গাজী রফিকের একগুচ্ছ কবিতা

দেহযোগ

যদি হৃদয় দিয়ে আকাশ অধিগ্রহণ করো। অপরিবর্তিত থাকে
প্রেমের জলবায়ু।
অতিবর্ষণ, বজ্র এবং অনাবৃষ্টির না থাকে ভয়, প্রতিরোধেঃ রিপ্রোডাক্টিভ ক্ষরা।

জন্ম গ্রহণ করেছ তাই, জন্ম দিতে এতোটা উদগ্রীব হয়েছ, পৃথিবীতে
এ-ই যদি হয়
ঋণ পরিশোধ তার…!
প্রাণরসায়ন বোঝার আগে, জীবনের সেই তত্ত্ব, অধিবিদ্যা জৈবিক কিনা;
ভালোবাসা ভালোবাসা বলে দেহ তল্লাশি করো?

কত কত বার বলেছিলে তুমি,
বংশবৃদ্ধি কলা শুধুই বায়লোজিক্যাল, অই যে…
(উচ্চ প্রজননশীল, একটি ভেড়ার খামার পরিদর্শনে গিয়ে
সেবার জীববিদ্যা ব্যাখ্যা করে, নিজেই তুমি বলেছিলে)
জৈবিক দেহযোগে প্রজননই হয়, লিঙ্গনিপীড়ন নয় ভালোবাসা।
সমাজবিজ্ঞান কিংবা দর্শনও যদি এ কথাটা বোঝাতে পারতো কী ভালো হতো… তাই না…

কত শক্ত বিষয়, এতো সহজ করে বলেছিলে,
মনে আছে ?

ভালোবাসা কী তবে…!
জ্ঞান, চিন্তা, সত্যোপলব্ধি, নৈতিকতা, অন্তরের চোখ ছাড়া
ভালোবাসা হয়?

হয় নাকি…? ভালোবাসা আকাশের মতো…?
তার পরে তো…

আকাশ অধিগ্রহণ করার কথা বলে, অবশেষে শেষ করেছ হৃদয় খুলে দিয়ে।

 

পদকর্তা

আমি বলি আমি নারী ভালোবাসি, তুমি বলে দিলে; নারী লোলুপ
যখনই মেরিনাকে পোস্টে দেখেছ, কড়া লিপস্টিকে হাসিতে,
হয়েছি নারী নিপীড়ক।
ফর্সা ত্বকের নারী, এই কথায়, তুমি বললে; আমি রেসিস্ট
পদ-পদধারি ভালোবাসি বলে, বললে আমাকে পদলেহী।
দেখো কে না চায়! ও-ই, মই বেয়ে বেয়ে ওপরে যেতে,
অই যে, বলে না… সমাজে ইজ্জত বলে একটা কথা তো আছে;
লোকে কত তোয়াজ, স্তব স্তুতি করে, আমার মন ভরে যায়
টাকা ছাড়া পৃথিবীতে কিছু হয়!
ভিক্ষা করে যদি প্রেম করা যেতে, তো ভালোই হতো,
কবে ঝরে যেতো, ত্বক চিকচিকে এই রেশমি লাবণ্য।

ধন ভালোবেসে ধন্য হয়েছি, তবু তোমার কাছে আমি বন্য!
(বড়লোকের) কোনো গুণ গান করেছিতো, অমনি হয়েছি চাটুকার।
একালের আমি মহা পদকর্তা, হাড়ে হাড়ে তুমি জানোও তা, তাও বলো
আমি নগন্য, লোভী:
অথচ আমিই কবি, সবার ওপরে এই কথা সত্য।
জনগণ আমাকে কবি বলে চেনে, এই ইহকালে একা;
এর থেকে বেশি কী চাই?
কেউ খেলো কিনা, কি মারিতে ভুগছে, কে উদ্বাস্তু এই ভুবনে !
তাতে আর আমার
কি যায় আসে? ধূলায় স্বর্গ রচনা করেছি, দখলে নিয়েছি মর্ত্য।

 

ত্রিশ লক্ষ প্রভাত

বাংলার মানুষের ভাগ্যাকাশে একটি মানচিত্র আঁকা হলো, কত দুর্যোগ
দুর্ভিক্ষ, শোষণ, বঞ্চনা শেষে, ষড়ঋতু শস্যশ্যামল-বাংলা, এই
মেঘের প্রেক্ষাপটে।
আরও কত নদ-নদীর প্রস্তাবনায়; দিকদিগন্ত মিলেছে এসে
ভালোবাসার বিশ্লেষণে
মন ছুঁয়ে গেছে পদ্মা মেঘনা যমুনার জলরং।

এই ১৯৭১-এ, অবশেষে একটি নতুন সূর্য এসে
আগুন রঙে জ্বেলে, এই মানচিত্রটি
মাটিতে এঁকে দিয়েছিলো।
ত্রিশ লক্ষ প্রাণ বলিদান শেষে,…কী আশ্চর্য!
যেন ত্রিশ লক্ষ প্রভাত মিলিত হলো,
হলো রক্তিমাভ একটি সূর্যোদয়ে
সাড়ে সাত কোটি হৃদয়ে হৃদয়ে লিখিত বাংলাদেশ।

 

রেপ্লিকা
মাথায় ছিলো তোমায় একটি গোলাপ দেবো।
নিউরনে ফুটলো গোলাপ, হৃদয়ে তার শেকড় খুঁজে মরি
চর্মচক্ষু নয়… কেন না
অন্তরের ও-ই প্রেক্ষাপটে
ধমনী আর শিরায় তাকে ইচ্ছে মতো আঁকি।

