিগ্রেডের সামনে পুব রাস্তায় চার পাঁচটি দোকানঘর। তার একটিতে কাজ শিখছেন কাজ করছেন খবিরুদ্দিন। সেলুনে ছোট ছেলেদের চুল কাটার জন্য যেমন উঁচু চেয়ার, তার সামনে সেখানে এক লোক বসে আছে। খবিরুদ্দিন কখনো হ্যান্ডপিস হাতে নেন, কখনো ট্রুইজারের আগায় গোলাপি তুলো; লোকটি রাবণের মতো মুখ হা করে আছে। খবিরুদ্দিনের আঙুল খুব সহজে সেখানে গতায়াত করে। তারপর আর কী কী ম্যাজিক হয়, আমার পায়ের জুতো হাতে ঝুলিয়ে নিয়েছি; উৎসুক দৃষ্টি। জুতোর ভেতরে মোজা, সে দুটোর সাদা রং ঘোলা হয়ে গেছে। পায়ে মোজা পরে সারা রাস্তা হাঁটা যায় না। জুতো জোড়া বড় যন্ত্রণা। দু পায়ের বুড়ো আঙুল কড়ে আঙুল আর পেছনে ফোস্কায় জ্বলছে। হাফ কিলোমিটার দূরের স্কুল, রাস্তায় রিকশা ট্রাক মটরবাইক, হাঁটার পথ বড় সংকীর্ণ। সেভাবেই আসা যাওয়া। সেদিন কেন মাঝে মধ্যে আর পারা যায় না। পায়ের জুতোয় ফোস্কা পড়ে, ফেটে ফুটে দমা দাম মাসকালান্দার।

মনসুর চাচার রেডিও মেকানিকসের দোকানে মাইক বাজে। রাস্তার পশ্চিমে দোকানের সামনে পাঁচ ফুটের বারান্দা, সেখানে নীল রঙের সেই লাউডস্পিকার থর থর কাঁপে। বিয়ে বাড়ির জন্য লোকজন এসেছে, মাইক আর কলের গান ভাড়া চাই। ‘হলুদ বাটো মেন্দি বাটো বাটো ফুলের মউ’ থাকতে হবে। এ ছাড়া দমা দাম মাসকালান্দার, আছে তো? সে গান না হলে চলবে না, আছে তো? আছে আছে সব গান আছে। কী কী চাই আর? ও রসিক রাজা, আর চাই কী তোমার বুঝিয়ে বলো না। আরও আছে, তুমি আসবে বলে ভালবাসবে বলে। না না মাসকালান্দার আছে তো? আছে আছে, আব্বাস উদ্দিন থেকে আহমাদ রুশদি সব আছে। গান শোনা পাবলিক, শুধু গান শোনে আর মাথা দোলায়। খবিরুদ্দিন উঁচু চেয়ারে বসে থাকা বৃদ্ধের মুখের সামনে একটি এলুমোনিয়ামের গ্লাস এগিয়ে ধরেন। তারপর চিলমচি। বুড়োর গালে ইধার উধার সমুদ্রের ঢেউ, তারপর পচাৎ করে কুলকুচার পানি ফেলে চিলমচিতে। মুখ ভর্তি পচা পানি, রক্তের সঙ্গে সঙ্গে দুর্গন্ধ। অনেক বছরের ব্যামো, পচে গলে একেবারে সার্ভিস ল্যাট্রিন। সেই দেশ বিভাগের সময় কত হই হল্লা করে আমগাছের আগায় সবুজ সাদা কাপড়ের চাঁদতারা পতাকা উড়িয়েছিল, এখন সেই কাপড়ের মতো ঝলসে গেছে সব। দুর্গন্ধের সঙ্গে রক্ত। রক্তের রং লাল। সব মুসলমান ভাই ভাই। তুমি খাবে চার আনা আমি না হয় দশ আনা দেব। তারপর কেটে গেল আরও কয়েক বছর। পঁচিশে গিয়ে ঠেকল। রক্ত উদ্দাম বাতাস। খবিরুদ্দিনের উঁচু চেয়ারে লোক বসে থাকে। তার পরনে সেমি টেডি প্যান্ট, ওয়াহিদ মুরাদ চুলের বাহার।

