সময় আমাকে কাটায়। আমি সময় নয়। তাকে আমার বলার কিছু নেই। তার নিজস্ব গতিতে, নিজস্ব ব্যাকরণে, নিজস্ব স্পিডোমিটারে আমাকে চালাবার আপ্রাণ চেষ্টা তার মধ্যে আমি দেখতে পাই। এই চেষ্টাকে সম্মান জানিয়ে কোনো গাজোয়ারিতে না গিয়ে সমপর্ণ করে দিই নিজেকে।
তারিখ আমার কাছে মূল্যহীন। একটি অপপ্রয়াস ছাড়া কিছু মনে হয়নি কখনো। কিন্তু আমিও কত বড়ো দ্বিচারী তার প্রমাণ আমি একবার অন্তত সৎ থেকে দিই। যেদিন আমার মৃত্যু হয়েছিল, সেই তারিখটা আমি কখনোই ভুলি না। মৃত্যু মানে শেষ হওয়া নয়। মৃত্যু মানে পূর্ণতা। পূর্ণ হওয়া। ৫ অক্টোবর, ২০০৪। সকাল ৯টা ৩৪ মিনিট ৯ সেকেন্ড।
রাত ৮টা চল্লিশ
সকাল সাড়ে আটটার অ্যালার্ম যখন আমার ঘুম ভাঙাল, তখনো আমার ঘরের ভেতরটা অন্ধকার। অ্যালার্মের আওয়াজে চোখ খুলেই প্রথম যেটা মনে হল, এত অন্ধকার কেন? ঘড়ি না দেখলেও আমি জানতাম এখন সকাল সাড়ে আটটা। কারণ, কাল রাত সোয়া একটায় শুতে যাবার আগে আমি নিজে হাতে চাবি টিপে ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়েছিলাম। গত সাড়ে সাত বছরে আশ্চর্যজনকভাবে আমার ঘড়ি সঠিক সময়ে বেজে উঠে আমার ঘুম ভাঙায়। তাই আমি ঘড়ি বা দিনের অবস্থান না দেখেও বুঝতে পারি এখন সাড়ে আটটা বাজে। এবং সেটা সকালই। কিন্তু এত নিশ্চিন্ত হয়েও প্রথম কয়েক সেকেন্ড, হবে তা বারো বা পনেরো, একটা ভূতুড়ে অনুভূতি হচ্ছিল আমার। ঘরটা এত অন্ধকার কেন? তবে কি আজ সুর্য ওঠেনি? হ্যাঁ, এই বোকা বোকা প্রশ্নটা মাথায় আসতে দিলাম। আরো যে প্রশ্নটা হঠাৎই উজবুকের মতো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, এখন কি তবে রাত? আমার ঘড়ি কি ভুলভাল ডাকল?
মোট তিরিশ সেকেন্ডের এই অধ্যায় শেষ হল আমার উঠে বসাতে। উঠে বসে হাত বাড়িয়ে বুদ্ধিমানের মতো খাটের পাশের জানলাটা খুলে দিলাম। তখনই জানতে পারলাম, শীতের জন্য জানলাটা বন্ধ রেখেছিলাম। এবং বাইরের আলো ঘরে না ঢোকায়, ঘর হয়ে ছিল অন্ধকার। এবং এরপর আমি একে একে ঘরের বাকি দরজা জানলা। এবং সমস্ত বাড়ি শেষ করে যখন বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম, শীতের তখনো শেষ না হওয়া কুয়াশায় রাস্তার ও-প্রান্তে কুকুরটাকে মুখ তুলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। তার আমার দিকে চেয়ে থাকা আমার অভ্যাসকে অভয় দিলো। কুকুরটা যে ট্যারা নয়, দীর্ঘদিন ধরে দেখে দেখে আমি তা বিশ্বাস করেছি।
(এবং এই পর্বে এসে আমি আধখানা মশা তাড়াবার ধূপ জ্বালাই, যার গন্ধ অবিশ্বাস্য মনোহর।)
রাত পৌনে ১টা
