চাঁদ, প্রজাপতি ও জংলি ফুলের সম্প্রীতি—১৬

মাসুদ খান

(পূর্বপ্রকাশিত-র পর)

এসি সিনড্রোম, গণসম্মোহন ও শিশু বিলকিস বানু যেভাবে পির-মা বিলকিস বানু হলেন

হাজি আলতাফ সিদ্দিকী। নবীন হাজি। হজ করেছে একবারে তরুণ বয়সে, হোঁচট খেয়ে। অবশ্য এখনো তরুণ সে— নম্র, ভদ্র, পরহেজগার। আমাদের এই পির-মা বিলকিস বানু ছিলেন আলতাফ হাজির প্রথমা কন্যা। বিলকিস বানুকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান তাঁর মা। এই বিলকিস-মা যখন  তাঁর মায়ের পেটে, এলাকার দুষ্ট ছোকরারা টিপ্পনি কাটত– ‘হাজিসাব-না ব’লে এত ভালো, তাইলে বাচ্চা হয় যে!’ প্রসবকালে প্রসূতি তো গত হলেনই, নবজাতিকার অবস্থাও খুব খারাপ, বাঁচানোই মুশকিল। বাবা আলতাফ হাজি আর পড়শিবাড়ির মেয়েটা মিলে সেবাযত্ন করে বাঁচিয়ে তোলে শিশুটাকে। উত্তরাধিকার সূত্রে হাজিসাব জমিজিরাত টাকাপয়সা পেয়েছে ভালোই। কিন্তু বাপ-মা-ভাই-বোন-নিকট-আত্মীয় বলতে কেউই নাই
তার। তাবলিগি চিল্লায় বছরের বেশিরভাগ সময়ই বাইরে বাইরে থাকতে হয় আলতাফ হাজিকে। এদিকে পড়শি মেয়েটাই আদরযত্নে পেলে-পুষে বড় করতে থাকে বিলকিসকে। পরে একসময় পাড়াপড়শিরা হাজিসাবকে নিকা করিয়ে দেয় মেয়েটার সঙ্গে।

 

বিয়ের পর থেকে ঘটতে থাকে অদ্ভুত সব ঘটনা। যে নারী এতটা সেবাযত্নে বাঁচিয়ে তুলেছে বিলকিসকে, পেলেপুষে আসছে অপত্য স্নেহে, সে-ই কিনা একদম বদলে গেল বিয়ের পর। কিছুই আঁচ করা যায় না তার আচরণবিধির। এখনই ভালো, এখনই খারাপ। ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস হাইড। বিলকিসকে আদর যত্ন স্নেহ সবই করে বটে, তবে একইসঙ্গে করে দুর্ব্যবহারও। মারেও। খুব তুচ্ছ কারণে। আর বিচিত্র সব শাস্তি! এমনকি ‘আয় তোক আদর করি’ বলে হাসতে হাসতে কারণ ছাড়াই মারতে থাকে মেয়েটাকে। আরো আশ্চর্যের ব্যাপার-হাজি যখন বাড়ি থাকে, তখনই বরং বেড়ে যায় অত্যাচারের মাত্রা। বউকে নানাভাবে সামলানো ও বোঝানোর চেষ্টা করেছে হাজিসাব। ফেরাতে চেষ্টা করেছে তার আগের আচরণে। ঝাঁড়ফুক, তুকতাক, তাগা-তাবিজ সবই করেছে। অগত্যা ক্ষোভে দুঃখে ঘর ছেড়ে চিল্লায় গিয়ে শান্তি খুঁজেছে নবীন হাজি। তখন আবার দেখা যায় বউটা ভালো হয়ে গেছে অনেকটাই। অবশ্য তারও কোনো ঠিক নাই। হাজি-র অবর্তমানেও বউটা নির্যাতন করে মেয়েটাকে, তবে খুব কম। হাজিসাব বাড়ি না থাকলেই বরং স্নেহের মাত্রা বেশি, মারধর কম।