একদিন পশ্চিম দেয়ালের পেছন ঘেষে যে গলি, সেখানের জানালা খুলে দিই। তারামনি সকালে এসে কাজ করে গেছে। এখন একটু সুবাতাস আর তাকলা মরু অভিযানের কাহিনী টানছে। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসে গরুর মাংস কষানোর ক্ষিদে লাগা সুগন্ধ। রমজান মাস, আমার কোনো রোজা নেই; দিনের বেলা আহারের যে রুটিন, রাতে শিফট করা গেল না। উপরি হিসেবে বুন্দিয়া জিলেপি পেঁয়াজু আলু চপ বেগুন চপ আর তেলে চপচপ ঘুগনি সবকিছুই প্রতিদিন আযানের পর খাওয়া চলছে। রোজা থাকতে চাই। অনুমতি নেই। বন্ধ শেষে বার্ষিক পরীক্ষা। অতএব তাকলা মরু পথে পানির পিপাসায় আকণ্ঠ কাতর সেদিন কষানো মাংস খেয়ে চলি। জানালা খুলে আম কাঠের পাল্লায় এক পা তুলে ফোল্ডিং চেয়ারে কোনো এক কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যাই, যেতে থাকি অনেক দূর। কোনো অসম্ভব কল্পনায় ফ্লাইং সসারের ছবি এঁকে মঙ্গল গ্রহের অভিযানে উড়ে যাই। তখনই বিপত্তি ঘটে গেল। মাংসের এক চিলতে আঁশ গেঁথে গেল দাঁতের ফাঁকে। তখন খবিরুদ্দিনের কথা মনে পড়ে যায়, তবে ওই পর্যন্ত; আমরা কত সহজে পায়ে কাঁটা নিয়ে ল্যাংচাতে থাকি।

সে প্রায় সতেরো আঠারো বছরের কথা। একটি সুঁই খুঁজে নিয়ে কিংবা ট্রিট ব্লেডের একটি কোণা, খুব সহজেই স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করি। আসলে কিছু হয় না, হয়ে যায় না; মাঝখান থেকে মনের মধ্যে একটি কাঁটা খুব সহজে জায়গা করে নেয়। সে ক্ষত কখনো কখনো যন্ত্রণা হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়, ওলটপালট কেয়ামত; তখন একটি সুঁই খুঁজে রক্তপাত আর অসহ্য যন্ত্রণা। একটি পেইনকিলার। এভাবে কেটে গেল কয়েকটি বছর। নতুন দেশ নতুন জীবন। এরমধ্যে মিলা এসে গেল। নতুন বউ নির্বাক দেখে দেখে একদিন মুখ খোলে। কথায় কথায় মালা গাঁথে। সে মালার প্রতি ফুলে ফুলে আবেগ আর গতিবেগ। অধৈর্যের বহিপ্রকাশ।

‘তুলে ফেলো না কেন?
‘তাহলে খাব কী করে?’
‘আর এতদিন যন্ত্রণা টেনে নিয়ে চলেছ, তারচেয়ে…।’
‘এবার তুলে ফেলব। ঠিক তুলে ফেলব।’

তুলে ফেলতে চাইলেই সবকিছু আপরুটেড করা যায় না। যন্ত্রণা থেকে বের হয়ে আসার মধ্যেও যন্ত্রণা থাকে। এ জিনিস সকলের বুকে আছে। কারও চেহারা ছবিতে কারও ভাবনায়, বুকের একান্তে। কেউ দেখতে পায় কেউ পারে না। কেউ দেখায় কেউ গোপন করে। আমার যন্ত্রণা বুকের ভেতর থাক। এখন একটি সুঁই খুঁজে বের করতে চাই। খাতা সেলাই করার মতো বড় মোটা আর শক্ত মজবুত। তারপর খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত পীড়ন-অবিনাশী দহন। একটি চকচকে মজবুত সুঁই।

