ফরিদা মজিদ: চিরন্তন বিস্ময়ের নিঃসাড় হাত – সাবেরা তাবাসসুম

সাবেরা তাবাসসুম

কবি ফরিদা মজিদ। জন্ম ১৯৪২ সালের ২৭ জুলাই, কলকাতায়। পিতা মহিবুল মজিদ ও মাতা ফিরোজা খাতুন। ফরিদা মজিদের পিতা পেশায় প্রকৌশলী ছিলেন। তাঁর মা ছিলেন কবি গোলাম মোস্তফার জেষ্ঠ্য কন্যা। শিশুকালে দ্বিতীয় ভাগ পড়ার সময় তাঁর প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় কলকাতার সত্যযুগ পত্রিকায়। কবিতা ও শিল্পের আবহেই বেড়ে ওঠেন তিনি। যৌবনের শুরুতে বিদেশে বসবাস শুরু তাঁর। তুলনামূলক সাহিত্যে মাস্টার্স ও এম.ফিল করেছেন নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য  পড়িয়েছেন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। সিটি ইউনিভার্সিটি অফ নিউইয়ের্কে পড়িয়েছেন ইংরেজি সাহিত্য।  বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিদেশে জনমত গঠনের জন্যে দেশের বিশিষ্ট কবিদের কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন, পাঠ করেছেন। পরবর্তীতে এই কবিতাগুলোর সংকলন প্রকাশ করার সূত্র ধরেই প্রকাশনা জগতে পা রাখেন। ফরিদা মজিদের প্রায় একক প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে স্যালামান্দার ইমপ্রিন্ট। জিম বার্নস-এর দ্য গোল্ডফিশ স্পিকস ফ্রম বিয়ন্ড দ্য গ্রেভ, কীট রাইট-এর দ্য বিয়ার লুকস ওভার দ্য হিল এবং আরও অনেক উল্লেখযোগ্য ব্রিটিশ কবির কবিতাগ্রন্থ প্রকাশ করেছে এই প্রকাশনা সংস্থা। কবি ফরিদা মজিদ শুরুতে লিখেছেন ইংরেজি কবিতা। যথেষ্ট প্রশংসিতও হয়েছিলেন তিনি। আশির দশকের শুরুতে বাংলা কবিতা লেখা শুরু করেন। প্রবন্ধ ও কবিতা রচনার পাশাপাশি ইংরেজি ও বাংলা কবিতার অনুবাদে লিপ্ত ছিলেন তিনি। তাঁর জীবদ্দশায় একটিমাত্র কবিতাগ্রন্থ গাঁদাফুলের প্রয়াণ ও যারা বেঁচে থাকবে প্রকাশিত হয়। এর দ্বিতীয় ‍সংস্করণটি  ত্রিয়েটিভ ঢাকা প্রকাশ করে ২০১৬ সালে। লন্ডনে বসবাসের কালে কমনওয়েলথ পোয়েট্রি প্রাইজ-এর বিচারকমণ্ডলীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন তিনি। ২০০৬ সালে বাংলাদেশে এসে আর ফিরে যান নি প্রবাসজীবনে। স্বাধীনচেতা প্রবল অভিমানী এক শিল্পীর জীবন কাটিয়ে গেছেন তিনি। কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০২১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন এই বিদূষী।

 

