ছোটগল্প: বীজ

মাহবুব আলী

 

শিহাবের এই কাজ করতে জঘন্য লাগে। সারা শরীর ঘিনঘিন করে উঠে। অথচ আগে এমন অনুভূতি হতো না। হঠাৎ যেদিন রানু বমি করার মতো চোখমুখ উল্টে বলে, –

‘যাও গোসল করে এসো।’

কেন কি হলো আবার?’

‘ই মা! কি জঘন্য কি নোংরা!’

সেই থেকে শুরু। না হলে কাজ নিয়ে ভালোমন্দ ভাবার কিছু ছিল না। সবাই করে। তাছাড়া তেমন ভাবার অবকাশই কোথায়! মাস গেলে নগদ টাকা আসে। সংসার করা নয়, জীবন চালাতে টাকার দরকার সবসময়। কিন্তু রানুর সেই উচ্চারণগুলো তাকেও ধীরে ধীরে সংক্রমিত করে ফেলে। এখন তার নিজেরও কেমন গা ঘিনঘিন করা শুচিবাই ধরেছে। শিহাব বোঝে এ অহেতুক…যুক্তিহীন। তারপরও রোগ মনে বসে গেছে। অনেকসময় মন কোনো যুক্তি বোঝে না। জীবনের প্রয়োজন অপ্রয়োজন আর পরিস্থিতি মেনে নিতে চায় না। তাকে এখন সকালে বাইরে কাজে যাবার সময় এবং ফিরে এসে আর একবার গোসল করতে হয়। সে গ্রীষ্মকাল হোক কিংবা মাঘের শীত।

আজ সন্ধ্যেয় শিহাব গোসল সেরে টিভি অন করে। প্রতিদিন এমন হয়। অফিস থেকে ফিরে মুড়ি আর চা কিংবা অন্যকিছু খেতে খেতে টিভি দেখা। অনেকটা রুটিনওয়ার্ক হয়ে গেছে। রানু আজ চা করবে না। সে মাঝে মাঝে এমন করে। কেন যে, তা শিহাব কোনোদিন ভেবে দেখে নি। সে এক কাপ চায়ের জন্য প্রায় সাধাসাধি করে। আজ করল না। মন বিষণ্ন। সে টিভির দিকে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করে। আজকাল বেশিরভাগ প্রোগ্রাম ঝাউলি হয়ে গেছে। একইরকম…টাইপড টক শো। আলু পটল ব্যবসায়ী প্রোডিউসার আর নকলবাজেরা বুদ্ধিজীবি হলে যা হয়! ফাজলামোর মতো আঁতেল সব কথাবার্তা। ‘আরে শালা, সারাদিন পরিশ্রম করে এসে এসব বক্তৃতা বাগাড়ম্বর কে শুনতে চায়। আর আলোচকদের ভাবখানা দেখ, একেকটজন বিদ্যেগজ’ সে মনে মনে খেদোক্তি করে পাশে বসা রানুর দিকে তাকায়। আপন মনে সেলাই করছে। টিভির দিকে তেমন নজর নেই।

‘চা খেতে ইচ্ছে করছে।’

‘পারব না।’

‘দাও না এক কাপ মাত্র।…আবার ছিঁড়েছো, দু মাসও হয় নি, নতুন ব্লাউজ।’

‘তোমার জন্যই তো…ষাঁড় একটা…জংলি।’

‘কি যে বলো, মানুষ আবার সভ্য হলো কবে?’

রানুর হাসিমুখ দেখে শিহাবের মন ভালো হয়ে গেল। সারা দিনের ক্লান্তি নিমিষে উবে গেল যেন। সে হাসতে হাসতে বাঁ হাতখানা তার পিঠে তুলে দেয়। কিন্তু রানু অজানা আতঙ্কের মতো মৃদু চিৎকার করে উঠে।

‘এই ছোঁবে না ছোঁবে না বলছি।’

‘কেন? কি হলো আবার!’

‘তোমার গা থেকে সেই কেমন গন্ধটা, উ মা আমি মরে যাব!’

