মূল থেকে অনুবাদ: জাভেদ হুসেন
বাগানে সব ফুল বিদ্রোহ করলো। গোলাপের বুকে দপদপ করছিল বিদ্রোহ। তার শিরায় শিরায় জ্বলছিল আগুন। একদিন সে নিজের কাঁটা ভরা ঘাড় তুলে, ভাবনাচিন্তা একপাশে সরিয়ে নিজের সঙ্গীদের ডেকে বলল:
“আমাদের ঘামে আয়েশ করার অধিকার অন্য কারো নেই। আমাদের জীবনের বসন্তের অধিকার কেবল আমাদের। এতে অন্য কারো হানাদারি সহ্য করা হবে না।”
গোলাপের মুখ রাগে লাল হয়ে যাচ্ছিল। থরথর করে কাঁপছিল পাপড়ি।
চামেলির ঝাড় থেকে সব কলি জেগে উঠলো কোলাহল শুনে। অবাক হয়ে একে অপরের মুখ দেখাদেখি করতে লাগলো। আবার শোনা গেল গোলাপের পুরুষালি গলা।
“প্রতিটি প্রাণের নিজ অধিকার রক্ষার অধিকার আছে। আমরা ফুলেরা বঞ্চিত থাকবো কেন? আমরা অনেক বেশি নাজুক, স্পর্শকাতর। এক ঝটকা গরম হাওয়া আমাদের রং গন্ধের দুনিয়া ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পারে। আবার এক বিন্দু অর্থহীন শিশির আমাদের তৃষ্ণা মেটাতে যথেষ্ট। আমরা কী করে এই কানা মালীর কর্কশ হাতের স্পর্শ সহ্য করি? ওর হাতে মৌসুমের বদলের কোন প্রভাবই পড়ে না।
জুঁই চিৎকার করে উঠলো “মানবো না, মানবো না।”
রক্তজবার চোখ লাল হয়ে উঠলো। সেও বলা শুরু করলো “এই অন্যায়ে আমার বুক রক্তাক্ত হয়েছে আজ। আমার হাতেই উঠবে ঘাতকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রথম রক্ত-লাল ঝাণ্ডা।”
এই বলে সে রাগে থরথর করে কাঁপতে লাগলো। চামেলির কলি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। বুঝতে পারছিল না এতো কোলাহল কীসের!
এক কলি অহংকারে উঁচু ঘাড় ঝুঁকিয়ে গোলাপের ডালকে বলল “তুমি তো আমার ঘুমটাই নষ্ট করে দিলে। এমন গলা ফুলিয়ে চিৎকার করছ কেন?”
কামিনী দুরে দাঁড়িয়ে গোলাপের কায়দা করা বক্তৃতা মন দিয়ে শুনছিল। সে বলে উঠলো “বিন্দু বিন্দু মিলে সমুদ্র হয়। আমরা নাজুক ফুল। কিন্তু আমরা এক হোলে দুশমনকে পিষে শেষ করতে পারি। ভাইয়েরা! গোলাপের সঙ্গে যোগ দাও! আমাদের বিজয় সুনিশ্চিত!”
এই বলে সে দৃপ্ত চোখে সবার দিকে তাকাল। গোলাপ কী যেন বলতে যাচ্ছিল, তখনি চামেলি শ্বেতপাথরের মতো শরীরে এক কাঁপন তুলে বলল, “কী সব অহেতুক কথা! এসো, আমাকে বরং কবিতা শোনাও। আমি তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাই। তুমি তো কবি! এমন সুন্দর বসন্তের দিন আজেবাজে কথায় নষ্ট কোরো না। তাকিয়ে দেখো, জগতে শুধু ঘুম আর ঘুম, শীতল শান্তির ঘুম!”
গোলাপের বুক কেমন করে উঠলো। তার শিরায় স্পন্দন বেড়ে গেল। মনে হলো সে যেন কোন অথই সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছে।
চামেলি কলির কথার নেশা দুর করতে সে বলল “না, আমি যুদ্ধে নামার কসম খেয়েছি। এই সব প্রেম-ভালবাসা এখন আমার পথের বাধা।”
চামেলি কলি নিজের শরীরে আড়মোড় দিয়ে স্বপ্নাতুর কণ্ঠে বলে গেলো “আহ! এমন কথা বলে না প্রিয়। আমার মন খারাপ হয়ে যায়। দেখো, কেমন চাঁদের আলো! আমি যখন বসন খুলে এই চাঁদের আলোয় স্নান করবো, তোমার গালে তখন লাল আলোর ঝলক কেমন মায়াবী লাগবে! তুমি আমার রুপোর মতন ঠোঁটে তখন চুমু দেবে। ছাড়ো তো এইসব বাজে কথা। আমি তোমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাবো এখন।”
চামেলির নাজুক কলি গোলাপের গাল ছুঁয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। গোলাপ নেশায় মাতাল হয়ে রইলো যেন। চারদিকে তখন অন্য সব ফুলের শ্লোগান চলছে। কিন্তু গোলাপের ঘুম ভাঙল না। সারা রাত সে রইলো নেশায় বুঁদ হয়ে ।
কানা মালী এলো সকালে। দেখল গোলাপের সাথে চামেলির কলি জড়িয়ে আছে। কর্কশ হাত বাড়িয়ে সে দুটোকেই ছিঁড়ে নিলো।
জাভেদ হুসেন
জন্ম ১লা আগস্ট ১৯৭৬। কুমিল্লায়।
সোভিয়েত পরবর্তীত সক্রিয় মার্কসীয় রাজনীতিতে হাতেখড়ি। মার্ক্সের লেখা এবং মার্ক্সীয় দর্শন বিষয়ে উল্লেখযোগ্য বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রয়েছে। এছাড়াও তিনি একজন গালিব গবেষক। উর্দু-ফার্সি সাহিত্য বিষয়ে রয়েছে তাঁর বিস্তৃত জানাশোনা। সাদত হাসান মান্টোর কালো সীমানা ছাড়াও মূল উর্দু ও ফার্সি থেকে অনূদিত বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে।
মার্কসীয় দর্শন বিষয়ক প্রকাশিত বই: ইহুদী প্রশ্নে মার্কস ও মুক্তি; মার্কসের সমাজ তত্ত্ব ও সমাজ দর্শন বিষয়ক প্রবন্ধ: মার্কস আসলে যা বলেছিলেন; হাউ টু রিড মার্কস; জার্মান ভাবাদর্শ;মার্কসের মানুষ; সোহতে মার্কস; কার্ল মার্কস ডক্টরাল থিসিস; ইকোনোমিক্যাল এন্ড ফিলোজফিক্যাল ম্যানুস্ক্রিপ্ট;উর্দু ও ফার্সি সাহিত্য বিষয়ক প্রকাশিত বই:ধ্রুপদী উর্দু কবিতা;ফয়েজ আহমদ ফয়েজের কবিতা;মনসুর হাল্লাজের কবিতা;বধ্য ভূমির উৎসব (আহমদ ফারাজের কবিতা);জান-এ-গালিব;সারমাদ শহীদের রুবাইয়াত।