কিছু কিছু শ্লীলতার গণ্ডী ছাড়ানো শব্দের প্রয়োগ এবং কিছু কিছু উত্তেজক দৃশ্যের কল্পনা সত্ত্বেও গত রাতের অতৃপ্ত রতিজনিত কারণে আমার আজ সব কাজে প্রচুর মনোযোগ দেখতে পাচ্ছি। (এইখানে এসে আমি একটু ভাবব, অতৃপ্ত থেকে অ কেটে বাদ দেবার কথাও বার কয়েক মনে হবে।) গোটা রাতের কিছুটা অংশ সেই চেষ্টায় অসফল হয়ে সকাল সকাল উঠে পড়ার চিন্তায় শেষ পর্যন্ত ঘুমানোর সিদ্ধান্তে পৌঁছাই আমি আর অনিমেষ। অনিমেষের পাশ ফিরে শোওয়াটা বিলক্ষণ লক্ষ করি আমি। তার পিঠের মাঝখানের লম্বা খাঁজে একটা সরু কালো সুতোর ওঠানামা ঘরের ছায়াবাজিতেও আমার দৃষ্টি ছুঁয়ে যায়। সেই ওঠানামাকে আমি আঙুল দিয়ে থামানোর ইচ্ছা মনে মনে লালন করি কিন্তু ঘুম এসে যাওয়াতে করা আর হয়ে ওঠে না।
আজ সকাল থেকে অনিমেষের মুখ বা পিঠ কোনোটাই নজর করার সুযোগ পাইনি। এবং জানার সুযোগও ঘটেনি ঠিক কতটা অনিমেষের মনোযোগ, ঠিক যতটা আমার। এর কারণ আর কিছুই নয়, সকালে কখন অনিমেষ চলে গিয়েছে আমার তা জানা হয়নি। এবং অনিমেষের চলে যাবার পর আমি ঘুম থেকে উঠি এবং রোজের যা-যা প্রাতের কাজকর্ম তা সেরে রাস্তায় বেরোই। যেখানে রোজ হাজিরা দেবার বদলে মাসান্তে কিছু দ্রুত বদলে যাওয়া সময় হাতে আসে।
ব্রিজে বাসটা ওঠার মুখে আমি ইচ্ছা করি বাস থেকে নেমে পড়ার। এবং সেইমতো আমি কন্ডাকটরকে বাস থামাবার অনুরোধ করি এবং আমার অনুরোধকে উপেক্ষা করেই সেই বাস সে থামিয়ে দেয়। সেটি প্রাকৃতিক নিয়মেই ছিল একটি যাত্রীবোঝাই বাস স্টপ।
আমার বোমকাই শাড়ির মসলিন পাড় বরাবর কন্ডাকটরের টিকেটসুদ্ধু হাতটা নেমে গেলে আমিও থেমে যাওয়া বাস থেকে নেমে পড়ি। আমার ব্যাগের গোপন কুঠুরি থেকে পতাকা বের করে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাই ব্রিজের দিকে। সন্ত্রাসবাদীর মতো ব্রিজটা আমার দিকে চেয়ে থাকে। আমি পতাকা হাতে দোল খেতে খেতে এক-পা এক-পা। খাড়া ব্রিজে ঠেলে তুলি নিজেকে। নাকি ব্রিজ আমাকে? গত চল্লিশ বছর ধরে ক্রমাগত। ব্রিজের ওপর চলতে থাকা সমস্ত যানেরা যখন রাস্তা ফাঁকা করে দেয় আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা নিরীহ মারুতি ভ্যানকে আমি এগিয়ে আসতে দিই। আশেপাশে রোদের ঠর্রা ওঠে। (এই সুখকর মিলন-মুহূর্তে রোদ এবং ঠর্রা—শব্দ দুটোকে স্থানচ্যুত করবার বাজে ইচ্ছেকে নষ্ট করে দেবার প্রাবল্যকে অস্বীকার করতে পারিনি।) আমি বিড়বিড় করে বলে উঠি, ‘আহ্, সেইসব ভালোবাসিগুলো।’ আর মারুতিকে আহ্বান করি—আয়! (এইখানে এসে আমার মোবাইল ফোনটি বেজে ওঠে। জনৈক ডাক্তার মধুমিতা ভৌমিককে একটি কাতর কণ্ঠ ডেকে ওঠে, ‘ডাক্তার ভৌমিক!’
