সহজ অথচ বহুস্তর: ফিরোজ এহতেশাম

পুরুষ, পিতৃত্ব ও অন্যান্য গল্প।। রাজীব নূর।। প্রকাশক: বাতিঘর।। মে ২০২১।। প্রচ্ছদ: শাহীনুর রহমান।। পৃষ্ঠা: ১০৪।। মূল্য:২২০ টাকা

 

রাজীব নূরের ছোটগল্পের তৃতীয় বই ‘পুরুষ, পিতৃত্ব ও অন্যান্য গল্প’। প্রচ্ছদসহ বইটির বহিরাঙ্গ ছিমছাম, সুন্দর। এতে নয়টি গল্প সংকলিত হয়েছে। প্রথম গল্প ‘পুরুষ’। বইটির ব্লার্ব থেকে জানা যায় এটি রাজীব নূরের লেখা প্রথম গল্পও বটে। অথচ এ গল্প পড়েই পাঠক তার মুন্সিয়ানার পরিচয় পেয়ে যাবেন নিঃসন্দেহে। এ গল্পে তিনি মানুষের সম্পর্ক, ধর্ম, সম্প্রদায় ও জাতপাতের জটাজাল অনায়াস সাবলীলতায় উন্মোচন করেছেন। দেখিয়েছেন নর-নারীর চিরন্তন প্রেমের কাছে এসব চাপিয়ে দেওয়া বিষয়গুলো কত ঠুনকো, তুচ্ছ, অর্থহীন। পাশাপাশি পুরুষের সামাজিক নানা পরিচয় ও মনস্তত্ত্বের গভীরে আলো ফেলার চেষ্টা আছে গল্পটিতে।

বইটির গল্পগুলোতে মানুষের সামাজিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক, সংকট ও সম্ভাবনার নানা দিক বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরেছেন লেখক। রাজীবের গল্প নির্মাণের কৃৎকৌশলের মধ্যে এক ধরনের ক্যাজুয়ালিটি আছে। তাঁর রচনাশৈলী ও শব্দচয়ন সহজ, সাবলীল। ভাষার ক্ষেত্রে অকারণ কোনো জটিলতা তৈরী করেন না তিনি। অথচ তার আখ্যানের বুনন ও বয়ানের কুশলতা বহুস্তর অর্থময়তা নিয়ে হাজির হয় পাঠকের সামনে। জটিল বিষয়কেও সহজভাবে উপস্থাপনের ফলে তার গল্পগুলো পাঠকের সাথে অনেক বেশি যোগাযোগ-সক্ষম হয়ে ওঠে।

মানুষের জীবনের অনিশ্চয়তার গল্প ‘পিতৃত্ব’। ঘটনাচক্রে এক মুয়াজ্জিনের যৌনপল্লীতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হওয়ার গল্প এটি। গল্পটির একেকটি বাঁক ও মোচর মুগ্ধ করার মতো। বারবার পাঠকের অনুমান ও কল্পনার শৃঙ্খলকে ভেঙে ফেলে চমকিত করে গল্পটি। আবার মুয়াজ্জিন তার কন্যাকে হত্যা করেছিল কিনা-যে ঘটনাকে কেন্দ্র করেই মূলত গল্পটি আবর্তিত, শেষ পর্যন্ত তা রহস্যময়তার আবরণে রেখে এর সমাধানের ভার পাঠকের কল্পনার ওপরই ছেড়ে দেন লেখক। বিষয়বস্তু ও কৃৎকৌশল, টুইস্ট ও কন্ট্রাস্ট, নির্মমতা ও স্যাটায়ার, বহুমাত্রিক বিচ্ছুরণ ও পরিমিতি বোধ, চমৎকারিত্ব ও রহস্যময়তা- নানা দিক বিবেচনায় এটিই এ বইয়ের সেরা গল্প বলে মনে হয়েছে।

‘নহ মাতা, নহ কন্যা’ অসম বয়সী দুই নর-নারীর মনস্তাত্ত্বিক গল্প। নির্দিষ্টভাবে ফ্রয়ডীয় মনস্তত্ত্বের কথাও মনে পড়তে পারে আমাদের। সংস্কৃতিমান মধ্যবিত্তের জীবনের একটি খণ্ডচিত্র উঠে এসেছে এ গল্পে।

