সেই কবে কৈশোরে নির্জন মধ্যন্দিনে
ভাতঘুম টুঁটেছিল অতিশয় বিবিৎসা-হেতু
সুর সেধে ডেকেছিল লোকাতীত কোনো ভায়োলিনে
মেদিনীতে নেমেছিল ক্রমায়াত হিমান্ত ঋতু।
ইশারায় ডেকেছিল কুরঙ্গী— বিজুবনে, দূরে
অনিমিখ আঁখিপাতে টেনেছিল সেই চঞ্চলা
অটবির ঝরে পড়া পত্রালি শরভের খুরে
গুণ্ডিত— হেন পথে হেঁটে বিসমিলা পথচলা।
বনপথে নেমে দেখি নেই শুরু-শেষ, নিগমের,
চলে গেছে পথগুলো দূরে, কাঁটাবনে-মায়াবনে;
মুছে গেছে পদছাপ রোমাঞ্চকামী মানবের—
প্রলুব্ধ, বিলোড়িত ছিল যারা কুহকিনী এণে।
আজ ভাবি কই তারা— ফিরল কি নিজ-নিকেতনে
পেল কি কস্তুরিকা, ওই রূপ— মায়াদর্পনে?
২.
পতিতপবনে জানে কতবার ভেবেছি যাইগা
ফিরে যাই চেনাভূমে। পিছুডাক কত না ডেকেছে
মায়ের মুখের মতো সিয়েস্তা স্নেহভরা ওমে
ভুলে নিষেধের নির্দেশ যেই তাকিয়েছি পিছে
দেখি, সে কী! নেই তারা, যেসব যেখানে ছিল, ক্রমে
হারালো ঝাঁঝালো দিন, চেনাজানা কিচ্ছু নাইকা।
হারিয়ে জননী-কোল, দিবাঘুম, কুষ্ঠিঠিকুজি
থাকে শুধু অবশেষ, অভিযান— কুহকিনী পথ
অদেখা সে-রূপখানি, দিদৃক্ষা আর শিহরন।
অনন্যোপায় তাই সেদিকে ছুটাই জোরে রথ
একাকি পেরিয়ে গিয়ে জাদুমায়াবন-পরাবন
পৌঁছাই কাচবাড়ি আঙিনায়— অবরতি খুঁজি।
কে যেন দাঁড়ানো হেথা, এগোলাম একপা দুইপা
একবার মনে হলো তাবরিজ অথবা লুই পা।
৩.
পৃথিবীতে আসে তবে নির্জন পিশুন দুপুর
ছেলেধরাদের মতো শত প্রলোভন দেয় ছুঁড়ে
ফাঁদ পাতে সুনয়নে, টেনে নেয় ভায়োলিন সুরে
কাচঘরে নাচে কেউ— নর্তকী, রূপালি নূপুর।
আর কেউ কেউ হয় ভারি অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়
এবং দৈবদোষে পথের ধূলিতে তারা মেশে;
খেলাছলে গেলে ঢোঁক হেমলক, যার নির্দেশে
দেখা তার মেলে কি রে, সেই সুধা মেলে কি, অমিয়?
এই ভাবি বিহরণে, সামনে তো কাচবাড়ি-ধাঁধা
চারিধার সবিতার রসে ধোয়া ক্রিমসন ঘাস;
কাচঘরে যেতে হবে ফেলে রেখে আপনার লাশ—
নিজের ভেতর ঢুঁড়ি, প্রাণভোমরাটা কোথা বাঁধা!
পাই না নিশানা আমি— কেউ কেউ জাগিয়ে ঈর্ষা
চলে যায়, কাঁদি হায়— কী হেতু এই বিজিহীর্ষা!
৪.
কাচবাড়ি, কাচঘর— সামনেই যাব, তবু ফের
পেছনের কথা ভাবি। পিছে বনপথ বিস্তৃত—
আলোক আলোক বলে ঘরত্যাগী রাগী মানুষের
হাড়ের প্রলেপে আঁকা— আঁকাবাঁকা বিন্যাসকৃত।
ঘুমঘোরে-জাগরণে-তন্দ্রায়-স্বপনে-চেতনে
যে দেখেছে অপরূপা কাপটিকা কুরঙ্গী এক
যে ধরেছে প্রাণবাজি চুর হয়ে ঘোর প্রলোভনে
যে ভেবেছে পথশেষে ওপারে কী আছে দেখা যাক—
সে দেখেছে কাচবাড়ি, কাচঘর— আয়নামহল
কোথায় শুনেছি আগে, কে যেন বলেছে, গেছি ভুলে।
দর্পনে কাকে দেখে যেন নির্বাণ— হলাহল
ক্ষয় হয় কোন বিষে— মায়াবি পর্দা ওঠে দুলে?
