বিজয় দিবস বাঙালির জাতীয় জীবনের এক আশ্চর্য অনুভূতিময় আনন্দ-বেদনার শিহরিত দিন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মহিমান্বিত ঐতিহাসিক দিন। বহু ত্যাগ তিতিক্ষার পর স্মৃতি চিহ্নিত এই বিশেষ দিনটিতে বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছে মুক্তি সংগ্রামের বিজয়কে। স্বদেশভূমিতে আত্মপ্রতিষ্ঠা ঘটেছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। এই বিজয় দিবসের পটভূমিতে রয়েছে বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশের এক অগ্রগামী অধ্যায়, রয়েছে পাকিস্তানের জঙ্গিশাহির দুই দশকের শাসন-শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে অগ্নিশপথময় আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস। সেই ইতিহাসের পাতায় এক অনন্য মাইলফলক মহান ভাষা আন্দোলন। পাকিস্তানি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে এই আন্দোলনের মাধ্যমে উন্মেষ ঘটেছিল বাঙালির ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার। সেই চেতনার ধারাই ক্রমবিকশিত হয়ে একাত্তরে এসে স্বাধীকার আন্দোলনে রূপ নেয়। অবশেষে যুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বাঙালির জাতীয় জীবনের নবতর অধ্যায়।
একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বরে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের পর বিজয় দিবসের সূচনা হলে বাংলার মানুষ স্বাধীনতা অর্জনের আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। সেই আনন্দের ধারাবাহিকতা চলতে থাকে প্রতি বছরের বিজয় দিবসে। এমনই এক বিজয় দিবসে আমার আব্বা আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলেছিলেন, ” আমরা এখন স্বাধীন। এখন নিজেদের মতো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারব।” কিন্তু পঁচাত্তরে পট পরিবর্তনের সাথে সাথে স্বাধীনতার বিষয়টিও প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে। আফসোস করতে করতে আব্বা ইহলোক ত্যাগ করলেন। স্বাধীনতার মর্মও বুঝে যেতে পারলেন না। আর আমরাও বড় হতে হতে লক্ষ্য করলাম বাঙালি ইতিহাস বিস্মৃতি হয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়কে বলছে গণ্ডগোলের বছর। সেইসাথে আরো বলে, “এটি একটি পুরনো বিষয়! একে নিয়ে এতো কথা বলার বা গবেষণার কী আছে? এখন শুধু কাজ করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। শুধু মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ করলে পেটে ভাত আসবে না!” এমন মানসিকতার মানুষের প্রতি শুধু করুণা নয়, ঘৃণা হয় আমার।
মুক্তিযুদ্ধকে ভুলে যাওয়া বা এড়িয়ে যাওয়া কিংবা অস্বীকার করা; অর্থাৎ যা কিনা নিজ অস্তিত্বকে অস্বীকার করার সমতুল্য। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক বাহক হয়েই দেশের একজন সুনাগরিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হয়ে দেশকে উন্নয়নের শিখরে নিয়ে যাওয়া— দেশের প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যত চর্চা হবে; ততই আমার নিজ অস্তিত্বের শেকড় পোক্ত হবে। একজন বাংলাদেশের বাঙালি হিসেবে আমার নিজেকে জানা মানে হলো মুক্তিযুদ্ধকে জানা। মুক্তিযুদ্ধকে জানা মানে হলো আমার দেশকে জানা। আর আমার দেশ মানেই স্বাধীন বাংলাদেশকে জানা। প্যালেস্টিনিয়নদের হয়ে এক কবি বলেছিলেন, ‘পাখিরও নীড় আছে, আমার তাও নেই!’ এখানেই আমি সদম্ভে বলি, আমার একটি স্বাধীন দেশ আছে, আছে মাথা গোঁজার ঠিকানা। মুক্তিযুদ্ধ আমার অস্তিত্বের ঠিকানা, এটা বারবার বলতেই হবে।
