ছোটগল্প: এক্সকিউজ মি স্যার আমার নাম সাজ্জাদ

আনোয়ার সাদী

এক্সকিউজ মি, আমার নাম সাজ্জাদ স্যার। একটা লেটেষ্ট এডিশন বই এনেছি। এটা ভালো।

ছেলেটি ছিপছিপে, ভেসে থাকা চোয়ালে সামর্থ্যের ছাপ ষ্পস্ট। তার হাসিমাখা মুখে তাকিয়ে বিব্রত রফিক। কেননা তার চোখ চিক চিক করছে অপ্রকাশিত কান্নায়। ভেতরটা কাঁপছে অজানা এক আশঙ্কায় । হাসপাতলের কৃত্রিম আলো তার চোখ থেকে মুছে দিতে পারছে না এই শঙ্কা।

বউ হাসপাতলে ভর্তি এটাই রফিকের শঙ্কার কারণ নয়। যে কোন মুহূর্তে একটা কিছু হতে পারে এটাই তার ভয়ের কারণও নয়। তার ভয়ের উৎস একটি আর্ত চিৎকার। তার রেশ এখনও কানে লেগে আছে রফিকের।

– আল্লাহরে আমারে নিতারে …বাবুটা কেন নিলারে…

না, হাসপাতাল কাঁপেনি এই বাক্যে। কিংবা কোন পরিবর্তন আসেনি সাদা এপ্রনের নার্সদের অভিব্যক্তিতেও। কেবল রফিকের বুকের ভেতরটা খালি করে গেছে এই চিৎকার। চিৎকারে নয়,উচ্চারণের তীব্রতায় হেলে গেছে তার জগত। আর তখন সামনে আসে ছেলেটি। বলে, স্যার আমার নাম সাজ্জাদ। একটা লেটেষ্ট এডিশন বই এনেছি। এটা ভালো। এটা ঘরে থাকলে ইংরেজিতে আর ভুল হবার সুযোগ নেই।

কী জবাব দেয় রফিক?

কেবল মাথা নেড়ে নেতিবাচক মনোভাব জানিয়ে দেয় সে। তাতে কোন বিকার নেই সাজ্জাদের। কোন জবরদস্তি নেই তার। সে যায় আরেকজনের কাছে।

– স্যার, আই এম সাজ্জাদ। আমাকে চিনেছেন। আই হ্যাভ এ বুক ফর সেল।
– দিজ ইস নট দ্য প্রোপার প্লেস ফর মার্কেটিং এ বুক।
– উল্টো ঘুরে যুবক। বলে, এভরি হোয়্যার ইজ দি রাইট প্লেস ফর সেলিং এ বুক লাইক দিস।

পেছনে হতবিহ্বল মধ্যবয়সি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে সাজ্জাদের দিকে। লিফট থামে। ভদ্রলোককে ধাক্কা দিয়ে নেমে যায় এক তরুণী, পেছনে তার পুরুষ। স্বামী হবে। শব্দ করে লিফট ছেড়ে যায় নিচে। তাতে সেই অবাক ভদ্রলোক্।

সাজ্জাদ যায় নার্সদের কাউান্টারে, বলে ডাক্তার স্যার কোথায় বসে?

ওই দিকে। আঙুল উঠে। পরিবর্তন আসে না তাদের চেহারায়।

– মে আই কাম ইন। সাজ্জাদ ঢুকে ইমার্জেন্সি রুমে।

রফিকের চোখ আটকে যায় নার্সদের মুখে। দেখে, সেখানে কোন ভাবান্তর নেই। রোদ ঠেকিয়ে দেয়া হাসপাতালের ভারি পর্দা আর অনুভূতি ঠেকিয়ে দেয়া নার্সদের মুখের চামড়ায় পার্থক্য করতে পারে না রফিক। বিশেষ করে একজন মায়ের সন্তান হারানো আর্ত চিৎকারের পরেও।

– ওনার কি হয়েছিল?

– কার? প্রশ্নবোধক চোখে রফিকের উস্কোখুস্কো মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে নার্সরা। সংখ্যায় ওরা তিন। সাদা পোষাকে এনার্জি বাতির আলোয় দেখতে একই রকম।

– ওই, যে মহিলাকে নিয়ে গেল ওরা।

– তার বাচ্চা মারা গেছে।

– তাতো জানি আপা, কিন্তু মারা গেল ক্যামনে?

