সুমী সিকানদারের গল্প: ইলিশ

ডাকাতের দল আরাম করে খাটে বসে আছেন। তারা কোথায় সেই ভোলা থেকে নাকি এসেছেন। নিজেরাই কে কোথায় কী কী ভাগে নিয়ে ফিরবেন তা বলাবলি করছেন । মামা-মামী সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে স্টিলের আলমারি খুলে সকল দামী, কম দামী জিনিস এবং সামান্য গহনাপাত্তি টাকা পয়সা যা কিছু ছিলো খুলে খুলে টেবিলে রাখছেন। মামী নতুন বউ । মাত্র তারা গত পরশু মহেশখালি থেকে হানিরমুন না কি তাই করে ফিরলেন। তার যত কান্নাই পাক মুখ সেলাই করে রেখেছেন। ডাকাত দলের আরেক সদস্য বিস্কিটের কোনও টিন আছে কিনা খুঁজতে রান্না ঘরে চলে গেছে। রান্নাঘর থেকে ঠং ঠং ঠুক ঠুক আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। অসাবধানতা বশত: মুড়ির টিন ঠিক মতো লাগানো না থাকায় গম্ভীর শব্দ করে সকল মুড়ি মেঝেতে একসাথে পড়ে গেলো। মানুষের মৌনতায় মুড়ির প্রতিবাদটুকু পরিবেশ কে সামান্য হলেও বাতাস দিলো। ছোটমামা হঠাৎ বীরত্ব দেখাতে গিয়ে ক্ষেপে গেলেন। চিৎকার করে প্রতিবেশীদের জানান দেবেন এমন শুরু করতেই দরজাতে ঠেকা দেয়া কাঠের তক্তা দিয়ে তাকে প্রচণ্ড বাড়ি দেয়া হলো। মুহূর্তেই মামা মাথা চেপে বসে পড়লেন। ওমনি বাড়ির মেজ , মাঝারি বড় , বয়স্ক সকলেই নেতানো মুড়ির মতোই চুপসে গেলেন।

রান্নাঘরে যে হাসি মাছ কুটছিলো মামী তা ভুলে গেছিলেন। তিনি অস্থির হয়ে হাসিকে ডাকছেন। কিন্তু তার সাড়া নেই। মামী কান্না শুরু করলেন। হাসি তার বাপের বাড়ির লোক। কতগুলো ডাকাত নানা অছিলায় রান্নাঘর থেকে আসে আর যায়।

ডাকাতের সদস্যবৃন্দ আপাতত খাটে নেই। তারা পরিশ্রম করে মহা আনন্দে বাড়ির সদস্যদের হাতে পায়ে দড়ি বেঁধে খাটে বসিয়ে রেখেছেন। ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছেন। কেউ কোন শব্দ করছে না। জিনিসপত্র বাঁধা-ছাদা চলছে। বিছানার উপর গহনার বক্স থেকে যৎসামান্য যা ছিলো নামানো হয়েছে।
শুধু বাড়ির পুঁচকেটা যার নাম মুনিয়া ৭ বছর কুল্লে বয়স, সে পাঁচগুটি খেলছে. তার যে হাত বাঁধা হয়নি, কেউ সেটা খেয়ালও করেনি। খেলতে খেলতে মুনিয়া মূল ঘরের থেকে কিছুটা আলগা হয়ে বের হয়ে উঠোনে গেলো। পেয়ারা গাছের সাথে বাঁধা দড়ির দোলনায় কতক্ষণ দুললো। কি মজা ! কখন বিকেল হবে গাছে পা উঠিয়ে বসে থাকবে। মামাদের ঘরে যে এত বড় কাণ্ড হয়েছে তা সে ভুলেই গেছে। শিশুমন ঘটনার অঘটন বোঝে নাই।

কতক্ষণ পর কি যেন মনে হতেই সে উঠোন পেরিয়ে ছোট খালার ঘরের দিকে নাচতে নাচতে গেল। সেখানে খালা মন দিয়ে মোটা তাজা বই পড়ছেন। সামনে পরীক্ষা। পরীক্ষা এলেই খালা কেবল পড়তে থাকেন। বাড়ির আরেক পাশে সকল সদাই লুঠ হচ্ছে , সে সংবাদ বা শব্দ তার কানে এখনও পৌঁছায়নি । লুঠের আলাদা কোন শব্দ আছে বলে জানা যায় না। এক মানুষেরই আচরণে নানাবিধ শব্দের আয়োজন আছে । খুশীর শব্দ , কান্নার শব্দ , ভাবনার শব্দ, ভালোবাসা না বাসার শব্দ , হুট করে প্রেমে পড়ার এবং প্রেম ভেঙ্গে যাবার মট করে শব্দ , এসব মানুষেরই আচরণ। । সবাই সব সময় সব শব্দ টের পায় না। এই যেমন এতক্ষণ ধরে রান্না ঘরে মাছ কুটতে থাকা হাসির কোন শব্দই পাওয়া যাছে না।

যাহোক ফ্রিল দেয়া ফ্রক পরা মুনিয়া এসে খালাকে নেচে নেচে যা জানালো তার অর্থ হলো ওই বাসায় মামা-মামী, নানা- নানু সবাইকে কি সুন্দর দড়ি দিয়ে ডাকামামারা (ডাকাতমামা ) বেঁধে রেখেছে, খালাম্মু তুমি দেখে এসো । চল এখন পড়তে হবে না । চলো দেখে আসবো আমরা ।