মাথায় ছিলো, তোমায় একটি গোলাপ দেবো
যা দিয়েছি, রেপ্লিকা তা,
আসল গোলাপ মাথায়ই আছে
প্রতিবার যা দেই তোমাকে, রেপ্লিকাটা !
আলাপঃ (বাকি কথা, আসলে গোলাপটি কাউকে দেয়াই হয়নি)

মাথায় ছিলো তোমায় একটি গোলাপ দেবো, গোলাপ কি আর
মাথায় থাকে! ধমনী আর শিরায় তাকে অক্সিজেনে রাখি।

 

ভালোবাসায় না থাকি

বোধে নাই ভোগে থাকি ষোলোআনা, রোজ তাই ষড়রিপু উদযাপনে যাই…
ভালোবাসায় না থাকি! দেহগত উন্মাদনায় আছি
জিন, রক্তকণিকায়, হিংসায়, লোভে, রিরংসায় আছি
পীড়াগ্রস্ত হৃদয়ের নিরক্সিজেন
নিকৃষ্ট ক্রিয়ায়…

আহা! কুৎসা, নিন্দা-মন্দ কিছুই না ক’রে কখনো, কীভাবে
রক্তমাংসে থাকি। বলি, তৈলাক্ত করি কাউকে কিছু পেতে,
যারা লুকিয়ে আয়নায় দেখি মুখ,
অথবা কুৎসা করে করে যারা অন্তরে মরে গেছি

মিথ্যা কথা বলে, মিথ্যা কথা বলে, মিথ্যা কথা বলে, কারো না কারো
মুখ কালি করে দিয়ে, যারা অনাহুত
নিজের চেহারায় তবু উজ্জ্বলতা পাই।

এই রেসপিরেটরি…! এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা…! বোধে নাই
ভোগে থাকি ষোলো আনা রক্তমাংসে, সংবেদনে নাই।

বংশবৃদ্ধি কলা’ই কলা, ষোলকলা, রোজ তাই ষড়রিপু উদযাপনে যাই।

 

ডার্ক ম্যাটারে ডার্ক ম্যাটারে মহাশূন্যে যাই

আকাশ কোথায় ! ডার্ক ম্যাটারে ডার্ক ম্যাটারে
মহাশূন্যে যাই,
আকাশ তো নেই।

উড়তে গেছি মহাশূন্যে…
আকাশ কোথায় ? গ্রহের পরে গ্রহই গ্রহ
গ্রহ-উপগ্রহের ব্যবধানে, নক্ষত্র মণ্ডলে গেছি…

ডার্ক ম্যাটারে ডার্ক ম্যাটারে মাধ্যাকর্ষণ পার হয়ে যাই,
গ্র্যাভিটি অমান্য করি, আকাশ কোথায় ?
কোথায় আকাশ, দেখলে কোথায় ?
নীল মানে তো মহাশূন্য !

আকাশ তো নেই, এই ছায়াপথ, আমরা ডাকি আকাশগঙ্গা।
সৌর পরিবার পাড়ি দেয়, কক্ষপথে।

আকাশ গঙ্গায় আমার বাড়ি এই পৃথিবী
তোমার বস্তি কোন যমুনায়… ? শূন্যতা কি নয় হাহাকার…
নীল বেদনায় কার এমন কী দুঃখ বেশি, দুঃখ বেশি…! কিসের দুঃখ…
আমরা কী নই প্রতিবেশী…?
ডার্ক ম্যাটারে ডার্ক ম্যাটারে, ছুটছে গ্রহ উপগ্রহ
এই পৃথিবী মহাশূন্যে ছুটছে নিজের কক্ষপথে, আকাশ কোথায়… !
আকাশ কী নেই… আকাশ কী নেই…

মনের মাঝে দশদিগন্ত, মনের মাঝে আকাশ ছিলো… মনই জানে হৃদয়ে দিয়ে দেখা।

 

গাজী রফিক

গাজী রফিকের জন্ম: ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৮। পড়াশোনা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি আশিদশকের একজন কবি। তাঁর কবিতার বই: চেতনার ফুল (১৯৮২), আদিঅন্ত পরাধীন (১৯৯০), মানবমুক্তির মন্ত্র (১৯৯৬), নব্যরূপান্তরবাদ ও অপ্রচলিত কিছু কবিতা (২০০৩), কালো মেয়ে কবিতা (২০০৯), পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতা (২০১১), নির্বাচিত কবিতা (২০১৪), গাজী রফিকের কবিতা (২০১৪)। সম্পাদিত গ্রন্থ: কবিদের প্রেম (১৯৯৬), রূপান্তর আশিদশকের কবিতা (২০০৩)।

গবেষণাঃ ১.তাঁর উদ্ভাবিত ‘তাপ ও ওজন পদ্ধতি’ প্রয়োগ করে রান্নার স্তরে চালে অতিরিক্ত জল ব্যবহার করলে ১৩-১৫% চাল অপচয়ের একটি নতুন ফাইন্ডিংস ২০১২ সালে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। ২. ২০১২-১৯ সালের মধ্যে গমের আটার সঙ্গে রাইস ব্রানের আপেক্ষিক মিশ্রণে ওরিফোকোট (OryFoCoT) নামে আটার একটি কম্বিনেশন করেন তিনি। এর রোগপ্রতিরোধী গুণ রয়েছে এবং এতে গ্লুটেনের উচ্চমাত্রা সহনীয় স্তরে নেমে আসে।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top