– আইসিইউতে ছিল মারা গেছে।

বিস্তারিত জানার আগ্রহ ছিল রফিকের। কিন্তু নার্সরা ফাইল ঘাটায় ব্যস্ত হয়ে গেলে আর প্রশ্ন করার সাহস হয়নি তার। কী জানি কী বলতে কী হয়। বউ যার হাসপাতালের বিছানায় ছটফট করছে নার্সকে ক্ষেপিয়ে দেয়া তার জন্য ঝুঁকির।

কিন্তু কান্নার এমন প্রকাশ কেন? গা শিরশিরে। তবে কী অন্য কিছু হলো? সুস্হ্য সন্তান রেখে গছিয়ে দিলো কী মরা বাচ্চা। এমন ঘটনাতো পড়া হয়েছে পত্রিকায়। তাইবা হবে কেন? নিজের সঙ্গে অনবরত কথা বলে রফিক। হতে পারে না? ধনি কোন পরিবার কিনে নিলো গরীবের সদ্যজাত সন্তান। বড় করলো নিজের পরিচয়ে। মাতৃত্ব পায়কি তখন? অন্যের সন্তানকে কতটুকু মানতে পারে মানুষ? কী জানি, অচেনা নারীটির জন্য অজানা মায়ায় ভরে যায় রফিকের মন।

আহা, বেচারি!

এদিক-ওদিক তাকিয়ে ফিমেল ওয়ার্ডে উকি দেয় রফিক। ওয়ার্ডের শেষ মাথায় কাঁচের জানালার পাশে নারীটির শয্যা পাতা। তার পেছনে দেখা যাচ্ছে আকাশ। না, নীল নয়। শহুরে ধুলায় ঢেকে থাকা কাঁচে ধূসর আকাশ। এখন আর চিৎকার নেই তার। কাঁদছে অঝোর ধারায়। পাশে বসে থাকা লোকটা কী তার স্বামী? অনুমান করতে পারে না রফিক। সান্ত্বনা দিচ্ছে সেই পুরুষ। এই পরিস্থিতিতে সান্ত্বনার ভাষা কী হতে পারে? জানা নেই রফিকের। তবে স্বামী হলে সান্ত্বনা দেয়া অনেক কঠিন। \

– রোগী আছে ভিতরে?

চমকে উঠে রফিক। তাকায় ইউনিফর্ম পড়া নারীর দিকে। কৃত্রিম ক্রুরতা চেহারায়। হাসপাতালের সিকিউরিটি।

– না।

– তাইলে মহিলা ওয়ার্ডে ঘুর ঘুর করেন ক্যান? এইবার তার বাঁজখাই গলা।

সাপের লেজে পা দেখার মতো দ্রুততায় সরে আসে রফিক। লজ্জায় কান লাল হয় তার। তাইতো তার কি কাজ?

ছি ছি, বউ শুনলে কি ভাববে?

দ্রুত সরতে গিয়ে সাজ্জাদের সঙ্গে ধাক্কা খায় রফিক। সেও ছিটকে বের হয়ে এসেছে ডাক্তারদের ঘর থেকে। ডাক্তাররা কি তাকেও বের করে দিয়েছে। নাকি বই বিক্রি করতে পারলো দুয়েকটা। প্রশ্ন করার সাহস হয় না রফিকের।

হন হন করে হাসপাতাল ছাড়ে রফিক। এক কাপ চা খেতে পারলে মন্দ হয় না।

 

দুই.

এখন আর না শুনে মন খারাপ হয় না সাজ্জাদের। কেউ বই কিনলে খুশীও লাগে না। তার যেমন অধিকার আছে বই কেনার প্রস্তাব দেয়ার ওদেরও অধিকার আছে না করার। তবে ধমক ও প্রত্যখ্যানে মন খারাপ হয় না কী? না । আগে হতো কী? তা নিয়ে ভাবতে চায় না সে। পাষ্ট ইজ ডাস্ট। মানে সে। আর কথায় বলে না যেখানে দেখিবে ছাই ওড়াইয়্যা দেখো তাই। মানিক রতন পাবে কী জানে না। শুধু জানে, মার্কেটিং এর জায়ান্ট হতে পারলে জীবনের পেছনে তাকাতে হবে না আর। পেছন মানে অতীত। মানে ডাস্ট।

