অরণ্য: বোধনের ডায়েরি– টিনের ট্রাঙ্ক

বড়-সড় কালো একটা টিনের ট্রাঙ্ক আমাদের বাড়িতে ছিলো, যা সারাবছরই বন্ধ পড়ে থাকত, আর নিয়ম করে খোলা হতো শীত আসার আগে। ট্রাঙ্কটির বন্ধ হয়ে পড়ে থাকা, এবং শোবার ঘরের এককোণ থেকে সারাবছর জানাতে থাকা তার নিভৃত, নির্জন অস্তিত্ব, যা আমরা কখনোই সেভাবে লক্ষ্য না করলেও শীত আসার আগে বেশ ভাল-করেই টের পেতাম পরিবারে তার গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ও অপরিহার্যতা, যা অনায়াসেই প্রকট হয়ে পড়ত আশ্বিন-কার্তিক মাসের কোনো এক উজ্জ্বল সকালে যখন সেটা ঘরের কোণ ছেড়ে বেরিয়ে আসত উঠোনে, আর তার বিশাল তালাবন্ধ ডালাটি ধীরে ধীরে খোলা হতো প্রায় উৎসবের আমেজে, এবং আমিসহ অন্যান্যরা তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগ নিয়েই উপভোগ করতাম অপেক্ষার প্রতিটি মুহূর্ত। ব্যাপারটা আমার কাছে ছিল দারুণ উত্তেজক, এবং নিজের মাথা ছাপিয়ে আরও উপরে প্রায় পায়ের পাতায় ভর দিয়ে হাত উঁচিয়ে নাগাল পাওয়া ডালা, হুক ও তালা আমাকে অনায়াসেই এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী করে তুলত যে, রূপকথার গল্পগুলো সবসময়ই মিথ্যে নয়, আর এই যে বিশাল ট্রাঙ্ক যা আজ খোলা হবে, এবং যা সারাবছর সবার অলক্ষ্যে চুপচাপ পড়ে থাকে ঘরের নিভৃত কোণে, নিশ্চয় ওর মধ্যেও লুকিয়ে রাখা আছে তেমন কিছু গোপনীয় ও মূল্যবান জিনিস যা আমরা সচরাচর বের করি না সবার সামনে। এভাবে ভাবতে ভাবতেই অপেক্ষা শেষ হয়, আর মা একসময় যখন ঢাকনাটা খোলেন, তখন তীব্র একটা গন্ধের ঝাপটা মুহূর্তেই এসে লাগে নাকে। একটু অস্বস্তি বোধ করলেও খুব দ্রুত তা সহনীয় হয়ে ওঠে যখন মা ডালাটা সম্পূর্ণ খোলেন, আর এক এক করে বের করতে থাকেন আমার সোয়েটার, বাবা অথবা দাদীর চাদর, মাফলার, গরম কাপড়ের পায়জামা, আপুর কার্ডিগেন, মোটা মোটা ভারী লেপ, ফুলতোলা চাদর, কাঁথা, বালিশের ওয়াড়, পাকিস্তানি কম্বল, আরও টুকিটাকি সব।

আমি ট্রাঙ্কের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকি, অথচ ভেতর থেকে তেমন কোনো মূল্যবান কিছুই বের হয় না দেখে হতাশ হয়ে পড়ি, আর একসময় মার কাছে জিদ ধরি যেন তিনি আমাকে কোলে নিয়ে ভেতরটা দেখান। আমি আমার সরল বিশ্বাস থেকে সরে আসতে পারি না বলেই ছিল সেই আবদার, যা কিনা মায়ের কোল, গভীর মনোযোগ দিয়ে সদ্য খালি হওয়া ট্রাঙ্কের ভেতরের সবটা যাচাই, এবং পরিশেষে কোল থেকে ট্রাঙ্কের ভেতরে নেমে পড়া পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছায়। হয়ত মা চান নি আমাকে নামিয়ে দিতে অথবা ছেড়ে যেতে, আর যখন সত্যিই তিনি আমাকে ওভাবে রেখে সরে গেলেন তখন কেউ হাসতে হাসতে বন্ধ করে দিয়েছিল ট্রাঙ্কের ডালা, এবং ঘটনাটা ঘটেছিল এতই দ্রুত ও আকস্মিক যে, মুহূর্তেই ঘুটঘুটে অন্ধকার আর চার দেয়ালের মাঝে সম্পূর্ণ বন্দী সাত বছরের এক শিশু সীমাহীন ভয় আর অজানা বিস্ময়ে খুব বেশি করে হয়ে পড়েছিল চুপ, আর তাকে সেদিনের সেই অন্ধকারে অযাচিতভাবে সঙ্গ দিয়েছিল উগ্র এক ঘ্রাণ, যা তাকে প্রায় নেশা ধরিয়ে দিয়েছিল, আর তার মাদকতায় বুদ হয়ে চুপচাপ বসেছিল ট্রাঙ্কের ভেতর ঘণ্টার পর ঘণ্টা আর যখন সেই ঘোর থেকে তাকে নিয়ে আসা হয়েছিল আলোতে, তখন তার ছোট্ট করুণ মুখটা হয়ে ছিল নীল, আর এক ধরনের কাঁপুনি ছড়িয়ে ছিল সারা শরীরে।

