পলি শাহীনার গল্প: দৃশ্যগুলো মুছে গেছে

দুপুরের গনগনে তেজদীপ্ত সূর্যটা বিকেলের গায়ে হেলান দিয়ে কিছুটা দুর্বল হয়ে পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে। রিকশাটা ঠিক তখন সুমনা’র পারিবারিক কবরস্থানের সামনে এসে থামে। লোকটা অত্যন্ত বিনয়ী গলায় বললো,
‘ এইতো আপনার বাড়ী এসে গেছে। নামেন আপা ‘

বুকের ভেতর গোরস্থানের অসীম নিস্তব্ধতা বইছে। এ বাড়ীতে সুমনা বেড়ে উঠেছিলো। একটু দূরে পাশাপাশি বাবা-মা শুয়ে আছেন। সুমনা বোবা দৃষ্টিতে অসহায়ের মত সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। স্পষ্ট যেন শুনতে পাচ্ছে বাবা- মা নাম ধরে দু-হাত বাড়িয়ে তাকে ডাকছে। শরীর-মন ঝিমঝিম, বোধশূন্য লাগছে। খরস্রোতা সময় গতিহীন লাগছে। ও রিকশাতেই অনড় বসে আছে৷ নামার একদম শক্তি পায় না। বাবা-মায়ের মাথার পাশে দাঁড়িয়ে আছে শিউলি ফুল গাছ। গাছটিকে ঘুম গাছ মনে হয় সুমনার। যে গাছের ছায়ায় বাবা-মা চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছেন। গাছের সবুজ পাতারা বাতাসের মর্মর ধ্বনির সাথে মিলেমিশে অপূর্ব সুরে বাঁশি বাজাচ্ছে। বাতাসের ভাঁজে ভাঁজে বাবা-মায়ের সুবাস বইছে।

তাঁদের সুবাস পেয়ে সুমনা ঝুপ করে রিকশা থেকে নেমে পড়লে, রিকশাওয়ালা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। লোকটাকে অনেকক্ষণ দেরি করে দিয়েছে। তার জন্য মনের ভেতরে একটা অপরাধ বোধ অনুভব করছে। তাঁকে বাড়তি কিছু অর্থ দিয়ে সুমনা বিদায় জানালো।

সুমনা বাড়ীর সীমানায় একা দাঁড়িয়ে আছে। নৈঃশব্দ্য আপাদমস্তক জুড়ে ঘিরে ফেলেছে ওকে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে এক বুক শ্বাস নিলো সুমনা। স্মৃতিরা আষ্টেপৃষ্ঠে ঝাপটে ধরেছে। স্মৃতি ভারে নুয়ে পড়া সুমনা তার ছোটবেলার পুকুর পাড়, কাদামাটির রাস্তা, টিনের চৌচালা ঘর, বাঁশঝাড়, ধানক্ষেত, ফুলের বাগান, খড়ের স্তূপ, সুপারি বাগান, আম বাগান, গোয়াল ঘর খুঁজতে থাকে। কোথায়ও কিছু খুঁজে পেল না ৷ আগের মতো কিছু নেই কোথায়ও।

সুমনার চেনা দৃশ্যগুলো সব মুছে গেছে। হঠাৎ মনে হল ওর – এখানেই কি আসার কথা ছিল! ভুল করে ভুল জায়গায় আসে নিতো!

স্মৃতি শুধু অঝোরে কাঁদায়। মানুষ একমাত্র প্রাণী যাকে স্মৃতির ভারী বোঝা বয়ে বেড়াতে হয় আজন্ম। আপনমনে এসব বলে নিজের মনকে নিজেই প্রবোধ দেয়। স্মৃতির মায়াময় চারদিকের উৎসগুলো অনর্গল কাঁদিয়ে যাচ্ছে সুমনাকে। বুকের একান্তের কান্নার হাউমাউ শব্দ বাতাসের তীব্র শোঁ শোঁ শব্দের সাথে শূন্যে মিলিয়ে যায়। চোখের পানি মুছে দেওয়ার আজ কেউ নেই। নিজেই নিজের চোখের পানি মুছে নেয়। সুমনার স্বর্গীয় ঠিকানা এই বাড়ীর পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে কত মায়াময় গল্প, হাসি-আনন্দ, রঙিন স্বপ্ন। সময়ের আবর্তে সেগুলো আজ সব মুছে গেছে।

শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি বিজড়িত বাড়ীটিতে সুমনা প্রায় এক যুগ পরে ভাইবোনের সাথে ঈদুল আযহার আনন্দ ভাগাভাগি করার জন্য এসেছে। নারিকেল আর সুপারি গাছের ছায়া বেষ্টিত মায়াময় শীতল মাটির বাড়ীটাকে দখল করে নিয়েছে আকাশ ছোঁয়া ইট-কাঠের অট্টালিকা। এই বাড়ীর শোবার ঘরগুলো থেকে এখন আর আকাশ দেখা যায়না৷ চারপাশে দেয়াল আর দেয়াল। মাঝরাতে জানালা দিয়ে জোনাকি পোকা ভুল করে মশারির ভেতরে ঢুকে পড়ে না। টিনের চালে বৃষ্টিজলের নৃত্য শোনা যায় না মাঝরাতে কিংবা নির্জন দুপুরে। মাটির নিকনো উঠোনটা ইটের সারির দখলে।
কাদা-মাটির জন্য চাতকের মতো সুমনার তৃষ্ণার্ত প্রাণ বিন্দু পরিমাণ কাদা – জল খুঁজে পেল না কোথায়ও। বাড়ীর পূর্ব পাশে ছিল গভীর বাঁশ ঝাড়। এখানে বসেই লুকিয়ে সুমনা দেখতো মাছরাঙার মাছ শিকারের কলাকৌশল। জল ময়ূরের বাসা বাঁধবার শৈল্পিক সৌন্দর্য।

বাঁশ ঝাড় কেটে ফেলা হয়েছে। যেদিকে ও তাকায় শুধু খাঁ খাঁ শূন্যতা।

বাড়ীর সবচেয়ে বেশী শোভা বর্ধনকারী কৃষ্ণচূড়া ফুল গাছটিকেও দেখা যাচ্ছে না।লাল লাল ফুলে বর্ষাকালে কী যে সুন্দর লাগতো গাছটিকে। কর্ম ক্লান্ত দিনশেষে শ্রান্ত শরীরে গাছটার ছায়ায় বসে সুমনার বাবা কত অলস সময় কাটাতো। বাবা খুব যত্ন করতো গাছটার। বাড়তি ডালপালা কেটে দিতো। গাছের অতিরিক্ত লতা, পাতায় ঘরের টিনে মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে যেত। বর্ষাকালে শ্যাওলা জমতো বলে মা গাছটাকে কেটে ফেলতে চাইতো। বাবা কোনভাবেই গাছটাকে কাটতে দেন নাই। মা কে কত রকমভাবে বুঝিয়ে সুজিয়ে গাছটিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। অথচ বাবার বাড়ীতে আজ গাছটার কোন চিহ্ন নেই। মনে হচ্ছে কোনকালেই বাবার প্রিয় কৃষ্ণচূড়া ফুল গাছটা এখানে ছিল না। কয়েক বছরের ব্যবধানে বাড়ীটির দৃশ্য পটগুলো সম্পূর্ণভাবে মুছে গেছে।

বাড়ীর ভেতরে প্রবেশ করে ঘরে না গিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে স্মৃতি রোমন্থনে কাতর হয়ে পড়েছে সুমনা। হরেক রঙের ফুল- ফল, পশু-পাখী, পাতাবাহারদের সাথে সুমনার সখ্য গড়ে উঠেছিল এই বাড়ীটিতেই। হাতে কোদাল-শাবল নিয়ে বাবার সাথে বাড়ীর উত্তর দিকের খোলা মাঠে পেয়ারা-কলা বাগানে কত মাটি নিরাতো ও। সাঁজের বেলায় গাছে পানি দিতো। সে যে কী আনন্দ মুখর সময় ছিল দিনগুলোর আনাচ-কানাচে।

