মনে পড়ছে বছর দুই আগের এক ডিসেম্বরের কথা। অনতিদূরেই বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান; তাই বিভিন্ন রিহার্স্যাল নিয়ে চলছে আমাদের মা-মেয়ের তুমুল ব্যস্ততা। এক বিকেলে মেয়ের গানের রিহার্স্যালে যাবার প্রস্তুতি নিতে নিতে উবার ডেকেছি। হুড়মুড় করে গাড়িতে উঠতেই ওর গানের কুইক একটা প্র্যাকটিস সেরে নিচ্ছি, এমন সময় চালক ভদ্রলোক নিজেই হাসি মুখে কথা শুরু করলেন! বিভিন্ন সৌহার্দ্যপূর্ণ কথা বলে জিজ্ঞেস করলেন “মা-মেয়ের দিন কেমন গেল?” আমি তো লজ্জায় শেষ! ছিঃ ছিঃ মিনিমাম ভদ্রতা দেখাতেও আমি আজ ভুলে গিয়েছি! যেই আমি কিনা গাড়িতে ওঠার আগেই সৌজন্যালাপ সেরে নেই, সেই আমি নিজের ব্যস্ততায় রোবটের মতো ব্যবহার করেছি গাড়িতে উঠেও! অস্বস্তি কাটাতেই, প্র্যাকটিস সহ নিজেদের সব আলাপ বাদ দিয়ে চালক ভদ্রলোকের সাথে গল্পালাপে ঢুকে গেলাম।
এ কথা, সে কথায় মেলবোর্নের আবহাওয়া থেকে শুরু করে, এখানকার রাজনীতির কথাও অনেক হলো| হঠাৎ মনে হলো তাঁর দেশ কোথায় জিজ্ঞেস করি| চেহারা দেখে মনে হচ্ছিলো মালয়েশিয়ান বা ইন্দোনেশিয়ান হবেন নিশ্চিত| কিন্তু উত্তর শুনে হতবাক হয়ে গেলাম! তিনি নাকি পাকিস্তানী! শুনে বললাম
—তোমাকে দেখে কিন্তু তা মনে হয় না| আমাদের সাবকন্টিনেন্টের মানুষের চেহারায় যে একটা কমন ধাঁচ আছে, তা তোমার মাঝে নেই| ইন্টারেস্টিং!
— হুম ঠিক| আসলে আমি পাহাড়ি| তাই একটা ট্রাইবাল লুক আছে আমার চোখে মুখে| ইন ফ্যাক্ট, আমি বেলুচ| এবং এটাই আমার আসল পরিচয়| কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার মানুষ এ পরিচয় শুনে আমায় আইডেন্টিফাই করতে পারে না! তাই কেউ দেশের কথা জিজ্ঞেস করলে ‘পাকিস্তান’ বলতে হয়। এত কথা যে বলছি, আচ্ছা তুমি নাম শুনেছো তো বেলুচিস্তানের?
—শুনবো না মানে? ‘বেলুচিস্তান’ পাকিস্তানের একটা প্রভিন্স| কিন্তু তোমরা বেলুচিস্তানের মানুষ এখন একটি স্বাধীন দেশ চাও! তোমরা সম্ভবত অনেকখানি বঞ্চিত পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে … তাই না?
— ওহ, মাই গুডনেস! তুমি দেখি ভালোই জানো আমাদের সম্পর্কে! বাই দ্য ওয়ে, তুমি কি বাংলাদেশী?
— হ্যাঁ ঠিক ধরেছো। কিন্তু কীভাবে বুঝলে বলো তো?
— জানি না, কীভাবে বুঝলাম| তবে হঠাৎ মনে হলো! হতে পারে, আমি এই মুহূর্তে বাংলাদেশের কথাই ভাবছিলাম, তাই! তাই-ই হয়তো ভেবে নিতে ইচ্ছে হলো— তুমি বাংলাদেশের!
— অদ্ভুত তো! তুমি হঠাৎ বাংলাদেশের কথা ভাবছিলে? কিন্তু কেন?
— হঠাৎ নয়| বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, আমরা বেলুচিস্তানের অনেকেই প্রায়ই বাংলাদেশের কথা ভাবি!