‘কেন গোসল করে এলাম তো।’

‘এখন গোসল করলেও তোমার গা গন্ধ করে।’

শিহাব বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো হাত সরিয়ে নেয় আর রানু ছুটে যায় বাইরে বারান্দায়। সন্ধ্য গভীর হচ্ছে আঁধারে। শিহাব কানপেতে এক প্রলম্বিত দীর্ঘশ্বাস শোনে। সেটি রানুর, ফুঁপিয়ে কাঁদছে। শিহাব কিছু করে না। জানে, সে কিছুক্ষণ কেঁদে কেঁদে আবার ঘরে ফিরে আসবে। জিজ্ঞেস করবে, এখন ভাত খাবে কি না। তারপর হয়তো খেয়ে দুজন শুয়ে পড়বে। বউটি একেবারে তার বুকে সেঁধিয়ে ঘুমুবে। সময় কেটে যাবে আদরে আদরে। নয়তো সেই ভয়ঙ্কর দূরত্ব। ‘ছোঁবে না আমাকে…ষাঁড় কোথাকার’ রানুর তীক্ষ্ণ ধারালো চিৎকারে শিহাব নিজেকে অসুখি, বিতৃষ্ণ করে তুলবে। বারবার মনে আসবে সেদিনের ভুল। এরমধ্যে বিপরীতমুখি দুজন শুয়ে শুয়ে জেগে জেগে পরস্পরের দূরত্ব মাপতে মাপতে ঘুমিয়ে পড়বে একসময়।

শিহাবের হঠাৎ ভালো হয়ে যাওয়া মন আবার অভিব্যক্তিশূন্য হয়ে যায়। টিভি অফ করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। রানু দোরগোড়া থেকে জিজ্ঞেস করে, –

‘কোথায় যাচ্ছ আবার? এসো আমারই ভুল হয়েছে। চা করে দিই এসো।’

‘সিগারেট নিয়ে আসি।’

শিহাব অত্যন্ত নিরাসক্ত জবাব দেয়। সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ দোকানগুলোর ঝলমল আলো আর মানুষ দেখে। এ শহর অচেনাই থেকে গেল। সেই বছর তিনেক আগে এসেছিল। বস তার কাজে মোটামুটি সন্তুষ্ট। তাই চাকুরি হারাবার ভয় নেই। অস্থায়ী থেকে স্থায়ী হয়ে গেছে। সেই সাহসে ভর করে রানুকে ঘরে তোলা। নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। কলেজে পড়ছিল। ঘটক যখন প্রস্তাব দেয় তখন সত্যি বলতে কি খুব ভয় পেয়েছিল। তার বিদ্যে এসএসসি। অকালে বাবা মারা গেল। মা তো গেছে জন্মের সময়। সংসার বলে কোনোকিছু আর রইল না। পড়াশুনা শেষ। খবরের কাগজের হকারি থেকে ছাব্বিশ বছরের মাথায় এই চাকুরি। এখন মন ঘর সংসার করতে চায়। কিন্তু আই. এ. পাশ বউ! না না ম্যাচ করবে না। সে বেশ ভড়কে যায়। কিন্তু ওর ফটো দেখে মন কেমন গলে গেল। কোনো মন্দির ধ্বংসাবশেষ পাশে তার দাঁড়ানো ছবি কেমন রহস্যময়, শুধু মনকে টানে। মনে হয়, একে কোথায় যেন দেখেছে, সেটি স্বপ্নে নাকি কল্পনায় কে জানে! সে না করতে পারল না। বিয়ে হয়ে গেল। সে একটু একটু করে বউকে চিনতে শুরু করেছে। একটু বেশি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন,  খুঁতখুঁতে…শুচিবাই। কখনো সবকিছু ঠিক। ঠিকবেঠিকের দোলায় রানু এখনো তার কাছে অচেনা। সেকি তার অল্প বিদ্যে বলে, নাকি…।

শিহাবের চারপাশ প্রচণ্ড রকম নিঃশব্দ নিঃসঙ্গতায় ছেয়ে যায়। সে রাস্তার লোকগুলোর দিকে ভালো করে তাকায়। আলো আঁধারিতে ছায়া ছায়া চেহারাগুলো রহস্যময় মনে হতে থাকে। তার জীবনও তো এক রহস্য। প্রিয় মানুষেরা তাকে বুঝতে চায় না। নাকি সে সহজবোধ্য নয়, নিজেকে বোঝাতে পারে না।

