বনসাই হয়ে গেছি
দুপুরের রোদে পোড়োবাড়ীর আঙ্গিনায়
একাকী শালিকের মতো নিঃসঙ্গ আমি
স্মার্ট ফোনের স্ক্রীনে আটকে রাখি চোখ।
আমাকে ঘিরে নিস্তরঙ্গ বয়ে যায়
চির বহমান কালের অচিহ্ন সময়।
দোতলা ফ্লাটের চিলতে বারান্দায়
নৃত্য করে যায় চড়ুই যুগল।
কম্প্যুটারের কী-বোর্ডে উর্বশীর মত
কথক নৃত্য করে হাতের আঙ্গুলগুলো
ক্লান্তিহীন, অবিরাম।
ড্রইংরূমে বনসাই বৃক্ষগুলোর
বেড়ে ওঠার ব্যর্থ ব্যাকুলতা
স্পর্শ করে না আমাকে।
শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত আসে
বামুন বৃক্ষগুলো জানতেও পারে না।
আমিও জানি না কখনো।
এই শহরের নিবিড় ঘেরাটোপে
কখন যে বনসাই হয়ে গেছি,
ঘাস-মাটির স্পর্শহীন
আমি এক বামুন মানুষ!
এই শহরে
চড়ুয়ের মত সখ্যতা গড়েছি
নির্মোক শহরের সাথে।
প্রখর রোদ্রে হেঁটে চলি
দালানগুলোর শীতল ছায়ায়।
বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মত কোলাহল
খরকুটোর মত ভাসিয়ে নিয়ে যায়
ব্যস্ত সড়কগুলো সারাটা সময়
সঙ্গী করে নিয়ে নির্লিপ্ত আমাকে।
হর্ণের সিম্ফোনিতে ডুবে থাকি
অস্ফুট স্মৃতির গভীরে।
যানজটের জালে আটকে পড়া
এ্যাম্বুলেন্সের করুণ কান্না শুনে
বিচলিত হতে ভুলে গেছি
সে তো অনেক আগেই।
নিয়নের পাণ্ডুর আলোয়
প্রতিবেশিনীকে দেখে মনে হয়
অচেনা কোন বিবরবাসিনী;
আগেতো তাকে কখনো দেখিনি।
এই শহরে নিজেকেও মনে হয়
কোথায়ও দেখেছি আগে
চিরচেনা মুখ আমাকে আমি।
অক্টোপাসের মত ধুসর শহর
সারাক্ষণ জড়িয়ে রাখে আমাকে
নিস্পৃহ বাহুর কঠিন বন্ধনে।
অবসর দেয় না কখনো।
রেললাইন
এক চিলতে লেকের ওপারে
এক ঝাক গগনচুম্বী অট্টালিকা।
এপারে জরাজীর্ণ বস্তির গৃহকোণ।
লেকের জলে ঝলমল ছায়া পড়ে
অট্টালিকার; ছায়া হয়ে পড়ে
শীর্ণকায়, কুন্ঠিত বস্তির অবয়ব।
বস্তির বুক চিড়ে বয়ে যায়
রেললাইন, দু’পাশ জুড়ে তার
নাড়ী পোতা দারিদ্র প্রখর।
ছুটে চলে ট্রেন সেই পথ ধরে।
দুপুরের রোদে সে বিবর্ণ সরীসৃপ;
নিকষকালো রাতে আলোয় ঝলমল।
এই শহর
এই শহরে বিত্ত, দারিদ্র বাস করে
পাশাপাশি, কাছাকাছি প্রতিবেশীর মত।
পরিচয় নেই,
চেনা-জানা হয় না কখনো।
এই শহরে খণ্ড খণ্ড বিবর্ণ আকাশ
সরব হয়ে ওঠে
ঘণ-কালো আষাড়ের মেঘ এলে।
এখানে দিগন্ত নেই, কখনো তাই
আকাশ-মাটি আসে না কাছাকাছি।
হাতে হাত রাখে না কখনো।
হেমন্তের সকালে বারান্দার গ্রীলে
ঝুলে থাকে সাদা জোনাকীর মত
নরম শিশির বিন্দু।
সারাটা সকাল টেলিভিসনের সঙ্গে
কথা হয়, মুখোমুখি। মুখরা রমনীর মত
ও-ই কথা বলে, আমি শুনে যাই।
শীতের অলস সকাল এলে
কক্রিট ছুঁয়ে আসা হিমেল বাতাস
বন্ধ জানালার কাচে মাথা ঠুকে ফেরে।
জানালার কপাট খুলে দেই না কখোনো।
নিজেকেও মেলে দেই না আমি
অনুভূতিহীন শহরের কাছে।
শহুরে নদীর বুক জুড়ে হাহাকার।
এলোমেলো নির্জীব দালানগুলোর ওপাশে
হারিয়ে গেছে সে চোখের আড়ালে।
