শৈশবের উৎসব – উৎসবের শৈশব: অপর্ণা হাওলাদার

বলা হয়, উৎসবের ধরণ দিয়ে একটা সমাজের অনেক কিছুই বোঝা যায়। কিছু চেষ্টা করা যাক।

মনে রাখা দরকার, নব্বই দশকে আমার শৈশবের যে বরিশাল শহরের কথা বলছি তা অনেক পুরনো, তখনো বরিশাল প্রায় গ্রাম। গ্রামীণ হিন্দু সমাজের উৎসবগুলোই প্রাধান্য ছিলো আমাদের পরিবারে। খাবারে, আচারে, কর্মে, সেদিনে মালপোয়া, লুচি, ডালের মধ্যে থেকে বড় বয়েছি। বার্গার, পিজ্জা, যেমন বললাম, আমি চিনতামও না। বরিশালে ঐকালে কোনোদিন রেস্টুরেন্টে খেয়েছি মনে পড়ে না। কিন্তু কয়েক দোকানের মিষ্টির বেশ নাম ছিলো। বাইরে থেকে আনা খাবারের চল অনেক কম ছিলো। সবই বাসায় বানানো হোতো প্রায়। আমি কি মানুষটা খুব খাদক প্রকৃতির? উৎসব বলতেই এমন মনের মধ্যে বুভুক্ষু বাসনা আসছে কেন!

বাসায় পূজার চল ছিলো না। ন্যুনতম ঠাকুরের আসনটুকুও ছিলো না সেইকালে। পুরোহিতের সাথে ক্যাচাল করে আমার দাদু তা অনেক আগে বন্ধ করে দেন বলে শুনেছি। কিন্তু ধার্মিক ছিলেন তিনি। আর, উৎসবের চল তো ছিলোই। হিন্দুদের বার মাসে তের পার্বণ, আজ লিখতে গিয়ে গুণে দেখলাম, কথাটা মিথ্যা না। উপরে ছিলো, আত্মীয়ের মত প্রতিবেশী মুসলিম বাড়িতে সামিল হওয়া আরও কিছু উৎসব।

দূর্গা পূজা সবচেয়ে বড় উৎসব ছিলো সেইকালে। ভেবে মনে হচ্ছে, বোধকরি এই ধারণাটা যুক্ত ছোটোদের জন্য নতুন জামার সাথে। আমি যেমন পরিবারে বড় হওয়া, কিংবা ঐকালে মধ্যবিত্ত যেকোনো পরিবারেই হয়তো, সারাবছর কেনাকাটার চল ছিলো না। নতুন জামাও অনেককাল হাতেই বানানো হোতো। বুড়ো মহিলার হাতের কাজ, নকশা করা ডিজাইনের কাগজ ইত্যাদির নামও ছিলো। চোখটা কাজ করতো না, তাই সুই-এ সুতো ভরে দিতে হোতো আর কাউকে। নতুন জামা, অন্তত দুই সেট মনে হয় পাওয়া হোতো। একটা দিদিমা’র দেওয়া, আরেকটা আমার বড়কাকীমা’র দেওয়া।

পূজার খাবার তো এখনো প্রায় অবিকৃতই থেকে গেছে। বাড়িতে বানানো মিষ্টি – নাড়ু, মোয়া, ক্ষীরের সন্দেশ, মিষ্টান্ন। মূল খাবারে থাকতো সবজির লাবড়া, খিচুড়ি, মাছ, বিভিন্ন ভাজা। পূজার অঞ্জলি বরিশালের রামকৃষ্ণমিশনে দেওয়া হোতো। মিশনের খিচুড়িটা মিষ্টি হোতো একটু, আর একই ঠোঙ্গায় চালের একটা দুধ মিষ্টান্ন থাকতো। এই খাবারটা আমি পরে কত জায়গায় খুঁজেছি। এমনকি ঢাকার মিশনে গিয়েও চেয়ে দেখেছি, পাইনি।

ঘুরে ঘুরে পূজো দেখার একটা চল ছিলো। কিন্তু আমি বাচ্চা হিসেবেও বেশ গাম্ভীর্য বজায় রাখতাম, তাই ভিড় হইচই ভালো লাগতো না অত। আর ছিলো, বাড়িতে সারাদিন পাড়াপ্রতিবেশি, দূরদূরান্তের লোকজনের আসা যাওয়া। আসলে, দাদু-দিদিমা’র কিন্তু তেমন আত্মীয় দেশে নেই। যারা আসছে, তাদের কেউই রক্ত সম্পর্কের কেউ নন। তারা যে কেউ রক্তসম্পর্কের নন, এই কথাটাও ওইকালে কেউ বলে নাই।

