পুলক হাসানের বারোটি কবিতা

ভাষা

তোমাকে সাফ বলে রাখি সুচেতনা
ভাষার ওপর কোনোরকম দুর্বৃত্তপনা
বরদাস্ত করব না।
সে নহে সাদাকে কালো, কালোকে সাদা করার
বিজ্ঞাপনী প্রতারণা!
সে আমার হাসি-কান্না, রক্তের দ্যোতনা
মরুর বুকে বসন্তের উষ্ণ ঝরণা।
এমনকি তার কারণেই তোমাকে দিতে পারি
ফি-বছর বন্যার সকরুণ বর্ণনা!
ভেবে দেখো পোশাকী-বন্ধন ছেড়ে
দুর্গত এষণা থেকে ফিরে
আত্মমুখী হবে কি না
হবে কিনা আত্মার ডুবুরি?
জ্ঞানের পিঠে মারছে কিন্তু ছুরি!

 

গতানুগতিক

তোমার মন ভ‚গোলে আমি নেই
মৃদুঝড়ে বহু আসেই
পাতার মতো গেছি উড়ে।
তবু বর্ষা এলে কেন যে মনে পড়ে?
আঁখিতলে জল ঘুরে ঘুরে
একাকী কথা বলে!
সেকি জীবনানন্দের টানে?
পুরনো সব পিছে ফেলে
সময় যখন ছুটছে উজানে
তখন কেন এই মগ্নতা
প্রশ্রয় দেয় কবিতা?
বলো, বলো নিভে যাওয়া আলো
সেকি শুধু স্মৃতিকাতরতার জন্য?
আমি কিন্তু বিনয় নই, থাকি ঢাকা
ভুলেও বলব না ‘ফিরে এসো চাকা’।

 

ছুটিতে

আরতি
এ যেন শ্বাসরুদ্ধকর সিনেমার বিরতি!
তুমি অনতিদূর মাওয়া
আর আমি ঢাকা
ছুটিতে ফাঁকা হয়ে যাওয়া ঢাকা!
তোমার মনে ফুরফুরে পর্যটনের হাওয়া
আর পদ্মার ইলিশের চকচকে আতিথেয়তা
ভেতরে তোলে তৃপ্তির ঢেঁকুর
আর আমার ভেতর বেজে চলে সতীনাথের গান
বিরহ-মধুর!
সঙ্গে অলস সময় কাটানোর জন্য ভ‚ণা খিচুড়ির
মতো টাটকা কয়েকটি মনোরম ঈদসংখ্যা।
কিন্তু এত গল্প পড়ি
তোমার গল্পের সঙ্গে মেলে না।
তুমি এত স্বার্থপর কেন মনা?
এড়িয়ে চলো আমার বিন্দুর মতো বাসনা!

 

কবিতাযাপন

শেষতক কবিতার সঙ্গেই বাঁধলাম গাঁটছড়া।
সে-ই সারাবেলা মুখস্থ রাখে আমার উ™£ান্ত মলিন চেহারা
মেঘের মতো ভাসিয়ে চলে আকাশ থেকে আকাশে
বিনা পূর্বাভাসে!
আমি সহজেই টের পাই কখন উঠবে বেজে বাতাসের দোতারা
আমাকে প্রসন্ন রাখতে প্রস্তুত থাকে
আষাঢ়-শ্রাবণ দুই সহোদরা।
আমার তাই মানুষ দেখে ক্লান্ত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

 

টের পাচ্ছি

দেশটা যে সোনার
টের পাচ্ছি।
টের পাচ্ছি
কাছে থেকেও তোমাকে না চেনার!
টের পাচ্ছি
কার মনে কতটা ঝলসানো রবি
কার মনে স্মৃতিগাথা ও বিরহের ছবি!
ধূর্ত রাজনীতির বিষবাষ্পে
ধূমায়িত চায়ের কাপে
ঝড় বয়ে যায় বটে
কিন্তু গোপনে জড়ো হয় আষাঢ় অনুশোচনা!
সে যে মধ্যবিত্তের ভুতুড়ে বিলাস
জোর করে কবিতা লেখার উপহাস
জানতাম না।
জানতাম না বলে
নতুন জোয়ারের মাছ এত খলবলে!
ফলে ভাবতে পারি না
ঘাসের ডগায় শিশির
ঝলমলে সূর্যকণা
মুখরতা ভেঙে প্রবল হয়ে ওঠে
নৈঃশব্দের ভ‚মিকা!
আর সেখানে অপেক্ষা
অনন্তের ঘাটেবাঁধা নৌকা।

