আন কারসনের পাঁচটি কবিতা

অনুবাদ: আলম খোরশেদ

আন কারসান

[কবি-পরিচিতি: এই সময়ের কানাডীয় সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ও পরিচিত কবি আন  কারসনের  জন্ম ১৯৫১ সালে। একেবারেই স্বতন্ত্র ধারার অনুসারী র্কাসনের কবিতার বিষয় ও শৈলীর মধ্যে রয়েছে নিরীক্ষা ও নতুনত্বের বহিঃপ্রকাশ। তিনি তাঁর কবিতার শরীরে ও আত্মায় গদ্য, পদ্য, নাটক, আখ্যান, দর্শন এমনকি সমালোচনাসাহিত্যের নানাবিধ উপাদানকেও বেশ বুদ্ধিদীপ্তভাবে ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন সময়ে। ১৯৮৬ সালে Eros the Bittersweet  কবিতাগ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে সাহিত্যজগতে তাঁর গৌরবময় আবির্ভাব ঘটে। এরপর একে একে Short Talks  (1992), Autobiography of Red (1998), Economy of the Unlost (1999), Men in the Off Hours (2000), Decreation (2005) ইত্যাদি বিচিত্র ও বহুমাত্রিক গ্রন্থপ্রকাশের মধ্য দিয়ে বিশ্বময় তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এতটাই যে, তিনি কালক্রমে আন্তর্জাতিক সাহিত্যপরিমণ্ডলের অসংখ্য মর্যাদাবান পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। সম্প্রতি নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের জন্যও একাধিকবার তাঁর নাম প্রস্তাবিত হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে। পেশায় সাহিত্যের শিক্ষক, আন কারসন ধ্রুপদী গ্রিক সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কিছু নাটক ও কবিতাগ্রন্থ ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। বর্তমানে তিনি টরন্টো শহরে অবসর জীবন যাপন করছেন। অনূদিত কবিতাসমূহ তাঁর বহুল আলোচিত, ব্যতিক্রমধর্মী কাব্যগ্রন্থ Short Talks এর অন্তর্ভুক্ত। —আলম খোরশেদ ]

 

মোনালিসা বিষয়ে

প্রতিদিন তিনি তার মধ্যে প্রশ্নগুলো ঢেলে দিচ্ছিলেন, একটি পাত্র থেকে আরেকটি পাত্রে যেভাবে জল ঢালেন আপনি, আর সে-ও ঢেলে দিচ্ছিল পাল্টা প্রশ্ন। আমাকে বলবেন না যে, তিনি তাঁর মাকে আঁকছিলেন, কিংবা বাসনাকে, এইসব। কোনো কোনো মুহূর্ত থাকে যখন কোনো পাত্রেই জল থাকে না—কী বিপুল তৃষ্ণা ছিল তা, আর তিনি ভেবেছিলেন চিত্রপট একেবারে শূন্য হয়ে গেলেই থামবেন তিনি। কিন্তু নারীরা শক্তিমতী। তারা পাত্র চেনে, চেনে জল, আর চেনে মানবের তৃষ্ণাকে।

 

ভোগ বিষয়ে

সৌন্দর্য আমাকে হতাশ করে। এ নিয়ে আর বেশি ভাবি না, আমি শুধু পালিয়ে যেতে চাই। আমি যখন পারি শহরকে দেখি তখন পায়ের বেড় দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করে। আমি যখন তোমাকে নাচতে দেখি তখন তার মধ্যে এক হৃদয়হীন তীব্রতা দেখি, শান্ত, মৃতপ্রায় সমুদ্রের মধ্যে নাবিক যেমন। রাতভর আমার মধ্যে সুগোল পিচফলের মতো বাসনার জন্ম হয়। ঝরে-পড়াদের আমি কুড়িয়ে নিই না আর।

 