এই কথায় কি জানি হলো , ছোটখালা এক ছুটে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে উঠোন পার হতে হতেই চিৎকার করে ‘’ডাকাত ডাকাত আমাদের বাসায় ডাকাত পড়েছে, বাঁচাও বাঁচাও ‘’ বলে এমন চেঁচাতে লাগলেন, যে আশে পাশের বাড়ির লোকজন পড়িমরি করে ছুটে আসতে থাকলেন । বিরাট সোরগোল পড়ে গেল এবং তারও আগে , যে সব ডাকাতমামারা বিস্কুট খাচ্ছিলেন তারা মুড়ির টিন ঝাঁকাচ্ছিলেন তারা সব শুদ্ধ নিমেষে উধাও হয়ে গেলো। কেউ নেই । মুনিয়া জানে না ডাকাতদের মামা ডাকতে নেই।

মুনিয়া এতক্ষণ ডাকাতদের আগমনে না বুঝে যে আনন্দে ভাসছিলো ঘরে ঢুকেই তার আনন্দ হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। মামা-মামী খোলা খালি আলমারির সামনে চুপ করে বসে আছেন। নানু জায়নামাজে কাঁদছেন। হাসিকে রান্নাঘরে পাওয়া যায়নি। কুলার মধ্যে ছাই এবং আস্ত মাছ কাটার অপেক্ষায় মাছ ফেলে রাখা। সে ভয়ে কোথাও দৌড়ে গেল কিনা বোঝা যাচ্ছে না। গ্রাম থেকে আসা হাসি ঢাকা শহরের কিছুই চেনে না। ছোটমামা থানায় গেছেন মামলা করতে। তাঁর আহত হাতে রুমাল পেঁচানো। এত সব কাণ্ডের মধ্যে মুনিয়ার খিদে পেয়ে গেছে। সে তো কতক্ষণ পর পর খায়। কেউ কিছু খেতে দিচ্ছে না। রান্না ঘরে কাঁঠালও নেই। সে ফিসফিস করে হাসিকে ডাকছে “হাসিবুয়া , হাসিবুয়া’’।
এক সময় মুনিয়ার ডাকাতদের উপর খুব রাগ হলো। তারা কেন তার হাত বাঁধেনি, তাহলে সে তো আর ছোটখালার কাছে খবর দিতে যেতে পারতো না। আর তাহলে নানুও তাকে খেতে দিতো। সবাই এত কাঁদতো না।

ডাকাত পড়া বাড়িটিতে সে বেলা কেউ আর রান্না চড়ায় নি। মুনিয়া তার সহোদরা পেয়ারা গাছে বসে চেয়ে চিন্তে পেয়ারা খেলো। মাঝে মাঝে তাঁর বরাদ্দ ভাত বাদ গেলেও সে পেয়ারা খায়। একথা সে কাউকে বলেনি। কেউ তাকে জিজ্ঞেসও করেনি। কিন্তু আজ তার সেজন্য দুঃখ হচ্ছে না। তার শুধু মনে হচ্ছে হাসিবুয়া কোথায় গেল।

ধলাফর্সা হাসির ছিলো বাদামি চোখ। ১২/১৩ বছরের এই মেয়ে ছিলো মুনিয়ার খেলার সাথী। উঠোনে দাগ কেটে এক্কা দোক্কা, লাফদড়ি, সাত চারা এসব খেলা হাসিই শিখিয়েছিলো তাকে। আর সন্ধ্যার পরে বসে বসে ফেলানো কাপড়ের টুকরো দিয়ে পুতুল বানাতো। মুনিয়ার জুতোর বক্সের সবগুলো পুতুল হাসির বানিয়ে দেয়া। মুনিয়া কি বুঝেছে জানে না, তার চোখে দিয়ে বড়বড় ফোঁটা পেয়ারা গাছের উপর থেকে মাটিতে পড়ে মাটির মন ভিজিয়ে ফেললো। এক সময় সে নেমে এলো।

রান্না ঘরে ইলিশের গায়ে হাত দিয়ে নানু-মামী পাথর হয়ে গেছেন। রক্তে সারা রান্নাঘর ভেসে গেছে। অথচ মাছের গায়ে কোনও আঁচড় নেই। আস্ত ইলিশ আস্তই আছে। হাসিকে সেদিন আর পাওয়া যায়নি। শুধু ডেটল পানি দিয়ে রান্নাঘরের মেঝেটা মামী বার বার মুছতে লাগলেন। তার সারা শরীর কেঁপে কেঁপে হুড়মুড় করে জ্বর আসছে।

 

সুমী সিকানদার

জন্ম ঢাকায় ১৬ ফ্রেব্রুয়ারি ১৯৭২
এ পর্যন্ত একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়েছে পাঁচটি কবিতার বই  এবং
প্রথম গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ২০১৮ সালে।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালখি ছাড়াও, অনলাইনের পোর্টালে নিয়মিত লিখছেন।।
গান এবং আবৃত্তি প্রিয় মাধ্যম।  অসংখ্যবার বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রয়েছে। ভালোবাসেন দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়াতে।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top