সুদূর অর্কেস্ট্রা: সালভাদর দালি (দ্বিতীয় পর্ব)

ফেরদৌস নাহার      

দ্বিতীয় পর্ব                                                                প্রথম পর্ব

ক.
Intelligent artists are those who are
Capable of expressing the most wild and
Chaotic experiments in classical form.
I have done all kind of experiments. I have
Even painted with a gun! — Salvador Dali.

ফ্রান্স ও স্পেনের বর্ডার থেকে মাত্র ষোল কিলমিটার দূরে পাহাড়ের পাদদেশে উর্বর শস্যভূমি সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক রিজন্স ক্যাটালোনিয়া’র ফিগুয়েরেস শহরে ১৯০৪ সালের ১১ মে সালভাদর দালির জন্ম। পুরো নাম, সালভাদর ডোমিঙ্গ ফিলিপে জাসিন্টো দালি ই ডোমেনেচ। তার প্রয়াত বড়ো ভাইয়ের নামও ছিল দালি। দালির জন্মের নয়মাস আগেই বড়ো ভাইটি মারা যায়। দালির পরিবার এবং দালি নিজেও মনে করতেন, তিনি তার মৃত ভাইয়ের ছায়া। ছেলেবেলা থেকেই মৃতের ছায়া হয়ে বেড়ে ওঠার বিষয়টি অবচেতন ভাবে তাকে তাড়া করে বেড়িয়েছে, সারাজীবন এই ভয়ঙ্কর অনুভব তার সঙ্গী হয়ে ছিল। আর তাই খুব অল্প বয়স থেকেই হয়ে উঠেছিলেন অন্যধরনের মানুষ। আর দশজন সাধারণ মানুষ এবং তাদের চিন্তা-ভাবনা থেকে দালি হয়ে উঠলেন ভিন্ন একজন। পারিবারিক আচার, সামাজিক রীতি-নীতি ভাঙার এক নিয়মিত প্রবণতা তার মধ্যে দেখা দেয়,

Take me, I am the drug
Take me; I am the hallucinogenic

টিকেট কেটে ভেতরে প্রবেশ করলাম ঠিকই, কিন্তু ক্যামেরা চালু করা যাবে না। ছবি তোলা, ভিডিও করা সব নিষেধ। অগত্যা ক্যামেরা গুটিয়ে ব্যাগে রেখে দিতে হলো। মনটা একটু দমে গেল, এত বড়ো প্রদর্শনী কিন্তু কোনো ছবি তুলতে পারব না! দেখে যাওয়া আর লিখে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। নিজের দুচোখ এবং নোটখাতা এই দুইয়ের ভরসায় এগিয়া চললাম।

আগেই বলেছি প্রদর্শনীর নাম, দালি ইউনিভার্স (Dali Universe)। খোদ ব্রিটেনে এই প্রথমবারের মতো এমন একটি প্রদর্শনী হচ্ছে, তাই সাজ সাজ রবটাও একটু বেশি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের আর্ট মিউজিয়াম থেকে আনা হয়েছে কাজগুলো, আনা হয়েছে ধর্নাঢ্য ব্যক্তিদের সংগ্রহ থেকে। বিশাল নিরাপত্তা। তাই বলে মোটেও পুলিশি তৎপরতার মতো নয়। টিকেট কাউন্টার থেকে টিকেটের সঙ্গে হাতে ধরিয়ে দিল প্রদর্শনী গ্যালারির পথ নির্দেশিকাসহ দালির সবগুলো কাজের তালিকা লেখা একটি ফোল্ডার।

