চারটি কবিতা

সিদ্ধার্থ হক

স্বপ্নের জলপান

সুগভীর তৃষ্ণা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লে
জলপান স্বপ্নে দেখা দেয়।
তৃষ্ণা মেটে না তাতে, ঘুম ভেঙ্গে যায়, বেদনায়

জলের সকল পাত্র, কেন যেন, অস্পষ্ট নিদ্রায়।
যাকে তুমি ছুঁতে চাও স্বপ্ন মধ্যে জলাধার ভেবে
ছোঁয়া মাত্র সে-ই দ্রুত অনির্দিষ্ট হয়ে ভেঙ্গে যায়

শূন্য থেকে দূরবর্তী শূন্যের ঘূর্ণনে
তৃষ্ণা গাঢ় হয় শুধু স্বপ্ন কুঠুরিতে ঘুরে ঘুরে
পাত্র আর বৃত্তের নৃশংস খেলা রাত্রিভর চলে।

তবে কি সজাগ নও? ঘুমেও কি নও?
তৃষ্ণা আর স্বপ্নের যৌথ নির্মমতায়
ঘুম আর জাগরণ একসাথে পার হয়ে গেছ?

সুগভীর তৃষ্ণা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লে, স্বপ্ন হয়ে
জল নয়, জলের মুখোশ পরে মন কাছে আসে।
তখন ঘুমের মধ্যে নিজ আর্তস্বর শোনা যায়।
শেষহীন সেই স্বরে ঘুম ভাঙ্গে। টের পাও তুমি
ডাকছে সজাগ তৃষ্ণা রাত্রির সীমান্তে হাঁটু গেড়ে
সেই কবে থেকে।

দলিত

ক্ষীণ ঘাস প্রায়, দলিত হবার পরে, মুহূর্তেই,
আবার দাঁড়াই। দেখি যে দলিত করে চলে যাও
তাকাও না ফিরে। মনে মনে বেপরোয়া ডাক দেই,
অতীন্দ্রিয়, অকৃত্রিম, তোমার দলিত
করা বুকে নেব,  তবু তুমি মুহূর্তের
জন্যে ফিরে আসো। কিন্তু আমি ঢাকা সিঁড়ি,
কিম্বা ঘাস, আমাকে দেখ না তুমি দলিত করার
মুহূর্তেও। শূন্যে যে অদৃশ্য মই আছে
তা শুধু ঝর্নার ব্যবহার্য। আমি তাকে,
কি করে বা পাবো? পরিপূর্ণ ঢেউহীন
আমি, যদিও বা মানুষের ঢেউ আছে,
ঘাসেরও তা আছে। ঘাস নই? মানুষও কি
নই, আকস্মিক? দূর স্কয়ারের গান বারান্দায়
বসে শোনা যায়। ঘরে মাঠ ঢুকে পড়ে।
ঘাসে ঘাসে বহুবিধ ঝর্না ও বাতাস।
আকাশ রয়েছে বলে গর্জে ওঠে ফায়ার-ওয়ার্ক।

