মৌসুমী ব্যানার্জীর ছোটগল্প: ক্যাকটাস

তখন সবে চাকরি পেয়েছি। গা থেকে ছাত্র ছাত্র গন্ধটা একদমই যায়নি। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে নবীন অধ্যাপিকা হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম, সেখানকার প্রবীণ এক অধ্যাপক তার বাড়িতে নেমন্তন্ন করলেন। উপলক্ষ্য বাড়ির হাউস ওয়ার্মিং পার্টি। আগে তিনটে হয়ে গেছে, আমরা চতুর্থ কিস্তিতে নিমন্ত্রিত। কানাঘুষোয় শুনেছিলাম বিরাট বাড়ি এঁদের, প্রায় ভুলভুলাইয়ার মতো সারা বাড়ি জুড়ে ঘর, ঘরের মধ্যে প্যাসেজ এইসব। একটা শনিবার সন্ধ্যেয় নেমন্তন্ন। সারাদিন ধরে খুঁটিনাটি নানা বাইরের কাজ সেদিন। সপ্তাহের বাজার থেকে শুরু করে নতুন সংসারের জন্যে সোফা, ডাইনিং টেবিল ইত্যাদি পছন্দ করতে যাওয়া, পোস্ট অফিস থেকে বই খাতাপত্রের পার্সেল তোলা, সব মিলিয়ে বিধ্বস্ত। সন্ধেবেলার পার্টিতে কি নিয়ে যাই? এদেশের রীতি অনুযায়ী এক বোতল ওয়াইন বা কোনো ডেসার্ট, নাকি হাউস ওয়ার্মিং-এর সম্মানে ওয়াইন গ্লাস এর সেট, বা ঘর সাজানোর কোনো জিনিস? কত লোক নিমন্ত্রিত জানি না। এক বোতল ওয়াইন বা একটা ডেসার্ট-এ কি হবে? আর তাছাড়া অত বড় বাড়িতে নিশ্চয়ই অনেক ওয়াইন গ্লাস। এইসব ভাবতে ভাবতে ঠিক করলাম একটু অন্যরকম একটা উপহার নিয়ে গেলে কেমন হয়! একটা নার্সারীর পাশ দিয়ে যেতে যেতে মাথায় এলো আইডিয়া’টা। ভারী সুন্দর মাটির পটে ছোট্ট একটা ক্যাকটাস কিনলাম। পটের গায়ে কালচে লাল’এ মেক্সিকান মোটিফ আঁকা, আর সাদা কালো নুড়ির বিছানায় ছোট্ট ক্যাকটাস। উচ্চতায় বড়জোর দশ ইঞ্চি কিন্তু রোদ পিছলে পড়া চকচকে চেহারা তার, আর পাতাগুলো কেমন যেন “মম চিত্তে, নিতি নৃত্যে” স্টাইল-এ মেলে ধরা।

গেটওয়ালা কমিউনিটি বিশাল প্রান্তর জুড়ে। দ্বাররক্ষীর কাছে নাম লিখিয়ে যখন ভেতরে ঢুকলাম আমরা, তখন সন্ধে নামছে। কম্পাউন্ড-এর ভেতরে ফোয়ারার গায়ে আলো জ্বলে গেছে। ছবির মতো সাজানো বাড়ির সারি। ঢেউখেলানো গল্ফ কোর্স পেরিয়ে আমরা এগোচ্ছি, হাতে চিরকুটে লেখা বাড়ির নম্বর। আজকের মতো তখন স্মার্টফোনের যুগ নয়, সুতরাং চিরকুটই ভরসা। খানিক দূর থেকে বিরাট ক্লাবহাউসের মতো দেখতে একটা বাড়ি ঠাহর হলো। ওপরতলার কাঁচ দিয়ে ঘেরা ব্যালকনি’তে অনেক আলো জ্বলছে। বাড়ির সামনে গোল ঘোরানো ড্রাইভওয়ে, তাতে সার দেওয়া গাড়ি। আরে, চিরকুটের নম্বরের সঙ্গে তো মিলে যাচ্ছে এই বাড়ির নম্বর! তখন মার্চ মাস, বাইরে ঠান্ডা। হিম বাঁচাতে ক্যাকটাস’কে লম্বা কোটের আড়ালে ঢুকিয়ে সেই বাড়িতে প্রবেশ করলাম আমরা।

