নাহার মনিকা: বিসর্গ তান- ৪

নাহার মনিকা

দ্বিতীয়বার ঢাকার স্কুলে ভর্তি হতে নিধি যখন ভোমরাদহ থেকে এলো, অয়ন তখনো সবার চেনা নিধিকেই চেনে আর কেবল নিজের দুনিয়া চিনিয়ে দিতে চায়। বলে– ‘জানস, এলিয়েন পাওয়া গেছে,  স্পেসশীপ আইসা একটা পুরা স্কুলবাস উঠায়া নিয়া গেছে’!

–‘কোথায়?’– নিধি বিস্ময়ে ফেটে পড়ে দৌড়ে রান্নাঘর বা খাতা দেখা থেকে ফুপুকে হাত ধরে টেনে আনছে।

–‘ল্যাটিন আমেরিকায়’।

–‘আর সারা দুনিয়া চুপচাপ বইসা আছে?’– ফুপু শাড়িতে হাত মুছতে মুছতে হাসি মুখে প্রশ্ন করে।

–‘নাহ, বিশাল হইচই হইতেছে, সবখানে টিভিতে দেখাইতেছে’।

–‘কই, কোথায়?’

–‘এইখানে’– অয়ন তার হাতের খাতা উঁচিয়ে দেখায়,‘আমরা ক্লাসের সবাই সাইন্স ফিকশনের গল্প বানাইতেছি, নিধিতো পড়তে শিখে নাই, তাই ওরে গল্প শুনাই’। অয়নের চালাক হাসিমুখ তখনো জানে না, নিধি নিজের বিস্ময় খুলে হাতের তালুতে নিতে শিখে গেছে, যা কেউ টের পায়নি! গুনতে গিয়ে তাকে আর চুলে গিট পাকাতে হয় না! তবু তখন পর্যন্ত অয়ন মারকুটে হলেও মজাদার ছিল, আর এখন!

–‘দিনরাত দরজা বন্ধ, কিই যে করে’– ফুপুর বলার মধ্যে খেদ আর ভালোবাসা থই থই মিলেমিশে থাকে।

যে ক’দিন আছে এখানে তো থাকতে হবে। মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করে নিধি। প্রথম ঢুকে ঘর দুয়ারগুলি যেমন ‘আগের মত নাই’ মনে হয়েছিল, চোখ সয়ে গেলে দেখা যায়- তেমন একটা বদল হয়নি। শোবার ঘরের পড়ার টেবিল (নিধির অল্প, অয়নের অনেকখানি) সেটাই আছে, ভেতরের একটা পায়া ঘেষে কালো পার্মানেন্ট মার্কার দিয়ে সে লিখেছিল ‘বীণা’, অনেকটা ঘষে গেছে কিন্তু এখনো বোঝা যায়।  মেঝেতে বিছিয়ে স্যুটকেসের চেইন টেনে খোলে নিধি।

পাততাড়ি গুটিয়ে অভ্যাস হয়ে গেছে, নিধির তল্পিতল্পাও বেড়েছে আনুপাতিক হারে। চার, সাড়ে চার বছর বয়সে প্রথম ভোমরাদহ থেকে ঢাকা আসার সময় ছবির বই, রং পেন্সিল খরগোশমুখী ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে তার দায়িত্ব শেষ। তারপর ছয় সাত বছরের সময় যখন মথুরাপুর গেলো, তখন ব্যাগ নিজে গোছাও। অনেক সময় লাগতো, কিন্তু মা কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকতো যেন ট্রাফিক কন্ট্রোল পুলিশ- নিধির নিজের করতে হবে (লার্নিং বাই ডুয়িং)। তবু অতকিছু বাদ দিয়ে মথুরাপুরের  সরকারী বিদ্যুৎ তৈরী কেন্দ্রের পেছনে সিমেন্ট বাঁধাই অপ্রশস্ত, অনতি গভীর খরস্রোতা ক্যানেলের ধারে দাঁড়িয়ে মায়ের পিঠে নাক ঘষার কথা ঘুরে ফিরে মনে থাকে নিধির।

তারপর আবার ভোমরাদহ, তখনকার তার একান্ত গ্রাম।  নিধির প্রায়ই এ গ্রামের বয়স জানতে ইচ্ছে করে। একটা গ্রাম কতদিনে জন্মে? প্রাপ্তবয়স্ক হয়! গ্রাম কখনো শোরগোল তুলে মরে যায়! মনের মধ্যে একটা দোআঁশলা ভাব আসে– যেন অনন্তকাল ছিল ভোমরাদহে, আবার মনে হয় সে বুঝি শুধু বুড়িছুঁই খেলেছে, এত অপ্রতুল সময়ে সেখানে কী দ্রুতবেগে ঘটে গিয়েছিলো কতকিছু! লিচু গাছের সারির ফাঁক দিয়ে খুচরো খুচরো আকাশ, বাদামী ধুলোর রাস্তায় হেঁটে যাবার শব্দ আর গন্ধ মনে আছে নিধির। থাকতেই হবে, কেননা সেসব শব্দবন্ধের মধ্যে তার নিঃশ্বাস দ্রুতলয় আর স্থির হবার কলকাঠি লুকিয়েছিল।