বারো নম্বর আসে নি। আমি সাতাশ থেকে বারো। তের নম্বরে মোটাসোটা বিউটিকুইন, লাল রঙের চেয়ারে গ্যাঁট হয়ে বসে আছে। চেয়ারের চারটি পা খুব স্টিফ, ঝুনা বাঁশের মতো শক্ত; তবু বাঁকা হয়ে গেছে। এক পাশে জবাফুল নির্মোহ দৃষ্টিতে দেয়ালে তাকিয়ে, সেখানে মুখ গহ্বরের পেশিতন্ত্র। তার পাশে মানব শরীরের রক্ত সঞ্চালন আর পরিপাক প্রক্রিয়ার খুঁটি নাটি রঙিন তথ্য। বিপরীত দেয়ালে মানুষের বিশাল চোয়াল। তার সামনে ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা আর তার ছেদন দন্ত। কীভাবে যত্ন করবেন। ব্রাশিং পদ্ধতি, উপর থেকে নিচ…নিচ থেকে উপর। কোনোকিছুই বাকি নেই। অবশিষ্ট থাকে না।

খবিরুদ্দিন হ্যান্ডপিস অন করেন। বাতাসে মৃদু ঘরর শব্দ ওঠে। বারের আগায় রাউন্ড স্কেলার। তারপর মনে হয়, মুখ আর মাথার ভেতর এক ভূমিকম্প ঢেউ উঠেছে। মুখের সকল খনিজ পদার্থ বের হয়ে আসছে। এশিয়া এনার্জি। কয়লা চাই না…আগে শহর রক্ষা করো বাবা।

‘শেষ করে ফেলেছেন তো!’
‘তেমন সমস্যা তো নেই। সেই কলেজে পড়ার সময় ব্লেডের এক চিলতে টুকরো আটকে গিয়েছিল, কিছুতেই বেরোল না। এখন চারপাশে কালচে রং ধরেছে।’
‘মরচে পড়েছে। কোন কলেজে পড়তেন? কোন বছরে?’
‘সরকারি। পচাত্তরে বিএ থার্ড ডিভিশন।’
‘অনেক বছর! এখন কি ব্যথা আছে? কোনো যন্ত্রণা? তারপর কী করা হয়?’
‘থার্ড ডিভিশনের কোনো খাওয়া নাই, চাকুরি হয় নি; মেধাহীন জঞ্জাল।’
‘কিছু তো করেন।’
‘চুক্তিভিত্তিক কাজ, যখন যেখানে যা জোটে।’
‘ও!’
মন অসম্ভব বিষিয়ে গেছে। যত্ন করে কত বায়োডাটা লিখেছি। কোনো কাজে আসে নি। অথচ অনেক অঘা-মঘা বড় বড় পদে চাকুরি করছে। তারা মুক্তিযোদ্ধা কোটা মাইনরিটি কোটা মামার টেলিফোন আর টাকায় অনেক কাজের অনেক দক্ষ রিসোর্স। যার কেউ নেই কিছু নেই, অর্থহীন অথর্ব জীবন। তার আবার ব্যথা…তার আবার যন্ত্রণা!

খবিরুদ্দিন পরিত্যক্ত এক আয়নার কাচে এক চিমটি জিংক অক্সাইড রাখেন, তার সঙ্গে ক্লোভ অয়েল ইউজিনাল। রিফাইন্ড মোবিলের মতো হাল্কা সোনালি রং। তারপর এক ভোতা সার্জিকাল নাইফ দিয়ে ঘেটে ঘেটে পেস্ট তৈরি করতে থাকেন। নাইফটি বেশ জম্পেস, বড় হাতলের সামনে ছোট একটি ব্লেড। বাইরের আলোয় চক চক করতে থাকে। তখন কত ছবি ঝিলমিল করে ওঠে।