অবশেষে ট্রাঙ্কের সবকিছু বেরিয়ে স্তূপ আকারে জড় হতে থাকে উঠোনের মাঝখানে, আর বাড়ির সবচেয়ে বড় হাড়িটি চড়ানো হয় চুলার উপর। এরপর কলসি কলসি পানি ঢালা হয় সেই হাড়িতে, তারপর সাদা পাউডারের মতো কীসের জানি গুড়া ঢেলে দিয়ে একটার পর এটা কাপড় ঢুকানো হয় হাড়িতে, আর ঘণ্টা ধরে সেদ্ধ করা হয় ফুটন্ত পানিতে। এরপর ঘাট, সেখানে পিঁড়ি অথবা কাঠের চওড়া তক্তার উপর দাঁড়িয়ে মোটা মোটা কাপড়গুলোর একমাথা হাতে ধরে, আর অন্যমাথা শূন্যে তুলে তাকে সজোরে পিঁড়ি বা কাঠের দিকে নামিয়ে আনার সময় কিছুটা সামনের দিকে শরীরের ঝুঁকে যাওয়া, পুনরায় সোজা হওয়া, এবং একটানা একই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি এমন এক ছন্দময় শারীরিক ভঙ্গিমার উদ্ভব ঘটাত যে, আমি ঘাটের পাড়ে হাঁটুমুড়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে মাথাটা একসাথে জড়ো করা হাঁটু ও হাতের উপর রেখে একভাবে তাকিয়ে থাকতাম নেশাগ্রস্তের মতো, আর পিঁড়ি ও কাপড়ের লাগাতার সংঘর্ষের ফলে উৎপন্ন একটানা শব্দ দীঘির অপর-পাড়ে বাড়ি খেয়ে পুনরায় এপাড়ে ছিটকে এসে এমন এক ঘোর লাগিয়ে দিত, যে ঘোর আমার আরও গাঢ় হত কাপড় কাচা, ধোয়া, ও শুকানো শেষে রাতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন লেপের ধবধবে সাদা ওমের ভেতর নিজের ছোট্ট অস্তিত্ব খুব বেশি করে ডুবিয়ে যখন নাকটা গুজে দিতাম লেপের ওয়াড়ের মধ্যে, তখন টাটকা একটা গন্ধ ক্রমশ: আমাকে ভরিয়ে তুলত নেশাতুর ঘুমের মায়াবী আবেশে।

এখনও ট্রাঙ্কটি আগের মতই চুপচাপ পড়ে থাকে ঘরের কোণে, কেবল পার্থক্য এই যে সেটি আর আগের মতো বন্ধ থাকে না, কেন না সারাবছর ধরে সেখানে জমা হতে থাকে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরত অথবা বসন্তের যাবতীয়, আর ঠিক শীত আসার পূর্বেই অদৃশ্য একটা তালা আপনা আপনিই ঝুলে পড়ে আমার অজান্তেই, যেন বা ভয় এই, ঘন কুয়াশার পরম পরশ ভিজিয়ে দেবে সব, আর বের করে মেলে দিতে হবে রোদে। ঠিক যেন রমা-গাপলীর শতচ্ছিন্ন জামা, শাড়ি, পেটিকোট ও ছেঁড়া চাদর, যা সে রাস্তার পাশে রোজ মেলে দিতো রোদে, আর ন্যাংটো হয়ে বসে থাকত সেগুলোর পাহারায়। কাপড় পরার চেয়ে কাপড় পাহারা দিয়ে রাখাই যেন ওর কাছে আনন্দের, এবং একেবারে আবরণহীন হয়ে পড়ার ভয় ওকে করে রাখত শঙ্কিত ও সচকিত। আশৈশব আমি ওকে ওভাবে দেখে দেখে জেনেছি, ওকে আমি ভালবাসি। ভালবাসি ওর বিড়বিড় করা, উদাস ও উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি, যে কোনোদিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একভাবে তাকিয়ে থাকা। প্রায় সময়ই ওর বাম স্তন বেরিয়ে থাকত। আমি দেখতাম ওকে, এবং দেখতাম নগ্ন স্তনসমেত ওর সবটাই, আর এই আফসোস নিয়ে ফিরে আসতাম বার বার, একবার ও যদি আমাকে দেখত ওর সেই উদাস ও উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি দিয়ে, তাহলে হয়ত আজ খুব সহজেই ভোলা যেত ওর সমস্ত উদাস দৃষ্টি অথবা বেরিয়ে থাকা স্তন।