ফুলের বাগানে বাবার সাথে খেলায় খেলায় ছুটির দিনগুলো কাটতো, ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়াতো সুমনা। একসঙ্গে ফুল তুলতো, ফুল বাগানে লুটোপুটি খেতো বাবা-মেয়ে। ফুলের বাগানে আসা রঙ -বেরঙের প্রজাপতিদের পিছন পিছন সারা বাড়ী দৌড়ে বেড়াতো সুমনা। কোনমতে একটা প্রজাপতি ধরে ফেলার সে কী উৎসব! এ ফুল থেকে ও ফুলে ঘুরে ঘুরে মৌমাছির মধু খাওয়ার অনিন্দ্য সুন্দর দৃশ্য দেখে মুগ্ধতায় হারাতো সুমনা। লজ্জাবতীদের ছুঁয়ে দেওয়া মাত্র তাদের চুপসে যাওয়া দেখে হাসিতে ভেঙে পড়তো। কালের আবর্তে হারিয়ে যাওয়া অন্যসব দৃশ্যগুলোর সাথে ফুল- ফলের বাগানগুলোও হারিয়ে গেছে।

মামাতো- খালাতো ভাইবোনসহ গ্রামের অন্য সমবয়সীদের সাথে সময় পেলেই বিকেলবেলা বাইরের মাঠে খেলতে যেতো সুমনা। খেলাধুলার দারুণ পরিবেশ ছিল তখন। খেলাধুলার প্রতি খুব আগ্রহও ছিল ওর। দাড়িয়াবান্ধা, ডাংগুলি, কানামাছি ভোঁ ভোঁ, বউ চি – আরো কত কী খেলা!

গ্রামের পাড়া- প্রতিবেশীরা একে অন্যের সাথে মিলেমিশে জড়িয়ে থাকতো। বিকেল ঘনিয়ে অন্ধকার নেমে এলেও দেখা যেত গ্রামের রাস্তায় ছোটছোট ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে গল্প – আড্ডা, আনন্দে মেতে থাকতো। মায়ার এক অলৌকিক চাদর ঢেকে রাখতো গোটা গ্রামটিকে। কোন বখাটের পাল্লায় পড়তো না কখনো গ্রামের কেউ। লুকোচুরি (পলান, পলান) খেলতে গিয়ে অন্যের ঘরের কত কাপ – প্লেট যে ভাঙতো ছেলেমেয়েরা, তার হিসেব নেই। তবুও তাঁরা খুব একটা রেগে যেতেন না।

হাত থেকে ছুটে গিয়ে এক বাড়ীর গরু অন্যের জমিনের সব ধান খেয়ে, মাড়িয়ে সাবাড় করে ফেলেছে, তাও খোঁয়াড়ে নিতে দেয় নি কেউ। এক বাড়ীর হাঁস-মুরগী-ছাগল আরেক বাড়ীতে চলে যেত। খবর পেলেই ফিরিয়ে দিত। আহা! কি বিশুদ্ধ ছিল তখনকার গ্রামের সহজ, সরল পরিবেশ!

সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে শৈশব, কৈশোরের চেনা দৃশ্যগুলো সব হারিয়ে গেলেও, সুমনা ভুলতে পারেনি কিছুই।

স্মৃতির অথৈ সাগরে ভাসতে ভাসতে সুমনা উঠোনে একটা চেয়ার টেনে বসলো৷ স্মৃতির ধুলোমাখা ফ্যাকাসে ঘুড়িটি উড়ছে বাড়ীর শরীর জুড়ে। চারদিকে এত এত জৌলুষ তবুও বাড়ীটিকে জরা জীর্ণ মনে হলো। কোন উচ্ছ্বাস, আনন্দ, সুখ খুঁজে পায় না সুমনা। বাবা-মায়ের শব্দ, হাসি নেই। বাবা-মা হীন চারপাশ জুড়ে সব নীরব, নিথর লাগছে। বাড়ীর মূল প্রাণ বাবা- মা নেই বলেই হয়তো এমন লাগছে। আবারো নিজেকে নিজেই সান্ত্বনা দেয়। বাবা-মা ছাড়া পরম আদরে মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনা দেয়ার আর কে বা থাকে! ও চুপচাপ একা একা বসে থাকে।

ছোটবেলার রোদ পোহানো উঠোনের দক্ষিণ দিকে পলকহীন তাকিয়ে থাকতে থাকতে কানে ভেসে আসে মারজান খালার গলা। যেখানে এখন শোভা পাচ্ছে নকশা আঁকা অত্যাধুনিক বৈঠকখানা। আগে এখানে ছিলো সারি সারি খড়ের স্তূপ। যে স্তূপগুলো ডিঙিয়ে মারজান খালা রোজ গোধূলি বেলায় অপেক্ষায় থাকতো সে সুর শোনার জন্য। যে সুর সুমনার চেনা থাকলেও, সুরের মানুষটি ছিল অচেনা। ওই অচেনা মানুষের জন্য সুমনার কোন তাড়া না থাকলেও, মারজান খালা প্রতিদিন নিয়ম করে অপেক্ষায় থাকতো।