বউটা যে হাজিকে অপছন্দ করে, তা-ও না, চিল্লায় গিয়ে পড়ে থাকে বলে রাগ বা অভিমান, তা-ও না। বউয়ের কোনো মানসিক অসুস্থতার লক্ষণও খুঁজে পায়নি গঞ্জের ডাকসাইটে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ কুতুব উদ্দিন। চিকিৎসা করতে এসে মোমিন কবিরাজ, ওসমান ওঝা, ঝাড়– জয়নাল…একে একে সবাই ফেরত গেছে বেয়াক্কেল হয়ে। পাড়াপড়শি, আত্মীয়স্বজন, অতিথি-কুটুম্ব সবার সঙ্গেই বউয়ের আচরণ অত্যন্ত অমায়িক। তারা বলে, “বিয়ের পর মেয়েটি বরং আগের চেয়ে আরো হাসিখুশি, আরো সুখী, সদালাপী।” বাড়ির ছোট্ট কাজের মেয়েটারও কোনো অভিযোগ নাই, বরং খুব প্রশংসা করে খালাম্মার। বিলকিসের মামা-চাচাদের সাথেও বউটার সম্পর্ক বেশ ভালো। তারা থাকে দূরের গ্রামে, মাঝে মাঝে আসে মা-মরা মেয়েটাকে দেখতে। এলে তাদের খুব খাতির-যত্ন করে বউটা।

আলতাফ হাজির ঘরে এল নতুন অতিথি। আদর-কাড়া হোঁদলকুতকুতে পুত্রসন্তান। যেন সাক্ষাৎ ননীচোরা কানাই। কিন্তু এবার আবার অন্য লক্ষণ– আপন সন্তানের দিকে মনোযোগ নাই বউটার। মনোযোগ বরং সৎ-মেয়ের দিকে। সৎ-মেয়ে বিলকিসের দিকে বইয়ে দিতে শুরু করল অত্যধিক স্নেহ, আদর, পরিচর্যা। বেচারা হোঁদলকুতকুতেটার কী আর হবে, আত্মীয়স্বজন পাড়াপড়শির কোলে-কাঁখে বড় হতে থাকল সে। বছর কয়েক পর, যেবার হাজিসাব পড়ল শক্ত অসুখে, বউয়ের মনোযোগ ফিরল আপন সন্তানের দিকে। তখন আবার সৎ-মেয়েটার প্রতি চলতে থাকল অবহেলা, অবজ্ঞা ও অত্যাচার।

তারও তিন বছর পর বউয়ের স্নেহস্রোত বইতে লাগল কাজের মেয়ে-শিশুটার দিকে। আপন ছেলে আর সৎ-মেয়েটাকে দিয়ে করায় পরিচারিকার সব কাজ আর পরিচারিকা থাকে আরামে আহ্লাদে। মায়ের কাছে আপন সন্তানের চেয়েও বেশি গুরুত্ব পায় কাজের মেয়ে। মায়ের এইসব অদ্ভুত, অনুমানাতীত আচরণের মাজেজা বিলকিস আর তার ভাই কিছুই বুঝতে পারে না। তারা আর কী বুঝবে, তারা তো নেহাত শিশু, বড়রাই পারছে না। এমনকি বড় শহরের বাঘা-বাঘা সব মনোরোগ বিশেষজ্ঞদেরও বোধের অতীত এই অস্বাভাবিক আচরণ। আলতাফ হাজি তো ছেড়েই দিতে চেয়েছিল বউকে। বলে, “রাখমুই না এই শয়তানের অছওয়াছাটারে। আর কোনো বিয়াশাদিও করমু না জিন্দেগিতে।” আত্মীয়স্বজন, পাড়াপড়শিরা পরামর্শ দিল, “না, বউ ছাইড়া দেওয়ার কাম নাই, বরং এক কাম করো, বিলকিস আর তার ভাইটারে ভর্তি করায়া দ্যাও বগুড়ার আবাসিক মক্তব্যে।” অগত্যা হাজিসাব তা-ই করে। ভর্তি করায়া দেয় আল-মারকাজুল আবাসিক মাদ্রাসায়। কিন্তু সেখানেও তারা ভোগ করতে থাকে নানা দুঃখকষ্ট ও যন্ত্রণা। তখন আবার হাজি গিয়ে ফিরিয়ে আনে তাদের।