দরজা দিয়ে ঢুকেই প্রায় মাথা ঘুরে যাবার জোগাড়! পায়ের তলায় স্বচ্ছ কাঁচ। পুরো একতলার মেঝেটাই কাঁচের। নীচে তাকালে দেখা যাচ্ছে অনেক মানুষ বাড়ির বেসমেন্ট’এ হাঁটাচলা করছে। দরজা থেকে দশ বারো পা এগোলেই একতলা থেকে ঝুঁকে বেসমেন্ট’এর খোলা প্রান্তর দেখার জন্য ব্যালকনি! বাড়ির ভেতরে বাড়ির অন্য অংশ দেখার জন্য ব্যালকনি! বাহ্, চমৎকার তো! আর সেই ব্যালকনি দিয়ে নিচে তাকাতেই অন্য জগৎ, থরে থরে দেশ বিদেশের পুতুল সাজানো! ঠিক যেমনটা দেখেছিলাম ছেলেবেলায় বাবা’র সঙ্গে নেহেরু চিলড্রেন’স মিউজিয়ামে গিয়ে। বাড়িতে দেশী বিদেশী বহু নিমন্ত্রিত মানুষ। ব্যাচে ব্যাচে সবাইকে ট্যুর দেওয়া হচ্ছে। আমরা কোট খুলে অনেকের দেখাদেখি দ্বিতীয় ব্যাচের সঙ্গে গিয়ে বসলাম। কোট রেক ‘এর ঠিক পাশেই সুন্দর একটা মার্বেলের টেবিল। সেখানে ক্যাকটাস’কে বসিয়ে দিলাম এক ধারে। গৃহকর্ত্রী’কে এখন খুঁজে পাওয়া মুশকিল, পরে নাহয় তার হাতে তুলে দেবো।

খানিক বাদে আমাদের ডাক এলো। জনা দশেকের ব্যাচে আমরা চললাম বাড়ি পরিদর্শনে। এক একটা বেডরুমে মোটামুটি ফুটবল খেলা যায়! প্রত্যেকটার লাগোয়া আরেকটা ঘর, যেটা কিনা জামাকাপড় রাখার ক্লোজেট। সেই ঘরের ঠিক মাঝখানে এদেশী কায়দায় একটা গ্রানাইট টপওয়ালা আইল্যান্ড। ঠিক যেমনটা রান্নাঘরে থাকে শাকসবজি কাটার জন্য। ফিসফিসিয়ে আমার পাশের মেয়েটি আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “what’s this doing here?” আমিও যখন তাই তো, তাই তো, এটা এখানে কেন, ভাবছি, তখন মধ্যবয়সী আরেকজন রঙচঙে মহিলা, যিনি তৃতীয়বার ট্যুর নিচ্ছেন, বললেন ওটা আইরনিং বোর্ড, অর্থাৎ ইস্তিরি করার জন্য ক্লোজেটের মধ্যে স্বতন্ত্র একখানি দ্বীপ! মনে মনে ভাবলাম, আহা রে, আমি তো কক্ষনো পারতাম না আমার প্রিয় শাড়ীটা’কে নির্বাসনে পাঠাতে!

একতলায় রান্নাঘরের পাশে খাবার পরিবেশনের জন্য আরেকটি দ্বীপ! তাতে এখন অনেকরকমের খাবার সাজানো। মূলত দক্ষিণ ভারতীয় মেনু, কিন্তু পাশাপাশি এদেশের ভেগান কিছু আইটেম’ও আছে। লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমার পেছনে সেই রঙচঙে মার্কিনী মহিলা, এবার আমি তাকে বদান্যতা করে ধোসা ইডলি’র বিষয়ে লেকচার দিচ্ছি। নিজে প্লেটে নিয়েছি খানিকটা স্পাইসি টোফু, দুটি উত্থাপম, আর এক বাটি সাম্বার। এতো খাবার সাজানো দ্বীপে, কিন্তু কোনোটাই আমার আত্মার আরাম দেবার মতো নয়। লিভিং রুমে আমাদের বসার আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে গুটি গুটি গিয়ে বসলাম খাবারের প্লেট সমেত। আমার মার্কিনী সহনিমন্ত্রিত তখনও ট্যুরের ঘোরেই আছেন। বললেন ওনার দ্বিতীয় ট্যুরে এক্সট্রা একটা “worship room” দেখানো হয়েছিল যেখানে অনেক “Golden Gods!” টুকটাক গল্প করছি আর একটু একটু টোফু খুঁটছি, হঠাৎ গৃহকর্ত্রী এলেন সবাইকে সাদর সম্ভাষণ জানাতে। সুইচ টিপে একসঙ্গে জ্বালিয়ে দিলেন ঘরের পাঁচটা ঝাড়লণ্ঠন। আর অমনি বোঁ করে ঘুরে গেলো আমার মাথা। এবার আক্ষরিক অর্থেই। মাথার ওপরে স্বল্প রিসেস লাইট’এ এতক্ষণ খেয়াল করিনি এই ঘরের প্রতিটি জানলায় রিফ্লেকটিং গ্লাস। হাজার ওয়াট’এর পাঁচ পাঁচ’টা ঝাড়বাতি এমনভাবে আলোর প্রতিফলন কাটছে জানলা থেকে জানলায়, জানলা থেকে ঘরের দেয়ালে, দেয়াল থেকে মেঝেতে, তার ধাক্কা আমি আর সামলাতে পারিনি। আমার মার্কিনী বন্ধু কি হলো, কি হলো? “are you okay? is it the spicy tofu?” এইসব বলতে বলতেই আমি সামলে নিয়েছি নিজেকে। দু’চার ঢোক জল খেয়ে বললাম “I think it is too strong for my taste.” ইট’টা যে কি, সেটা উহ্যই রইলো।

