চাঁদ, প্রজাপতি ও জংলি ফুলের সম্প্রীতি—১৪

imagesমাসুদ খান
(পূর্বপ্রকাশিত-র পর)

শীত যায় গীত গায়/ শিল পড়ে কিল খায়

ঝড়ের প্রকোপ বাড়তেই থাকে ক্রমশ। একপর্যায়ে ঝড়ের কেন্দ্রে তৈরি হয় এক বিশেষ ধরনের ঘোর ও ঘূর্ণি, যার প্রভাবে হাওয়ায় জাগে তীব্র কেন্দ্রাতিগ টান। প্রকৃতি যেন এক অতিকায় অদৃশ্য সেন্ট্রিফিউগাল মেশিন বসিয়ে দিয়েছে ঝড়ের উৎকেন্দ্রে। ঝড় যেদিকে যায়, অদৃশ্য মেশিনটাও সেইদিকে। ঘটতে থাকে অদ্ভুত সব কাণ্ড।

এ-অঞ্চলের রসিক মানুষজন আড্ডায় খোশগল্পে ঠাট্টায় চুটকিতে ব্যবহার করে বিচিত্র ধরনের শালীন-অশালীন, ভব্য-অভব্য প্রবাদ প্রবচন ধাঁধা শোলক ও বাগধারা। ঝড়কেন্দ্রের সেই প্রবল কেন্দ্রাতিগ টানে বাতাসে বিলীন হয়ে ভেসে বেড়ানো তাবৎ কথার এলোমেলো জঙ্গলের মধ্য থেকে জট ছাড়িয়ে ছিটকে বেরিয়ে আসছে এ-যাবৎ উচ্চারিত যাবতীয় প্রবাদ প্রবচন শোলক-শায়েরি ধাঁধা ও বাগধারা– অনর্গল, অফুরন্ত, নিরবচ্ছিন্ন, নিরবদমিত। প্রথম-প্রথম বেরুচ্ছে গুচ্ছাকারে, সবকিছু মেশামেশি ও একাকার হয়ে; পরে আস্তে-আস্তে অনেকটা শোধিতরূপে, স্পষ্টভাবে… যেমন প্রবাদ-প্রবচনগুলি একদিকে, বাগধারা-বাগবিধি আরেক দিকে, ধাঁধা ও শোলক অন্য পাশে। আবার, প্রবাদ-প্রবচনের মধ্যে অন্ত্যমিল-অলা দ্বিপদীগুলি একদিকে, একপদীগুলি অন্যদিকে। অভব্য ও চটুল প্রবচনগুলি বেশ হালকা, তাদের প্লবতাশক্তি বেশি। তাই সেগুলি ভেসে উঠে ছিটকে বেরিয়ে আসছে সবার আগে আগে। চারদিক থেকে বাগবাহুল্যের লাগাতার ঘূর্ণি ও ঝাপটা এসে সবকিছু একরকম গুঁড়িয়ে উড়িয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে। একপর্যায়ে সুস্পষ্ট শোনা যাচ্ছে বিলীনদশা থেকে উদ্ধার-পাওয়া, জীবন্ত ও মুখর হয়ে ওঠা ওইসব বিচিত্র প্রবাদ প্রবচন ধাঁধা ও শোলক…। কিছুটা শোনেন তাহলে…