‘ তুমি বিনে আকুল পরাণ
থাকতে চায় না ঘরে রে
সোনা বন্ধু ভুইলো না আমারে
আমি এই মিনতি করি রে
সোনা বন্ধু ভুইলো না আমারে ‘

উত্তপ্ত উনুনে ভাজা কৈ মাছের মতো ছটফট করতে থাকা খালা শান্ত হতো এই গানের সুর শুনে। এই সুর ভেসে আসা মাত্রই মারজান খালার মুখে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ার আভা ছড়িয়ে পড়তো। চোখেমুখে খেলে যেত গুপ্তধন পাওয়ার আনন্দ।

কী আশ্চর্য ! সে মধুময় সুর আজ এত বছর পর কোথা হতে ভেসে আসছে সুমনার কানে!

সুমনা ছোটবেলায় না বুঝলেও আজ খুব বোঝে, কেনো এমন অপেক্ষায় থাকতো মারজান খালা!

যেদিন মারজান খালার পরিবার তার মতামতকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে দূরের দেশে নির্বাসন দিয়ে দিলো তাকে, এরপর থেকে গোধূলিতে আর কোনদিন শোনা যায় নি সে অপূর্ব জাদুর সুর।

সুমনা জানে হারিয়ে যাওয়া সে সুর আজো আছে কোথাও না কোথাও, দীর্ঘশ্বাসের গল্প হয়ে।

প্রাক সন্ধ্যার আকাশ ভেঙে একঝাঁক পাখী উড়ে গেলো। ওরা উড়ে যেতেই হুড়মুড়িয়ে নেমে এলো সুমনার ছোটবেলা। নারিকেল পাতার সলা দিয়ে মাটিতে দাগ কেটে রোজ নীড়ে ফেরা পাখীদের গুণে গুণে রাখতো ও। এঁটেল মাটির বুকে খুব যত্নে গাঢ় চিহ্ন এঁকে রাখতো, যেন পাখীর সংখ্যার এদিক ওদিক না হয়। পুরোদস্তুর অর্পিত দায়িত্ব ভেবে কাজটি করতো সুমনা। পাখীদের হিসেব কষতে কষতে মায়ের দেয়া গুড় – মুড়ি খাওয়ার কথাও ভুলে যেত।

এত এত বছর পর আজো নিয়ম করে এক ঝাঁক পাখী উড়ে গেলো ওর মাথার উপর দিয়ে, কিন্তু পায়ের নিচে তো মাটি নেই। কোথায় দাগ কেটে হিসেব রাখবে পাখীদের?

বাড়ীর পশ্চিম দিকে চোখ যেতেই সুমনা থমকে গেলো। গোয়াল ঘরটা আগের জায়গাতেই আছে। তবে আগের মত স্যাঁতস্যাঁতে নয়, বেশ গুছানো ও পরিপাটি। এটি একটি গোয়াল ঘর, সুমনা প্রথমে ভাবতেই পারে নি।

ঘরটিতে নাইলনের দড়ি দিয়ে কুরবানির জন্য কেনা গুরুটাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। তার সামনে বেতের ঝুড়িতে রাখা হয়েছে সবুজ ঘাস। সন্ধ্যার ম্লান আলোতে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সুমনা – ঘাসের দিকে গরুটার কোন মনোযোগ নেই। সে সুমনার মুখের দিকে করুণ চোখে অপলক তাকিয়ে আছে। সদ্য কুরবানির জন্য কেনা গরুটার অন্যরকম চাহনির দিকে তাকিয়ে সুমনা আবারো নস্টালজিক হয়ে পড়ে।