শীর্ণকায় শরীর ওর স্মৃতির ভাগাড়।
ফুটপাথে লাইটপোস্টের পিছনে
দাঁড়িয়ে থাকা অসহায় গাছটার
বিনিদ্র রাত কাটে সারা রাত
নিয়নের পলকহীন আলোর ঝলকানিতে।
এভাবেই কাটে তার অসহায় দিন,
মাস, বছর এক এক করে।
বিল্ডিংয়ের ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা
মোবাইল টাওয়ারের মাথায়
লাল-টিপ বাতিটা সারা রাত জ্বলে
রাত জাগা এককী তারার মত।
আমারও রাত কাটে নির্ঘুম
শহুরে রাতের বিবর্ণ জঠরে।
ভোর নেমে আসার আগেই
রাতের গর্ভ থেকে হামাগুড়ি দিয়ে
বেরিয়ে আসে উদ্ভ্রান্ত শহর
অলিগলি, জনপথের ঘুম ভাঙ্গাতে।
ওদের ব্যস্ত করে তোলে আমাকে সহ।
নতুন আরেকটি দিনের কাছে
অনিচ্ছায় সমর্পিত হই।
এভাবেই কাটে দিন, কাটে রাত,
মাস, বছর এক এক করে,
চেনা-জানা এই অচেনা শহরে।
চোখে চোখ রাখে না কখনো
চেনা-জানা, বৃক্ষহীন, বিবর্ণ শহরে
বিল্ডিংগুলোর ছায়ায় ছায়ায়
ক্রমাগত হেটে চলি। কখনো এই শহর
চোখে চোখ রাখেনি আমার।
যেন চোখে রোদচশমা পড়ে
দেখে সে আমাকে।
আমিও কখনো তাকে
নেই নি কাছে ডেকে।
দু’দণ্ড বলিনি কথা
বিরামহীন ব্যস্ততার মাঝে।
অনেক দিন দেখিনি শহুরে আকাশ।
খণ্ড খণ্ড ওই আকাশের গায়ে
বিল্ডিংগুলোর চূড়া ছুঁয়ে ছুঁয়ে
ভেসে বেড়ায় শরতের সাদা মেঘ;
হেমন্তের হিমেল হাওয়া নিচে নেমে আসে
দুরন্ত শিশুর মত হামাগুড়ি দিয়ে।
চেনা-জানা এই অচেনা শহরে
চিরদিন আগন্তুক আমি।
শহরগুলো এমনই হয়,
কাউকে কখনো ডাকে না কাছে।
নির্লিপ্ত বিবাগী যেন,
শরণার্থী কিশোরীর মত
শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে,
চোখে চোখ রাখে না কখনো।
ফারুক হাসান
লেখক-গবেষক ফারুক হাসানের লেখা ও গবেষণার বিষয় বিচিত্র কিন্তু বিজ্ঞানমনষ্ক সমাজ গঠনে তা অবিস্মরণীয়। তিনি একদিকে লেখেন দক্ষিণ এশিয়ার নিউক্লিয়ার প্রোলিফারেশন সম্পর্কে অন্যদিকে লেখেন সুন্দরবনের বাঘ নিয়ে। লিখেছেন চিত্রকলা ও ভাস্কর্য নিয়ে। ঢাকার চারশ’ বছরের ইতিহাস উঠে এসেছে তাঁর লেখায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বোঝার জন্যে এর দশ হাজার বছরের প্টভূমিকেও সামনে এনেছেন তিনি। এ পর্যন্ত তিনি এরকম ১৭ টি গ্রন্থ লিখে মানুষের মননের উন্মেষ ঘটানোর চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থের নাম ‘বাঙালির ধর্মবিশ্বাসে বিবর্তন প্রধান ধর্মসমূহে ঐক্য অনৈক্য’।
বর্তমানে তিনি কক্সবাজারকে আগামীদিনের একটি চমৎকার পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলার কর্মযজ্ঞে একজন অভিজ্ঞ পরামর্শক হিসেবে কাজ করে চলেছেন। বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে অবস্থিত VUB বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যানেজমেন্টে স্নাতক পাশ করার আবার সেখান থেকেই ইন্ডাস্ট্রিয়াল লোকেশান ও ডেভেলপমেন্টে স্নাতক করেছেন। তিনি দেশ-বিদেশ ঘুরতে পছন্দ করেন।