শিহাব অনেকক্ষণ পর ঘরে ফিরে। দেখে, রানু বিছানায় অগোছালোভাবে শুয়ে আছে। কপালের উপর ডান হাতখানা তোলা। কড়িকাঠের সাথে ঝোলানো ষাট ওয়াটের বাল্ব মিটমিট করে আলো দিচ্ছে। ওটার পাশে দুটো বড় সাইজের টিকটিকি মৈথুনরত। শীৎকারের সাথে সাথে লেজ নাড়ছে। সে বিহ্বল দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু মনে হয় অনেক দূরে চলে গেছে। কোথায় কোন্ জগতে কে জানে! কি যে চিন্তা করছে সে, কোনো হতাশা কোনো দুঃখ? শিহাব দেখে রানু মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে খাবার সাজিয়ে রেখেছে। সে বসে পড়ে। রানুর দিকে না তাকিয়ে বলে, –

‘রানু এসো খাবে।’

‘খিদে নেই, হাসফাস লাগছে আমার।’

‘কই বলো নাই তো। আবুল ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলে?’

‘হু।”

‘কি বলল?’

‘এখন শয়তানটা নড়াচড়া করবে।’

‘ওভাবে বলছ কেন?’

‘কেন মায়া লাগছে!’

কথাটি বলে রানু এমনভাবে তাকায় যে শিহাবের মন থেকে আবার সকল বিষণ্নতা উবে যায়। রানু আসলেই অসম্ভব সুন্দরী, তার সাথে মানায় না। সে হাসল।

‘শয়তান না শয়তানী?’

‘যদি মেয়ে হয়, পাঁচ শ টাকা পুরস্কার।’

‘আর যদি ছেলে হয়, তাহলে?’

‘খুব আদর করব তোমাকে।

‘ষাঁড় কোথাকার!’

রানু বিছানা থেকে নেমে তার পাশে বসে। জড়িয়ে ঢলে পড়ে শিহাবের বাঁ কাঁধে। আলতো করে চুল নেড়ে দেয়। শিহাবের ভালো লাগে। সেও বাঁ হাত দিয়ে রানুর কোমর পেঁচিয়ে ধরে। অদ্ভুত মায়াময় মনে হয় জীবন। পৌষের হিমেল বাতাস দরজা দিয়ে শিরশির করে আসতে থাকে। ভেজাতে থাকে মন।

‘একটু করে খাও রানু।’

‘ভালো লাগছে না তো।’

‘এসো আমি সামান্য একটু খাইয়ে দিই।’

‘হু! আবার শুরু হলো। আচ্ছা সামান্য একটু দাও।’
মাঝরাতে শিহাবের ঘুম ভেঙ্গে যায়। কেউ কলতলায় গোসল করছে। পাশে হাত বাড়িয়ে বোঝে, রানু নেই। সেই গোসল করছে। সে বিছানায় উঠে বসে। বেডলাইট অন করে সিগারেটের প্যাকেট খোঁজে। সেসময় রানু ঘরে ঢোকে। স্নান শুভ্র নারীকে সুন্দর দেখায়। রানুকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। বুকের উপর পেটিকোট বাঁধা। ঘরের স্বল্প মৃদু আলোতে তার গ্রীবা চকচক করছে। শিহাব আনমনা হয়ে যায়। হাতে ধরা সিগারেট আর জ্বালান হয় না। সব যেন আর একবার কামনা বধির করে তোলে তাকে। রানু ম্যাক্সি হাতে নিয়ে পেটিকোটের ফিতে খুলে ছেড়ে দেয়। স্ফীত পেটের ভাঁজে এসে সেটা আটকে যায়। পুরুষ্ট আর ভারী হয়ে উঠেছে বুক। হ্রদের মতো গভীর নাভিমূল উঁচু হয়ে উঠেছে। সম্মোহিত শিহাব দেখতে থাকে। রানু দুষ্টুমির চোখে তাকায়।

‘বুঝলে কেমন লাগছিল তাই…।’

‘তাই বলে এই ঠাণ্ডায় রাত দুটোয় কেউ গোসল করে! ক্ষতি করবে না?’

‘কি ক্ষতি? তুমি না আসলে বেশি বেশি ভয় করো।’

‘ভয় কি সাধে করি! হয়তো অজানা অনেক পূণ্যে তোমাকে পেয়েছি রানু।’

‘কেন আমি কি মরে যাব?’

‘এমন কথা বলো না তো!’

