চঞ্চল শাহরিয়ারের একগুচ্ছ কবিতা

মায়া

অন্দরমহলে ঢোকার আগে কতো কিছু দেখে নিতে হয়।
নদী পাড়ের মানুষ, অসহায় বেদেনীর মুখ, সাহেব বাড়ির
গেট, নির্জনতা থেকে বাঁচবার জন্য যাত্রাদলের নায়িকার
আঁচল ধরে কেঁদে ফেলা।

অবসরে যাইনি কখনো। অন্দরমহলে ঢোকার আগে তাই
মন ভরে দেখে নিই দূরের আকাশ, শীতের রোদ্দুর,
অদিতির বাঁধাভাঙা হাসি, সিংহদরোজায় কারুকাজ করা
ময়ূরের নাচ, খেয়ালী সংঘের নাটকের রিহার্সেল।

অন্দরমহলে কে অপেক্ষা কবে? কাজীদের মেয়ে? শীর্ষেন্দু
মুখ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস? গরম কফির ঘ্রাণ? রুদ্র ভাই?
রুদ্র ভাই?

কোন কিছুু বুঝে ওঠার আগেই আছরের আজান দেয়
মসজিদে মসজিদে। অন্দরমহলে ছলাৎ ছলাৎ করে
শৈশবের সাহীহারা ঢেউ।

 

রাজকন্যা

কী যে ভালোবাসি মেয়ে, কী যে ভালোবাসি। তুমি তা বোঝো
না বোঝো না। বোঝো না বলে আবার হলুদ দোতলা বাড়ি নিয়ে
কবিতা লিখছি। ছাইরঙা জানালায় মিশে যাওয়া তোমার লজ্জা,
আলো নিভিয়ে দেবার পর আরো আলোকিত ঘরের রহস্য আমাকে
গোলকবাঁধায় ফেলে। তুমি চুল বাঁধতে বাঁধতে আমার বোকামো
দেখে হেসে কুটিকুটি।

ময়ূরের পেখম ছুঁয়েছি কবে, কবে দেখেছি হরিণের ছুটো চলা, জলপাই
আচার কেনার কথা কেন ভুলে গেছি, শাড়ি কেনার সময় আমি কেন
ষোল আনা এইসব খুনসুটিমাখা সুখ তুমি সেফটিপিনের মাঝামাঝি
লুকিয়ে রেখেছো।

শৈত্যপ্রবাহের রাতে উষ্ণতা পাবার জন্য তোমার নামটা উচ্চারণ
করি। হলুদ দোতলা বাড়ি, কুয়াশায় ভেজা লাইটপোস্টের নির্জনতা,
পিচঢালা পথ, হা¯œুহানা ফুলের গন্ধ, সিঁড়িতে কারো পায়ের শব্দ
আমাকে মাতাল করে দেয়।

কী যে ভালোবাসি মেয়ে, কী যে ভালোবাসি। তুমি তা বোঝো না
বোঝো না। তবু অহর্নিশি তোমার বন্দনা পুনর্জন্ম দেয়। ফুরফুরে
থাকে মন। মনে হয় এই বুঝি তুমি জেনে গেলে আমার বেদনা…।

 

চিটাগাং

আমি মোবাইল ফোন বন্ধ করে চার্জ দিলে তুমি খুব টেনশন
করো। কক্সবাজার থেকে ফিরতে কখনো দেরি হলে আগ্রাবাদ
থেকে চলে আসো চিটাগাং ক্লাব। আমার খোঁজ না পাওয়া
পর্যন্ত তোমার অস্থিরতা কমে না, কমে না।

আমি যেই চেরাগী পাহাড় মোড়ে ঢুকি, আমি যেই কাজীর
দেউড়ী এসে কবুতর ওড়ানোর গল্প বলি, ফ’য়স লেকের
ভোরবেলা আর আসকার দিঘির পাড়ের মিষ্টি নির্জনতা নিয়ে
কথা বলি তুমি তখন খুশিতে মাতোয়ারা।

আমার সাথে সেলফি তুলতে তুলতে বলো-পাগলা, এ
চিটাগাং শহর তো তোমারও। তুমি সারাক্ষণ চিটাগাং থাকতে
পারো না? আমার চোখের সামনে থাকতে পারো না।?