— ওহ, বলো কি! … সত্যি?!
— হ্যাঁ, সত্যিই ভাবি। বাংলাদেশের কথা ভেবেই যে আমরা আমাদের নিরাশার দিনগুলোতে আশাবাদী হয়ে উঠি! বাংলাদেশের জয়ের গল্পটিকে যে আমরা আমাদেরও ভবিষ্যৎ জয়ের গল্প ভাবি! …. তুমি তো বোধহয় তোমাদের ৭১ এর যুদ্ধ দেখোনি, যুদ্ধের আগের পাকিস্তানী শোষণও নিশ্চয়ই তেমন করে জানোনি! কিন্তু তুমি ওদের সব লোমহর্ষক বর্বরতা’র কথা জানতে পারবে, যদি আমার কাছে আমাদের স্রেফ একটি বেলুচিস্তানি দিনের রুটিনটুকু শোনো! সকালে উঠেই মেয়েরা … না থাক, বাদ দাও!
— কেন? বাদ দেবে কেন! বলো!
— না থাক, আবার শেষে খুব হতাশ হয়ে পড়তে পারি!
— কিছুই বুঝলাম না! কি এমন ঘটলো যে মনে হচ্ছে হতাশ হয়ে পড়বে?
— জানো, মাস তিনেক আগে একজনকে পিক করেছি, তোমার মতোই বেশ একটু দূরের যাত্রী তিনি। তোমার মতোই কিংবা কিছু কম হবে তার বয়স। তাঁর সাথেও ছিল তাঁর সন্তান। গ্রিটিংস বিনিময়ের পরই তিনি জানতে চাইলেন আমি কোন দেশের। ‘পাকিস্তান’ শুনেই তিনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন! ভাবলাম তার দেশ পাকিস্তান নিশ্চয়ই। কিন্তু অবাক হয়ে জানলাম তিনি বাংলাদেশের নাগরিক! বছর পাঁচ হয়েছে এখানকার রেসিডেন্সি পেয়েছেন। উনি অত্যন্ত আগ্রহের সাথে জানালেন তাঁর ফেভারিট ক্রিকেট টিম পাকিস্তান! … জানো, নিজের কানকেও বিশ্বাস করলাম না প্রথমে! অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম ‘সত্যি?’ তিনি বললেন ‘নিশ্চয়ই’! তাও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না পুরোপুরি। কিন্তু বিশ্বাস শেষে করতেই হলো যখন অতি এক্সাইটেড হয়ে তিনি আরও জানালেন তাঁর বিয়ের ল্যাহেঙ্গাটিও ছিল পাকিস্তানী| শখ করে অর্ডার দিয়ে নাকি বানিয়ে এনেছিলো তাঁর পরিবার!
— পাকিস্তানী ড্রেস-এ আগ্রহ শুনেই তাহলে বিশ্বাস করলে যে তিনি পাকি-টিমের ভক্ত?
— হ্যাঁ করলাম| কারণ আমি মানে আমরা বেলুচরা কখনোই ভাবতে পারি না বাংলাদেশী কোনো নারীর পক্ষে ৭১ এর পরে আর কখনো পাকিস্তানী কাপড় গায়ে ওঠানো সম্ভব! কারণ আমরা জানি কীভাবে ওরা মা বোনেদের কাপড় ছিঁড়েছে বা ছিঁড়তে পারে! নিজের জাতির এহেন সর্বোচ্চ অপমান ভুলে গিয়ে, যে ঐ শত্রু-দেশেরই তৈরি কাপড় পরে গর্ববোধ করতে পারে, সে সেদেশের ক্রিকেট টিমের ফ্যান হতেই পারে! অবশ্যই হতে পারে! …. ওহ সরি… আমি তো জানিই না, হয়তো তুমিও অমন বিশ্বাসের অধিকারী! কিন্তু বিশ্বাস করো, আমাদের বেলুচ নারীর সাথে ওরা দিনের পর দিন যা করেছে এবং এখনো করে চলেছে, তার অর্ধেকও যদি ৭১-এ তোমাদের সাথে করে থাকে তো, পাকিস্তানী ড্রেস কেনা?!… পাকিস্তানে তৈরি সুতো দেখলেও তোমাদের মন ঘৃণায় ভরে ওঠার কথা!
