‘ঝিল্লি’: কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের সেরা ছবি

অভিষেক ঘোষ
ফিল্ম : ‘ঝিল্লি’ (Discards, 2022)
চিত্রনাট্য, সিনেমাটোগ্রাফি, সম্পাদনা ও পরিচালনা : ঈশান ঘোষ ।
অভিনয়ে : অরণ্য গুপ্ত, বিতান বিশ্বাস, সৌরভ নায়েক, শম্ভুনাথ দে, সায়নদীপ গুহ, ভাস্বতী হালদার, প্রিয়া সাহা রায়, রাজু হালদার ।
আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বরাবরই বিদেশি সিনেমা দেখে উচ্ছ্বসিত হয়েছি । আক্ষেপের সঙ্গে ভেবেছি, বাংলা সিনেমার মরা গাঙে কবে ফের জোয়ার আসবে ? কবে ‘ইন্ডাস্ট্রি’ আবার ‘আর্ট’ প্রসব করবে ? নাকি বাংলার সংস্কৃতির অন্যান্য শাখাগুলির মতো এই শাখাটিও পরানুকরণসর্বস্ব, শোচনীয় অধঃপতনের পথেই ডুবতে থাকবে ! আরো ভয়ের ব্যাপার, যে যুগে সবাই কবিতা লেখে, সবাই শর্ট ফিল্ম বানায়, সবাই ‘ভাইরাল’ হয়ে উঠতে পারে রাতারাতি, সে যুগে চারিপাশের এই ঘৃণ্য সাধারণের কোলাহলে ‘ভালো’ কোনো কিছুর আদৌ কোনো মূল্য অবশিষ্ট থাকবে কি ? এই চরম অনাস্থার আবহেও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনে ‘ঝিল্লি’-র মতো কিছু চলচ্চিত্র, যা দেখে আজও কিছুটা আশাবাদী হতে সাধ জাগে ! যে ছবির লোকেশন বলতে ধাপার মাঠ আর পার্ক স্ট্রীটের ফুটপাথ, কলা-কুশলী তথা ‘কাস্ট অ্যান্ড ক্রু’ বলতে বন্ধু-বান্ধব আর আত্মীয়-স্বজন, হাতের তাস বলতে গতি আর ছক-ভাঙার দুঃসাহস (যা এযুগে সৎসাহসের মতোই কমে যাচ্ছে); সেই ছবি যে এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় প্রায় কালবৈশাখী হয়ে বুকের উপর নেমে আসবে আর গতে বাঁধা ভাবনাগুলো তছনছ করে দেবে, ভাবি নি ! আর যা ভাবি না, সিনেমা যখন তাই ঘটিয়ে ফেলে, তখনই অপার্থিব আনন্দে মনটা ভ’রে ওঠে… মনে হয়.. আহা ! এই তো জীবন ! তবে লোকে খামতি খুঁজে পাবেই, পেয়েওছে । লা ভন ট্রিয়েরের ‘Antichrist’ (২০০৯) ছবির পোস্টারের সঙ্গে কিছুটা মিল থাকায়, কেউ কেউ বক্রোক্তি করছেন; তাই মনে হয় এ ব্যাপারে নির্মাতাদের আরো সতর্ক হওয়া উচিত । কিন্তু তাতে সিনেমাটির শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার পাওয়া আটকায় নি । অভিষেকেই ঈশান ঘোষের ‘ঝিল্লি’ সাতাশ-তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘International Competition: Innovation in Moving Images’ বিভাগে ‘Golden Royal Bengal Tiger Award for the Best Film’ জিতে নিয়েছে ।