রাত ৯টা পনেরো
‘আমি রেজিনগর গেছিলাম।’—এই বাক্যটি আমাকে উথালপাথাল করে দিলো। কিছুতেই মনে করতে পারছি না। আমি রেজিনগর দেখেছি। আমার চোখের সামনে রেজিনগর বানানটা জ্বলজ্বল করছে। জায়গাটা কি উত্তরপ্রদেশে? নাকি হালিশহরের গায়ে? (অতঃপর ভেবে উঠুন কে, কোথায় রেজিনগর দেখেছেন। আমাকে সাহায্য করুন। আমি খুঁজে পাচ্ছি না।) অথচ, উত্তরপ্রদেশে আমি যাইনি। হালিশহরেও না। কিন্তু রেজিনগর গেছি।
লোকটা আজ বৃষ্টির পতন দেখেছিল।
আজ শহরে বৃষ্টি। কয়েক ফোঁটা গড়িয়ে যাচ্ছে আমাদের নর্দমা দিয়ে। আমি সেই গড়িয়ে যাওয়ায় নিয়নের রেতঃপাত দেখি। (ভাবলাম, বিসর্গটা কি মুছে দেবো? দিয়ে ধারাপাত দেখব?) রেজিনগর শোনার পরই আমি গড়িয়ে যাওয়া দেখতে পাই। আর রেজিনগর শুনলেই আমার রেতঃপাত মনে পড়ে।
রেজিনগর আমি দেখেছি। কিন্তু কোনোদিন যাইনি। রেজিনগর এন. এইচ. থার্টি ফোর-এ। কোনোদিন বাস থেকে নামিনি। সেখানে ডাব বিক্রি হয়। আর বিক্রি হয় গাঢ় শাড়ি-লুঙ্গির পাশে রঙিন গামছা। রেজিনগর ছুঁয়ে চলে গেছি। দাঁড়াইনি। নামিনি। আমি জানি আমার স্খলনকে আমি আটকাতে পারব না।
দুপুর ১টা পঁচিশ
আমার বারান্দা আজ আমি অন্য জায়গায় শিফ্ট করব। তারপর একটা গাছ। সেই গাছে আমি সকাল-সন্ধে হাওয়া ঢালব। আর রোদ খাওয়াবে আবহাওয়া দপ্তর। এটা তাদের একান্ত ইচ্ছা। জলের দায়িত্বে আর কেউ। এইরকম ভাগাভাগির সংসার আমার গাছের।
গাছের নাম ৩০০ নিরানব্বই। সে রোজ একটু একটু করে বেড়ে উঠবে। প্রথম প্রথম আমার সোনার চাঁদ হয়ে। নয়নমণি হয়ে। তারপর আর একটু বড়ো হওয়ার পর তার বেড়ে ওঠা মাপার জন্য নিলাম ডাকব বা স্কেলদের। তারা তাদের তামাম গোলপার্ক ধারণা নিয়ে আমার বেডরুমে আয়না দেখবে। আয়নাটা তাদের সঠিক বাতলাবে ৩০০ নিরানব্বই আজ কতটা দৌড়ঝাঁপে।
(আমার নীচের তলার লোহা শ্রমিকদের কথা কাটাকাটি খুব হালকা চাল দিচ্ছে আর তাকে কাটিয়ে বেজে উঠছে কুকারের বাঁশি।)
এতদিনে, বলা যেতে পারে ষোলোটা বছর কেটে গেছে
রাত ৮টা বাইশ
আজকাল আমি যত না হাঁটি তার চেয়ে বসে থাকি বেশি। বসে বসে চেয়ারে মাথা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করি বা খুলে কড়িকাঠ দেখি। আমার দুটো ঘর আছে। প্রায় একশো বছর বয়স বা তার বেশিই হবে ঘর দুটোর। ঘরের দেওয়ালগুলোয় যানবাহনের ঝাঁকুনিতে বড়ো বড়ো কিছু ফাটল ধরেছে। পলেস্তারা খসে পড়েনি এখনো। খসে পড়লে ছায়াচিত্র তৈরির একটা সুযোগ হত। আজকাল আমার কথা বলতে ভালো লাগে না। কোনো সম্পর্ককেই কথা দিয়ে বাঁধা যায় না—এটা এতদিন লাগাতার কথা বলার পর বুঝেছি। কথা, তার পিঠে কথা, তার পিঠে আরো কথা। তারপর অখণ্ড নীরবতা কাম্য। আমি তাই-ই চাই। কিন্তু, তবু কথা বলতেই হয়। ইদানীং একটা বিষয় নিয়েই কথা বলতে ভালো লাগে। যার সঙ্গে, সে আমাকে রেঁধে খাওয়ায়। তাকে প্রায়ই ফোন করে বলি, ‘গেঁড়ি-গুগলি খাওয়াবি? সেই সাত-আট বছর বয়সে একবার খেয়েছিলাম।’ সে বলল, ‘ও মাসি, ১০০ গ্রাম গেঁড়ি-গুগলির দাম ৩০ টাকা! তা-ও খোলসুদ্ধু! আজ তোমার জামাই বাজারে দর করেছিল।’ এটুকু বুঝলাম গেঁড়ি-গুগুলি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কারণ, জামাই বলেছে, ফালতু পয়সা নষ্ট।