তোমার মধুর ইচ্ছায় গা ভাসিয়ে কখনো সখনো।
টেকনাফ, রাঙ্গামাটি, বান্দরবানের উজ্জ্বলতা চোখেমুখে মাখি।
আর তখন বাতিঘরের বারান্দা ভালোবাসা দিবসের উৎসব নিয়ে
দারুণ আড্ডা জমায়।

 

বুদ্ধদেব গুহ

আপনার লেখা পড়ে যে কেউ ভাববে আপনি বন বিভাগের
অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী। কিন্তু আপনি তো ছিলেন রসকষহীন
ব্যস্ত চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যাণ্ট। ছিলেন দারুণ প্রকৃতি-প্রেমিক।

আপনার ঠোঁটে রাখা পাইপের ধোঁয়া, তামাকের জন্য
আপনার ব্যস্ততা দেখার সৌভাগ্য যাদের হয়েছে তারা
ভাবতেই পারবেন না এই আপনার হাত দিয়েই লেখা
হয়েছে একটু উষ্ণতার জন্য উপন্যাস। এই আপনার হাত
দিয়েই লেখা হয়েছে সবিনয় নিবেদন, কোয়েলের কাছে,
বাবলী, মধুকরী আর মউলির রাত।

আপনি আমাকে প্রকৃতিপাঠের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন কত
কত বার। আপনার জন্যই রোমান্টিক উপন্যাস লিখতে
আমি কখনো পিছপা হইনি। সেই আপনার ¯েœহের হাতটা
আজ মাথার ওপর থেকে সরে গেল দাদা।

ভ্রমণবিলাসী এই আমি সারাক্ষণ কেঁদে কেঁদে মরি।
নারীপ্রেমে বুঁদ হয়ে থাকা এই আমি আজ বড় অসহায়।
কার কাছে চিঠি লিখি? কাকে বলি, এই নাও মুঠো মুঠো
রোদ…।

শূন্যতায় ছেয়ে গেছে আমার বসন্তের দিন।

 

বেদনা বোঝার আগে

বেদনা বোঝার আগে তোমাকে বুঝতে চেয়েছি মেয়ে। তুমি
যদি ফরেষ্ট ঘাটের কাছে ডাক দাও ফের। যদি বলো ভালোবাসি।
যদি বলো জীবন রাঙাতে এসো সাউথ সেন্ট্রাল রোডে। যদি বলো
বাবু খান রোডের বৃষ্টির দুপুর নিয়ে ফিরে আসো ক্যাম্পাসের কৃষ্ণ।

আমি তাই রেডি থাকি। খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস নেই।
তবু ভোরবেলা উঠি রোজ। যদি তুমি ডেকে ডেকে ফিরে যাও।
যদি বলো কলাপাতা রঙের মটর সাইকেল নিয়ে দাঁড়িও যুবক
রয়েলের মোড়ে। আমি তাই দোলখোলা মোড়, সিমেট্রি রোডের
আড্ডা পেরিয়ে পকেটে গুজেছি লার গোলাপের ঘ্রাণ।

প্রিয় শহরের দোতালার বারান্দায় নীল শাড়ি পরা কাউকে
দেখলে ভাবি তুমি শুধু তুমি। রিক্সায় বেড়াতে যাওয়া মেয়েদের
উচ্ছলতা দেখে ভাবি তোমার তুমুল সান্নিধ্য। ভালোবাসি মেয়ে।
খুব ভালোবাসি। বেদনা বোঝার আগে তাই তোমাকে বুঝতে চেয়েছি।

আড়ংয়ের দুমদাম শার্ট পরে অপেক্ষায় আছি শিববাড়ি মোড়।

 

চঞ্চল শাহরিয়ার

বাংলাদেশের সাহিত্য ভূবনে এক সুপরিচিত নাম। শৈশব থেকেই লিখছেন। প্রেম ও প্রকৃতি তার প্রিয় বিষয়। দেশের সব জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকায় নিয়মিত লিখছেন গল্প, কবিতা ও উপন্যাস, শিশুসাহিত্যেও তিনি সমান পারদর্শী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ (অনার্স) সহ এম.এ (ইতিহাস) করেছেন।

কর্মজীবনে সাংবাদিকতা, অধ্যাপনা, এনজিও কর্মকর্তা হিসেবে যুক্ত হয়েছেন। চঞ্চল শাহরিয়ারের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২৬। সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য পেয়েছেন কোটচাঁদপুর প্রেসক্লাব পুরষ্কার (১৯৯৯), খুলনা মোহনা সাহিত্য সংসদ পুরষ্কার (২০০৩), মৌচাকে ঢিল সম্মাননা (২০১০), কিংশুক সম্মাননা (২০১৮), মহেশপুর সাহিত্য পরিষদ সম্মাননা (২০১৯)।

বাংলা একাডেমির সদস্য চঞ্চল শাহরিয়ারের জন্ম ৯ মার্চ ১৯৬৬।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top