পশ্চিমে জেলরোডের মসজিদ। তার পুবে রাস্তা। সেটি পেরিয়ে সামনে হরেক রকমের মনিহারি দোকান। সেখানে চাকু কিনতে গেছি। কয়েকদিন ধরে টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে একটি সাধের চাকু। তারপর ফায়ার ব্রিগেডের আম বাগান। ছোট ছোট আম…পকেটে চাকু আর ঝাল লবণের গুড়ো। আমরা তখন কেউ ক্যাপ্টেন মার্ভেল কেউ আলাউদ্দিন, আকাশে উড়ে বেড়াই; ভেসে ভেসে স্বপ্ন দেখি কোহকাফের পর্বত। জ্বিন ডেকে স্বপ্নের প্রাসাদ গড়ি। সে-সব গল্প আতা আর সোনালু গাছের ডালে ডালে দাপাদাপি আর নেচে বেড়ানো এক একটি বাঁদর করে রেখেছিল। তবু দিন ভালো ছিল। আমাদের হাতে কোনো সেলফোন এমপিথ্রি আর মেমরি কার্ড নেই। ছিল না কোনো নিষিদ্ধ দুনিয়া।

খবিরুদ্দিন স্টিলের একটি গ্লাসে পানি এগিয়ে ধরেন। সেদিনের সেলুন মার্কা উঁচু চেয়ার এখন হাউড্রোলিক হয়েছে। পরনের সেমিটেডি প্যান্টের সঙ্গে গায়ে একটি কোট। একাত্তর কত সহজে কত চেহারা বদলে দিয়েছে। যে দুই পয়সার পান বেচতো, তার চারতলা ভবন। মটরসাইকেলের বিশাল দোকান। ভারতেও এক বাড়ি। তার পরনের পোশাক থেকে শরীরের ভেতর থেকে কত বাহারি সুগন্ধ বাতাসে মেশে। আর যারা কোনোকিছু লুট করতে পারল না, কেড়ে নিতে শেখে নি; অনিবার্য পথের ফকির। এক সন্ধ্যা খাওয়া শেষে পরের কথা ভেবে ভেবে আয়ু কমিয়ে ফেলে।

‘কুলি করেন।’

হাইড্রোলিক চেয়ারে আধশোয়া থেকে মাথা উঁচিয়ে কুলকুচা করতে হয়। পায়ের কাছে ফ্যাকাসে সবুজ বালতি। চিলমচির জায়গায় এই পরিবর্তন। বালতি না বড় মগ কে জানে, সেটির কোনো হ্যান্ডেল নেই। গ্লাস মুখে নিতেই থুতুর গন্ধ, বিকারের মতো বিবমিষাময়। এ কথা তো বলা যায় না। আলগোছে এক দলা পানি মুখের ভেতরে নিয়ে ফেলে দিতে হলো। বালতির ভেতরে লাল থেকে ধূসর, অবশেষে বিকট কোনো ঢেউ হয়ে থিতিয়ে পড়ে। দৃষ্টিতে খবিরুদ্দিন। যুবা খবিরুদ্দিন কৃশ টিংটিঙে লম্বা…এখনকার, বয়স্ক শেভহীন গালভর্তি সাদা দাড়ি। চিলমচি আর বালতি। বালতি নাকি মগ? ফ্যাকাসে সবুজ, থুতু মেশানো কুলকুচা; কখনো কপিশ কখনো লাল।

খবিরুদ্দিন আয়নার কাচে ঘষে ঘষে পেস্ট নরম করতে থাকেন। কাচের উপর সার্জিকাল নাইফের পট পট শব্দ ওঠে। শব্দের ঢেউ তারপর আকস্মিক পাট্টাশ। যুবা খবিরুদ্দিন পাকিস্তান…বয়স্ক স্বাধীন বাংলাদেশ। চিলমচি থেকে বালতি। চল্লিশ বছরের পরিবর্তন। কত বদলে গেছে সবকিছু। হোটেলের মেচিয়ার হোটেলের মালিক। সকলে নিজেকে সাজিয়ে নিল। ছোট থেকে বড় হলো। চুরি করা বিদ্যায় পিএইচ. ডি. য়ুনিভার্সিটির প্রফেসর। আমার কিছু হলো না। একাত্তরের ফার্স্ট ডিভিশন? দুরো সেতো চেয়ার-টেবিল পাস! বুকের ভেতর এ যন্ত্রণা কোনো হাইড্রোলিক চেয়ারে বসে সীল করা যায় না। মুখের ছবিতে এনে দাঁড় করাতে হয় এক কৃত্রিম মুখোশ। তারপর কোনো কোনো রাত কি না দিন, যন্ত্রণার শুরু হয়। গাল মুখ ফুলে ওঠে। পেইনকিলার এন্টিবায়োটিক পাকস্থলির কোণায় হজম হতে শুরু করে। তবু ব্যথা তবু যন্ত্রণা। ধীরে ধীরে উৎস থেকে মাথা আর মস্তিষ্কের কোষে কোষে ছড়িয়ে যায়। একদিন মিলা বলে উঠে, –

‘তোমার তো কোনো সমস্যা ছিল না, সীল করাতে গেলে কেন? এখন খামোখা শুধু কষ্ট!’