দুপুর ১টা তেত্রিশ
যদি সম্ভব হত, ঘরের দেওয়ালগুলো ধোপাবাড়ি পাঠিয়ে একবার কাচিয়ে আনতাম। রঞ্জক সাবান দিয়ে রাঙাতাম। তারপর ছাদের আলসেতে টানটান করে শুকোতে দিতাম। এখন শরতের রোদ বেশ মচ্মচে। কিন্তু তাড়াতাড়ি সন্ধে হয়ে যাচ্ছে। সারাদিনে রোদের পাটাতনে দেওয়ালগুলোকে উলটেপালটে নেবার পর আবার জায়গামতো তাদের টাঙিয়ে দিলেই ঘরটা ফুরফুরে হয়ে উঠে রোদের গন্ধ ছড়াবে।
রাত ৮টা উনপঞ্চাশ
আমার মাথাটা। আমার চোখ দুটো। চশমার ভেতর দিয়ে তাকিয়ে আছে। তাকগুলোর দিকে। বইগুলোর দিকে। আমি মাথাটাকে ভাঙলাম। তাকগুলোকে ভাঙলাম। তারপর বইগুলোকে ছুড়ে ছুড়ে ফেললাম। বইয়ের মলাট, পাতা, সূচিপত্র সব ছিঁড়লাম। বড়ো টুকরো ছোটো টুকরো করে করে চারিদিকে উড়িয়ে দিয়ে চোখ থেকে চশমাটা খুলে ছুড়ে ফেলে দিলাম। চেয়ারটা নিজে থেকে গড়াতে গড়াতে আমার কাছে এসে এলিয়ে পড়ল। আমাকে আশ্রয় দিলো। চোখ বুজে প্রথমে মাথাটাকে খুঁজে বের করলাম ছেঁড়া বইয়ের স্তূপের তলা থেকে। জায়গামতো বসালাম। এক-এক করে বইয়ের পাতাগুলো জড়ো করে এক জায়গায় রাখার পর তারা তাদের আশ্রয় খুঁজে পেল। তাকগুলোকে এক-এক করে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দেওয়ালে ফেলতেই তারা আবার সারিবদ্ধ হয়ে যেতেই বইগুলো উড়তে উড়তে তাদের আশ্রয়ে চলে গেল। আমি আমার আশ্রয়ে বসে বসে এ-দৃশ্য দেখলাম।
দুপুর ১২টা এক
নীল রং আমার অপছন্দের নয়। কোনোকালেই ছিল না। কিছু দুর্ঘটনার কারণে নীল রংটা এড়িয়ে চলতাম। নীল ব্যাগ কাটা পড়েছিল ভিড় বাসে। নীল পার্স চুরি গিয়েছিল হাওড়া স্টেশনে। নীল জামা ছিঁড়ে গিয়েছিল চলন্ত বাসের খোঁচায়। তিনটে ঘটনাই বাড়ির বাইরে, রাস্তায় ঘটেছিল। বাদ দিয়েছিলাম প্রিয় রংকে। এখন লিখছি নীল রঙের কলম দিয়ে, যার কালিটা নীল। একে বাড়ির বাইরে বের করব না। এ আমার আগুন গোত্রে পূত বারি হয়েই থাকবে। ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি।
সুদেষ্ণা মজুমদার
জন্ম ১৯৬৫-র ১০ ডিসেম্বর উত্তর কলকাতায়। বেড়ে ওঠা, পড়াশুনো সবই আজ পর্যন্ত একটানা কলকাতাতেই। কিন্তু মনের তলায় সরষে, সেই ঘুরে বেড়ানো স্বভাব নিয়ে গদ্যসংস্কৃতির নির্দিষ্ট বাঁধা সুর, গঠন বা আঙ্গিকের ঢং অগ্রাহ্য করে সুদেষ্ণা মজুমদারের লিখছেন। চিরায়ত গদ্যসীমার অনুশাসন ভেঙে প্রতিবার জন্ম দিয়েছেন ভিন্নধারা ও ভাষার কারুকাজ আঁকা গল্প ও উপন্যাস।
প্রকাশিত বই :
১. সেই সাপ জ্যান্ত, (গল্প সংকলন, কৌরব, কলকাতা, ২০০৯)
২. নিঃসঙ্গতা এক অন্তহীন কারুকাজের আরামকেদারা (উপন্যাস, কৌরব, কলকাতা, ২০১১)
৩. মায়া, নগর এবং একটি গল্পনা (উপন্যাস, প্রকাশক আড়িয়াল, ঢাকা, ২০১৩)
এছাড়া অসংখ্য পত্র-পত্রিকায় ছড়িয়ে রয়েছে নানা রকমের গল্প, গদ্য ও জার্নাল।