“ধ্যাৎতেরিকার…মজা মারবে ফজা ভাই/ আমাগো খালি ঘুম কামাই//। ট্যাকায় করে কাম/ মিছাই মর্দের নাম//। হরির উপর হরি, হরি শোভা পায়/ হরিকে দেখিয়া হরি হরিতে লুকায়//। স্বর্ণকারের ঠুকঠাক, কামারের এক বাড়ি/ অন্যে দেয় সুড়সুড়ি, হকসেদে রাম-ঝাড়ি//। হাজিসাব-না ব’লে এত ভালো, তাইলে বাচ্চা হয় যে! টাইম থাকতে পিওর হন/ ধুমায়া আসিচ্চে জনগণ//। নাম শুইনা কাম কী?/ ভাঙ্গা হাঁড়ির দাম কী?//। এক বাড়ি-ত ভোলে/ আরেক বাড়ি-ত খোলে//। বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায়। সব মাছে গু খায়/ ঘাইরা মাছের নাম হয়//। ফৌজদারি জাল ছিঁড়তে পারি/ লাগে আমার এক তুড়ি// কিন্তু যেই মাথা দেই জালের ফাঁকে/ অমনি আমার খালি-খালি হাসি লাগে//। শীত যায় গীত গায়/ শিল পড়ে কিল খায়//। আগে দর্শনদারি/ পরে গুণবিচারি//। খাইছি সুজি/ কিছু হইলেও তো বুঝি//। না না, ওইটা তো ফেলশানি কেস, খিক-খিক-খিক…পুরাদমে ফেলশানি। আরে নাহ্, জানোস না তুই, মামুলি ব্যাপার বে, স্রেফ আটা-চুরির কেসে ফাঁইসা গেছে বেচারা… কী আর করা… কপালের নাম গোপাল… মানলে তালগাছ/ না মানলে বালগাছ//। দাদির কবর কই, আর ফুফুরা কান্দে কই? ছাল নাই কুত্তার বাঘা নাম। বুদ্ধি থাকতে কেউ শ্বশুরবাড়ি যায়? শালাগো দিছি এক ফাঁকি/ এক ট্যাকা দিয়া আনছি তিন সিকি//। আইজ প্রতিপদ, কাইল দ্বিতীয়া/ চান উঠবো আসমান গুতিয়া//। বগলে ইট/ মুখে শেখ ফরিদ//। কীসের মধ্যে কী/ পান্তা ভাতে ঘি//। হক্কের মাল ঠক্কে খায়/ উৎপাতের মাল চিৎপাতে যায়//। ন্যাংটার নাই বাটপাড়ের ভয়। মোল্লাবাড়ির বিলাইও দুই-চার হরফ আরবি জানে। যার যার বাচ্চা/ তার তার কাছে আচ্ছা//। ডাইল দিয়া ভাত খাই/ বিলাইরে সালামালকি দেই//। চোরর মায়ের বড় গলা/ লাফ দিয়া খায় গাছের কলা//। জঙ্গলে মঙ্গল। আপন থেইকা পর ভালো/ পরের থেইকা বন//। যদি বর্ষে আগনে/ রাজা যায় মাগনে//। যদি বর্ষে মাঘের শেষ/ ধন্য রাজা পুণ্য দেশ//। কালো, জগতের আলো। আচ্ছামতো ক্ল্যাশ লাইগা গ্যাছে ফ্ল্যাশ মব আর স্মার্ট মবে। আরে! এ দেহি আলাপে আলাপে মাওইজির প্যাট। যাত্রা দ্যাখে ফাৎরা লোকে/ সিনেমা দ্যাখে ছেমড়ি লোকে//। গরম ভাতে বিলাই ব্যাজার। কী লাগে? খালাত ভাই? নাড়ার খ্যাতে বিয়াইলো গাই/ সেই সূত্রে খালাত ভাই//। সেইর’ম খালাত? মা যখন নানির প্যাটে/ হামি তহন ডুগডুগির হাটে//। কহে কবি কালিদাস, শিশুকালের কথা/ এক লক্ষ তেঁতুলগাছে কয় লক্ষ পাতা?// ছাইড়া দে মা, কাইন্দা বাঁচি। বন থেইকা বারাইলো টিয়া/ লাল টোপর মাথায় দিয়া//। ভাত পচলে তা-ও খাওয়া যায়, পোলাও পচলে একদম না। দাতা দেয়, বারানির মার্গে টাটায়। উনা ভাতে দুনা বল/ বসা ভাতে রসাতল//। আরে! এ দেহি বাংলা কুত্তা ইংরাজি ভোগে। অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী/ কথায় কথায় ডিকশনারি//। দিয়ো কিঞ্চিৎ/ না কইরো বঞ্চিৎ//। জন্ম মৃত্যু বিয়া/ এই তিন তাঁর হাত দিয়া//। বাপ-কা ব্যাটা/ সিপাই-কা ঘোড়া/ মাও-কা বেটি/ নাটাই-কা ফেটি//। জমিলা, তুমি থাকলা পাওয়ারে/ আমি থাকলাম টাওয়ারে//। ভাই বড় ধন, রক্তের বাঁধন/ যদিও পর হয় নারীর কারণ//। ভিক্ষা চাই না মা, কুত্তা সামলা। যেইর’ম জংলা ওল/ সেইর’ম বাঘা তেঁতুল//। রাজায় কইছে চুদির ভাই/ আনন্দের আর সীমা নাই//। লঘু পাপে পায় গুরু দণ্ড/ গুরু পাপে ছাড়া পায় ভণ্ড//। সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে/ গুণবান পতি যদি থাকে তার সনে//। সুখে থাকতে ভূতে কিলায়। পুলিশের ভালবাসা/ গেরস্তের মুরগি পোষা//। কবুতরের কল্যাণে মোষ বলি। ভাগ্যবানের মরে বউ, অভাগার মরে গোরু। আমপাতা নড়েচড়ে/ বন্ধুর কথা মনে পড়ে//। নরনং নাপিত ধূর্ত, বুদ্ধিনং বায়স। আইলস্যা, তোর খালুই গেল ভাইসা/ –না যায়, না যায়, আরেকটা বানামু বইসা//। আমপাতা জোড়া-জোড়া/ মারব চাবুক, ছুটবে ঘোড়া//। মনে করি, কড়ি করী/ কিন্তু হায়, হয়-ই হয় না//। সুলতানা বিবিয়ানা/ সাহেববাবুর বৈঠকখানা/ আলবেলিতে যাইতে/ পানসুপারি খাইতে/ পানের আগা, মৌরি বাটা/ তালে-তালে মারব ঝাঁটা//। একে তো নাচুইন্যা বুড়ি/ তার উপর ঢোলের বাড়ি//। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়/ উলুখাগড়ার জান যায়//। পাটাপুতায় আচ্ছা ঘষা/ মরিচের মরণদশা//। এঙ্গুর ভেঙ্গুর/ তিন শয়তানের লেঙ্গুর//। গোরু হারাইলে হুঁশ থাকে না/ শালীক কয় বউ, বউয়েক কয় মা//। কাজির গোরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নাই। কারো পৌষমাস/ কারো সর্বনাশ//। ঝড়ে বক মরে/ ফকিরের কেরামতি বাড়ে//। চেনা বামুনের পৈতা লাগে নি কোনো?। কই রাজা রঘু/ আর কই বনের ঘুঘু//। কই আগরতলা/ কই চোকির তলা//। কই শেখ সাদি/ কই বকরির নাদি//। কই রাজরানি/ কই বিছনার মুতুনি//। যত দোষ নন্দ ঘোষ/ কলকাঠি সুরেন ঘোষ//। তোমারও মনমনি/ খোদারও মেহেরবানি//। সুঁই কয়, চালনির তলা/ বড়-বড় ফুটা-অলা//। উপরে ফিটফাট/ ভিতরে সদরঘাট//। কিংবা ভাষ্যান্তরে… উপরে গায়ের গেলাপ/ ভিতরে হায়রে হায়//… হোল নাই, তার আবার আংচার/ প্রেস্টিজ নাই, তা আবার পাংচার//।