মূল প্রদর্শনীতে ঢুকবার আগে একটি লম্বা প্যাসেজ। যা-কিনা দীর্ঘ পথের মতো মিশে গেছে মূল কক্ষের সঙ্গে। এই প্যাসেজের দুপাশের দেয়ালে ঝুলানো হয়েছে শিল্পী সালভাদর দালির অসংখ্য ব্যক্তিগত আলোকচিত্র। ছবিগুলোর অধিকাংশই শিল্পীর পরিণত ও মধ্যবয়সের। আলোকচিত্রগুলোতে দালির ঝাঁঝালো ব্যক্তিত্বের প্রবল ও প্রকট দিকটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ছবিগুলো নানা মাপের। কোনোটি পাঁচ-সাত ফুট দৈর্ঘ-প্রস্থের, আবার কোনো কোনোটি দু-তিন ফুটের মতো। আলোকচিত্রগুলোতে এমন ভাবে আলোকসম্পাত করা হয়েছে, যাতে করে একধরনের আলো-আঁধারি আবিলতা তৈরি হয়েছে সম্পূর্ণ প্যাসেজটি ঘিরে। প্রতিটি ছবির পাশে লেখা আছে দালির নিজস্ব দর্শন ও মন্তব্য। ক্ষ্যাপাটে শিল্পী সালভাদর দালি কত ভাবেই না ছবি তুলেছেন। কখনো বন্ধুদের সঙ্গে, কখনো পাহাড় চূড়ায়, বালুচরে আটকে রাখা নৌকায়, কখনো নানারকমের পোশাকে, কখনো বা রাজকীয় ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে। শেষ নেই তার বিপুল উপস্থিতির। ছবির ফাঁকে ফাঁকে গুঁজে দেয়া দালির কথাগুলো সবাইকে আকৃষ্ট করছে। আমার মতো অনেককেই দেখলাম নোট বইয়ে টুকে নিচ্ছে সে-সব:

– Everything alters me, but nothing changes me.

– For me, love must be ugly, looks must be divine 
   and death must be beautiful.

– There is less madness to my method, than 
   method to my madness.

খ.
১৯২২ সালে সালভাদর দালি মাদ্রিদের বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রেসিডেন্স দি স্টুডেন্ট-এর একাডেমি অব ফাইন আর্টসে যোগ দেন। এখানেই তার পরিচয় হয় স্পেনের বিখ্যাত কবি ও নাট্যকার ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা, চলচ্চিত্রকার লুই বুনুয়েলের মতো অন্যতম সেরা প্রতিভাবানদের সঙ্গে। দালি ও বুনুয়েল মিলে তৈরি করেছেন দুটি স্যুরিয়ালিস্ট চলচ্চিত্র, ১৯২৮ সালে অ্যান আন্দালুসিয়া ডগ  ও ১৯৩০ সালে দ্যা গোল্ডেন এ্যাইজ । এদিকে ১৯২৫ সালে  বার্সেলুনায় অনুষ্ঠিত হলো দালির একক চিত্র প্রদর্শনী, এখান থেকেই শুরু হলো তার অসম্ভব খ্যাতির যাত্রা। কিন্তু দালি তার একাডেমিতে টিকতে পারলেন না। কারণ দালি ঘোষণা দিয়েছেন, ফ্যাকাল্টিতে এমন কোনো শিক্ষক নেই যে তার পরীক্ষা নেবার যোগ্যতা রাখে। আরো দাবি করলেন- ওইসব অধ্যাপকের চাইতে তিনি নিজেই অনেক বেশি অভিজ্ঞ। তোলপাড় পড়ে গেল, ১৯২৬ সালে ফাইনাল পরীক্ষার অল্প কিছুদিন আগে তাকে একাডেমি থেকে বহিস্কার করা হলো। সেবছরই তিনি প্যারিস যান। সাক্ষাৎ করেন বিখ্যাত স্প্যানিশ চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো ও জোয়ান মিরো-র সঙ্গে, দেখেন তাদের কাজ। পরবর্তীতে দালির আঁকা বেশ কিছু ছবিতে এই দুজন শিল্পীর প্রবল প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। শিল্পী ও শিল্পের নগরী প্যারিসে স্থায়ী হবার জন্য মিরো তাকে উৎসাহিত করেন। ১৯২৮-এ দ্বিতীয়বারের মতো প্যারিস গেলে সেখানকার দাদাইজম ও স্যুরিয়ালিস্টদের সঙ্গে দালির পরিচয় ঘটে।