 

শ্রমিক দিবসের কবিতা

আরক্তিম ঊষার আবীরে
রক্তিম চেতনায়
ঐ রোদ যেন অগ্নিস্রোত
বহিছে তার শিরা-উপশিরায়!
আমি তাকে শ্রমিক বলে ডাকি
আর সুখপাখিটাকে আড়াল করে রাখি
যেহেতু নিচের দিকে তাকাতে
মাথা নোয়াতে
কে চায়?
অথচ তারই শ্রমে-ঘামে নির্মিত
তোমার আমার স্বপ্নসৌধ।
পতাকার মতো পতপত
মন উড়ে
শিখরে
যেন বৈষম্য বাগানের পিঁপড়ে!

 

ক্ষমাহীন

সেই যে শীত ছুঁয়ে গেছে গতর
আজও তার মন পাথর।
পাথর গলে জানি ভালোবাসার উত্তাপে
তবে কি সে ভালোবাসা আদিপাপে ছিল শীতের নগ্ন রূপে?
সময় তাকে দিচ্ছে না পাত্তা
কবিতার কেন এত কাতরতা?
আর রাজনীতিও তো বর্জ্য লালনের কথাই বলে
যেহেতু তারও হাঁসের মতো বেড়ে ওঠা কাদাজলে!
তাহলে তোমাকে আমাকে নীলিমা
কেন করবে ক্ষমা?

 

সংযম

কবিতা কখনও কখনও এমন অস্পষ্ট ও অপ্রয়াসী
যেন তার ভেতর ঢুকতে প্রয়োজন দোভাষী!
এমন ভাবের সমুদ্রগামী কেউ
আছড়ে পড়লেই কি প্রবালের ঢেউ?
অন্যরকম আলো সে বয়ে বেড়ায়!
কিন্তু গোপীর মতো বহুরূপী সময়
কেবলই রঙ্গলীলা চায়
চায় স্থুলতায় সময়কে রাঙাতে!
অথচ নক্ষত্রের আগুনভরা রাতে
হৃদয় সঁপে দিয়ে মালবিকার হাতে
নিজেকে পরখ করে দেখেছে রুমী
প্রকৃত প্রেম আসলে রমজানের মতোই সংযমী।

 

আজ বুধবার

আজ বুধবার। মন খারাপের দিন বলব না
বলব নদীর মরণ মোহনা!
বলব সময় বইছে শতাব্দীর গøানি
কিন্তু তুমি রমণী!
ধরে নিয়েছ সবই অভ্যাসগত
নক্ষত্রের পতনেও তাই নও বিস্মিত।
নইলে শান্তির পূর্বশর্ত
ভালোবাসার মধ্যে যখন ঢুকে পড়ছে সনাতন বিষ
ধর্ম ও বিজ্ঞানে যখন বাড়ছে দূরত্ব
তখন তুমি আমায় ডাকবে কেন অনাহুত?
আমি এখন ছন্দচ্যুত বাতিল পদ্য
আর ঘটনা বেদনাপ্রসূত!
ফলে ফুলের সুবাসে কিভাবে হয়ে উঠব অনবদ্য?
যখন তোমার হৃদয়ে ঢোকা দুঃসাধ্য!
গানগুলি চরণামৃত, শ্বাশতও প্রবঞ্চিত।
তবু তুমি আমায় ডাকছো একটা ব্যর্থ চিৎকারের
ভেতর অবাক জ্যোৎস্নায়!
যাকে আমার মনে হয় মাকড়সার জালবুনন
মনে হয় গোধূলির রক্তক্ষরণ!
তারচেয়ে ভাল নয় কি রোদের দহন?