সাজ্জাদ দেখে ব্যস্ততা। দেখে ফাইল হাতে রোগীর আত্মীয়দের ছুটাছুটি। দেখে ক্যান্টিন। সেখানে দুয়েকজন চা খাচ্ছে। ক্ষুধার রাক্ষসটা পেটে মোচড় দেয়। সেখানে যায় না সে। যদিও প্রবাদ আছ খাওয়ার সময় বন্ধু আসে,ঘুমের মধ্যে শত্রু আসে। খাওয়ার সময় কিছু বিক্রি করতে গেলে বেশি বিরক্ত হয় মানুষ। তাই ক্যান্টিন এড়িয়ে চলে সে।
সাজ্জাদ যায় আরো সামনে। সেখানে ক্যাশ কাউন্টার। তার সামনে দাঁড়িয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে এক লোক। কত হবে তার বয়স? ৪০ হতে পারে, ৪৫ ও হতে পারে। নিশ্চিত হতে পারে না সে।  গ্রামে থাকলে ৪০ এ একরকম আবার এ্কই বয়সের শহরবাসীকে দেখতে লাগে আরেক রকম। সাজ্জাদ এগিয়ে যায়। মনের ভেতর থেকে ঠেলে আসে কথা, স্যার আমি সাজ্জাদ…

কিন্তু কথা শেষ হয় না। তার আগে সচেতন হয় তার কান। সে মনযোগ দেয় কথপোকথনে।

– কতোদিন হইছিল বয়স?

– চাইর মাস। জন্মের সময় শরীরে রোগ নিয়া আসছে। কত ডাক্তার দেখাইলাম। পরে মাষ্টার সাব কইলো ঢাকা নেও। ভাইরে ঢাকাও বাঁচাইতে পারলো না।
চোখে আর পানি নাই লোকটার। কত আর কাঁদতে পারে মানুষ। বাচ্চাটির জন্মের পর থেকেই নিশ্চয়ই কান্না শুরু।

– ওই যে গাইনীতে যে মহিলাকে কাঁদতে দেখলাম, তিনি আপনার ওয়াইফ? বলতে বলতে পাশ থেকে আলোচনায় যোগ দেয় আরেক যুবক। স্যুট পড়ে এসেছে হাসপাতলে। তার নিশ্চয়ই সব কিছু ভালো চলছে। তা না হলে এত পরিপাটি হয়ে হাসপাতালে আসে কেউ?

যুবকটিকে সম্ভাব্য ক্রেতা ভেবেছিল সাজ্জাদ। কিন্তু মৃত নিয়ে আলাপে যোগ দেয়ায় বই বিক্রির প্রস্তাব দিতে ইচ্ছে হলো না তার। না, মার্কেটিং জায়ান্ট হওয়া অনেক কঠিন। অনেক কিছু বিবেচনা করতে হয়। অনেক পরিশ্রমও করতে হয়, ভাবে সাজ্জাদ।

 

তিন.

আপনার কাছে এক হাজার টাকার ভাংতি আছে?

কথাটি যে সাজ্জাদকে লক্ষ্য করেই বলা হলো বোঝতে পারে না সে। আসলে সবার সঙ্গে যেচে কথা বলার অভ্যাস হয়ে গেছে। কেউ তাকে ডেকে কথা বলবে ভাবতে পারে না সাজ্জাদ। তাই চলে যাচ্ছিলো আনমনে।

– এই যে ভাই, বুক ব্রাদার, হবে নাকি এক হাজার টাকার ভাংতি?

– আমাকে?

– জ্বী।

হবে। তবে একটা কথা স্যার । এক্সকিউজ মি, আমার নাম সাজ্জাদ। আমি একটা বই এনেছি। লেটেষ্ট।

– বইয়ের কথা পরে। যদি ভাংতি থাকে দেন।

ভাংতি দেয় সাজ্জাদ।

টাকা দিয়ে এক মুহুর্ত দাঁড়িয়ে থাকে সে। দেখে যুবকটি মাথা ঝুঁকিয়ে কথা বলছে এক রূপবতির সঙ্গে। কি হবে তার? বউ নিশ্চয়ই। গালফ্রেন্ড ও হতে পারে। কিংবা কেবলি চেনা কেউ। পরকীয়া? হতে পারে।

-তাহলে কি ঠিক করলে?