‘বলব না।’

রানু এগিয়ে এসে শিহাবের গালে চুক করে চুমু খায়। তার চুল থেকে গড়িয়ে পড়া পানি শিহাবকে ভালবেসে স্পর্শ করে। এখন কি রানুর গা ঘিনঘিন করা অনুভূতিটা হচ্ছে না? আঁশটে গন্ধ নাকে লাগছে না? অথচ রাতে মরা মাছের মতো শুয়ে থাকল। নিজেকে তখন এক নির্বোধ অথচ বন্য পশু মনে হচ্ছিল শিহাবের। না, এভাবে কিছু হয় না। শুধু শুধু…অর্থহীন। তারপর সে অনেকক্ষণ জেগে থাকে। রানু ঘুমিয়ে গেছে। তার ছন্দোবদ্ধ নিঃশ্বাসের ভেতরেও নিজেকে একজন স্বার্থপর আর কামার্ত পশু মনে হতে থাকে শিহাবের। এমন ভরা অবস্থায় এসব ঠিক নয়। কিন্তু কি করে যে কি হয়ে গেল! সে আয়নায় তাকিয়ে নিজের ছায়া দেখে কেঁপে উঠে। সে কি ষাঁড়ের মতোই! ভ্রু কুঞ্চিত হয় আর বুক থেকে এক বড় শ্বাস বের হয়ে আসে। সেটি ঘৃণায় না আত্মদহনের হতাশায় কে জানে!

রানু ম্যাক্সি রেখে দিয়ে শাড়ি বের করে। সুন্দর করে ভাঁজ করে করে সেটি পরে। এতরাতে এভাবে শাড়ি পরার কোনো অর্থ নেই। কিন্তু শিহাব কিছু বলে না। রানু তোয়ালে পেঁচিয়ে বার কয়েক চুল ঝাড়ে। তারপর বিছানায় উঠতে উঠতে বলে, –

‘তুমি আমাকে খুব ভালবাস তাই না?’

‘এতদিনে বুঝলে?’

‘বুঝি বুঝি…আজকের তারিখে তোমার আমার বিয়ে হয়েছিল, মনে আছে?’

‘আজ কি সতেরোই পৌষ?’

রানু মৃদু হাসে। শিহাব আর কিছু বলে না। আধখাওয়া সিগারেট মুচড়ে দেয় মেঝেতে। দুচোখ বন্ধ করে ভাবে। এখন রানু একটু দূরে শোবে। কিছুতেই তার স্পর্শ নেবে না। অথচ এসবে কোনোকিছু হয় না। ভাবনা জট পাকাতে শুরু করে। সে ভাবতেও চায় না। অনেক ভেবেছে। সব দোষ তার। সেবার ইউনিটগুলোতে যাবার আগে রানুর কথা ভেবে বাসায় এসেছিল। হঠাৎ অকারণ মন উন্মন হয়ে গিয়েছিল তার। ফাল্গুন মাসের উদাস বাতাসে মন কেন জানি এমন হয়ে যায়। এক অলীক শূন্যতা…খা খা করা অনুভূতি। তখন রানু বারান্দায় বসে গল্পের বই পড়ছিল। তার হাতে বড় ফ্লাক্স দেখে জিজ্ঞেস করে, –

‘কি আছে এতে, ভ্যাকসিন?’

‘ওসব কিছু না, তাড়াতাড়ি ভাত দাও তো…ঘোড়াঘাট পর্যন্ত যেতে হবে।’

রানু দ্রুত ভাত বাড়ে। বাঁধাকপির ভাজি আর মসুরের ডাল। এসময় কপি খেতে ভালো লাগে না। বাজারে তাই নামমাত্র দামে বিকোয়। লোকে কেনে, গরুকে খাওয়ায়। তার বেতন অল্প, পনেরো দিনও চলে না। তাই গরু হয়ে খেতে হয়। সে সবদিন মাছ মাংস কিনতে পারে না। দু তিনটি তরকারির আইটেম করার সাধ্যও নেই। এ নিয়ে মাঝে মধ্যে মনের মাঝে ছোট্ট ক্ষোভ জমলেও সেটি নিজের জন্য নয়, রানুর জন্য…বেচারা, তাকে ঠিকমতো খাওয়াতে পারে না। সে ছোট করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এ সমাজে যারা বেশি কাজ করে তাদের আয় কম আর যারা কম কাজ করে কিংবা করে না তাদের অর্থের অভাব নেই। এই আজব নিয়মই আজ চূড়ান্ত সত্য। ক্ষুধা লেগেছিল। সে অনেক খেয়ে ফেলে। শেষে ঢেঁকুর তুলে বলে, –

‘এখন যেতে ইচ্ছে করছে না। বেলা দুটো, কিন্তু কি করা…যেতে হবে। তুমি দরজা ভালো করে লাগিয়ে দিও। ফিরতে রাত হয়ে যেতে পারে।’

‘এসব কি?’

