স্মরণ: চেতনাতে নজরুল…

হাসিব নেওয়াজ

‘ভোর হলো দোর খোল, খুকুমনি ওঠোরে…’ এই লাইনগুলোর মাধ্যমে শৈশবে কাজী নজরুল ইসলামের সাথে আমাদের পরিচয়। পরবর্তীতে স্কুলের আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় ‘দেখিনু সেদিন রেলে, কুলি বলে এক বাবুসাব তারে ঠেলে দিলো নিচে ফেলে’— উচ্চারিত শব্দমালা নতুন এক পৃথিবীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। এরপর ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি বার বার পড়েছি। রণসংগীত ‘চল্ চল্ চল্, উর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’ গেয়ে স্কুলে লেফট্-রাইট করেছি। নজরুল তখন কেবলই বিদ্রোহী কবি, নজরুল মানে ঝাঁঝালো প্রতিবাদ। কিন্তু তাঁর ‘মৃত্যুক্ষুধা’ সবকিছু ওলট-পালট করে দেয়। মানুষে মানুষে ভেদাভেদের অশ্লীল চিত্রটি কিশোর চোখে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তীব্র হয় সমাজবদলের আকাঙ্খা। হাঁটতে শেখায় স্রোতের উল্টো দিকে। আরও পরে নজরুলের প্রেমিক রূপটাকে অনুভব করেছি তাঁর কবিতা ও গানে।

নজরুলের ইসলামের জন্ম ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ (২৪ মে ১৮৯৯), পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, সঙ্গীতজ্ঞ, সৈনিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিক। গ্রামোফোন কোম্পানি, বেতার, মঞ্চ ও চলচ্চিত্রের সাথেও যুক্ত ছিলেন তিনি। সাহিত্যকর্ম এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অবিভক্ত বাংলায় পরাধীনতা, সামপ্রদয়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ, মৌলবাদ এবং দেশি-বিদেশী শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। এ কারণে ইংরেজ সরকার তাঁর বই ও পত্রিকা নিষিদ্ধ করে তাঁকে কারাদণ্ড দেয়।

নজরুল তাঁর কবিতায় এমন সব বিষয় ও শব্দ ব্যবহার করেন যা আগে কখনও ব্যবহৃত হয় নি। সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক যন্ত্রণাকে কবিতায় ধারণ করায় তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। নজরুলের রাষ্ট্রীয় ধ্যান-ধারণাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিলেন তুরস্কের কামাল পাশা। সামন্ততান্ত্রিক খিলাফত বা সুলতানকে উচ্ছেদ করে কামাল পাশা তুরস্ককে একটি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত করেছিলেন। তুরস্কের সমাজজীবন থেকে কামাল পাশা যে মৌলবাদ ও পর্দাপ্রথা দূর করেছিলেন তা নজরুলকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলো। গোঁড়ামি, রক্ষণশীলতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও আচারসর্বস্বতার বিরুদ্ধে তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন।

বাংলা গজলের স্রষ্টা নজরুল। শোষণের বিরুদ্ধে মানুষকে উজ্জীবিত করতে রচনা করেছেন গণসংগীত। গান রচনা ও সুর দিয়েছেন মঞ্চ নাটক ও চলচ্চিত্রে। নজরুলের গানে বাংলা সংগীতের সকল ধারার মিলন ঘটেছে। তাঁর গান একদিকে যেমন মধ্যযুগীয় বাংলার কীর্তন ও শ্যামাসংগীত বা ঐতিহ্যবাহী লোকসংগীতকে ধারণ করেছে তেমনি রাগসংগীত, খেয়াল, ঠুংরি, টপ্পা ও গজলকে সুরের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছে। আধুনিক বাংলা গানের পাঁচ প্রধান ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন— রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রনাথ, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ ও নজরুল।

নজরুল ১৯২১ সালে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেন। তখন থেকে বাংলার দুই প্রধান কবির মধ্যে যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি নজরুকে রবীন্দ্রনাথ তার ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য উৎসর্গ করেন ( ১৯২৩)। ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে শোকাহত নজরুল রচনা করেন ‘রবিহারা’ ও ‘সালাম অস্তরবি’ কবিতা এবং ‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে’ শোকসঙ্গীত। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর বছরখানেকের মধ্যেই নজরুল অসুস্থ এবং ক্রমশ নির্বাক ও সম্বিতহারা হয়ে যান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৪ বছর কবি এই অসুস্থ-নির্বাক জীবনযাপন করেছেন।

১৯৭৪ সালের ২৪ মে কবিকে সপরিবারে বাংলাদেশে আনা হয়। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট (১২ ভাদ্র ১৩৮৩) ঢাকার পিজি হাসাপাতালে কবি মারা যান। তাঁর গান বাংলাদেশের রণসংগীত। তিনি আমাদের জাতীয় কবি ।

আজ চারিদিকে মেরুদণ্ডহীন মানুষের ভিড়ে একজন নজরুলকে আমরা খুঁজে বেড়াই। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে তাই এ শ্রদ্ধাঞ্জলি।

 

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top