ভেঙে যাওয়া পরিবারের একটি শিশুর মানসিক সঙ্কটের গল্প ‘মা-মেয়েটা কিংবা কোকিলছানার গল্প’। শিশুটিকে তার সৎ বাবা কাকের ঘরে কোকিলছানার সাথে তুলনা করলে তার সেই সঙ্কট আরও ঘনীভূত হয়। শিশুটি তার পুতুলের সাথে কথা বলে। পুতুল-মেয়েকে সে কোকিলের কান্না নিয়ে রূপকথা শোনায়। এভাবে শিশুটির আত্মকথন বা স্বগতোক্তির মধ্য দিয়েই নির্মিত হয় গল্পটি। এরই ফাঁকে জানালা দিয়ে নারকেল গাছে কাকের বাসা দেখতে পায় মেয়েটি। এসব অনুষঙ্গ গল্পের মধ্যে এক ধরনের টুইস্ট তৈরী করে। শেষে শিশুটির করুণ পরিণতি পাঠকের মর্মমূলকে নাড়িয়ে দেয়।

কয়েকটি গল্পে রাজীবের সাংবাদিক সত্তার প্রতিফলন ঘটেছে। যেমন ‘বাংলার মুখ’, ‘ইন্দ্রনাথ কেন খুন করল’, ‘কেন কাঁদলেন উপেন্দ্রনাথ সরকার’, ‘জয়ন্তী কেন সংগ্রামের জন্ম দেবে’ গল্পগুলোর আঙ্গিক অনেকটা প্রতিবেদনধর্মী। ধীরে ধীরে গল্পগুলোর ভাবজগৎ ও কাঠামোয় যে পরিবর্তন এসেছে তা টের পাওয়া যায়। ‘যখন কান্নায়ও আড়াল তুলতে হয়েছিল’ বইটির শেষ গল্প। মর্মস্পর্শী এ গল্পে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যার ঘটনাকে ভিন্ন এক কোণ থেকে তুলে ধরা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ঠিক লাগোয়া বাড়ির দুটি শিশু, যমজ ভাই-বোন, তারা বঙ্গবন্ধুর ছোট ছেলে শেখ রাসেলের খেলার সঙ্গী। বোনটির ভাষ্য ও স্মৃতিচারণাতেই গল্পটি মূর্ত হয়ে ওঠে। দুই বাড়ির সীমানা দেয়ালের বুক চিরে জন্ম নেওয়া একটা পাকুড় গাছে এই তিন শিশু আবিষ্কার করে একটি টুনটুনির বাসা। টুনটুনির বাসাটি মজবুত করে গড়ে তুলতে রাসেলের তৎপরতা আর শিশু দুটির সহযোগিতার একটি যৌথ ও উজ্জ্বল স্মৃতি ছিল তাদের। হত্যাযজ্ঞের সময় সেই বাসাটিও ভেঙে ফেলে সৈন্যরা। সবাইকে হত্যা করার কথা শুনে বোনটি যখন কাঁদছিল তখন এক সৈন্য আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করে ‘কাদছ কেন?’ শিশুটি সৈন্যকে বলে, ‘আমাদের টুনটুনির বাসাটা ভেঙে ফেলেছ তোমরা।’ টুনটুনির বাসা ভাঙার কষ্টের আড়ালে আসলে তারা রাসেলের জন্য কাঁদছিল। দুই ভাই-বোনের কান্না দেখে সৈন্যটা হাসিতে ফেটে পড়ে।

মূল গল্প-কাঠামোর ভিতর ছোট ছোট শাখা-গল্পগুলোর কারুকাজ রাজীবের রচনাগুলোকে অদ্ভুত সুষমা দান করে। আর এভাবেই চকিত ইঙ্গিতে বহু বহু কাহিনীর বীজ বুনে দেন তিনি একেকটি গল্পে। কেন্দ্র থেকে পরিধির দিকে যাত্রা করে পুনরায় কেন্দ্রে ফিরে আসা- মোটা দাগে এটাই তার রচনার চালচলনের বৈশিষ্ট্য। গল্পের ভেতর ছোট ছোট পর্যবেক্ষণ ও কূটাভাস পাঠকের চিন্তাকে আন্দোলিত করে।

