তূয়া নূরের একগুচ্ছ কবিতা

হারিয়ে ফেলা

তুই কবে বড় হবি? কবে হবি সাবালক?
ধরবি সংসারের হাল?
বড় হবার বয়সতো পার হয়ে যায়!
তোর ভেতর ঘরে কার বসবাস?
কে তোর লাগাম টেনে ধরে?
বেঁধে রাখে হাত পা শেকলে,
চুপচাপ মাথা পেতে মেনে নেয়া সব মনটাকে জীবন্ত মাটিচাপা দিয়ে।

জীবনটা কী আর খিচুড়ি রান্না!
তিন মুঠো চাল, এক মুঠো ডাল, লবণ, আদা, রসুন, তেল পিয়াজ
হাড়িতে ঢেলে চুলোয় বসিয়ে দিয়ে জমে গেলি ব্যাচেলর ছেলেদের সাথে তাস খেলায়!

এতো কথা বলি তোকে, তবু এতো নির্বিকার কেন তুই?
একটা দুটো কথা বলে সব কথা শেষ হয়ে যায়,
অথচ দেখ, কতো কথা বলে অন্য সব মানুষ।

এতো কী ভাবনার ভার  বিমূঢ় করে রাখে তোকে?
আজ না কাল বলবো, আরেকটু বড় হয়ে নি—এরকম আবোলতাবোল করে কোনদিন কিছু বলা হয়ে ওঠে না।

একদিন দেখিস তুই সব হারাবি
তাকেও হারাবি!

কোনদিন ভোর হবে না

আমরা এখন অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলি না,
কথা বলতে ইচ্ছে হয় না।
ব্যপারটা এরকম না যে এসব প্রসঙ্গ টেনে এনে কথা বললে দু’জনের সম্পর্ক খাদে এসে পড়বে।
অথবা ইচ্ছা থাকলেও একটা অচেনা বাঁধা ট্রাফিক পুলিশ সেজে পথ আটকায়।
প্রসঙ্গ এলেও আগের মত জমজমাট আলোচনা হয় না,
আমরা খুব সাবধানে উইকেট বাঁচিয়ে টেস্ট খেলোয়াড়ের মত ব্যাট করে যায়।

আমরা এখন অনেক বিষয় এড়িয়ে চলি, অবহেলা করি।
যেমন মন চায়, এই খানে এসে দাঁড়াক— একটু থেমে ভাল করে দেখে নিক নিজে!
তেমনটা আর হয়ে ওঠে না কোন পক্ষ থেকে।

খিল পড়ে যায় মনের জানালায়
বন্ধ হয়ে যায় সন্ধ্যা হবার অনেক আগে,
মরিচা ধরে কব্জায়, বাড়তে থাকে মরিচা—এমন কি যখন আমরা ঘুমায়!

বন্ধ হতে থাকে মনের সব জানলা গুলো
হাতুড়ি ও পেরেক দিয়ে শক্ত করে আটা হয়
এখানে যেন আর কখনো কারো কোন দিন সকালের আলো দেখার প্রয়োজন হবে না,
কোনদিন আর ভোর হবে না।

তার আর ওড়া হয় না

মানুষ মনে মনে এক ভীষণ রকম পরিযায়ী পাখি
গাছের একটা ডালে তার মন বসে না বেশীক্ষণ
সারা জনম চঞ্চল সে—মনের মত এক নির্ভার জায়গা খোজে,
উড়োজাহাজের ডানার সাথে পাল্লা দিয়ে
লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে
সূর্যের তেজোহীন বরফের দেশে ফেলে রেখে
আসে কোন উষ্ণতার দেশে,
সে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে অজানা অচেনা এক তল্লাটে এসে।

মানুষ পারে না পরিযায়ী পাখি হতে
তার শরীরের হাড় পাখির মতো ফাঁপা নয়,
জোড়ায় জোড়ায় বাড়ে তার পা
গেঁথে যায় গাছের শেকড় এর চেয়েও শক্ত হয়ে মাটিতে।

মানুষ চায় একটা কিছু ঠিক তার মনের মত,
চায় একটা ছায়া, তার সাথে আরো কিছু…
যা করে সে সব কিছুই যেন ভুল
ভুলের একটা গলি থেকে বের হয়ে আরেকটা ভুলের কাদাজলে মাখামাখি।

ভেতরের এক সময়ের পরিযায়ী পাখি আর পরিযায়ী পাখি থাকে না
তার মনটা মরা নদীর ঘাট হয়ে যায়।
সারা জনম অপেক্ষা করেও জোয়ার জলে আর হয় না সওদাগরী নাও ভাসানো।

 

পরাধীন হই বারবার

আমাদের কষ্টের অর্জনগুলো আর আমাদের থাকেনা,
পর হয়ে যায় দু’দিনেই।
মজুতদারিদের হাতে গিয়ে ঠিকই জমা পড়ে,
সিন্ডিকেট করে বেচাকেনা হয়।

আমাদের অর্জনগুলো তৃষ্ণার্ত ঠোঁটের কাছে আঁজলা ভরে তুলে আনা জলের মতো—
মুখের কাছে আনার আগে আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে সবটুকু ঝরে পড়ে।

সব কিছু খেয়ে নেই উইপোকা,
ফুলে ভরা লাউয়ের মাচান ভেঙে পড়ে মাটিতে।

আমাদের সব কষ্টের অর্জন,
আমাদের পূর্বপুরুষের জীবন দিয়ে সব অর্জন নিছক গলা পচা মৃতদেহ হয়ে যায়,
আমরা ভালো করে কিছুই যেন ধরে রাখতে পারি না।

সবকিছু যেন আজো তেমন রাজরানীদের কর্তৃত্বের পাশা খেলা—
আমরা নিজ মাটিতে বারবার অন্তরীণ হই!
বারবার পরাধীন হই!