আলোকচিত্র দিয়ে সাজানো লম্বা প্যাসেজটি পার হলাম। এবারে মূল শিল্পকর্মের জগতে প্রবেশ করবো। আবারো নিরাপত্তা কর্মীদের দায়িত্ব পালন করতে দিয়ে পা রাখলাম শিল্পী সালভাদর দালির সৃষ্টিময় ভুবনে। চোখ যেন বিশ্বাস করতে চায় না। এ আমি কোথায়, এযে সত্যিই অন্যএক মহাবিশ্ব! একজন শিল্পীর এতগুলো জগৎখ্যাত শিল্পকর্ম একসঙ্গে দেখার এই অনিন্দ্য আয়োজনযাত্রা কীভাবে শুরু করবো! পারব কি একবেলায় সবগুলো কাজ দেখে শেষ করতে? সম্পূর্ণ জীবন ধরে দালি তার অগণিত শিল্পকর্ম নানা ধারায়, নানা কৌশলে সৃষ্টি করেছেন। যার স্বাক্ষর ধারণ করছে এই প্রদর্শনীটি। ত্রিশ হাজার স্কোয়ার ফুট দৈর্ঘ্য-প্রস্থেরও বেশি কাউন্টি হলের বুক আজ কাণায় কাণায় পরিপূর্ণ।

এই প্রদর্শনীকে সালভাদর দালির তিনটি মূল চেতনার আলোকে উপস্থাপন করা হয়েছে। ত্রিধারার তিন সুরকে অসম্ভব এক ঐক্য উপস্থাপনার মাধ্যমে পৌঁছে দিয়েছে নানন্দিক শোভাযাত্রার দিকে।

. কামুকতা এবং নারীত্ব (Sensuality and Femininity)
. ধর্ম এবং পুরাণ (Religion and Mythology)
. স্বপ্ন এবং উদ্ভট কল্পনা (Dreams and Fantasy)

এই সবগুলো চেতনাকে সালভাদর দালি তার শিল্পকর্মের নানা মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। পাঁচশরও বেশি শিল্পকর্ম রয়েছে এই প্রদর্শনীতে, রয়েছে ভাস্কর্যের বিশাল উপস্থাপনা (১৯৩৫-১৯৮৪), তেলরঙ, জলরঙ, ড্রইং, দুষ্প্রাপ্য গ্রাফিক্স, লিথোগ্রাফ, কোলাজ, সোনার গহনা, কাচ ও ক্রিস্টালের শো-পিস, কাঠ-ব্রোঞ্জ ও স্টিলের আসবাবপত্র। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে দালি রেখেছেন তার কালজয়ী স্বকীয়তা। এই মূল্যবান ও ঐতিহাসিক প্রদর্শনীর মাধ্যমে দর্শকের সামনে পূর্ণাঙ্গরূপে তুলে ধরা হয়েছে দালির নিজস্ব স্টাইলের প্রতি চূড়ান্ত দখলদারিত্ব ও স্যুরিয়ালিস্টিক শিল্পশৈলীর পরিণত বিশ্বমানের রূপকে। প্রতিভাবান দালির বহুমাত্রিকতায় মুগ্ধ কাল, মুগ্ধ পৃথিবী, মুগ্ধু আমরা। এ-তো মহাকালের বুকে ঠাঁই করে নেয়া অনবদ্য শিল্পরাজ্য।

বিশাল এই ঘরটিতে প্রবেশ করে, আমি ও শামীম আজাদ বিচ্ছিন্ন হয়ে যে যার মতো দেখতে শুরু করলাম। গত শতাব্দীর প্রায় প্রথম দিকে তৈরি কাউন্টি হল। স্বাভাবিক ভাবেই উঁচু এর ছাদ। স্থাপত্য শিল্পে গ্রীক সৌকর্যের রীতি সুস্পষ্ট। প্রশস্ত আয়তন, সুদীর্ঘ পিলার আর সুউচ্চ দেয়াল সহসাই দাঁড় করিয়ে দেয় বিশালত্বের মুখোমুখি। আর সেই দেয়ালেই ঝুলানো হয়েছে দালির চিত্রকর্ম। সুপরিসর কক্ষটির মধ্য ও প্রান্তভাগ জুড়ে স্থাপন করা হয়েছে ভাস্কর্যগুলো। এই প্রদর্শনীতে চল্লিশটিরও বেশি লাইফ সাইজ ভাস্কর্য রয়েছে, আর রয়েছে একশত চব্বিশটি ড্রইং। যা কিনা সারিবদ্ধভাবে দেয়ালের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত, যেন শেষ নেই- যেন অশেষ।