‘ঝিল্লি’ মানে জানতাম ঝিঁঝিপোকা । তাই প্রথমেই মনে হয়েছিল, কারা এই শহরের ঝিঁঝিপোকা ? যাদের ‘নুন’ কবিতায় আমরা বলতে শুনি, “মাঝে মাঝে চলেও না দিন
বাড়ি ফিরি দুপুররাতে;
খেতে বসে রাগ চড়ে যায়
নুন নেই ঠান্ডা ভাতে ।” তারা কি ? হতে পারে । আমরা কি সত্যিই আমাদের শহরটাকে আপাদমস্তক চিনি ? এই যে উন্নয়ন, বিশ্বায়নের ‘বিশ্ববাংলা’, তা নিয়ে এই ‘ঝিল্লি’দের কী বক্তব্য ? “এই দ্যাখ… আকাশ.. পাতাল; আর তার মাঝে বিশ্ববাংলা!” – এই সহজ মন্তব্যেও নিরাসক্ত, কীটতুল্য তুচ্ছ বকুলের যে অমোঘ উদাসীনতা ঝ’রে পড়ে, সেই প্রত্যাখ্যানই অনন্য করে তোলে ছবিটির চলচ্চিত্র-ভাষাকে, নানা মাত্রার রাজনীতির সঙ্গে যার সহোদর-সম্পর্ক । সিনেমার শুরুর দিকেই যদিও জানিয়ে দেওয়া হয়, ‘ঝিল্লি’ শব্দের ভিন্ন একটি অর্থ; সশব্দে মেশিনে পশুর হাড় গুঁড়ো হচ্ছে । সেই টুকরোগুলোই হল ধাপার ভাষায় ‘ঝিল্লি’ । ধাপার মাঠে ছেঁড়া চটি পা থেকে প্রায় খুলে যায় বকুলের, সামনে বিস্তীর্ণ আবর্জনায় অজস্র মৃত পশুর দেহাবশেষ, পায়ে ফুটলেই বকুল শেষ ! তার হাত মরা ঘোড়ার পাঁজর গলে বের করে আনে মেরুন-রঙা হৃৎপিণ্ড, এক হাতে সেটা রেখে সে তুলনা করে নিজেরটার সাথে, সেটাও কি খুব সজীব ? দাম আছে তার কোনো ? ‘এখানে এসে সব গল্প শেষ হয়ে যায়’ – জানে তারা । ওদিকে পার্ক স্ট্রীটের অন্ধ গলিতে গুড্ডু, শম্ভুদারা এখনও স্বপ্ন দেখে, স্বপ্নের পিছু ধাওয়া করে, তাদের টাকা চাই, অনেক টাকা ! তবেই তারা ‘টপ লেভেলে’ উঠতে পারবে । এই বাংলা-জোড়া প্রবল উন্নয়নে সামিল হতে পারবে । হাড়-গুঁড়ো করার মেশিনে আর পচা কাগজের স্তুপে বকুলের মতো তাদের স্বপ্নও চিরতরে শেষ হয়ে যাক্, এ তারা চায় না । পোকা-মাকড়ের এই জীবন, সেখানে দুঃখ ভুলতে আছে ‘দাদা’ (‘বিরহী’র সৌজন্যে আপনারা এখন এই ‘দাদা’ সম্পর্কে অবগত), নয়তো রয়েছে প্লাস্টিকের প্যাকেটে খানিকটা ডেন্ড্রাইট ফেলে মুখে চেপে ধরে, টান দেওয়া ! তারপর দিগন্তজোড়া ময়লায় শূকরগুলোর পিছু-ধাওয়া করা, যে খাদ্যটি ধাপার আবর্জনায় বেজায় সহজলভ্য; উন্নয়নের আবর্জনায় বেঁচে থাকা শূকরগুলো উন্নয়নের প্রদীপের আড়ালে, অন্ধকারে থেকে যাওয়া ঝিল্লিদের মোচ্ছবের খাদ্য হয় – শঙ্খ ঘোষ মনে পড়ে – “দেখ খুলে তোর তিন নয়ন / রাস্তা জুড়ে খড়্গ হাতে দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন !”