সালটা ২০১২। কবি অনুবাদক শামস আল মমীন ভাই ন্যুইয়র্ক থেকে বাংলাদেশে এসেছেন মাস দুয়েকের জন্যে। ওই সময়টায় ওনাদের ইন্সটিটিউটের গ্রীষ্মকালীন ছুটি চলে। আমাকে বললেন বিটিভিতে শিক্ষা বিষয়ক একটা অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং সেরে বদরগঞ্জে যাবেন। পরে ঢাকায় ফিরলে ছোটখাটো একটা আড্ডা হবে আমাদের। যথা সময়ে মমীন ভাই জানালেন অনুষ্ঠানটির সম্প্রচারের সময়। বিটিভির সুবর্ণ সময় পার হওয়ার পর পরিচিতজন ছাড়া সাধারণত অন্য কারো প্রোগ্রাম দেখা হয় না। মমীন ভাই তার বিশ্লেষণাত্মক পর্যবেক্ষণ তুলে ধরবেন সে ভরসা ছিল। তাই বসে গেলাম। তবে দেখতে বসার খানিক পরেই আমার বিস্ময়ের মাত্রা বাড়তে লাগল আরো একটা কারণে। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে প্রাসঙ্গিক ও  গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় মেতেছেন আরো একজন আলোচক। যেমন তার ভাষার দখল (বাংলা ইংরেজি দুটোতেই), তেমন তার শব্দ বাছাই ও প্রক্ষেপণ। সবটা মিলিয়ে  তার নিজের বক্তব্য পরিবেশনের ওপর যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ আমাকে আকৃষ্ট করে বসল। অস্বীকার করব না, আর সকলের মত তাঁর চূঁড়ো খোঁপা আর শাড়ি সামলানোর দারুণ কায়দাটিও আমাকে মুগ্ধ করেছিল। মমীন ভাইয়ের কাছে জিজ্ঞেস করলাম, উনি কে? আমাকে ভড়কে দিয়ে উনিও খানিক আশ্চর্য হয়ে উলটো প্রশ্ন করলেন, ওনাকে চেনেন না? উনি কবি ফরিদা মজিদ। দুর্দান্ত স্কলার মানুষ! আমাদের দেশে যে ক’জন হাতে গোণা পড়াশোনা জানা মানুষ আছে উনি তাদের মধ্যে একজন। সেই যাত্রায় লজ্জিত হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না আমার।

মমীন ভাইয়ের কাছ থেকেই ধীরে ধীরে জানলাম ফরিদা মজিদের বিলেত ও আমেরিকায় কাটানো দীর্ঘ প্রবাস জীবনের কথা, শিক্ষকতার কথা। মমীন ভাই বলছিলেন, ওনার ইন্টেলেকচুয়াল হাইট কী রকম সেটা বুঝতে পারবেন একটা নমুনাতে। ওনার বাসায় যে সকল বিখ্যাত কবি সাহিত্যিকদের আড্ডা হতো তাদের মাঝে অন্যতম ছিলেন বিখ্যাত কবি টেড হিউজ। এসব তথ্য জানতে খুব ভালো লাগছিল। স্বস্তি পাচ্ছিলাম এটা ভেবে যে, একজন ব্যক্তি মূল্যায়িত হচ্ছেন তাঁর মেধা আর কাজের ভেতর দিয়ে। নারীকে দেখার যে অর্ধেক দৃষ্টিটা এই উপমহাদেশের সংস্কৃতিতে আছে উনি তার ভিত্তিতে মূল্যায়িত হচ্ছেন না। বলা বাহুল্য, আমার এ ধারণা ভুল প্রমাণিত হল আরও কিছুদিন পর যখন তিনি আমাদের কাছে প্রিয় ফরিদা আপা হয়ে উঠলেন।

২০১৪ সালের ২৫ অক্টোবর। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের আয়োজনে ইংলিশ উইকের কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে অধ্যাপক আহমেদ রেজার আমন্ত্রণে কবিতা পড়তে গেছি। বন্ধু কবি সাকিরা পারভীন অংশ নিচ্ছে এটুকু শুধু জানি। সকালবেলায় ওখানে পৌঁছে দেখি দারুণ ব্যাপার-স্যাপার। কবি আসাদ চৌধুরী, কবি খালেদ হোসাইন এবং আরো অনেক কবির মাঝে আলো হয়ে বসে আছেন কবি ফরিদা মজিদ! ওই অনুষ্ঠানে পরিচয় হল শাহনাজ নাসরীন, সাদিয়া আরমান, লাভলী বাশারের সাথে। সকলেই কবি এবং নিজ নিজ কাজের ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। ফরিদা মজিদ যখন কবিতা পাঠ করছিলেন এক অনন্য বিভায় মুগ্ধ হচ্ছিলাম। আমরা সাধারণত একটানা কবিতা পড়া দেখতে অভ্যস্থ। উনি একখানা দস্তানা কবিতাটি পড়ছিলেন এবং থেমে থেমে কথা বলছিলেন। এক ধরনের  যোগাযোগ তৈরি হচ্ছিল অডিয়েন্সের সাথে। অভিভূত হচ্ছিলাম তাঁর কথায়, সন্দেহ নেই। কবিতা পরবর্তী আড্ডায় দেখছিলাম তাঁর দাপট। অনর্গল বলে যাচ্ছিলেন দেশ-বিদেশের কবি, কবিতা ও সাহিত্য নিয়ে। তখন তিনি আমার কাছে দূরের কবি, দূরের মানুষ ফরিদা মজিদ।