পাঠক হয়তো ভাবছেন গাঁও-গেরামে লোকে তো কতই প্রবাদ-প্রবচন-ধাঁধা-শোলক বলে থাকে, তা-ই বলে এতটা সময় ধরে গরগর করে এতগুলি ভব্যাভব্য, শোভনাশোভন শোলক-শায়েরি-প্রবাদ-প্রবচন বলে যাওয়া! ঠিকই ভাবছেন, এতগুলি না বললেও পারতাম। কিন্তু কী করব, আজব ঝড়ের গজব-ঝাপটায় সারা শরীরে ও মনে অদ্ভুত এক বাক্যরসাধিক্য (নাকি রসবাক্যাধিক্য) রোগ এমনভাবে ধরেছে যে, তাতে আর না বলে থাকতে পারলাম কই?

আপনারা হয়তো এও ভাবছেন, আমার লেখাটি শুরুর দিকে ছিল বেশ সিরিয়াস-ভাবাপন্ন। কিন্তু ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে পরিহাসপ্রবণ, কৌতুকাবহ। সত্যি বলতে কি, গোটা সমাজই যেখানে আগাগোড়া নিদারুণ কৌতুকের নিশ্ছিদ্র মাদুরে মোড়ানো, সেখানে লেখা যে কৌতুকাবহ হবে এতে আর বিচিত্র কী! তা ছাড়া, হকসেদ কীসব-বলে-না-বলে, কীসব-শ্লেষ-কৌতুক-করে-না-করে সেগুলির দায় তো আমার না। সে তো নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কারুরই কন্ট্রোল নাই তার ওপর। আছে কি? আওয়াজ-কালাম তো কিচ্ছু মানেই না, এমনকি খোদ লেখককেই মেরেছে থাপ্পড়, বদনাম তো করেছেই।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top