কোনো কোনো দিন মিশন স্কুলের সামনে দিয়ে একটি ভ্যান হেঁটে যায় উত্তরের দিকে। আঠারো কি কুড়ি বছরের একটি লোক, হাতে হ্যান্ড স্পিকার। ‘অবাক কাণ্ড/কানা ফুটা বন্ধ/টিন দিয়ে পানি পড়ে টিপ টিপ টিপ। রাতে ঘুমাতে পারেন না/মগের ফুটা জগের ফুটা বন্ধ করে/আসল পুডিং লাগান। ভ্যানের কাছে আসুন। প্রতি প্যাকেট দশ টাকা। স্পিকারের বাণী আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয়ে এক আমোঘ কোরাস। সমস্বরের উচ্চ এক স্তবগান। কে কোথায় কোন্ ফুটা বন্ধ করে!

তখন যুগপৎ এক গল্প মনে পড়ে যায়। এক গ্রামের পাশে এক বড় দিঘি। তার জল কাকচক্ষুর মতো গভীর আর হিম শীতল। সামনের এক জঙ্গল পেরিয়ে সেখানে যেতে হয়। সেই জঙ্গলে নানারকম গাছ-গাছালি, ঝোপঝাড় আর ফার্ণের ছড়াছড়ি। কয়েকটি শাল সেগুন মাথা উঁচু করে, দু তিনটি বট আর পাঁকুড় নিজেদের ছড়িয়ে স্থায়ি আসন করে নিয়েছে। সেই জঙ্গলের খুব গভীরে এক অশ্বত্থতলায় এক সাধু দরবেশ ধ্যানমগ্ন থাকেন। সৎ মা আর বোনের অত্যাচার নির্যাতনে পিতৃহারা এক কিশোরী সারা দিনের কাজ শেষ বিকেলে দিঘিতে যায়। শীতল জলে নেমে মন শান্ত করার আগে খুব করে কাঁদে। সে কান্না খুব গোপন আর অতীত সে কান্না তার বর্তমান। মায়ের কথা ভেবে বাবার স্মৃতি হাতড়ে সে কান্নার নীরব সুর বাতাসে ঢেউ খেলে খেলে তরঙ্গ তুলে তুলে সাধু দরবেশের কানে গিয়ে আঘাত করে। তিনি একদিন তাকে ডেকে বলেন, –

‘মা জননী দুঃখ করিস না। একদিন সব দুঃখের শেষ আছে।’
‘সে শেষ কবে বাবা?’
‘সেই শেষের শুরু কবে তা কারুর জানা থাকে না মা, গল্পের শুরু শুধু মানুষ জানে। তুই কাঁদিস কেন? একদিন তারও যে শেষ আছে।’
‘আমার জীবন এক গোলকধাঁধা বাবা, কবে এ থেকে মুক্তি তার সূচনা কি তবে শুরু হয়েছে?’
‘এ এক জটিল প্রশ্ন মা জননী। যা তুই এই দিঘির জলে একটি মাত্র ডুব দিয়ে সে প্রশ্নের ইতি করে আয়।’