 

সহজ কবিতা

বিশ্বাস একটা ফুলের চারা
তুমি তার সুবাস নিতে না পারো
উপড়ে ফেলো না
দুঃখীর মতো তার ফ্যালফ্যাল আঁখি
বড় মায়াময়।
আর যে সহজে বিলিয়ে দেয় প্রজাপতি হৃদয়
সে-ই তো ঐশ্বর্যময়।
তোমার সনাতন উত্তেজনা
সেখানে হাঁসের ছলনা!
আমি তা কল্পনাও করি না
বরং অবাক হয়ে দেখি
ধুলোকণার ভেতরও সে স্বর্ণরেনু।
তোমার অধীত বিদ্যার অবহেলায়
তার কী এসে যায়।
কী এসে যায় সেখানে যুক্তির জঞ্জালে
কেউ যদি দেয়াল তোলে?

 

অবিকল্প

বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দেব না
আগুনের সঙ্গেও না
আগুনে যে অঙ্গার
বাতাস বইছে তারই বেদনাভার!
অবিকল্প তাই এই গল্প।
মমতা নামের মেয়েটি এত দুঃখিনী
আমি তাকে ডাকি বাঙালিনী
কিন্তু মসনদের নেশায় তাকে বারবার
হাতবদল করতে চায় সময়
আর সেই হচ্ছে আমার বিস্ময়!
বিস্ময় আরো
সে এখন পুরোপুরি দুর্বৃত্তদের করতলে!
ফলে টলটলে চোখের জলে
মমতা জাগে না কারো।
তাহলে কী লাভ হলো
বর্গী থেকে তাকে রক্ষার?

 

প্রতিভা কাহিনি

প্রতিভা টর্চের মতো অন্ধকারে
আলো ফেলে ফেলে যাওয়ার কথা
কিন্তু দিচ্ছে বিপরীত বার্তা!
প্রতিভার চমকে তাই টের পাই না
কার মনের ভেতর আলো কার অন্ধকার।
প্রতিভাকে জানতাম সোনালী আঁশ
ভ‚গোলময় বাংলা পরিচয়
আর মসলিন আরও প্রাচীন আরও দ্বিধাহীন।
এখন দেখছি রূপসী এক বাউল
কাদায় নিমজ্জিত হাঁসের কানের দুল!
ফলে বলার অবকাশ আছে
বহু প্রতিভার এই দেশে
একমাত্র প্রতিভাহীন মেঘ।
সে মেঘ উজান ঢলে হাওরের বাঁধভাঙা আবেগ
স্বপ্নের শস্য হারানো কৃষকের বুকের হাহাকারে রচিত এক কাহিনি
যা তুমি আমি টিভির সামনে বসে মনোযোগ দিয়ে শুনি!
কিন্তু বাড়িয়ে দিই না হাত
যেন টানে পশ্চাৎ।

 

পুলক হাসান

জন্ম ২৪ জানুয়ারি ১৯৬১ নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ৯নং ওয়ার্ড জালকুড়ি গ্রামে। পিতা : আবদুল বারেক ও মাতা : নূরুন্নাহার বেগম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কেটিং-এ সম্মানসহ ¯œাতকোত্তর। পেশা : সাংবাদিকতা। বিবাহিত। স্ত্রী রীনা ইসলাম ও কন্যা আরিয়ানা ইফফাত নূর রুসামাকে নিয়ে যাপন।

প্রকাশিত গ্রন্থাবলি: চক খড়ি মেয়ে (কবিতা) ১৯৯১; ও জল ও তৃষ্ণা (লিরিক) ১৯৯৭; সব দাগ ওঠে না (কবিতা) ২০০৮; পরকীয়া ওমে (কবিতা) ২০১১; রোদ ও ছায়ার রচিত (কবিতা) ২০১২; কবিতার গদ্যরূপ (প্রবন্ধ) ২০১৩; কবিতা : সহজ করে বলা (প্রবন্ধ) ২০১৭; বাছাই কবিতা (কবিতা) ২০১৮; আরো কিছু বুদবুদ (কবিতা) ২০২০;মুহূর্তের কবিতা (কবিতা) ২০২০; প্রতিবেশি ও বেলুন সভ্যতা (কবিতা) ২০২১ এবং আমার কবিতা (কবিতা) ২০২১

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top