ছোটবেলায় সুমনাদের পরিবারে দুধ খাওয়ার জন্য একটা গাই ছিল। সুমনার মা রাতদিন পোয়াতি গাইটার সেবা যত্ন করতো। কাচি আর বাঁশের ঝাঁপি হাতে মাঠের পর মাঠ চষে সবুজ কচকচে ঘাস কেটে আনতো সুমনা আর তার ভাই মিলে, গাইটাকে খাওয়ানোর জন্য। পরম আদরে তাকে ঘাসগুলো খাওয়ানো হতো। গরুর কচকচে সবুজ ঘাস খাওয়ার দৃশ্য এত সুন্দর যে সুমনা সম্মোহিতের মত তাকিয়ে দেখতো।

পরিবারের সবার সেবা, যত্নে গাইটি একদিন শেষরাতে ফুটফুটে একটা বাছুরের জন্ম দিল। সবাই তো মহাখুশি। সারারাত সুমনা সহ ঘরের কেউ ঘুমায় নি। ভোরের আলো আধো আধো ফুটতে শুরু করেছে। মা ভীষণ যত্নে গরু ও তার বাছুরটিকে পরিষ্কার করে শুকনো জায়গায় ছালার বস্তা দিয়ে শুইয়ে দেয়।

গোয়াল ঘর ঝেড়ে মুছে ফজরের নামায পড়ে মা সহ সবাই ঘুমাতে যায়। ঘুম থেকে উঠে পুরো বাড়ী তন্নতন্ন করে খুঁজেও বাছুরটিকে কোথায়ও পাওয়া যায় নি। গাইটার চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে বাড়ীর দক্ষিণ পাশে বেড়ীবাঁধের গভীর পানিতে মৃত বাছুরটিকে পাওয়া যায়।

এমন অচিন্তনীয় ঘটায় সবাই হতভম্ব। কারো মুখ কোন কথা নেই।

গোয়াল ঘরে গিয়ে নির্বাক সুমনা নিজের চাদর দিয়ে গাইটির চোখের পানি মুছে দেয়, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। পাথর চোখে সেদিন গাইটি সুমনার মুখের দিকে অবাক তাকিয়ে রয়।

তার কয়েক সপ্তাহ পরেই ছিল কুরবানির ঈদ। সন্তান হারানোর শোকে গরুটি খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিন দিন কেমন কঙ্কালসার হয়ে পড়ে। মাঠে নিয়ে গেলেও শুয়ে থাকতো, নড়াচড়াও করতো না। ঘাস, পানি কিছুই খেতে চাইতো না।

মায়ের সিদ্ধান্তে কুরবানির হাঁটে গরুটিকে বিক্রি করে দেয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয় । কুরবানির হাঁটে নিয়ে যাওয়ার আগে সেদিন গরুটি যেভাবে সুমনার মুখের দিকে শুকনো মুখে তাকিয়ে ছিল, এত এত বছর পর আজো ঠিক একইভাবে কুরবানির জন্য বেঁধে রাখা গরুটিও সুমনার মুখের দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে।

হায় জীবন! কেন মায়াময় দৃশ্যগুলো মুছে গিয়েও বারবার ফিরে আসে!

বড় ভাইয়ের ডাকে সম্বিত ফিরে পায় সুমনা। আকাশের শেষ উজ্জ্বল আভাটুকুও হারিয়ে গেছে অনেক আগেই দিগন্তে। রাত পোহালেই কুরবানির ঈদ। গরুটিকে জবাই করা হবে। আর কোনদিন গরুটার চোখে চোখ রাখা হবে না। বুকের ভেতরে চিনচিন ব্যথা অনুভব করছে সুমনা। বুকের বাম দিকটার ভার বহন করতে পারছে না ও। দু’হাতে শক্ত করে বুক চেপে দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে সুমনা ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে।

 

পলি শাহীনা

ন্ম ৪ জুন, নোয়াখালী জেলায়। ছাত্র-জীবনেই লেখালিখির শুরু। এ-পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থ তিনটি। প্রথম কাব্য গ্রন্থ-গভীর জলের কান্না (২০১৬), দ্বিতীয় স্মৃতিগদ্য-হৃৎকথন (২০১৯), তৃতীয় গল্পগ্রন্থ-ধূসর নির্জনতা (২০২১)।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বসবাস করছেন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও অনলাইন সাহিত্য পত্রিকায় লিখছেন। নিউইয়র্কের ‘সাহিত্য একাডেমি’র সঙ্গে যুক্ত আছেন, এছাড়া বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডেও সক্রিয়।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top