২/৭/১১

এ বসন্তে মাঠ

এ বসন্তে পাতার ক্ষমতা জাগে শূন্যকে কাঁপিয়ে—
পৃথিবীর ট্রেনের জানালা ওরা, ছুটে চলা ডালে ডালে।
বসায় বাতাস কত গোলপোস্ট মাঠের দিগন্তে।
এক পাখি থেমে থেমে ডেকে যায় সকালের পরে বহুবার
তার দুই ডাকের মাঝখানে যে অলঙ্ঘ্য নীরবতা, দেখি,
সেও এক ঝুঁকে আসা ডাক;
পুনরায় শূন্যগুলি সবুজাভ হলে ছায়া জাগে।
দুপুরের দিকে আমি কত যে বাতাস শুনে চলি
কতবার শুয়ে শুয়ে দেখি ঐ মাথার উপর থেকে
পাতার সংসার তাকে ডাকে
বাতাসের সাহচর্যে ত্বক জাগে; নৌকার গলুই হয়ে
মন চলে যায় কত অফুরন্ত স্রোতে;
তারপর দেখি আমি মাঠের ভিতরে বহু শব্দহীন সাড়া।
মাঠের এসব সাড়া ধীরে ধীরে ভেবে দেখি আমি
আরও ভাবি গাছদের সাথে কিছু কথা বলে নেয়া প্রয়োজন
পরে আর গাছ নেই জ্ঞান নেই কথা বলা নেই,
শূন্য নেই, হেঁটে দেখা নেই, মাঠ নেই,
তাকিয়ে থাকবার কেউ নেই বলে রাজহাঁসও নেই
অথচ সমস্ত থাকা মাঠের ভিতরে আজ আছে। তাই ঐ
গাছদের ধরে ধরে কিছু কথা বলা নেয়া এখনই প্রয়োজন
গাছদের ধরে ধরে কথা বলি, নুয়ে যাই, সোজা হই, একা,
যেন আমি সেই ঘাস, এই মাত্র যাকে কেউ মাড়িয়ে গিয়েছে।
গাছদের ধরে ধরে সীমাহীনতার ঐ কোনাকুনি পথ—
অস্তোন্মুখ পায়ে পার হই।
গাছদের ধরে ধরে সারাদিন বাতাসের স্কুল করি তবু
সন্ধ্যায় অসীম নিরক্ষর হই আমি আর মাঠ
আমাদের নিরক্ষরতাকে ঘিরে রাত্রির রহস্যগুলি হেলে থাকে, জ্বলে

১০-০৬-২০১১

প্রেম ও প্রার্থনা

অনন্তের ডাল হয়ে পরের সকালগুলি আমাকে ছুঁয়েছে।
আমি তাই, ভোর থেকে ভেবে চলি সারাদিন কিভাবে কাটবে।
সকাল কি সন্ধ্যা নয়, প্রেম নেই যখন নগরে?
ভোর থেকে ডালগুলি নামে চারপাশে, পাতাহীন।
এই মন অভাবের সাথে আর লড়তে চায় না
এ শরীর দূরগামী হাঁসদের উড়ে যাওয়া ডাক;
সুবিস্তৃত হতে হতে শূন্য-মধ্যে কোথায় মিলায়?
জন্মের মুহূর্তেই মৃত্যু ছাপ রেখে যায় আঙ্গুলের।
ধোঁয়ার দর্পণে কত মুখ ঢেকে যায় ধীরে ধীরে…
দীর্ঘ সমতল রৌদ্রে বাতাস ক্রমশ: হেঁটে যায়।
দুঃস্বপ্নের পরে ঘুম ভ্রান্ত কাঁচ, অর্থহীন কলহের মত।
অপরাহ্ণে ছায়া নেই, রৌদ্রের অভাবে পড়ে আছে…
সূর্যাস্তে পুড়ছে সব দেহ ভোর থেকে
সন্ধ্যা ফুরায় না দেখে আলো না জ্বালিয়ে বসে থাকি।
তবু দেখি আমার এ বসে থাকা ঘিরে আলো জ্বলে।
সন্ধ্যায় দিনের প্রশ্ন মুখ্য নয়, টের পাওয়া যায়।
শেষ শাখা প্রশাখায় ডুবে যেতে যেতে
প্রার্থনার প্রায় কিছু জাগে কি হৃদয়ে?
কোনো কষ্ট, দীর্ঘশ্বাস যেন আর কোনোদিন তাকে
সম্পৃক্ত না করে। কোনোদিন যেন আর না দাঁড়াই
তার কাছে, খুব কাছে গিয়ে, নীল মনে।
আমার বেদনা যেন শেষ হয় আমার মৃত্যুর সাথে সাথে।
পৃথিবীর সকল বেদনা যেন আমার মৃত্যুতে শেষ হয়।
পাতাহীন ডালে বসে যে পাখীর সারাদিন কেটে গেল
নিঃসঙ্গ বৃষ্টিতে বুক খুঁটে, আমার মৃত্যুর পরে
সে যেন সমৃদ্ধ করে পৃথিবীকে কোনো গান গেয়ে।

১১/৫/২০১১

Facebook Comments

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top