সেখান থেকে আবার ঢাকা শহর, ঠা ঠা রোদের চৌদিক নিয়ে ফুপুর ফ্ল্যাটের বিস্তর ব্যস্ত গলিপথ।

–‘দেখছো কান্ড! অয়নের মাথায় চা’য়ের কাপ উপুড় করলো নিধি! মনে হইতেছিল মাথা ফাইটা রক্তের স্রোত’।

বাবা অধোমুখে বসে আছে সোফায়। ফুপু কলকল করে কথা বলে হেসে যায়, তার কথায় স্নেহ আর নালিশের ময়ান। আর নিধি বাথরুমের কপাটের আড়ালে নিমজ্জমান থেকে ক্লান্ত হয়ে তারপর চিলতে বারান্দায় ভয়ে মুখ শুকিয়ে বসে নখ দিয়ে খুটে খুটে দেয়ালের পলেস্তারা তুলে প্রায় সন্ধ্যা নামিয়ে আনে। পেছন দিকে বয়ে যাওয়া বিরতিহীন মানুষ আর যানবাহনের সয়ংক্রিয় ডামাডোল ভরে দিয়ে যায় নিধির ছোট্ট আকুপাকু করা বুক।

–‘তুই একটা কুত্তীর বাচ্চা, তোর মা কুত্তী, জানস’, (এসব শুনতে অনভ্যস্থ কান নিধির), তাকে কোনমতেই সহ্য করবে না বলে অয়ন ধনুকভাঙ্গা পণ করেছিল!  কিন্তু মা সম্পর্কে এমন কথা সে কেন সহ্য করবে? সকালে অয়নের হিস হিস  এসব গালিগালাজের পরেই যে ওর মাথায় গরম চায়ের কাপ উপুড় করে দিলো  সেটা নিধি কাউকে বলবে না।

তবুও একটা কোমলমতি অয়নের আশায় দিনের পর দিন নিধি অপেক্ষা করে থেকেছে, গলা চেপে ধরার পর ঢোক গেলার ব্যথা সেরে যাবার আগেই যে এসে তাকে ‘সরি’ বলবে। তবে হাইস্কুলে উঠে বুঝে গেছে- অয়ন এমনই। জবরদস্তকারী, অপরাধবোধের বালাই বহু দূরের কথা, সেখানে শিশুকাল প্রাপ্তবয়স্ক বলে কোন কথা প্রযোজ্য নয়। রিপুর এই কতৃর্ত্বকে কি নাম দিতে হয় জানে না নিধি, তার প্রত্যাশাও তেল ফুরানো সলতের মত নিভেছে। অথচ, সে নিজে ফুপুর একটা গ্লাস ভাঙ্গলে কেমন মরমে মরে যেতো!

ফুপু তাকে দূরে দূরে রাখেনি, তবু বাবার ওপর অভিমানে হাঁচড়ে পাচড়ে একটা মত্ত হাতি হয়ে যেতে ইচ্ছে করতো নিধির। কি সহজে বাবা  অন্য একটা গন্তব্য নিজের জন্য বেছে নিল। আর ক্রমে ক্রমে ‘কোনকিছু কারো জন্য অনিবার্য নয়’ প্রমানিত করে নিধিরও এসে গেল সীমানা ডিঙ্গানোর পালা। ঠিক ক্লান্তি না, ভেতরে ভেতরে নোঙ্গর আলস্য ভর করে নিধির।

তেমন দেখা শোনা জানা না হলেও সে বুঝে গেছে- জীবন আসলে দুই প্রকার- হয় দুঃখের, না হয় কৌতুকের। তবুও তার বুকের ভেতর থেকে থেকে নদীর কূহক ডেকে যায়! জীবনের এক পিঠে সে রোদ মেখে বসে থাকে আর উল্টোদিকে বৈঠাভোলা নাও ভাসিয়ে অপাঙ্গ আকাশ মেঘে ঢেকে দিয়ে যায় কেউ। একটা সাহসী বন্দর পেলে নোঙ্গর করে মধ্যরাতের আকাশে আলোর বর্ষা ছুড়ে দিতে সাধ জাগে! নোঙ্গর হয়ে গেলে সে কিনবে জুমচাষের পাহাড়, দেখবে অকিঞ্চিতকর ঘাসের ওপরে শিশিরের অস্পষ্ট উবে যাওয়া। অথচ মৃত্যুর মত ধ্যানমগ্ন বাতাস সেই কবে দেখে ফেলেছে নিধি!

(চলবে)

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top