সুদূর অর্কেস্ট্রা: সালভাদর দালি (প্রথম পর্ব)

ফেরদৌস নাহার

প্রথম পর্ব

ক.
হিথ্রো এয়ারপোর্টের ডিসপ্লে কাউন্টারে সাজানো রয়েছে নানা রকমের লিফলেট। ট্রেন, বাস, টিউবের (পাতালরেল) ম্যাপ, দর্শনীয় স্থান বা পণ্য সামগ্রীর তথ্যচিত্র, সপিং সেন্টারের সেল, প্যাকেজ ট্যুরের বিবরণ– কী নেই! হাজারো বিষয়ে কত না রঙিন লিফলেট, বুকলেট, ফ্লায়ার তার ইয়ত্তা নেই। যেহেতু এসব পয়সা দিয়ে কিনতে হয় না, এক্কেবারে ফ্রি! তাই দেরি না করে ঝটপট তুলে নিলাম একগাদা রঙিন প্রচারপত্র। আগ্রহ নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখতেই, হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো পেয়ে গেলাম জগৎ খ্যাত শিল্পী সালভাদর দালির একক প্রদর্শনীর খবর।

ওয়েস্ট মিনিস্টার ব্রিজের পাড়ে, টেমস নদীর দক্ষিণ তীরে দাঁড়িয়ে থাকা বিখ্যাত কাউন্টি হলের রিভার সাইড বিল্ডিং-এ শুরু হয়েছে এই প্রদর্শনী। পাঁচশোরও বেশি শিল্পকর্ম দিয়ে সাজানো হয়েছে শিল্পী সালভাদর দালির একক প্রদর্শনীটি। জলরঙ ও তেলরঙ, পেন্সিল স্কেচ, ভাস্কর্য, কাঠ ও লোহা দিয়ে নির্মিত আসবাব, নানা বর্ণের ধাতু ও কাচের গহনা, শিল্পে কোনো মাধ্যমেই বাদ নেই যেন। সালভাদর দালিকে নিয়ে এমন জোরদার ও বৃহৎ প্রদর্শনী গ্রেট বৃটেনে এই-ই প্রথম। নাম: দি দালি ইউনিভার্স । চলবে পাঁচ বছর ধরে, প্রয়োজনে আরো সময় বাড়ানো হবে। তার মানে ২০০৪ পর্যন্ত তো চলবে, বলে কী! খুশিতে দম আটকে যাবার মতো অবস্থা। যে করেই হোক যেতেই হবে এই প্রদর্শনী দেখতে, তানা হলে যে এবারের এই ভ্রমণের ষোলকলাই পূর্ণ হবে না। এভাবে সালভাদর দালিকে এত কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েও হাতছাড়া করব?  মাত্র এসেছি বিলেতে। তখনও জানি না কাউন্টি হলইবা কোথায়, কোথায়বা তার রিভার সাইড বিল্ডিং? তবু সেখানে যেতে হবে– এটাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।

ঘুরতে বেড়াতে যেখানেই গেছি, প্রতিটি টিউব স্টেশনের এক্সিলেটরের দুপাশে লাগানো রয়েছে দি দালি ইউনিভার্স-এর পোস্টার। প্রায় প্রতিদিনই দেখি, গাঢ় বেগুনী রঙের ভিতর রাগী চোখে তাকিয়ে আছেন সালভাদর দালি। তার সেই বিখ্যাত গোঁফ জোড়া বৃশ্চিকের তীক্ষ্ম-সূচালো পা হয়ে সদম্ভ উপস্থিতি ঘোষণা করছে। চোখের দিকে তাকালেই মনে হয় ঠিকরে পড়ছে আগুনের দাম্ভিক উত্তাপ। বিংশ শতাব্দীর এই বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী স্যুরিয়ালিস্ট শিল্পী সালভাদর দালি তার খামখেয়ালী, পাগলাটে আর একরোখা অভিব্যক্তি ছড়িয়ে দিয়েছেন চোখে মুখে। মনে পড়ছে দালির নিজের সম্পর্কে নিজের মন্তব্য–The difference between a madman and me is that I am not mad

খ.
এবারে গ্রীষ্মে যখন লন্ডনে পৌঁছলাম, তখন সবে দক্ষিণের ইংলিশ চ্যানেল আর উত্তরের আইরিশ সাগরের বাতাস  কিছুটা উষ্ণ হয়ে উঠেছে। আর তাই উষ্ণতার উন্মুক্ত স্পর্শ পথ-ঘাট-প্রান্তর জুড়ে। তারই মাঝে সালভাদর দালি, বিস্ময় থেকে বিস্ফোরণের কারণ হয়ে আমাকে টানছে। প্রায় দিন লিফলেটের ভাঁজ খুলে উল্টে পাল্টে দাখি। ততদিনে চিনে গেছি কাউন্টি হলের অবস্থান। নানা পথ পরিভ্রমণের পর একসময় প্রদর্শনী দেখবার দিনটিও এলো এবং সেই সঙ্গে পেয়ে গেলাম মনের মতো সঙ্গী। কবি শামীম আজাদ। বাংলাদেশের কাব্যভুবনের পরিচিত নাম। শামীম আপা আমার খুব প্রিয় ও একজন কাছের মানুষ। দীর্ঘদিন ধরে বিলাতে বসবাস করছেন। কবিতা ও লেখালিখির পাশাপাশি জড়িত রয়েছেন নানা রকমের সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডে। তাকে এই প্রদর্শনীর কথা জানাতেই তিনি একবাক্যে রাজি, আর কে পায়! আজ তার সঙ্গে পৌঁছে গেলাম কাউন্টি হলে, প্রদর্শনী প্রাঙ্গণে।