 

জাহাঙ্গীরনগর থেকে ফিরে শাহনাজ নাসরীন, সাকিরা পারভীন আর সাবেরা তাবাসসুম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফ্যালে কবিতার আসর সাজানোর। যখন প্লাটফরম নামে আয়োজন শুরু করি, আমাদের তৃতীয় আসরের কবি হিসেবে পেতে চাই কবি ফরিদা মজিদকে। পেয়েও যাই তাঁকে। সানন্দে মত দিয়েছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ, ২০১৫য় কবিতা পাঠের আসরে ফরিদা মজিদ পাঠ করলেন তাঁর বাংলা ও ইংরেজি কবিতা। বলা বাহুল্য, প্রতিবারই তাঁর পাঠের অনন্যতায়, বিভায় মুগ্ধ হয়েছি। তিনি যখন বলছিলেন, কবিতার প্রেক্ষাপট নিয়ে, বিষয়বস্তু নিয়ে, একটা চমৎকার সংযোগ স্থাপিত হচ্ছিল তাঁর দর্শক শ্রোতার সাথে। অডিয়েন্সকে ইনভলভ করে ফেলার অভিনব কৌশলটি তিনি রপ্ত করেছিলেন সহজাত ভাবেই। বলছিলেন তাঁর অচেনা উত্তরণ কবিতাটি নিয়ে। তখন তাঁর ‘রাইটার্স ব্লক’ চলছে। কবি টেড হিউজ তাঁকে বললেন কেন তুমি তোমার প্রপিতামহীকে নিয়ে কিছু লেখ না? টেড হিউজের উৎসাহে লেখা হল অচেনা উত্তরণ কবিতাটি–

‘ঘুমভাঙ্গা চোখে তুমিও দেখেছিলে

                  ভোরের এই রাঙানো আকাশ,

যে আকাশে আমি আজ…’

                             অচেনা উত্তরণ

ওই আসরে কবি ফরিদা মজিদের কবিতা নিয়ে প্রবন্ধ পাঠ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক আহমেদ রেজা। বিশ্লেষণাত্মক একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ ছিল সেটি। এর পর থেকে কবির সাথে যোগাযোগটা সহজ হয়ে এলো। কবিতার  প্লাটফরমের অন্য আসরগুলোয় কিংবা অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ফরিদা আপার সাথে দেখা হতে থাকল। কথা হতে থাকল।

তাঁর সঙ্গে যে সময়ে আমাদের আলাপ জমছে তখন উদ্দাম সৃষ্টিশীল সময়গুলো পার করে এসেছেন তিনি। সোনালী স্মৃতির সিন্দুক আগলে বসে আছেন যেন। চারপাশে চাটুকার আর সুযোগ সন্ধানীদের ভিড়ে হতাশা দানা বাঁধে তাঁর মনে। বুদ্ধিবৃত্তিক নৈঃসঙ্গ্য স্পষ্ট রেখাচিত্র আঁকে তাঁর চোয়ালে। কবি ব্যারিস্টার সাদিয়া আরমান ও  সীমান্ত সাগরের কল্যাণে ফরিদা মজিদ আপার সেঞ্চুরি টাওয়ারের বাড়িতে যাওয়া হল বেশ কয়েকবার। মনে মনে তাঁকে নিয়ে আমাদের কত প্রস্তুতি! তাঁর জীবনের নানা উত্থান-পতনের গল্প শুনি। বেশিরভাগটাই অগ্রন্থিত। কথার পিঠে কথা, একটু সায়, দু একটা প্রশ্ন—ব্যস, আড্ডা চলতে থাকে কবিতা আর চায়ের সাথে। গল্পে গল্পে জানলাম তাঁর ৬ বছর বয়সের প্রথম কবিতাকে—