এর কয়েক মাস পর এক জটিল রোগে ধরল বিলকিসকে। মরণব্যাধি। মেয়েটি যখন রোগশয্যায়, বউটা তখন একরকম স্বামী-সংসার-সন্তান সব ভুলে গিয়ে, আরাম হারাম করে দিয়ে সেবাযত্ন করতে থাকল তার। মাস দুয়েক ধুঁকে ধুঁকে, সমস্ত সেবাযত্ন চিকিৎসা ঝাঁড়ফুক তুকতাক তাগা-তাবিজ ব্যর্থ করে দিয়ে সবাইকে ফেলে রেখে বিলকিস একা-একা যাত্রা করল আঁধার-ঘরের তালা খুলতে। সৎ-মেয়ের এই অকাল যাত্রায় স্থান-কাল-পাত্র-পরিস্থিতি ভুলে গিয়ে আউলাঝাউলা হয়ে উন্মাদের মতো মাতম করতে লাগল বউটা। মেয়েকে কবর দিতে দেবে না কিছুতেই। উদ্ভ্রান্তের মতো আহাজারি করতে করতে বলতে থাকে, “মাইয়ারে হামি কব্বর দিতে দিমু না। দিমুই না। মাইয়ার মুর্দা হামি মমি কইরা রাইখা দিমু ঘরোত। নাইলে কইলাম আজই হামি এনডিন খামু।” পরে পাড়ার ময়মুরুব্বিরা এসে বউটাকে একরকম ধরে-বেঁধে রেখে বিলকিসের দাফন-কাফন সম্পন্ন করে। বিলকিস বানুকে কবর দেওয়া হয় তাঁর প্রিয় সেই হরিতকী গাছের নিচে, যেখানে বসে থেকেছে সে বহুদিন একা-একা, সৎ-মায়ের আদর ও অত্যাচারের আতিশয্য থেকে ছুটে পালিয়ে এসে, কেটেছে তার অশ্রু- ও আনন্দ-ভরা বহু সকাল দুপুর বিকাল-নিঃসঙ্গ, নির্বান্ধব।

এদিকে যতই দিন যায় ততই বাড়তে থাকে বউটার শোক ও যন্ত্রণার মাত্রা। সন্তান-সংসার-ঘরবাড়ি ফেলে সকাল-সন্ধ্যা পড়ে থাকে বিলকিস বানুর কবরে। মেয়ের কবরের উত্তল অংশকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে থাকে সারা রাত। ধীরে ধীরে বউটা এতটাই ভেঙে পড়ে যে তার নিজের মায়ের আকস্মিক মৃত্যুতেও কোনো ভাবান্তর হলো না। রাতদিন শুধু মা-বিলকিস…মা…মাগো…মা আমার…। রাতে স্বপ্নাদেশ পায় সৎ-মেয়ের কাছ থেকে। সেই আদেশ পালন করে অক্ষরে অক্ষরে। দ্যাখে, কাজ হয়। স্বপ্নে-পাওয়া ভবিষ্যৎবাণীও ফলতে থাকে কাঁটায় কাঁটায়। এইভাবে বিলকিস বানু পরপার থেকে স্বপ্নাদেশ দিয়ে দিয়ে সারিয়ে তুলতে থাকল সৎ-মাকে। সারা এলাকা রাষ্ট্র হয়ে গেল এই অত্যাশ্চর্য খবর। শুধু এলাকা কেন, খবর হয়ে গেল আন্তর্জাতিক মনোবিজ্ঞানী সঙ্ঘেও। আশপাশের নারীপুরুষশিশুরা এসে জুটতে থাকল দিনে দিনে। দূর-দূরান্ত থেকে, এমনকি দেশ-বিদেশ থেকেও আসতে থাকল লোকজন নানান মানত ও এরাদা নিয়ে। কবর পাকা হলো, চাতাল বাঁধানো হলো, টাঙানো হলো শামিয়ানা, চড়ল লালসালু, জুটল খাদেম। গড়ে উঠল দরগা। শুরু হয়ে গেল ছদকা, মানত আর শিরনির হিড়িক, স্বপ্নাদেশ পাওয়ার মহামারী।