রানুর কৌতূহল ফ্লাক্সে। শিহাবের কানে প্রশ্ন গেছে কি না কে জানে। সে একটু তাড়াহুড়ো করে। রানু কাছে এসে ফ্লাক্সটি হাতে ধরে। চোখের ইশারায় আবার জিজ্ঞেস করে। অগত্যা শিহাব বলে, কৃত্রিম উপায়ে গাভী প্রজননের কথা। ফ্লাক্সটিতে রয়েছে সেই কাজের জন্য প্রয়োজনীয় বীজ। ছোট ছোট শিশিতে রাখা সেই বীজ পলিথিন ব্যাগে পোটলা করে বাঁধা। এগুলো বড় আকারে রাখতে হয় লিকুইড নাইট্রোজেনে। কিন্তু এখানে সে ব্যবস্থা নেই। আইসকিউবে যতটুকু সম্ভব সংরক্ষণের চেষ্টা চলে। অবশ্য এতে ফার্টিলিটি রেট কমে যায়।

সে খুব সংক্ষেপে কথাগুলো বলে চোখ দুটো দুষ্টুমিতে ভরে রানুর দিকে অদ্ভুতভাবে তাকায়। ফ্লাক্স খুলে পোটলা বের করে তার চোখের সামনে তুলে ধরে। প্রতিটি শিশি গলা অবধি পাঁশুটে রঙের তরল পদার্থে ভরা। রানু আঁতকে উঠে পিছিয়ে যায় দুহাত। চিৎকার করে উঠে, –

‘ইমা কি জঘন্য! তুমি এসব বয়ে বেড়াও।’

কেন এমন হলো। শিহাব ভাবনার সাথে সাথে বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে যায়। সে শুধু ‘রানু-রানু কি হলো তোমার?’ উচ্চারণ করে এগিয়ে যায়। রানু আরও পেছনে সরে গিয়ে আবার চিৎকার করে, –

‘ছোঁবেনা তুমি আমাকে খবরদার।’

‘আশ্চর্য কি হলো তোমার?’

‘তুমি এসব নোংরা জিনিস বয়ে বেড়াও। বাসায় এনেছো। উহ্ মাগো আমি মরে যাব।’

‘না না আমি এসব বয়ে বেড়াই না। রেজিষ্টার মেইনটেইন করি। রানু তুমি বিশ্বাস করো। আজ শফিজুল নেই বাধ্য হয়ে আমাকে নিয়ে যেতে হচ্ছে। তুমি এমন করছ কেন? এটা তো স্বাভাবিক ব্যাপার। তোমার কি হলো আবার?’

‘কিছু হয় নি, তুমি যাও, যাও তো।

যখন শিহাব রাস্তায় নেমে রিক্সা ডাকে তখন কলতলায় জোরে বালতি রাখার শব্দ শোনে। রানু আবার গোসল করতে গেল। ফ্লাক্স ধরেছিল বলে? কিন্তু এতে ঘৃণার কি আছে? শিহাব কোনো যুক্তি বের করতে পারে না। তার মাথায় শুধু অর্থহীন ভাবনা কিলবিল করে। বাসায় যাওয়া ঠিক হয় নি। বাসস্ট্যান্ডের কোনো রেস্তোরাঁতে খেয়ে রওয়ানা দিলে কোনো সমস্যা হতো না। অবশ্য পরে রানু যে শুচিবাই রোগে আক্রান্ত হবে কে জানত! মানসিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। রানুকে বলেছিল, এসময় মেডিকেল চেক আপ দরকার। ডাক্তার জানায়, কনসিভ করলে কোনো কোনো মেয়ের নানারকম মেন্টাল ডিসঅর্ডার হয়, পরে সেরে যাবে। এতে ভয়ের কিছু নেই। মনে হয়, কথাটি সত্য। কিন্তু এখন তাকেও সংক্রমিত করেছে রোগ। কেন? জঘন্য কাজ?