উল্লিখন ও তার পুনর্নির্মাণ, নতুন নতুন চিত্রকল্প, নিসর্গের বহুরৈখিক উন্মীলন, দেশজ ও বৈশ্বিক ঐতিহ্য, নিজস্ব দর্শন, সময় ও ইতিহাস চেতনা, রাজনীতি, সামাজিক অসঙ্গতি, মিথ-পুরাণের বিনির্মাণ, বক্রোক্তি, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ বা স্যাটায়ার প্রভৃতি তাঁর গল্পে সাবলীল দক্ষতায় তিনি ফুটিয়ে তোলেন।

কোনো গল্পে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার বইটির মধ্যে ভিন্নরকম ধ্বনিমাধুর্য ও স্বাদ যুক্ত করে। তাঁর ভাষার ক্যাজুয়ালিটি ও ভাবের বহুমাত্রিকতার কন্ট্রাস্ট সম্ভব করে তোলে এক নতুন ধরনের রসায়ন। আর পরিমিতি বোধ তাঁর রচনাকে সুসংহত ও ঘনবদ্ধ হতে সাহায্য করে।

তাঁর রচনায় এভাবেই তিনি নির্মাণ করে তোলেন এক নবতর পরিমণ্ডল। এসব কৃৎকৌশল আর অন্তর্নিহিত সূক্ষ্ম কারচুপির সুষম বিন্যাসের মধ্য দিয়ে রাজীব নূরের গল্পকে, গল্পের শক্তিকে আলাদা করে চেনা যায়।

তাঁর গল্পগুলো জীবনঘনিষ্ঠ, প্রাণবন্ত, কখনো রোমাঞ্চকর। গল্পের আঙ্গিক নিয়ে নীরিক্ষার প্রবণতাও লক্ষ্য করা যায় রাজীবের মধ্যে। গল্পগুলো কখনো সংলাপ-নির্ভর, কখনো আত্মকথন ও স্বগতোক্তিময়, কখনো প্রতিবেদনধর্মী, বর্ণনাত্মক। নানা আঙ্গিকের মধ্য দিয়ে তিনি অনাড়ম্বর ভঙ্গিতে তার গল্পগুলো আমাদের বলেন। তা সত্ত্বেও তাঁর গল্পের বিষয়বস্তুর জোরেই চাঁছাছোলা বাস্তবতাও কখনো কখনো পরাবাস্তবতাকে স্পর্শ করে। ফলে এই পরাবাস্তবতা বানানো, তৈরী করা বা মেকি বলে মনে হয় না আমাদের।

তার গল্পগুলোর মধ্যে মতাদর্শিক কচকচানি নেই, তবে শুভ চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা, মানবিকতার গান অন্তপ্রবাহের মতো বেজে চলে। প্রকট না হওয়ার কারণেই হয়তো এই গানের মধ্য থেকে উৎসারিত ইতিবাচকতা আমাদের অবচেতনের সঙ্গে মিশে যায়।

নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর চরিত্ররাই মূলত তাঁর গল্পে বিচরণ করে। মূল বা পার্শ্বঘটনার সাথে রূপকথা, উপকথা, পুরাণের সমান্তরাল উপস্থাপন তাঁর গল্পে ভিন্ন মাত্রা যুক্ত করে। এটি রাজীবের গল্পের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যও বটে।

বইটির গল্পগুলো পাঠকচিত্তে দীর্ঘ সময়জুড়ে অনুরণন তুলতে থাকবে বলেই আমার বিশ্বাস। এই সাহিত্যকর্মের জন্য রাজীব নূরকে সাধুবাদ।

 

ফিরোজ এহতেশাম

জন্ম ২৪ মে ১৯৭৭। বেড়ে ওঠা রংপুরে। পড়াশুনা করেছেন কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ও বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটে। ১৯৯৪ সাল থেকে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন ও দৈনিক পত্রিকায় লেখালেখি শুরু। কবিতা, গল্প, মঞ্চ নাটক, প্রবন্ধ, ছড়াসহ নানান শাখায় তিনি লেখালেখি করেন। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ১টি-অস্ত্রে মাখিয়ে রাখো মধু (সংবেদ, ফেব্রুয়ারি ২০১০)। বাউল সাধকদের সাক্ষাৎকারভিত্তিক প্রকাশিত গ্রন্থ ‘সাধুকথা’। সহ-সম্পাদক হিসেবে একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় কাজ করছেন।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top