একুশের বইমেলায় প্রচুর মুক্তিযুদ্ধের বই প্রকাশ হয়। প্রচুর তরুণ লেখক মুক্তিযুদ্ধের বিষয়কে প্রতিপাদ্য করে রচনা করেন ফিকশন এবং ননফিকশন কাহিনী। আমি ব্যক্তিগতভাবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা যেকোনো ননফিকশন কাহিনীর পক্ষে। মুক্তিযুদ্ধ স্বতঃস্ফূর্ত এবং সহজাত বিষয়। একে মনের মাধুরী মিশিয়ে কল্পনাপ্রসূত কোনোকিছু লেখার দরকার আছে বলে মনে করি না। এখনো বীরাঙ্গনারা বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধারা। তাদের পদভারে আজো বাংলার মাটি কেঁপে ওঠে। তাঁদের সম্মুখে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ফিকশন কাহিনী বানানো মানেই হবে বিষয়টাকে অতিরঞ্জিত করে তোলা। সেইসঙ্গে কাহিনির বিশ্বাসযোগ্যতাও হারাবে। তাই লিখতে হবে বস্তুনিষ্ঠ লেখা। সরেজমিনে ঘুরে তথ্য, উপাত্ত সংগ্রহ করে কাহিনির সত্যতা তুলে ধরতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যত বেশি গবেষণা হবে; যত বেশি লেখা হবে; ততই মুক্তিযুদ্ধের সত্যরূপ উঠে আসবে। হয়তো দশটা বই পড়লে একটা সত্যচিত্র দেখতে পাবো। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী যাদের জন্ম, তাদের জন্য বিষয়টা এমনই হবে। এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করা মানুষগুলি যদি একে অপরের প্রতি ভ্রুকুটি দেখান তাহলে সেটা হবে আত্মঘাতী একটি দিক। নিজেই সঠিক ইতিহাস লিখছেন আর অন্যজন ভুল ইতিহাস লিখছেন বলে বিভ্রান্তি ছড়ানোর মানসিকতা দেখানোও ঠিক নয়, যদি মোটাদাগে ভুল না থাকে। ভুল ইতিহাস আস্তাকুঁড়ে চলে যাবে, এটা সময়ের দাবি। তাই যার যেখান থেকে যেটুকু সম্ভব; নিজ নিজ এলাকার যত কাহিনী; এমনকি নিজের দেখা যত স্মৃতি আছে; তার সবটাই লেখায় উঠে আসুক, এটাই সর্বোপরি কাম্য। এমনটাই আহবান জানিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা এবং কবি রফিক আজাদ; তাঁকে নিয়ে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে।
একটা বিশেষ বিষয় হলো- কীভাবে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কী ঘটেছিলো; এর ধারাবাহিক ইতিহাস তুলে আনতে গেলে; ঘটনার পরম্পরায় ঘটনা আসবে। এমন ঘটনার বিবৃতিতে ব্যক্তির চেয়ে কাহিনী গুরুত্ব পাবে বেশি। মানুষ প্রথমে মুক্তিযুদ্ধ বুঝতে চাইবে, তারপর আসবে যুদ্ধ পরিচালনাকারীদের কথা। ঘটনার ধারাবাহিকতায় নেতৃত্বের কথা আসলেও মূখ্য বিষয় থাকে শুধু মুক্তিযুদ্ধ। কারণ, যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য ছিলো স্বাধীনতা অর্জন এবং নিজ দেশকে পরাশক্তি থেকে মুক্ত করা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া মুক্তিযোদ্ধাদের তাই ছিলো একই স্বপ্ন, ধ্যান এবং আত্মবিশ্বাস। সেইসাথে তারা ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছিলো, একমাত্র জামায়াতী ইসলাম, মুসলিম লীগ ও অন্যান্য কয়েকটা বামপন্থী দল ছাড়া। স্বাধীনতা অর্জনের জন্যেই জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলে এক হয়ে গিয়েছিলো। ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান ছিলো সবার কণ্ঠে। এক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক দল যদি দাবি করে তাদের দল থেকেও অনেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন; তাহলে সেই রাজনৈতিক দলের দায়, সেই বীরদের বীরত্বগাথা তুলে ধরা। বিশেষ করে বামপন্থীদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের বিষয়টা বামপন্থী কারোর কলমে উঠা আসা উচিৎ। তাহলে বামপন্থীদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং ভূমিকাটাও পরিস্কার হয়ে আসে। কারণ, সেই বীরদের বিশেষ রাজনৈতিক দল বিশেষভাবে চিনবে এবং জানবেন। এক্ষত্রে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠতা হবে প্রধান মানদণ্ড।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করার হাজারো দিক আছে। একজন মানুষের পক্ষে সবদিক নিয়ে কাজ করাও সম্ভব নয়। তাই যতভাবে এবং যে যেভাবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চর্চা করবে; ঠিক ততভাবেই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়টি শাণিত হবে।
পরিশেষে বলবো, অসাম্প্রদায়িক, কল্যাণমুখী, মানবিক ও প্রগতিশীল জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এদেশের মানুষের মৌলিক ও ন্যায়সংগত অধিকার নিশ্চিত করা, জাতীয় পরিচয় প্রতিষ্ঠা, শোষণ-বঞ্চনা-অন্যায়ের অবসান ঘটানো ও সাধারণের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করাই ছিলো মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিলো। শাশ্বত সত্য এবং চিরন্তন সত্যরূপে মুক্তিযুদ্ধ আমাদের কাছে ধরা দিয়েছে। আমরা তাকে ধারণ করেছি। স্বাধীনতা অর্জন করেছি। স্বাধীন রাষ্ট্রের অধিকারী হয়েছি। একে ধারণ, বাহন এবং রক্ষণাবেক্ষণ প্রতিটি বাঙালির অবশ্যম্ভাবী একটি কাজ। মুক্তিযুদ্ধ বাংলার আকাশে চিরকাল স্বাধীনতার সূর্য হয়ে জ্বলজ্বল করবে। বিজয় দিবসের তাৎপর্যও সেখানেই নিহিত।
আঞ্জুমান রোজী
আঞ্জুমান রোজী: ১৯৯২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি কানাডা প্রবাসী। কবিতার প্রতি প্রেম বেশি হলেও গদ্য এবং গল্প লেখায় বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।এ পর্যন্ত তার তিনটি কবিতাগ্রন্থ, দুটি গল্পের বই এবং একটি গদ্যের বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম কবিতার বই, ‘এক হাজার এক রাত’ (২০১০) , এবং গল্পের বই ‘ মূর্ত মরণ মায়া'(২০১২) সাকী পাবলিশিং ক্লাব থেকে প্রকাশিত হয় । ২০১৩ ও ২০১৫ তে নন্দিতা প্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় কবিতার বই ‘বৃষ্টির অন্ধকার’ এবং তৃতীয় কবিতার বই ‘নৈঃশব্দ্যের দুয়ারে দাঁড়িয়ে’।২০১৭তে গদ্যের বই অনুপ্রাণন প্রকাশনা থেকে ‘মুখর জীবনগদ্য’ এবং চৈতন্য প্রকাশনা থেকে ২০১৯এ গল্পগ্রন্থ ‘সবুজ পাসপোর্ট ও অন্যান্য নিঃসঙ্গ গল্প’ প্রকাশিত হয়।ভ্রমণবিলাসী আঞ্জুমান রোজী লেখালেখির পাশাপাশি আবৃত্তি শিল্পের সঙ্গেও জড়িত আছেন । বাংলাদেশের অন্যতম সেরা আবৃত্তি সংগঠন- ‘কন্ঠশীলন’ এবং বাংলাদেশ গ্রুপথিয়েটারভুক্ত নাঠ্যসংগঠন- ‘নাট্যচক্র’র তিনি সদস্য ছিলেন।বর্তমানে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ করে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যক্ষ সাক্ষী নিয়ে গঠিত গবেষণামূলক আর্কাইভ 1971GenocideArchive এর সঙ্গে জড়িত আছেন।
Pingback: মহান বিজয় দিবস সংখ্যা - সাহিত্য ক্যাফে