উন্নয়ন এরপর ধাপার মাঠের ভূমিপুত্রদের জায়গা-জমি দখল করার ব্লু-প্রিন্ট বানায় । ‘বিলাইতি হোটেল’, ‘ইকো পার্ক’ আরও কত কী ! ‘গার্ডেন’ মানেই বকুল-গুড্ডুদের কাছে ‘টেপাটিপির জায়গা’! তারা শহরের প্রগতিশীলদের ছাড়পোকার মতো গুলি করে মারে কল্পিত রাইফেল-পিস্তলে – ‘ঢিচক্যাঁও ঢিচক্যাঁও’ রব তুলে । মরা জীবজন্তুর শরীর টানতে টানতে কেউ কেউ নিজেরাও মরে পাঁচজনের কাঁধে উঠে পড়ে, তারা জানেও না ‘জীবনবীমা’-র মানে ! পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে ওঠা ধাপার মাঠের বাউন্ডারির ওপারে আলোয় আলোকিত একটা শহর আর এপারে অন্ধকারের দুর্ভেদ্য দেওয়াল । মানুষ, না এরা পোকা ? ওদের শোষণের নিত্য-রসদ, চম্পা আসলে কী ? মানুষ, পুরুষ, নারী, হিজড়া, নাকি সেও নিতান্তই আরেকটা পোকা ? পোকার আবার লিঙ্গ-পরিচয়ের মূল্য আছে নাকি ? স্বাধীনতা দিবসেও তার মানুষ হিসেবে মুক্তি নেই এই মুক্ত দেশে ! ধর্মতলার পথ-শিশুরা পর্যন্ত তাকে কাঁদিয়ে ছাড়ে, তার শৈশবের বন্ধুরাও তার শরীর-স্বভাবের ভিন্নতার মধ্যে কদর্য গ্লানিই দেখতে পায় শুধু ।
নীল রঙের এক মায়াবী ধোঁয়ায় শত শত কাক সশব্দে উড়ে বেড়ায় তাদের মাথার উপর সর্বক্ষণ । গুড্ডুরা ডেকেছিল বকুলকে, পার্ক স্ট্রীটে সেকেন্ড হ্যান্ড অথবা দু-নম্বরি জামা-প্যান্ট, সস্তা ঘড়ি বেচে দু-পয়সা কামানোর জন্য, কিন্তু বিকল্প জীবনে যেতে অপারগ বকুলের মতো এখানকার আরো অনেকে । সভ্য-সুশীল সমাজ এর কোনো বোধগম্য ব্যাখ্যা খুঁজে পাবে না – কেন বিরসা মুন্ডা ধনুঃশর ত্যাগ করে ক্রিশ্চান হতে পারে নি, এরও যেমন ব্যাখ্যা হয় না কোনো । ছবিতে যখন বকুলদের ‘ইউনিভার্স’টাই হাতছাড়া হয়ে যায়, সেই মুহূর্তে তার উন্মাদদশা আর গুড্ডুর ডাকে সাড়া না দিয়ে তার এলোমেলো দিশেহারা দৌড়ে বেড়ানো দেখে, আবেগাপ্লুত না হয়ে উপায় থাকে না । মনে পড়ে, সম্প্রতি রনি সেনের ‘ক্যাট স্টিকস্'(২০১৯) দেখেও মনে হয়েছিল বটে, একটা নির্মাণ দেখছি ! এমন একটা নির্মাণ যেখানে প্রলাপেরও একটা পরিপ্রেক্ষিত রয়েছে; নিকষ কালো অন্ধকারেও রয়েছে কোথাও মমতার স্পর্শ, শহরের অদৃশ্যপ্রায় তলপেটেও রয়েছে অপেক্ষারত কতকগুলো মানুষ, সাদা-কালো; এমন একটা নির্মাণ যার কিছু বলার ছিল, যে কিছু শুনেওছিল, ফাঁকা বুলি কেবল আওড়ায় নি, পিছলে যাওয়া দিনের আলোর প্রবেশপথে যে নির্মাণ বৃষ্টির রাত দিয়ে দেওয়াল তুলেছে, পাপ-পঙ্কিল তালা ঝুলিয়েছে তার ভালোমানুষ চিনি-গোলা(sugar-coated) গতানুগতিকতার ফটকে । ঈশানের ‘ঝিল্লি’ও তাই, বহুদিন যার ঝিল্লিরব দুই কানে রয়ে যাবে ।