তারপরও শীত আসে, আর সেই সাথে ফিরে আসতে চায় রমা-পাগলী। ফিরে আসতে চায় সে কোনো এক বর্ষার সকালে নিশ্চুপ, নির্বিকার। সারারাত বর্ষার ঝমঝমে বৃষ্টিতে ভিজে ভোরবেলা কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে পড়ে বাড়ির দরজায়, মায়ের চোখে চোখ রেখে। কিছু হয়ত বলল, যা দূর থেকে বোঝা গেল শুধু কয়েকবার ওর ঠোঁটের কেঁপে ওঠা দেখে। এরপর দরজার কাছেই পড়ে গেল। তারপর আর উঠল না। ওর নিথর শরীরের পাশে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ওকে দেখলাম, এবং আশ্চর্য-ভাবে পুরোটা-সময় ওর বামস্তনটা অদৃশ্য হয়ে রইল, যেন বা গতরাতের ঘোর বর্ষা ওর শরীর থেকে ধুয়ে নিয়ে গেছে সব, আর ওকে ফিরিয়ে দিয়েছিল সেই পথ যা চিনে চিনে সে ফিরে এসেছিল ওরই চিরচেনা বাড়ির দরজায়, যেখানে সে জন্মেছিল ত্রিশবছর আগে, এবং সেখানেই মারা গেল কোনো এক বৃষ্টিস্নাত দিনের উজ্জ্বল সূচনায়। রমা আমাদের কেউ ছিল না, শুধু সারাবছর বন্ধ পড়ে থাকা বিশাল কালো ট্রাঙ্কটার সামনে আসলে মনে হয়, এখানেই তাকে লুকিয়ে রাখা যেত অনায়াস, পরিবারের অতি-প্রয়োজনীয় মূল্যবান ও জরুরী সম্পদ হিসেবে, যখন সে আমাদের-ই কারও না কারও বীর্যপাপ একাই বয়ে বেড়াতে ছেড়েছিল সব। রমা সত্যি সত্যিই আমাদের কেউ নয়, শুধু ভালবাসার অনন্ত চাদর এক, যা শীত কিংবা বসন্ত সবসময়ই জড়িয়ে রেখেছে অদৃশ্য অস্তিত্ব, গোপন কোনো হৃদয়।

মা মারা যাবার বহু-বছর পর যেদিন আমি প্রথমবারের মতো খুলেছিলাম ট্রাঙ্কটার বিশাল কালো ডালা, সেদিন কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই জেনেছিলাম ঘোরলাগা সেই গন্ধটার নাম ন্যাপথালিন নয়, পেট্রোল। পুরো ট্রাঙ্ক জুড়ে গাদাগাদি করে ঠেসে রাখা একটা গোটা বাড়ি, বিশাল দীঘি, খোলা বিল, কয়েকটা নারী-পুরুষ, হেঁসেলঘর, দরজা-জানালা, বারান্দা, উঠোন, কবাট, নকশীকাঁথা, ফুলতোলা চাদর, পুকুরঘাট, খেলনা হাড়ি-পাতিল, কাপড়ের পুতুল, মাটির সদাহাস্য বুড়োর ভাঙা মাথা, সাদা হ্যাট, রঙিন পেন্সিল, কালো সিলেট, সাদা চক, ধারাপাতের ছেঁড়াপাতা, বর্ণমালা শিক্ষা, রূপকথার গল্প, পালাগানের খাতা, আপুর চুড়ি, লাল-নীল ফিতে, ক্লিপ, আমার কাঠের বন্দুক, চকচকে মার্বেল, ম্যাচের তাস, ময়ূর-পালক, মায়ের বিয়ের শাড়ি, কবিতার খাতা, বাবার গোপন ডায়েরী, দাদার ভাঙা চশমা, হোমিওপ্যাথির বাক্স, দাদীর পানের বাটা, যাঁতি, আওলা পাতা, ওষুধের খালি শিশি, সিভিটের পাতা, আর রমা-পাগলীর আস্ত লাশ ও তার উগ্র ঘ্রাণ, নিমিষেই সবকিছুতে আগুন ধরিয়ে দিল দাউ দাউ।

––


জন্ম: ১৯৮১, রাজশাহী। পেশা: ম্যানেজার, এইচ. আর
প্রকাশিত বই : যে বেলুনগুলো রংহীন [কবিতা]; কাক সিরিজ [কবিতা] এবং এখন আমি নিরাপদ [ছোট গল্প]।
ই-মেইল : [email protected]

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top