…সরি এগেইন, তোমাকে আহত করে থাকলে! আসলে কি জানো, খুব কষ্ট পেয়েছি সেদিন! তুমি নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছ! কিন্তু বিশ্বাস করো যাঁদেরকে ‘আলো’ ভেবে, স্বপ্ন দেখে, খুব কঠিন এক পথ আমরা অতিক্রম করছি, সেই তাঁদেরকেই অন্ধকারের দিকে সামান্য ঝুঁকতে দেখলেও দিশেহারা লাগে!
— হুম … বুঝতে পারছি! সরি! খুবই সরি! কিন্তু সত্যি কথা কি জানো সবাই এমন নয়! হতে পারে, আমরা লাকিলি অতি দ্রুত জয়ী হয়ে যাওয়ায়, খুব দ্রুত ভুলেও গিয়েছি কষ্টের সে অতীত! কিন্তু প্লিজ তোমরা হতাশ হবে না, হওয়া উচিত ও না!
—আসলেই হওয়া উচিত না| আমাদের অনেকেই দেশে অবস্থান করে, অসম এক যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে, কেউবা আবার সে যুদ্ধ করছে গোপনে! আবার কেউবা আমার মতো দূর দেশে থেকে তিল তিল করে ডলার উপার্জন করছে, দেশের মানুষকে মাসে মাসে পাঠাবে বলে..| আমাদের এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধটা ৯ মাস নয়, ৯ বছরেরও নয়! আরও অনেক অনেক বেশি|. …. ওহ, তোমার ডেসটিনেশনে পৌঁছে গিয়েছি| ভালো লাগলো, তোমার সাথে কথা হয়ে| কি জানি, কেন… আজ সকাল থেকেই দেশের কথা মনে হচ্ছে খুব! আর সেজন্যই হয়তো ইমোশনাল হয়ে গিয়েছি এমন| তুমি কিছু মনে করো না; আর প্লিজ দোআ করো আমাদের বেলুচিস্তানের জন্য!
— হ্যাঁ অবশ্যই করবো … তোমরাও জয়ী হও … আর ভালো থেকো!
বিদায় জানিয়ে মনে মনে বললাম, “আরো একটু দোআ করছি হৃদয় দিয়ে, জয়ী হয়ে, তোমরা যেন ভুলে না যাও, তোমাদের এ কষ্টের অতীতটাকে”!
জান্নাতুল ফেরদৌস নৌজুলা
বিবিএ, এমবিএ (ঢাকা ইউনিভার্সিটি)। পেশায় একাউন্ট্যান্ট, পার্ট টাইম টিচার। বসবাস করছেন মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়ায়। ভালোবাসেন গল্পের বই পড়তে, ঘুরে বেড়াতে | ভালো লাগে মানুষের সাথে মিশতে, মানুষকে জানতে। মেলবোর্ন স্টেটের বৃহত্তম বাংলাদেশী সংগঠন “ভিকটোরিয়ান বাংলাদেশী কমিউনিটি ফাউন্ডেশন”-এর ‘কমিউনিকেশন সেক্রেটারি’ হিসেবে ইলেক্টেড হয়ে বর্তমানে কমিউনিটির জন্য কাজ করছেন।
কোনো দিন ভাবেননি যে, লেখক হবেন। নিজের খেয়ালে লিখেতেন। তারপর একসময় গল্পপাঠ ওয়েবজিনের প্রেরণায় নারায়ণ গঙ্গ্যোপাধ্যায়ের ‘টোপ’ গল্পটির রিভিয়্যুর লিখে যাত্রা শুরু হলো। রিভিয়্যুর পাশাপাশি মেমোয়ার লিখলেন, এরপর একদিন সাহস করে লিখে ফেললেন প্রথম গল্প “জোড়া শালিখের ভোর”। এখন বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকায় নিয়মিত লিখছেন।
Pingback: মহান বিজয় দিবস সংখ্যা - সাহিত্য ক্যাফে
Ferdous is an excellent story teller. Enjoyed reading every line of it. All the best!!!
Very nice writing Ferdous. I feel mentally attached with the people of Baluchistan. Your writing explored their background.