প্রথম যেটিতে চোখ গেল Alice in wonderland। ব্রোঞ্জের তৈরি তিন ফুট উঁচু। চুল ও মুখখানি ফুটন্ত গোলাপগুচ্ছ। আর হাত দুটি ও গ্রীবা গাছের শাখার আদলে তৈরি। বিমূর্ত ধারার মাঝে স্পষ্টতই বুঝা যায় এলিস যেন বিকশিত হচ্ছে, ভেসে যাচ্ছে। এরই কাছাকাছি ব্রোঞ্জের তৈরি চেয়ার ও টেবিল। একেবারে ভিন্ন আঙ্গিকে তৈরি করা হয়েছে এই আসবাব দুটি। চেয়ারের হাতল হয়ে এসেছে মানুষের হাত, টেবিলের পায়ায় ব্যবহার করা হয়েছে পা এবং হাতের ডিজাইন। ছবি তুলতে পারছি না বলে আসবাব দুটোর গঠন নোটবইতে এঁকে নিলাম।

এখানেই রয়েছে সালভাদর দালির জগতখ্যাত দুটো ভাস্কর্য The Nobility of time ১৯৭৭-এ এবং The Profile of time ১৯৭২-এ সৃষ্টি  করেছেন। স্যুরিয়ালিস্টিক শিল্পধারার অন্যতম ক্ল্যাসিক কাজগুলোর দুটি এখন আমার সামনে। ব্রোঞ্জের তৈরি ভাস্কর্য দুটিতে কালচে খয়েরি ও সবুজ রঙের ব্যবহার রয়েছে, রয়েছে মিথের ব্যবহার। গাছের মাথায় মুকূট ঘড়ি ইত্যাদির ব্যবহারের মাঝে ফুটে উঠেছে শিল্পীর পরাবাস্তব চেতনার ধারাবাহিকতা। যদিও শিল্পকর্মগুলোতে হাত দিয়ে স্পর্শ করা নিষেধ, তারপরও কিছুটা আড়াল করে ছুঁয়ে দেখলাম দালিকে। যদি অন্যায় করে থাকি শিল্পের কাছে সে অন্যায় আমার জমা থাক ভালোবাসার ঘরে।
(চলবে)

ছবির বর্ননা:
১। প্রিয় গোঁফ নিয়ে দালির নানান অভিব্যক্তি
২। এক্সিবিশন হলের ভেতরে,লন্ডন/ Dali Universe Exhibition at London
৩। নবেলিটি অব টাইম/ Nobility of Time
৪। প্রোফাইল অব টাইম/ Profile of Time

Facebook Comments

3 Comments

  1. Johora Bebe Ira

    Read with much excitement like a thriller.
    Unusual but cant help …its true!
    While going through the write up I felt like I was Ferdous visiting the exhibition. I almost visualized the small inscriptions on every painting. I saw the exploring imago of sub consciousness. Such is the supreme power of Ferdous in creating that bonding with her readers through her fluid rich use of words in interpreting works of Dali. I especially admire her B-school student like ardent meticulousness in looking into every detail and taking notes. She is apparently serious but could not hide her deep intense emotional admiration for Dali when she wrote … তারপরও কিছুটা আড়াল করে ছুঁয়ে দেখলাম দালিকে. Wow! That’s almost a teenager crush for the love of Art and the Artist.
    Expression extraordinaire!

  2. Pingback: সুদূর অর্কেস্ট্রা: সালভাদর দালি (তৃতীয় পর্ব) » সাহিত্য ক্যাফে

  3. Pingback: সুদূর অর্কেস্ট্রা: সালভাদর দালি (চতুর্থ পর্ব) » সাহিত্য ক্যাফে

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top