এই ভাবনায় ইতিপূর্বে কোনো বাংলা ছবি হয়েছে বলে তো মনে হয় না ! ইউটিউবে মোহন কুমার ভালাসালার ‘পঞ্চভূত’ নামে একটি তথ্যচিত্র আছে বটে ! সেটি এই ছবির অনুপ্রেরণা হলেও হতে পারে ! কিন্তু ঈশানের ছবি ‘ডকু’ নয়, একেবারে খাঁটি সিনেমার ভাষায় গল্প বলেছে, নবাগত ঈশান ঘোষ (প্রখ্যাত পরিচালক গৌতম ঘোষের সুপুত্র) যেমন আনকোরা অভিনেতাদের মধ্যে থেকে সেরাটা সফলভাবে বের করে এনেছেন, তেমনি ছবির কালারটোন, শট্ ডিজাইন, ইম্প্রোভাইজিং স্কিল, প্যাশন, ক্যামেরা ও সম্পাদনাতেও তাক্ লাগিয়ে দিয়েছেন । ফেস্টিভ্যালেই কথা হল ছবির তরুণ এক অভিনেতার সঙ্গে, যিনি দর্শকদের আপ্লুত হাততালির মধ্যেও স্তম্ভিত, বুঝতে পারছেন না কী ঘটিয়ে ফেলেছেন ! একটা লাইফ-টাইম কাজ, যা লোকে ভুলতে পারবে না ! এই গতি আর এই ক্যামেরা ওয়ার্ক, এভাবে নাগরিক পরিসরের লোয়ার ডেপথ্-এ নেমে এসে তাকে ছুঁয়ে ফেলা যেন বাংলা ছবির বুকের বাঁ-দিকে ফের কিছুটা প্রাণবায়ু ঢুকিয়ে দিয়ে যায় । ব্যোমকেশ-ফেলুদা-কাকাবাবু আর অনির্বাণের সাথে সাথে দক্ষিণ-ঘেঁষা, ‘Monopoly’-আক্রান্ত, পঙ্কিল এই ইন্ডাস্ট্রি যদি এ’রকম ছবি মুক্তির পথ প্রস্তুত করতে পারে, তবে শপথ করছি, বাংলা ছবির পাশে থাকবো, নয়তো নয় । ছবিতে সামান্য দুর্বলতা রয়েছে সাউন্ড  ও আবহ সঙ্গীতে – বিজিএম কোথায় একটু লাউড, কোথাও দৃশ্যের সাথে মৃদু বেমানান । কিন্তু ছবিতে স্বত:স্ফূর্ত একটা ক্যাওস, জমজমাট চিত্রনাট্য আর ক্যামেরার দুরন্ত গতি সবকিছু সামলে নিয়েছে । অকপট সংলাপ আর নৈতিকতার ধার-না-ধারা চিত্রভাষা ছবিতে যোগ করেছে নতুন সুর আর অনুপম এক অভিজ্ঞতা । গিম্বল ও হ্যান্ড হেল্ড ক্যামেরার এই ঔৎসুক্য আর ‘মৃণাল সেনের কলকাতা’টাকে ফের ছুঁয়ে দেখার দুর্মর বাসনা না থাকলে এই ছবি হতো না । আউটডোর শ্যুটের ফুটফুটে আলো জ্যোৎস্নার মতো এই ছবির গোটা শরীর জুড়ে বিরাজমান সমস্ত অন্ধকারকে প্লাবিত করেছে । জাস্ট ভাবতে পারছি না, একটা নতুন ছেলে এরকম একটা মৌলিক ছবি বানিয়ে ফেলেছে ! এই গতি, এই অনন্য মুক্তি, এই অকুতোভয় নিরুদ্বেগ চলন, এভাবে বিশ্ব-সিনেমার চিত্রভাষার মূল সুর স্পর্শ করতে পারা – সিনেমার দর্শক হিসেবে ও সর্বোপরি বাঙালি হিসেবে, কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বসে এ’রকম একটা বাংলা ছবি দেখতে পেয়ে আপ্লুত ! কলকাতা শহরটার তলপেট খামচে ধরেছে পুরো । বলাই বাহুল্য এই পরিচালকের পরের কাজ দেখার জন্য আমরা মুখিয়ে থাকব ।
অভিষেক ঘোষ
পেশায় শিক্ষক, নেশায় কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক । প্রকাশিত কবিতা সংকলন ‘শব্দের অভিযান’ ও উপন্যাস ‘পরজীবী’ ।
Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top