মেয়েটি তাই করে। তখন রূপের আলোয় গাছের শাখায় শাখায় গোধূলির আলো চমকে উঠে। কে এই স্বার্থহীন স্বচ্ছ মনের মানুষ! তার সৌন্দর্য গ্রাম থেকে গ্রামে বাতাসের আগে আগে ছড়িয়ে যেতে ব্যস্ত হয়। সে নিশ্চিত বোঝে সমাপ্তির শুরু হয়ে গেছে। এই গোপন তথ্য জেনে নিয়ে সৎ বোন দিঘিতে আসে। একটি ডুব দেয়। দেখে আহা কি মজা! এ দিঘির শীতল জলে এত জাদু মায়া! সে আর একটি ডুব দেয়; আরও মজা। তারপর আর একটি। অতি লোভে তাঁতি নষ্ট। একটি কালো কোলা ব্যাঙ তার কপালে স্থায়ি হয়ে ঝুলে পড়ে। ঘর্ঘর নিনাদে ভরে যায় বাতাস।

মোকসেদ দরজার সামনে সবুজ এক প্লাস্টিকের টুলে বসে ঝিমোয়। ব্রয়লার মুর্গির মতো থলথলে থুতনি, ঝুলে পড়া চোয়াল; সে থেকে থেকে লাফ মেরে তালিকার নাম ধরে হাঁক দেয়। জবা ফুল এগারো। অনেক অপেক্ষায় থেকে এবার ভেতরে গেছে। এরপর বারো, অরিজিনাল আসে নি; এই ফাঁকে যদি হয়ে যায়। মোকসেদের দিকে দৃষ্টি ফেলে এইটুকু বুঝি, সময় হয়ে এসেছে।

শীতল ঘর। অনেক বড় পরিসরের। অদ্ভুত নিশ্চুপ শান্ত দিঘির পাড়। কখনো কোনো কৃত্রিম আবহমণ্ডল ভেবে ভুল হয়ে যায়। গ্রীন হাউস এফেক্ট। এখানে হাইড্রোলিক নেই, দুটো ইলেকট্রিক্যাল চেয়ার। সুইচ টিপে দিলে কত এঙ্গেলে কাকে ঘোরাতে হয়, সবকিছু জ্যামিতিক। একটি চেয়ারে বসি। দেবদূতের মতো লাগে নুরল ইসলামকে, তার এসিস্ট্যান্ট দুজন আজ্ঞাবহ দাস।

‘বলুন তো সমস্যা কোথায়?’

মুখ হা করে সমস্যা দেখাতে হয়। যে সমস্যার সৃষ্টি আমার নিজের একার। সেখানে কারও দায় বা ওজর থাকে কি? আজ সমস্যার জট সুদ্ধ তুলে ফেলতে চাই। কষ্টের মূলোৎপাটন চাই। কী কী কষ্ট কোথায় কোথায়, তার তালিকা অনেক দীর্ঘ। মিথ্যে প্রতিশ্র“তি অন্যায় শঠতা দুর্নীতি সন্ত্রাস লুটপাট আর কত কী? অনেক যুগ ধরে অনেক কষ্টে কেটে গেল কাল; এবার একটু নির্মল হতে চাই। বড় সাধ হাজার বছরের বাঙালির শেষ্ঠত্ব নিয়ে আসি।

‘এটা তো প্রাইম টিথ, এটা না থাকলে খাবেন কী করে? এ হলো চর্বন দন্ত। তুলে ফেললে কিছু খেতে পারবেন না।’
‘মাঝে মাঝে খুব যন্ত্রণা, ভার ভার লাগে। সারা দিন চিনচিনে ব্যথা!’

বুকে দংশনের কথা তো বলা যায় না। দেখানো যায় না। সে তো বিবেকের দংশন। আর সে দায় আমারই বা কেন? কেননা চালাক আর ধূর্তরা চিরকাল গাছের উপরের আর তলার সবকিছু খায়, আরও খাবে; খেতে থাকবে। তোমার জন্য পড়ে থাকবে শুধুমাত্র ছোবড়া। তোমাকেই বহন করতে হবে তার সকল দায়। তারা বুদ্ধিমান…তারা শুধু পাট্টাশ করবে আর তুমি জীবনের ঘানি টেনে টেনে কোনো এক অলীক সৃষ্টিকর্তার কাছে কখনো নালিশ, কখনো প্রার্থনা করে যাবে স্বর্গ সুখের; অন্যকোনো গ্রহে এক সুনির্মল জীবনের। এ সকলই কল্পনা আর গল্পে বর্ণিত রহস্যকথা। আপাতত যা তুলে ফেলবার তুলে ফেলো।