শিহাব দূরত্ব রেখেই ঘুমোয়। ভোর রাতে ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখে। গোঁ গোঁ করে কিছুক্ষণ। তারপর কে যেন জোরসে এক ঝাঁকুনি দিয়ে তাকে জাগিয়ে দেয়। সে চোখ মেলে চারপাশে তাকায়। দেখে কেউ নেই। রানু কিচেনে গেছে। চায়ের উন্মাতাল সৌরভ ভেসে আসছে। সে দুচোখ বুঁজে দুঃস্বপ্নের ছবি ভাবতে চেষ্টা করে। কিন্তু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়। সে এক শিরশিরে ভয়ের অনুভূতিতে ঘেমে উঠে।

ফ্লাক্স হাতে নিতেই কেমন অদ্ভুত উপলব্ধি হয় শিহাবের। আজ ইউনিটগুলোয় যাবার প্রোগ্রাম। সে রানুকে মিথ্যে বলেছিল, রেজিষ্টার সংরক্ষণ নয়, স্টক দেখা, ফ্রিজ পরিস্কার করা আর ইউনিটগুলোয় এ্যম্পুল পৌঁছে দেয়ার কাজও তাকে করতে হয়। ফিল্ডে গেলে একটু বাড়তি পয়সা। তাকে বাসে যেতে হয়। বাসভাড়া, লাঞ্চ ও পকেটমানি মিলিয়ে একটা ভালো পারডিয়াম জোটে। টাকার দরকার। সে এ কাজের জন্য এক নিজস্ব টেকনিক বেছে নিয়েছে, বাসের ডানদিকে জানালার ধারে বসে থাকা। তাকে আর কষ্ট করে নামতে হয় না। বাস স্টপেজে ইউনিট অফিসের লোক আসে। সে দ্রুত ফ্লাক্স খুলে হিসেব মতো পলিথিনের প্যাকেট তার হাতে তুলে দেয়। নির্দিষ্ট লোক ওগুলো তার ফ্লাক্সে নিয়ে চলে যায়।

আজ সে খুব মনোযোগের সাথে যাবার প্রস্তুতি নেয়। পলিথিন প্যাকেটের মধ্যে রাখা শিশিগুলো গুণেগুণে ডিসপ্যাচ এন্ট্রি করে। কাজটি করতে তার ভেতরে ঘৃণার উদ্গিরণ হয়। না এ কাজ আর করা যাবে না। বসকে বলে দেখবে অন্য কাজের বিষয়ে। সেই ভাবনা নিমনগর-বালুবাড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে অনুরণিত হতে শুরু করল। সে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বাইরের সবুজ দৃশ্যাবলী গাছ ইরিক্ষেত দোকানপাট মানুষজন ইত্যাদি দেখে ভুলতে চাইল। কিন্তু তা হলো না। মনকে প্রবোধ দেয়া যায় না। খুব শক্ত কাজ।

বাস লক্ষীতলা পৌঁছুলে অকস্মাৎ মনে পড়ে যায় দুঃস্বপ্নে দেখা ছবি। শিহাব হাতেপাইয়ে চমকে উঠে। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক অস্থিরতা গড়াগড়ি করে। গলা শুকিয়ে দুহাত থিরথির কাঁপতে থাকে। নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। তবু ফ্লাক্সের মুখ খুলে কয়েকটি পলিথিন প্যাকেট বের করে। সেগুলো আবার আইসকিউবের বড় পলিথিনে জড়িয়ে দেয়। কিন্তু ঠিক মতো হয় না। বাসের জানালার কাছে এগিয়ে আসা জব্বারের দিকে তাকায়। প্যাকেটটি দেয়ার জন্য হাত বাড়ায়। কিন্তু পরক্ষণে ইউনিট তিনের পরিচিত লোকটিকে অচেনা মনে হতে থাকে। চেনা অচেনার দ্বন্দ্বে মাথা গুলিয়ে যায়। ঝাপসা লাগে সবকিছু। সে হাত গুটিয়ে নেয়। কিছুক্ষণ চোখ বুঁজে থাকে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়, আজ আর যাবে না। বাস থেকে নেমে পড়ে। জব্বারের দিকে সেই ধূসর নীল ফ্লাক্স এগিয়ে ধরে।

‘জব্বার ভাই, শরীরটা হঠাৎ খারাব করে উঠল। আজকে আপনি একটু কষ্ট করে পৌঁছে দিন।’

‘হঠাৎ শরীর খারাব, রাস্তায় কোনোকিছু খেয়েছেন নাকি? দিনকাল ভালো না, কেউ কিছু…। নাকি প্রেশার?’