 

নিষেধের পায়ে দড়ি

খুব ইচ্ছে হয়
নিষেধের পায়ে দেই শক্ত দড়ি
আটকে রাখি দাদীমার লোহার সিন্দুকে তালা দিয়ে।
দু’ হাত তুলে অবরোধ করি পথ।
ফুটবল পায়ে নিয়ে খেলার মাঠ জুড়ে দৌড়ায়
সবাইকে তাক লাগিয়ে দুরন্ত নৈপুণ্যে গোলপোস্টের জালে তুলি ঝড়।

সাইকেলের প্যাডেল জোরে ঠেলে মোড়টায় এসে দাঁড়ায়,
যদি তার সাথে দেখা হয় বাসায় ফেরার পথে।
দেখা হয়, পাশাপাশি হাঁটি—

কোনদিন বলা হয়ে ওঠে নি কথাটা,
সব কথা জট পাকায়, দিক হারায় তেপান্তরের মাঠে,
তারপর ভীষণ মন খারাপ করে একা ফিরে আসা।

ইচ্ছে হয় শিকড় উপড়ে তুলে আনি এক হাতে—
অনভ্যস্তয় নিঃশ্বাসে পড়ে টান
ফুসফুস থেমে যায় হঠাৎ
মুখ থুবড়ে হুমড়ি খেয়ে করে পড়ি মাটিতে।
গড়ায়ে যায় বল।
খুটোতে বাঁধা অদৃশ্য দড়িতে ষাঁড়।
নিষেধের পায়ে দড়ি দেই— এমন সাহস কই?

রাজা আলেকজান্ডার ও ডায়োজিনিস

দরবার আলো করলো কোরিন্থের গুণীজন, রাজন্যবর্গ ও সন্ন্যাসীরা,
দিগ্বিজয়ী রাজা আলেকজান্ডারের সাথে এসেছে তারা সৌজন্য সাক্ষাতে
সাথে মিললো রাজকীয় উত্তরীয় ও উপঢৌকন।
আলেকজান্ডার খুঁজছেন কোথায় সন্ন্যাসী ডায়োজিনিস!
তাঁর কথা শুনে কোরিন্থে এসেছেন তিনি।

পরের দিন খুব ভোরে বের হলেন আলেকজান্ডার ঘোড়ায় চড়ে সৈন্য-সাবুদ নিয়ে,
সূর্য উঠেছে পূর্ব আকাশে তখন যখন তারা ডায়েজিনিসের ডেরার সামনে।
ডায়োজিনিস আধশোয়া, মাখছে সকালের নরম রোদ।
রাজা আর সৈন্যদের দেখে তিনি উঠে বসলেন।
তাঁর চোখ স্থির হলো রাজার ওপর।
ঘোড়া থেকে নেমে যথাযথ সম্মান দিয়ে রাজা বললেন, কি চায় আপনার,
যা চাইবেন তাই আমি দিবো আপনাকে!
ডায়োজিনিস নিজের গায়ের সামান্য কাপড় ঠিকঠাক করতে করতে বললেন,
দয়া করে সূর্যের সামনে থেকে সরে দাঁড়াও!
আমি গণতন্ত্র পোহাচ্ছিলাম।
যা তুমি দিতে পারো না
তা থেকে আমাকে আড়াল করো না!

 

দেহ

ভেবে দেখো, মানুষের দেহ স্বল্প পরিসরে একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ রাষ্ট্র ব্যবস্থার মতো,
শরীরটা নিয়ত টিকে থাকে প্রবল যুদ্ধ করে,
তার শত্রু অনেক, দৃশ্যত ও অদৃশ্যত।
তাকে পরাস্ত করা এতো সহজ নয়!
চার চারটা প্রতিরক্ষা স্তর পার হয়ে তবে তাকে ধরাশায়ী করে।

পরাজয়ের সাথে সাথে শরীর জুড়ে চলে পোকাদের আনন্দ ভোজ উৎসব।
দুর্গন্ধ ছড়াবার আগে শবদেহের অন্তেষ্ট্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় নিজ নিজ ধর্ম ও আচার মতে।

চিকিৎসার ভাষায় মৃত ঘোষণার পর কখনো কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস দিয়ে রাখে,
সেটা আত্মীয় স্বজনের জন্য সান্ত্বনা শুধু
অনুমতি পেলে টিউব ও যন্ত্রপাতি খুলে দেবার অপেক্ষা।

যদি দেখ এক রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে দুর্গন্ধ ছুটে বের হচ্ছে—
আতর মাখায় গায়ে,
নাকে রুমাল দিতে হয়,
দেখেও না দেখার ভান করে পথ এড়ায়ে চলতে হয়।
জেনে রেখো সেই রাষ্ট্র-দেহ মরে গেছে অনেক আগে
বাকীটা এখন পচে গলে যাচ্ছে।
আপনি পাঠিয়েছেন

 

তূয়া নূর

কবি ও অনুবাদক। জন্ম যশোর শহরের পুরাতন কসবায়। বাবা এ কে নূর মোহাম্মদ। মা জামিলা নূর। পড়াশুনা ও বেড়ে ওঠা যশোর শহরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্মেসিতে পড়াশুনা শেষ করে পাড়ি দেয় যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে উচ্চ শিক্ষার জন্য।  ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির সাথে জড়িত।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top