দিনের আলো পালিয়ে গেল

রাতের কালো ঘনিয়ে এলো

ঘরে ঘরে জ্বললো আলো

দেখতে আমার লাগলো ভালো

                                         সন্ধ্যা

বলছিলেন কবিতায় তাঁর মগ্নতা নিয়ে। বৃটেনবাসের কালে (সময়টা সম্ভবত ১৯৭২ থেকে ১৯৭৯) ইংরেজি কবিতা লেখা ও তাঁর প্রকাশনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তারপর বাংলা কবিতায় ডুবে যাওয়া—

এই মুহূর্তটা

           গভীর ভৌতিক অরণ্য

                         আমি হন্যে, পথ হারানো।

বাঁকাচোরা প্রাচীন গাছের গুঁড়িতে পড়ি ভাষা—

কেবলই কেন নিষেধের অঙ্গুলী আঁকা?

                                              আবর্তক

কখনও লাহাইনা বন্দরের বিকেল ভর করত কবির স্মৃতিতে। সে বিষন্নতা ছুঁতে পারে নি তাঁকে সকলের মাঝে। কেবল কবিতাই ছিল পরম আশ্রয়—

যে পাথরের উপর বসে আছি দু’বাহুতে হাঁটু মুড়ে,

হাঁটুতে ঠেকিয়ে থুঁতনি, দৃষ্টি দিগন্তে বুলিয়ে ,

দুঃখ সয়ে সয়ে, দুঃখ সয়ে সয়ে

সেই পাথর বনে যেতে আমার কোন দুঃখ নেই।

                                                          লাহাইনার বিকেল

 

৪.
কবি ফরিদা মজিদ কেবল কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক ছিলেন তা নয়। ভাষার প্রতি তাঁর আগ্রহ এবং দখল দুই-ই ছিল মজবুত। অপ্রচলিত শব্দবন্ধ তৈরি ও তার কায়দা মত ব্যবহারে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। আবার সাদামাটা শব্দ ব্যবহার করে বাক্যগঠনের মুন্সিয়ানায় শেষ পঙক্তিতে অনন্য মোচড় দিয়ে কবিতাকে এনে দিতেন কাঙ্ক্ষিত শিরোপা। সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে রচিত তাঁর কবিতায় কোরানের আয়াত, বেদের শ্লোক স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এসেছে। গল্পে গল্পে বলছিলেন একদিন, পবিত্র কোরানকে শুদ্ধভাবে পড়ার জন্যে, জানার জন্যে আরবী ভাষা বেশ ভালোভাবে রপ্ত করেছেন। আমরা কল্পনায় দেখে নিই সিম্পোজিয়ম অন জেন্ডার এন্ড ট্রান্সলেশন-এ ‘মিসট্রান্সলেশন ইন এইড অফ মিসজিনি’ পেপারটি উপস্থাপন করছেন প্রবল দাপটে। আনন্দিত হই তাঁর ওই না-দেখা রূপ ভেবে। আবার ঈমান আলীর কবিতা’র মতো ধারালো কবিতা পাঠ করে অনুভব করি তাঁর রাজনীতি সচেতন চিন্তাযুক্ত মন। তারপর দেখতে পাই নিঃসঙ্গ এক বৃক্ষশাখায় অবশিষ্ট পাতাটির মত তাঁকে একা। শীতের দেশে হারিয়ে যাওয়া একখানা দস্তানার মতো একা। অপচয় হয়ে যাওয়া মেধার মত একলা একা।
মাত্র একটি প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ রেখে দিয়ে আমাদের সামনে, মিলিয়ে গেলেন তিনি। কত কিছুর জন্য প্রস্তুতি নেয়ার ছিল আমাদের! অথচ সবকিছু পণ্ড করে দিয়ে সেঞ্চুরি টাওয়ারে দুটো বাদাম গাছের নিচে শুয়ে থাকলেন একা ফ্রিজিং কারে। সাহিত্যাঙ্গণের রথি-মহারথিরা শোকবার্তা পাঠালেন। তাঁর কবিতা নিয়ে নয়, অধিকাংশেরই আলোচনা, দুঃখ প্রকাশ হল তাঁর চুঁড়ো খোঁপা, পাথরের আঙটি পরা আঙুলের মুদ্রা, পরিপাটি শাড়ি আর এ্যালেন গিন্সবার্গ ও জন এ্যশবেরির সাথে পানপাত্র হাতে করিডোরে বাঁকা হয়ে দাঁড়ানো ছবির জন্যে। মাথা নিচু করে ভাবি, এ-ই তাঁর মেধার স্বীকৃতি! একজন কবিকে শিল্পীকে তাঁর কাজের ভেতর দিয়ে জানার প্রস্তুতি শুরু হোক জোরেশোরে। লিঙ্গে, ধর্মে, বর্ণে বা শ্রেণিতে পর্দা তুলবার প্রস্তুতি নয়। কবির সংক্ষুব্ধ যাত্রায় সমূহ সংকটের মুখোমুখি হবেন জেনে লিখেছেন তিনি—
‘…নিপীড়ক প্রশ্ন কেবল প্রতিধ্বনি তোলে—
তোমার চোখ, ঠোঁট ও কণ্ঠস্বরে কি ছিল
তোমার সঠিক পরিচয়?