‘না ভাই কেউ কিছু দিলে আমি খাই না। প্রেশার হলেও হতে পারে। ভালোই ছিলাম হঠাৎ মাথা কেমন কেমন করছে।’

‘অফিসে চলেন, একটু রেস্ট নেবেন।’

‘না আমি শহরে চলে যাই। বাসায় গিয়ে রেস্ট নেব। অসুবিধা নেই, স্যারকে মোবাইল করে দেব। আপনি যান।’

ফেরত বাসে কিছু দূর এগিয়ে আসতে শিহাবের ছটফট বেশি হয়ে গেল। কপালে বিন্দু বিন্দু স্বেদ জমে উঠে। দপ দপ করতে শুরু করে তার দু পাশ। মাথা ঝিমঝিম করে। তার ভেতর দুঃস্বপ্নের দৃশ্য উজ্জ্বল আর বর্ণিল হয়ে ভেসে উঠে। অথচ স্বপ্ন বেশিরভাগই সাদাকালো। সে অজানা আতঙ্কে আর দুর্ভাবনায় চোখ বন্ধ করে সীটে ঝুলে পড়ে প্রায়। আর তখনই ভেসে উঠে এক বীভৎস মুখ। এক নবজাতক কিন্তু মুখ বাছুরের মতো। স্বপ্নে কে যেন বলে উঠে, শিহাব সাহেব, আপনার স্ত্রী একটি অদ্ভুত দর্শন শিশুর জন্ম দিয়েছে। শরীর মানুষের কিন্তু মাথাটি গরুর। এঁড়ে বাছুর…ষাঁড়…ষাঁড়। কথাটি কানে বাজতে থাকে। ষাঁড়…ষাঁড়। ধীরে ধীরে সেই শব্দ ক্ষ্যাপানোর মতো চিৎকারে রূপান্তরিত হতে থাকে। কানে বাজতে থাকে। ষাঁড়…ষাঁড়…ষাঁড়! সেই চিৎকার বদলে যায় অট্টহাসিতে আর দিগন্ত বিস্তৃত করে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে শুরু করে। আকাশ কাঁপতে থাকে।

সে ছুটে যায় হাসপাতালের সরু করিডোর দিয়ে। এ পথ যেন ফুরোয় না। করিডোর ক্রমশ প্রলম্বিত হতে থাকে। সে দৌড়ুতে পারে না। মনে হয় কে যেন তার পা দুটো চেপে ধরে রেখেছে। অসম্ভব ভারী হয়ে গেছে। তারপরও কিভাবে সে রানুর বেডে পৌঁছে গেছে। তখন রানু নবজাতককে কোলে নিয়ে অদ্ভুত আর ভয়ঙ্কর চেহারার হয়ে যায়। তার কোলে থাকা শিশুর মুখ এঁড়ে বাছুরের মতো…নিষ্পাপ বড় চোখ মেলে তাকে দেখছে। রানুর বীভৎস মুখ থেকে বের হয়ে আসে চিৎকার, তুমি, তুমি একটা ষাঁড়। তুমি ষাঁড়ের বীজ বয়ে বেড়াও। তুমি একটা ষাঁড়…একটা ষাঁড়। হঠাৎ সে দৃশ্যের মাঝে বেডের পাশে বড় একটি টেবিল গজিয়ে উঠে। তার উপর এক ধূসর-নীল ফ্লাক্স। সেটি একাকী টেবিলের উপর রাখা। ওটার গায়ে বড় অক্ষরের লেবেল আঁটা, সেটি পড়া যায় না। সে গভীরভাবে খোঁজার চেষ্টা করে, ওতে কি লেখা আছে। লেখাটি কি ‘উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীজ’? তার চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসে।

শিহাবের মাথা বাসের সীটে আস্তে ঢলে পড়ে।*

(গল্পটি সাপ্তাহিক ২০০০ (নববর্ষ সংখ্যা ১৪১৮) এপ্রিল ২০১১-এ প্রকাশিত।)

Facebook Comments

2 Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top