ট্যুর, খাওয়া দাওয়া, অল্প আলাপচারিতার পরে এবার ফেরার পালা। মাথা তখনও একটু একটু চক্কর কাটছে। আবার সেই ঘরের পরে ঘর, দ্বীপের পরে দ্বীপ, বাড়ির ভেতরে বাড়ির অন্য অংশ দেখার জন্য ব্যালকনি পেরিয়ে সামনের দরজা। পাশে কোট রেক। কোটের ভিড়ের মধ্যে থেকে রীতিমতো খুঁজে নিজের কোট আর টুপি উদ্ধার হলো । জাব্বাজোব্বা চাপিয়ে বাইরে পদার্পণ করার জন্য প্রস্তুত, হঠাৎ নজর পড়লো মার্বেলের টেবিলের ওপর ক্যাকটাস। এক লহমায় দেখে মনে হলো কেমন যেন সংকুচিত হয়ে একপাশে বসে আছে ও, সেই মম চিত্তে নিতি নৃত্যে ভাবটা নেই। আচ্ছা, এখানে ও তো ভারী একলা হয়ে যাবে, ওকেও কি বাড়ির অসংখ্য দ্বীপগুলোর একটা’তে বসিয়ে দেওয়া হবে? খুব কষ্ট হলো হঠাৎ। ক্যাকটাসের মসৃণ পাতাগুলো’তে একবার হাত বোলালাম। তারপর ভীড়ের নজর এড়িয়ে ত্বরিতগতিতে ওকে টেবিল থেকে তুলে কোটের আড়ালে লুকিয়ে বেরিয়ে এলাম সেই বাড়ি থেকে। হাউস ওয়ার্মিং পার্টি’র উপহার ফেরত এলো আমাদের সঙ্গে আমাদের বাড়িতে।

ক্যাকটাস এখন আমার পড়ার ঘরের জানালার পাশে বিরাজমান। ওর নতুন নামকরণ হয়েছে –চকোরী। রোজ বিকেলের পড়ন্ত রোদে ওর সঙ্গে খেলা করতে আসে জাপানী মেপেল’এর শাখা’টা।আর আমি গীতবিতান খুলে বসলেই চকোরী ওর ছোট্ট ছায়া’টা দুলিয়ে নেচে ওঠে
“মম চিত্তে, নিতি নৃত্যে
কে যে নাচে
তাতা থৈ থৈ, তাতা থৈ থৈ, তাতা থৈ থৈ……”

 

মৌসুমী ব্যানার্জী

আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগানের বায়োস্ট্যাটিসটিক্স-এর অধ্যাপক ড: মৌসুমী ব্যানার্জী, গবেষণার বিষয়বস্তু ক্যান্সার ডাটা মডেলিং । জন্ম এবং লেখাপড়া কলকাতায়। কর্মসূত্রে বিশ্বনাগরিক। লেখালেখির শুরু কলেজ জীবন থেকেই। কবিতার পাশাপাশি ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ লেখেন। বাতায়ন, পরবাস, বাংলা লাইভ, সুইনহো স্ট্রিট, কেয়াপাতা, TechTouchটক, Antonym ইত্যাদি বহু পত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: একলাঘর (যাপনচিত্র প্রকাশনী)।

 

 

Facebook Comments

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top