বৃষ্টি বিষয়ে

জলপাইয়ের চেয়েও কালো ছিল আমার বিদায়ের রাত্রি। খুব অদ্ভুত এক আনন্দ নিয়ে আমি যখন প্রাসাদগুলোকে অতিক্রম করে যাচ্ছিলাম, ঠিক তক্ষুনি বৃষ্টি নামল। কী দারুণ এক বিষয়ই না ছিল সেটা—এই ছোট ছোট আকারগুলো। তাদের গুনতে গুনতে হারিয়ে যাচ্ছিলাম আমি। এর কথা প্রথম কে ভেবেছিলেন? অন্যদের কাছে এটাকে তিনি ঠিক কীভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন? সমুদ্রের মধ্যেও বৃষ্টি ঝরছিল। কোনো মানুষের গায়ে নয়।

 

আশ্রয় বিষয়ে

মাছের হৃৎপিণ্ড দিয়ে আপনি দেয়ালে লিখতে পারেন, এর কারণ ফসফরাস। তারা সেটা খায়। নদীর কিনার ধরে খানিক দূরে সেরকম কিছু কুটির রয়েছে। আমি এটা লিখছি আপনার চোখে যতটা সম্ভব ভুলভাবে। যাবার সময় দরজাটা পাল্টে দিও, লেখাটা বলে। এখন আপনিই বলুন কতটা ভুল সেটা, কতদূর অব্দি তা জ্বলজ্বল করে। বলুন আমাকে।

 

শার্লট বিষয়ে

মিস ব্রন্টি ও মিস এমিলি ও মিস আন, এই তিনজনে মিলে, প্রার্থনার পর সেলাই বন্ধ করে, বসবার ঘরের টেবিলের চারপাশে, একের পেছনে আরেকজন, ক্রমাগত হাঁটতে থাকতেন রাত প্রায় এগারোটা অব্দি। মিস এমিলি যতদিন পেরেছেন হেঁটেছেন, তাঁর মৃত্যুর পর মিস আন ও মিস ব্রন্টি সেটা চালিয়ে গেছেন— আর এখন আমার হৃদয় ব্যথায় ভরে ওঠে মিস ব্রন্টির একা একা হেঁটে যাওয়ার শব্দ শুনে।

 

আলম খোরশেদ

প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক আলম খোরশেদের জন্ম ১৯৬০ সালে কুমিল্লায়। পেশায় প্রকৌশলী আলম খোরশেদ প্রবাসে উচ্চশিক্ষা ও দীর্ঘ পেশাজীবনশেষে স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে আসেন ২০০৪ সালে। ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি সাহিত্যচর্চা ও নানাবিধ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। শিল্পসাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় সমান উৎসাহী, তাঁর প্রধান আগ্রহের বিষয় অবশ্য সমকালীন বিশ্বসাহিত্য। তাঁর সম্পাদিত লাতিন আমেরিকান ছোটোগল্প সংকলন জাদুবাস্তবতার গাথা আমাদের অনুবাদ সাহিত্যের একটি পথপ্রদর্শক কাজ।

সম্পাদনা, অনুবাদ ও মৌলিক রচনা মিলিয়ে তিনি এ-পর্যন্ত প্রায় কুড়িটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকীর্তির মধ্যে রয়েছে নোবেল-বিজয়ী কবি ভিস্লাভা শিম্বর্স্কার ‘ত্রিশটি কবিতার অনুবাদ’, বাংলাদেশের নারীবাদী গল্প-সংকলন ‘কাটা জিহ্বার কথা’, মূল স্প্যানিশ ভাষা থেকে অনূদিত ‘বোর্হেস ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর আলাপচারিতা’, ভার্জিনিয়া উলফ্-এর অ্যা রুম অভ ওযানস্ অউন-এর অনুবাদ ’নিজের একটি কামরা’, হেনরি মিলার-এর রিফ্লেকশনস্-এর অনুবাদ ’ভাবনাগুচ্ছ’ ইত্যাদি।

বর্তমানে তিনি মননশীল লেখালেখি ও অনুবাদকর্মের পাশাপাশি চট্টগ্রাম শহরে তাঁর নিজের গড়া সংস্কৃতিকেন্দ্র বিস্তার পরিচালনার কাজে সার্বক্ষণিকভাবে ব্যাপৃত রয়েছেন।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top