কীরূপে সে-ঘরে যাব— কাচের নেকাবখানি তুলে,
কোন দোরে রাখি বন্ধ কবাট, কোন দোর খুলে?
৫.
ঝড়ে দোলে আলোছায়া পরাআলো পরাছায়া মৃদু
কাঁপাকাপাঁ কাচবাড়ি কাচঘর বহুদূরে ধু ধু
প্রাণ করে দুরুদুরু চারিপাশে পরাবায়ু বয়
ছায়াছায়া কারা জানি ফিসফাস করে কথা কয়।
এরা কারা?— ভাবতেই ছায়াগুলো দূরে সরে যায়
একজন শুধু থাকে দূরে শুয়ে শরশয্যায়;
চেনা চেনা লাগে, আরে এতো মহামহিম ভীস্ম!
কোথায় যে এলাম রে এতো দেখি মিথের বিশ্ব!
মিথের গল্পও না, নয় কোনো কল্পনা এ তো
অলি আর আউলিয়া হয়েছেন দূরে সমবেত—
মাথায় আলোর তাজ মনসুর হাল্লাজ কহে:
আমার হৃদয় থেকে স্রষ্টার নিঃশ্বাস বহে!
বিস্মিত হয়ে আমি ভুলি পথ পেছনে যাবার
একজন কেউ বলে সামনেই সাধুর বাজার।
৬.
একতারা বাজে শ্যামবাঁশি সাথে কেউ তো গাইছে গীত,
একসাধু বলে ওই গায়কের নামটা পরীক্ষিত!
মাতার গর্ভ তথা এ বিশ্ব করেছে তার পালন
নদীয়ায় তিনি নাম ধরেছেন সাঁই, ফকির লালন।
বাড়ির পাশের আরশিনগরে পড়শি বসত করে
তিন পাগলায় ধরার ধুলায় গড়াগড়ি খেয়ে মরে।
যিনি মুর্শিদ তিনিই রাসুল খোদাও তিনিই হন
কাচবাড়ি আর কাচঘর থেকে উঁকি দেন নারায়ণ।
অযুত নিযুত আরশিতে তিনি ঢেকেছেন তার মুখ
মুমিনেরা সব মুস্তাকিমের সাধনায় উন্মুখ।
সঙ্গের শেষে সাধুগণ কহে: শক্ত করো গা ভিত
তাইলেই নিজে জানতে পারবা ক্যান সে পরীক্ষিত!
এইটুকু শুনে যেই না কথার ফেলেছি হারিয়ে খেই,
চেয়ে দেখি ঘোর ধু ধু প্রান্তর— সাধুসঙ্গ তো নেই!
৭.
যেতে যেতে যেতে পথ বেড়ে চলে পথের হয় না শেষ
শেষের অন্তে শুরুর আভাস নতুনের উন্মেষ।
আর এই হলো সারসংক্ষেপ তত্ত্বকথার মূল
পিতার রক্তে ভুলটাকে বলে মাতার গর্ভে ফুল।
প্রত্যেক দেহে তেইশ প্রকার ভুল আর ফুল ফোটে
ফুলের খবরে ভ্রমের ভ্রমর পরিমল খেতে ছোটে।
নাট্যমঞ্চে পুতুল নাচিয়ে এভাবে যে বাজিগর
লীলাখেলা করে বাসভূমি তার কাচবাড়ি, কাচঘর।
বনভূমি থেকে মনোভূমে এসে সন্ধ্যাবাতাস বাঁচে,
অর্গল খুলে ঝাঁপতালে দুলেদুলে বিন্দাস নাচে!
তিনি প্রসন্ন তাই আসন্ন তার শুভ আগমন
চারিদিকে বাড়ে ঐশী আলোর মোহনীয় আলোড়ন!
এই যে বাতাস কিংবা আলোক দেয় যা যা সংকেত
দরকার তার সম্প্রসারণ আর অর্থের ভেদ।
৮.
কৈশোর থেকে আমি এ-অবধি এখানে দাঁড়িয়ে
কেউ তো ধরেনি হাত স্নেহভরে হাতটা বাড়িয়ে;
সকাল গড়িয়ে হলো দুপুর গড়িয়ে ফের রাত
শিশির জমেছে শুধু রিক্তই রয়ে গেছে হাত।
চমকে দেখেছি শুধু করতল নীলালোকে মোড়া
আমাকে দেখাবে পথ কোথায় সে যুযুধান ঘোড়া;
বাঁচাবে আমার প্রাণ, প্রভু, কোথা সে শিরোস্ত্রাণ,
কোথা সে মর্মপাখি আর তার নিঁদহরা গান!