পরে জানা গিয়েছিল, বউটার এই জটিল মনোদৈহিক আচরণ নাকি মনোবিজ্ঞান, মনোচিকিৎসাবিদ্যা ও শিশু-পরিচর্যাবিদ্যার জগতে এক অভূতপূর্ব, অদ্বিতীয় ঘটনা। এই আচরণ পেরিয়ে গেছে মানববিদ্যার তাবৎ তত্ত্ব ও তথ্যের সীমানা। এ নিয়ে কত সেমিনার, কত গবেষণা, কত জার্নাল, মনোবিজ্ঞানের জগতে কত তুলকালাম কাণ্ড! আন্তর্জাতিক মনোবিজ্ঞান সঙ্ঘের নামজাদা সব বিজ্ঞানীরা এসে পর্যবেক্ষণ করে গেছে তাদের এই ইউনিক সাবজেক্টকে। নিয়ে গেছে মাঠ-সমীক্ষার তথ্য-উপাত্ত। শেষে গবেষণা করে বের করেছে– এ এক সূক্ষ্ম সফিস্টিকেটেড মানসিক গোলযোগ। শত-কোটিতে এক-আধটা ঘটে থাকে এরকম।

ব্যাপারটা এরকম– যখনই কোনো পরিপ্রেক্ষিত বদলায়, তখনই বউটার স্নেহব্যবস্থায় ঘটে অস্বাভাবিক পরিবর্তন। বিয়ের আগে তার স্নেহব্যবস্থা ছিল এক রকম, বিয়ের অব্যবহিত পরে আরেক রকম, স্বামী ঘরে থাকলে এক রকম, বাইরে থাকলে অন্য রকম, আবার সন্তান জন্মের পর এক রকম, স্বামী অসুখে পড়ার পর আরেক রকম এবং শেষকালে সৎ-সন্তানটা মারা যাবার পর আরেক রকম। এবং সময়ে-সময়ে তার স্নেহব্যবস্থা অস্বাভাবিকভাবে এতটাই প্রবল হয়ে ওঠে যে, অনেকসময় বুঝতেও পারে না, কোনটা স্নেহ আর কোনটা নির্যাতন। নির্যাতনটাও তার কাছে তখন স্নেহেরই একটা ধরন মনে হতে থাকে। আবার সে একইসঙ্গে একাধিক শিশুকে স্নেহ দিতে পারে না, মানে তার ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না অ্যাফেকশনাল মাল্টি-টাস্কিং। তা ছাড়া, তার স্নেহস্রোত এবং অবজ্ঞা-অত্যাচারের স্রোত দিকবদল করে পর্যায়বৃত্তিকভাবে। মনোবিজ্ঞানের জগতে এই অদ্ভুত, অদ্বিতীয় গোলযোগের নাম দেওয়া হলো ‘অলটারনেটিং কারেন্ট সিনড্রোম’ বা ‘এসি সিনড্রোম’। রোগের নামকরণ হলো বটে, কিন্তু নিদানবিধান আবিষ্কার হলো না। অবশেষে নিদানের কাজ করল পির-মা বিলকিসের সম্মোহিত-করা স্বপ্নাদেশ।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top