‘কত চিকিৎসা আছে, রুট ক্যানেল করা যায়। না হলে ডেন্টিউর। গোড়া নড়ে না কি, কোনো পেরিওডেন্টাইটিস?’
‘বুঝলাম না!’
‘মাঢ়ি থেকে রক্ত পড়ে? এটা হলে মুখে দুর্গন্ধ হয়।’

তারপর কী হলো কিছু বোঝা গেল না তেমন। সামান্য এক লাল পিঁপড়ের চিমটি, লোকাল এনেস্থেশিয়া। তখন তাকলা মরু দুর্গম বালুময় পাথার, মাথার উপর উদ্দীপ্ত সূর্যের তেজ; আর মরীচিকা ঝিলমিল মরূদ্যান ভেসে উঠতে থাকে। আমার চোয়াল ভারী হতে হতে নাই হয়ে যায়। আমার দাঁত নেই, মাঢ়ি নেই; মাথা নেই। শুধু এক মাথাভার মাথার অস্তিত্ব জানিয়ে দেয়, তুমি মরো নাই; দেরি আছে বাছা। দেবদূত বলে যায় কী সব স্তবকথা তার কোনোটি কানে আসে কোনোটি দৃষ্টি ঝাপসা।

‘প্রথমে টেম্পরারি ফিলিং। সপ্তাহ খানেক পর দেখে শুনে সে ফিলিং তুলে ফেলে রুট ক্যানেল করা হবে। সে ফিলিং হবে পার্মানেন্ট। খুব সহজ ব্যাপার বুঝেছেন? রিমাল ফাইল দিয়ে এক্সট্রাক্ট করে দেয়া হবে।’

আমার কণ্ঠস্বর আছে কি না জানি না, শুধু মুখ হা করে শীতল ঘরের হিম খেতে থাকি। তারপর বাকি পথটুকু কীভাবে জানি না, ফিরে এসে শুনি এক অনন্ত জিজ্ঞাসা। সেই দুটো চোখ আকুল হয় আর মিলা জিজ্ঞেস করে, –

‘হয়ে গেল?’

এ প্রশ্নের জবাব নেই। হায় সকল জিজ্ঞাসার যদি উত্তর জানা থাকত! তবে এই চুয়ান্ন বছরে বারবার দীর্ঘশ্বাস বেরোত না। তেপান্তরের শেষ প্রান্তে এসে মন ফিরে দেখতে চাইত না কী কী করে গেলাম কী কী আছে রাখার ফেলে যাবার। প্রত্যাশার চেয়ে প্রাপ্তি কতটুকু শূন্য আর বঞ্চনার কতটুকু ভার বহন করে এলাম। তাই মাঝরাতে আবার যন্ত্রণা। এনেস্থেশিায়ার স্বপ্ন-মায়া কাটিয়ে তখন কঠিন বাস্তব। পুনরায় ফিরে আসে চাপ চাপ মাথা ভার অসহনীয় যন্ত্রণা; সহ্য করা আর এক কষ্ট। যেভাবে ঘুরে আসে দিনকাল আর নিত্যদিনের তিক্ত অভিজ্ঞতা। আমরা কী চাই কী পেয়েছি আর কীইবা লালন করে চলেছি। আজ রন্ধ্রে-রন্ধ্রে অনু-পরমাণুতে বাসা বেঁধেছে শূকরের দল। পুরীষভোজী গু-খোর নষ্টরা। এদের আর রাখা যায় না। অসহনীয় কষ্ট। উপড়ে তুলে ফেলতে হবে। একটি সুঁই দরকার। এখন একটি সুঁই খুঁজি, শক্ত মজবুত আর সুতীক্ষ্ণ ফলার মতো ধারালো। সেটি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করতে চাই। উপড়ে ফেলা দরকার সকল দুষ্টক্ষত। খুব অনায়াসে ফাটিয়ে দিতে চাই গু-খোর শূকরের বর্ণালি মুখোশ। ফরমালিন মাখানো সবুজ চেহারার বাহারি খোলস। পাট্টাশ! (এপ্রিল ’১৩)

Facebook Comments

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top