উল্টা আমাকে বাঁধে দুরাচারী চল্লিশ চোরে
এবং আমাকে বধে তারা ঘনঘোর মায়াডোরে;
বন্দিদশায় হয় কোথায় যে কে অগ্রসর!
রয়ে গেছে তাই অধরাই কাচবাড়ি, কাচঘর।
বয়েস গড়িয়ে গিয়ে দৃষ্টির কমেছে আগুন
চোখের সহায়, হয়েছে কাচের সব গুণাগুণ!
৯.
আয়না ঝাপসা হবার আগেই পড়ে নিতে হবে মন,
মনোধ্বনি ও মনোনীত পুঁথি। বহুপরে জেনেছি যে,
চোখ হলো এক প্রকৃত গোপন সুড়ঙ্গ, যার নিচে
প্রবাহিত ঋতুমতী কিশোরীর অবচেতনের মতো,
বিপরীত দুই স্রোতের জলধি। বহু শতাব্দী আগে
নগ্ন সাধুরা একেই ‘জীবন’ নামে লিখেছিল আদি
সান্ধ্যমন্ত্রে। কাদার ভেতরে এক পায়ে এক ঝাঁক
মরাল পালকে মুখ গুঁজে দিয়ে ধ্যানরত ছিল, তবু
দ্বিধা সত্ত্বেও জেগেছিল কাম আর এসেছিল ধেয়ে
একশ’ জন্ম। সেসবের দায় মিটিয়ে এবার আমি,
চোখ যে ম্যাজিক লণ্ঠন, তার নিগুঢ় অর্থ পাঠে
তীর্থ পেরিয়ে এসেছি অমোঘ কল্পবিদ্যালয়ে।
পড়ি চিদাকাশ, পড়ি যে প্রবল পার্পল কম্পন—
আয়না ঝাপসা হবার আগেই পড়ে নিতে হবে মন।
১০.
এবে যতি টানবার কোনো গতি নেই আর, আহা,
নিজেকেই হতে হবে সাধনায় সর্বংসহা!
অনেকটা হাঁটা হলো পথ আরো বাকি বিস্তর,
তারপরে হতে পারে দেখা কাচবাড়ি, কাচঘর।
তবু ভালো হলো যে খেলাচ্ছলে উদ্বোধনটা
নিয়তির নির্ণয়— আগে-পিছে গোটা কয় ঘণ্টা—
বুঝে বা না বুঝে হোক এ মার্গ নেবে অন্তর—
তা না হলে টেনে নেবে কুহকিনী কোনো মর্মর।
এ যাত্রা শুরু সবে, শেষ তার আরেক জন্মে
জ্ঞানরূপী আলো এসে সেদিনকে পশিবে মর্মে;
এভাবেই হবে সারা স্রষ্টার সব অভিলাষ
দেহ থেকে শত দেহে আত্মার ভ্রমণ-বিলাস।
এ জন্মে খানিকটা এগিয়ে তো যেতে পারলাম
খতিয়ান রাখছি না— জিতলাম না-কি হারলাম!
১১.
আশানদী তীরে এখনো দাঁড়িয়ে, যথাসম্ভব
চিনে নিতে হবে মন্ত্রণাদেও কোনটা ঋষভ
কোনটা শুধুই মোহনীয় ফাঁদ, লোভনীয় ছল।
নিমগ্নতায় হয়তো কেবল বয়ে যাবে জল
গলবে বরফ অপারগতার, জড়ময়তার।
রেখে দিতে হবে উর্ধ্বে সকল অধ্যেষণার
দেহমনটাকে বয়ে যেতে দিতে হবে তার মতো
মুছে দিতে হবে মুখচ্ছবিটা, নিরাশায় হত।
যে তুমি আমার রয়েছ গোপন তব অন্দরে
কাচবাড়িঘর-আরশিনগর অভ্যন্তরে;
যে তুমি গড়েছ আরশ তোমার আলোয়-আলোয়
এনেছ আমায় দ্বন্দ্বের মাঝে সাদায়-কালোয়;
যে তুমি আমায় নিতেছ হে টেনে ধ্বনিময়তায়
তোমাতে স্বয়ং মিশে যেতে চাই নিমগ্নতায়।