আগস্টের ঝকঝকে দিন। যাব বলে সকাল সকাল তৈরি হয়ে নিলাম।

শামীম আজাদের আমন্ত্রণে গতকাল বিকেলে লরেডল হাউজে ব্রিটিশ সাউথ এসিয়ান পয়েট্রি শুনতে গিয়েছিলাম। ওখান থেকে কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক ও আমাকে– শামীম আপা তার বাড়িতে নিয়ে এলেন। সারা রাত ধুম আড্ডা চললো, ঘুমাতে ঘুমাতে প্রায় ভোররাত। সকালে উঠেই আনোয়ারা আপা চলে গেলেন তার কর্মক্ষেত্রে। আমি আর শামীম আপা তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বাড়ি থেকে বেরিয়ে গ্যানস-হিল স্টেশন। সেখান থেকে ওটারলু। দীর্ঘপথ, সেন্ট্রাল লাইন ধরে টটেনহ্যাম কোর্ট রোড স্টেশনে নেমে, পাতালরেল বদল করে আবারও নর্থান লাইন ধরে ওয়াটারলু। প্রায় সোয়া ঘণ্টার একটানা পাতাল ভ্রমণ। ট্রেন থেকে নেমে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলাম। আমাদের মাঝে চাপা উত্তেজনা। শিল্পী সালভাদর দালির পৃথিবী দেখব আজ। একেবারে জীবন্ত, বাস্তব, কোনো রিপ্রোডাকশন বা রেপ্লিকা নয়। সব কটি আসল, খাঁটি। এতদিন যা দেখেছি ছবিতে, পেপারে, পোস্টারে, বইতে। আজ কিনা তার অনেক কিছুই দেখতে পাব জীবন্ত সত্যিকারে!

লন্ডন আই ও জুবলি গার্ডেন ডানে রেখে, টেমস নদীর পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে পৌঁছে গেলাম কাউন্টি হল। হলের বাইরে প্রদর্শনী প্রাঙ্গণ দি দালি ইউনিভার্স- ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন আর ভাস্কর্যের বিশাল বিশাল সব সব রেপ্লিকা দিয়ে সাজানো। দূর থেকেই চোখে পড়ে। কাউন্টি হলের গা ঘেষে বয়ে চলছে লন্ডন শহরের বড়ো আদরের টেমস নদী। ডানে লন্ডন আই-এর নাগরদোলা, এতে চড়লে নাকি পঁচিশ মাইল দূর পর্যন্ত লন্ডন শহরকে দেখা যায়। আরো রয়েছে সংস্কৃতি-অনুষ্ঠানের প্রাণকেন্দ্র রয়েল ফেসটিভাল হল। বাঁয়ে সেন্ট থমাস হসপিটাল, এখানে একদা আমার মা প্রচণ্ড পেটে ব্যথা নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। আজ মা নেই কিন্তু আমার ব্যক্তিগত স্মৃতির সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেন্ট থমাস হসপিটাল। সামনে টেমস নদীর ওপারে পার্লামেন্ট হাউজ আর এপার-ওপারকে যোগাযোগ করেছে ওয়েস্ট মিনিস্টার ব্রিজ। খুবই নান্দনিক ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান। পার্লামেন্ট হাউজের বিখ্যাত বিগব্যান ঘড়িটা ঢং ঢং! করে দুপুর বারোটা বাজার সময় সংকেত শোনাল। প্রদর্শনী হলের বাইরে দাঁড়িয়ে বেশ কিছু ছবি তুলে নিলাম। কবি শামীম আজাদের সঙ্গে এইসব ভালোলাগা ভাগ করে নিতে নিতে ঢুকে পড়লাম দালির পৃথিবীতে।
(চলবে)

————
ছবির বর্ণনা:
১। দালি ইউনিভার্স এক্সিবিশন ফোল্ডার ২। কাউন্টি হল ৩। এক্সিবিশন হলের বাহির প্রাঙ্গণ

Facebook Comments

5 Comments

  1. খুবই সাবলিল এবং অসাধারণ আপনার লেখা। পড়তে পড়তে মনে হলো আমি নীজেই ওয়েস্ট মিনিস্টার ব্রিজের মাঝখানে দাঁড়িয়ে টেমস নদী আর তার দুপাশের সুন্দর্য উপভোগ করছি…

  2. Johora Bebe Ira

    Read with much delight the lyric narration of the journey toward the exhibition hall of Salvador Dalí at London. The description created much anticipation, eagerness and excitement about Dalí. Much flavor is added to the write up by echoing general sentiment about angry face of Dalí. In addition, rater er josh adda among mandarins and personal sad memory about mother made this chronicle more humane. But in sum, an intense desire is created for the arrival of Dalí …Wow! Fascinating !

    We know about Dalí in our own way! Now we will peep into him again through the eyes of an ingenious mind like Ferdous Nahar..I will be waiting because it is worth waiting for!

  3. Pingback: সুদূর অর্কেস্ট্রা: সালভাদর দালি (দ্বিতীয় পর্ব) » সাহিত্য ক্যাফে

  4. Pingback: সুদূর অর্কেস্ট্রা: সালভাদর দালি (তৃতীয় পর্ব) » সাহিত্য ক্যাফে

  5. Pingback: সুদূর অর্কেস্ট্রা: সালভাদর দালি (চতুর্থ পর্ব) » সাহিত্য ক্যাফে

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top