ভীতচিত্ত, ভীষিত আমি, গভীর সমুদ্রের গহ্বরে।

…আমি তবু রোপিত এইখানে সমস্ত যৌবন।
ক্ষিতিতলে রজনীগন্ধার ঝাড় নিয়ে তুমি
খুঁজেছিলে আমাকে কিছুক্ষণ নক্ষত্রের আলোয়।’
                                                                           প্রপঞ্চিত

কবিতার নিঃসঙ্গযাত্রায় নিজের শেষবিন্দুটি কি দেখেছিলেন তিনি— তাঁর মেহেদি রাঙানো দীর্ঘ কেশরাশি, আর সপ্রতিভ উপস্থিতির বাইরে, সীমান্ত সাগরের বাইকের পেছনে চড়ে ঢাকার অপ্রতুল কবিতা ও সাহিত্য আসরগুলোয় যেতে যেতে? ফরিদা মজিদের লেখা ভিলানেল অভিপ্রয়াণ আকাঙ্খী থেকে তুলে দিই আরো কিছু প্রিয় পঙক্তিমালা—

একদিন আমার ছোট মরদেহ ভেসে যাবে অক্ষত
বালির অভ্র আর ঘাসের ঘ্রাণ মেখে জোয়ারের ঢলে।
শীর্ণ রূপোলী নদীটা বাঁক নিয়েছে যেখানে,
তীরে তার চিকচিকে বালি আর সবুজ ঘাসের রাশি।

তাঁর কবিতাগ্রন্থের শিরোনামের মতই বিদায় নিয়েছেন তিনি। এক নিঃসঙ্গ গাঁদাফুল ঝরল অগোচরে। ভীড়ের মানুষ তিনি ছিলেন না। তাঁর কাজও ভীড়ে হারিয়ে যাওয়ার নয়। এক মরুপথের যাত্রী যেন তিনি। গন্তব্যে পৌঁছতে পারবেন কিনা সে ভাবনা নেই। যেতে হবে শুধু এটুকু জানা তাঁর। আজ জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করছি ব্যথাতুর হৃদয়ে। মনে পড়ছে বিশেষ দিনগুলোয় তাঁর উচ্ছ্বাস, তুখোড় আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক। সবশেষে কবিতাপাঠে মগ্ন মেধাবী মুখ। পৃথিবী একজন বিদগ্ধ কবিকে বিদায় জানায় কি?

                                  

সাবেরা তাবাসসুম


কবিতা লেখা শুরু পিতা মোঃ সাইদুল হক ভুইয়ার অনুপ্রেরণায়। পড়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত বই ১৪টি। ১৩টি মৌলিক কবিতা এবং একটি হিন্দী ও উর্দু কবি গুলজারের কবিতার অনুবাদ-গ্রন্থ। একমাত্র পুত্রকে নিয়ে বেশিরভাগ সময় কাটে। চলচ্চিত্রের প্রতি রয়েছে তীব্র টান। সবকিছু্র বাইরে কবিতাই সাবেরার আরাধ্য ভূমি, পাশাপাশি অনুবাদ ও মুক্ত গদ্য লেখা তো আছেই।

Facebook Comments

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top