-আল্ট্রা সাউন্ড করাবো।

-কালই তো করলে?

– এক রাতে বাচ্চার হার্ট বিট আসতে পারে না? আমি স্বপ্নে দেখছি। শেষ রাতের স্বপ্ন মিথ্যা হয় না। এটাও মিথ্যা হবে না। কাজেই ডি এন সি করার আগে আমি আরেকবার আল্ট্রা সাউন্ড করাবো।

– যদি এবারও বাচ্চার হার্ট বিট না আসে?

মৃদু ঠোট বাঁকা হয় সাজ্জাদের। না, পরকীয়া নয়। তাহলে বাচ্চা রাখার কথা নয়। বরং বাচ্চা হতে পারে এই ভয়ে পরকীয়া জমে না তেমন।

– আসবে,বলে মেয়েটি। মিরাকলে তোমার আস্থা আছে?

সাজ্জাদ দেখে নীরব থাকে ছেলেটি।

– বলো।

– আছে।

– থাকতেই হবে। জগতে কত রহস্য হয়, তা কে কতটুকু বোঝতে পারে। আমি স্বপ্নে দেখেছি, বেবী আছে। ডাক্তার কী ভুল করতে পারে না?

– পারবে না কেন? অবশ্যই পারে। কত ভুলের গল্পইতো আমরা জানি।

– তা হলে এটাই ফাইনাল। তুমি টাকা জমা দাও। আল্ট্রা সাউন্ড না করে কোন ডিএনসি না। আর ডিএনসির দরকারই বা কী।পরীক্ষায় দেখা যাবে, বাচ্চার হার্টবিট এসেছে। তারপর আমরা বাসায় চলে যাব।

ছেলেটি টাকা জমা দেয়। সিরিয়ালও পায়। তাকে কিছুটা বিভ্রান্ত লাগে। এতবড় ডাক্তার দেখলো। বিদেশ থেকে ফেটাল হার্ট বিটের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তার দুই দফা আল্ট্রা সাউন্ড করে দেখলো, কোন সুখবর নেই। আবার বউয়ের কথা অবিশ্বাসও করতে পারছে না। যদি দেখা যায় আল্ট্রা সাউন্ডে এবারও বাচ্চার হার্ট নেই, তবে কী হবে?

ডাক্তার কী বসে থাকবে ডিএনসি করতে। তারতো আরো রোগী আছে। নামি ও ব্যস্ত ডাক্তার। হয়তো বলবে আজ আমার সময় নষ্ট করেছেন,ডেট দেয়ার পরও আসেননি। এই সপ্তাহে না। হয়তো বলবে আর দেখবেই না। তাহলে যাবে কার কাছে? আবার আল্ট্রা সাউন্ড না করে ডিএনসি করালে সারাজীবনের গ্লানি থেকে যাবে। বউটা বিশ্বাস করে আছে,সারাজীবন ভাববে জীবিত একটা বাচ্চাকে অ্যবরশন করা হয়েছে।

– রোগীর কি পেশাবের চাপ আছ?

সনোলজিষ্টের সহকারি জানতে চায়। কি চাপ আছ? জানতে চায় যুবকটিও।

– আছে।

– তাইলে আসেন। বেশীক্ষণ লাগবে না। আগের সব কাগজ নিয়া আসেন। ম্যাডাম দেখবে।

বউয়ের যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকে যুবকটি।

– এক্সকিউজ মি। স্যার আমি সাজ্জাদ, এই যে আপনাকে ভাংতি দিলাম। আমি একটা বই এনেছি।

– সাজ্জাদের মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে যুবকটি। দীর্ঘ একটা শ্বাস নেয়। তারপর বলে, বসেন,আমার বউ আল্ট্রা সাউন্ড করতে যাচ্ছে। যদি পরীক্ষা বলে আমাদের বাচ্চাটার হার্টবিট আছে,তাহলে একটা বই কিনবো।

মাকের্টিং জায়ান্ট হওয়া অনেক কষ্টের,বিড় বিড় করে নিজেকে বলে সাজ্জাদ। তারপর বসে যুবকের পাশের চেয়ারে।

বউটি ধীর পায়ে সনোলজিষ্টের ঘরে ঢুকে।

 

Facebook Comments

2 Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top