কুন্তল মুখোপাধ্যায়ের একগুচ্ছ কবিতা

প্রার্থনা

নিজের সংগে একলা থাকার সঙ্গতি দাও

গাছপালারা যেমন থাকে একলা একলা তাঁতিপুকুর
ভরা শহর দাঁড়িয়ে থাকে অনতিদূর –

সারাটি রাত প্রদীপ জ্বেলে ল্যাম্পপোস্টের দাঁড়িয়ে থাকা
সারাটি দিন জাগতে থাকা মনের মধ্যে নীল নিরাকার …
ঘুরতে ঘুরতে বামাবর্তে
যৌনতাহীন মাঠের মধ্যে একটি পাগল
কী উদাসীন দাঁড়িয়ে আছে!

হঠাৎ সজল ঘনিয়ে এল, অল্টোস্ট্র্যাটাস দুঃখ দিল একফোঁটা জল
ভাঙা বাড়ির কান্না নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রুগ্ন, বাতিল

‘বেঁচে আছেন? বেঁচে আছেন? আপনি কী আর বেঁচে আছেন?’
বলতে বলতে মাথার উপর বৃত্ত আঁকছে সুপক্ষ চিল …

 

শোধ

রক্তক্ষরণের দিন। কিনে এনে বিষাদের চক
লক্ষণরেখাটি টানো – কে বিজোড় কে কে উৎপাদক!

সে রেখারা বেড়ে গিয়ে একে –ওকে –তাকে কাটাকুটি
প্রচ্ছন্ন বাতাস হাসে, অট্টহাস্য করে গ.সা.গু-টি –

গুণিতক ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়েছে। দেখে ঘুমঘোরে
পূর্ণ চাঁদ বসে আছে সিঁড়িভাঙা অংকের উপরে।

নীচে থেকে সে দেখেছে টিলাশীর্ষে যত বন্ধু, প্রিয়
ক্ষুধার্ত আগুন তারা জ্বালিয়েছে সরলবর্গীয়

সে আগুনে চুমু নিয়ে ছুটে আসবে যে সমস্ত তির
তারা জানে কোনখানে জেগে আছে তোমার কুটির

লেখা দিয়ে তৈরি ঘর। লোকে বলে তিমিরবিনাশী
তবু তার ধ্বংসে দূর টিলাশীর্ষ হাসে অট্টহাসি

আগুন জ্বালাবে, ছাই ঘেঁটে ঘেঁটে টিলা খোঁজ করে
ও কি বেঁচে? ও কি স্মৃতি? ও কি কারও মনের ভিতরে?

পাগলের মতো টিলা খুঁজে খুঁজে দেখে রাতভোর …
দেখে সে মরেনি আজও, দেখে, ছাইমাখামাখি হয়ে

দাঁড়িয়ে রয়েছে তার সারিসারি কালো পোড়া অজর অক্ষর

 

শান্ত একটা হিংস্র ছায়াছবি

কপাল তোমার চোদ্দ পুরুষ দূরে
বসিয়ে দিলে কুয়াশা ঘেরা মন
হামফারা এক যুবক তাতে আঙুল দিয়ে দিয়ে
লিখে দিয়েছে প্রেম আর মন্থন

কপাল তোমার সাহচর্যে থেকে
জেনেছি দুর্ভাগ্য যেন খুবই কাছের গ্রাম
সকাল বেলার শান্ত নাবিক আনন জোড়া সারারাতের ঝড়
লিখে দিয়েছে ঘণ্টা, পেন্ডুলাম

কপাল তোমার গণিকা আছে নাকি?
সম্প্রতি কোন স্বপ্নে তারা ছিন্নভিন্ন, খুন?
পিতার কোলে পুত্রবধূর শরীর রেখে এসে
নিজের জন্যে লিখেছে মৈথুন

কপাল তোমার মুখের ভিতর দিলাম শক্ত কালো
শরীরজোড়া পাহাড়জোড়া পাথর
সারা শহর স্তব্ধ ছবি আয়না ফেরি করিস
স্বপ্নমাখা খুন খারাবা তোর
কপাল এমন ঘুরছে ঘুরছে আয়ু
দূরের থেকে হাত নেড়েছে পরাগমিলন নানা
আমার নামে মাছির নামে মৌমাছিটি পুষে
খুলেছ একটা রুগ্ন কারখানা

কপাল আমি ভালবাসতে চাই

 

সন্ধি

জীবন তোমার সঙ্গে লড়াই করে
আমার গায়ে সময়মাখা ক্ষত
সতীর্থরা সুযোগ বুঝে দূরে
চলে যাওয়াই ভেবেছে সঙ্গত

মনন আমার অস্ত্র চালাই রোজই
আয়ুধ ক্লান্ত, শ্রান্ত তাদের শরীর,
আমিও শেষে হেরে যাওয়ার ভয়ে
হৃদয়পুরে শান্তিচুক্তি করি

এবং সবার শেষে বন্দি হলাম
হেসে বললে সালাম চাও না সাজা?
জীবন আমি সেদিন বলেছিলাম
রাজার কাছে যতটা পাওয়া রাজার

 

রাগ

তোমাকে বোঝে না কেউ। নিজেও কি বুঝেছ কখনও?
কোন হাওয়া শান্ত করে কোন হাওয়া হু হু বয় শোনো

বড়ো কথা বল তুমি আবেগের ক্রীতদাস বড়ো
এত প্রতিশ্রুতি তুমি এত কষ্টে, ভয়ে জড়োসড়ো

আবেগ তোমাকে বোঝে? ক্রোধ বোঝে দিনের অতীত?
পড়ন্ত রোদের ছায়া জানে আজ তীব্র ছিল শীত?

জানে না জানে না বলে সে শুধু তোমার রাগ দেখে
আগুন ধরায় মনে খুব দূরে চলে যেতে শেখে

কে কাকে শেখায় রাত কে কাকে মেপেছে কোন স্কেলে
এ কোন গভীর দেশে বিরহিণী ভুল করে এলে!

এসেছ যখন, প্রিয়, কীর্তিনাশা দাও অঞ্জলিতে
আশ্চর্য স্বান্তনা আছে প্রকৃত কান্নার পৃথিবীতে!

আমি তো তোমাকে দেখি আমি তো আমাকে বেশ চিনি
আমি যে রাতের চাঁদ তুমি সে রাত্রির নিশীথিনী

 

বিশ্বাস

একলা তো নই, বলেছে স্বর
কোথায় বাড়ি? অন্তত ঘর
কোথাও আছে
নিকটবাসা একটু হেসে এদিক দিয়ে এগিয়ে ছিল

সে বলল এই মিছিলও
সবার রঙে রঙিন, জানো?

কিন্তু শোনো এ- ঝলসানো গ্রীষ্ম দিনে মিছিল কোথায়?
একলা তুমি মালভূমিতে পর্বতে বা খরস্রোতায়

সে বলল, দেখতে পাও না ফুলেশ্বরী,
আমার পিছে হাজার হাজার মানুষ হাঁটছে, হাওয়ায় তৈরি তাদের শরীর

 

কুন্তল মুখোপাধ্যায়

ইন্দিরা পল্লি, বড়বাগান, সিউড়ি
জেলা- বীরভূম / ৭৩১১০৩

Facebook Comments

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top