সবার মধ্যেই বড় হয়েছি। সাম্প্রদায়িকতা বলতে একবার বরিশাল সদর গার্লসে “হিন্দুদের নাস্তিক নাস্তিক লাগে” শোনা ছাড়া কিছু মনে পড়ে না। পূজার দিনে, পাড়ার সব শিশুকিশোরের দশমীর দিন নিমন্ত্রণ ছিলো। অনেকপরে ঢাকায় যখন কেউ একজন বাসায় ঢুকে জানতে চান, “আচ্ছা, এই যে আমি চলে এলাম, আপনারা কিছু মনে করলেন না?”। প্রশ্নটা শুনে ভাবতে হয়েছে। হ্যাঁ, এই চল যে ছিলো না বাড়িতে, হিন্দু ব্রাহ্মণ বাড়ি হলেও। আজ পেছনে তাকিয়ে মনে হয়, সেটাই সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ হয়তো আমার শৈশবের। শিশু যদি সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে থেকে বড় হয়, তার একার পক্ষে যুদ্ধ করা নিশ্চয়ই সোজা নয়।

দূর্গা পূজার কয়েকদিন পর লক্ষ্মী পূজা। পাশের বাড়িতে বেবি মাসি, বিনয় মেসো এই দম্পতি হিন্দু ধর্মে প্রচলন আছে, এমন কোনও একটি পূজা বাদ দেন না। আর প্রতিবেশী তারা নামকাওয়াস্তেই। এরা পাশাপাশি থাকেন বহুকাল। আমি মানুষটা এমনই অশিক্ষিত, পূজা বলতে কেবল খাবারই মনে আছে। তো, এই পূজার একটি খাবার আমার খুব প্রিয় ছিলো। বুটের ডাল ভিজিয়ে নরম করে, সাথে নারিকেল কোরানো দিয়ে মাখানো। আহা, এ এক অমৃত। আর আছে, পাকা কলা আর চাল মেশানো। বিভিন্ন ধরণের ফল। তারপর খাবারে লুচি, ডাল, সবজি। নিরামিষ খাবারেরই পূজাতে প্রাধান্য ছিলো। কিন্তু, ঐ হাতের রান্না, আর ওই স্বাদের নিরামিষ যেকোনো আমিষকে ছাড়িয়ে যাবে। কাঁচা কাঁঠালের তরকারি কিংবা কলার মোচা। পাঁচমিশালি সবজি। মাছের মধ্যে রুই, কাতল এর চল ছিলো। মাংস করতে হলেই সেটা হোলো পাঁঠার মাংস কষা। বড় বাড়িতে সবার মাঝে বড় হওয়ায়, খাওয়ার ব্যাপারে কোনও আহ্লাদী করা যেতো না। এটা নিউট্রাল ফ্যামিলির আবিষ্কার।

এরপর যেটা নিয়ম করে মানা হোতো, তা হোলো সরস্বতী পূজা। স্কুলঘরগুলোতে নিজস্ব পূজার চল ছিলো। একটা মজার ব্যাপার হোল, এই পূজার আগে বরই আর ইলিশ ঢোকানো হোতো না ঘরে। সিজনালি এই দুইটা আগে জমে উঠত না বোধহয়। সরস্বতী পূজার দিন পড়া লাগতো না। আর একটা চল ছিল, ক্লাসের বই পূজার ঘরে প্রতিমার পাশে রাখা। সরস্বতী পূজাটা ভালো লাগতো, একটা ডিভাইন ভাব ছিলো। বাড়িতে আলপনা করা হোতো পূজার কালে। বলেছি তো আগেই, আর্টের কোনো শাখায় জন্মাবধি আমার কোনো সম্ভাবনা দেখা যায়নি কোনোদিন। কিন্তু অন্যরা করছে দেখতে ভালোই লাগতো। সরস্বতী পূজা খিচুড়ি, ইলিশ মাছ দিয়েই মূলত পালন করা হোতো।

আর কয়েকটি পূজা বেবি মাসির বাড়িতে হোতো, যার কথা মনে আছে, কিন্তু এগুলো স্বল্প আকারের। যেমন, শনি পূজাতে কুমির বানানো হোতো মাটি দিয়ে, তার চোখ বানানো হোতো মার্বেল দিয়ে। শনির কোনও মূর্তি নাই, তাই। শিব পূজা একটা মজার ব্যাপার যেটা আমার মা আর বিনয় মেসো এই দুইজন উপোষ রেখে মানতেন। মানে সারাদিন উপোষ করে রাতে খেতেন। তখনো মা’র সাথে শিব নিয়ে হাতাহাতি শুরু হয় নি। একজন মধ্যবয়সের পুরুষ, বিনয় মেসো, যার সব সন্তান ততদিনে এডাল্ট, আরেক আমার মা; কি কারণে এই দুইজন কি চেয়ে শিবকে পূজা করতেন, কে জানে। কিন্তু আতপ চালের ভাত মায়ের সাথে ঘি দিয়ে আমিও একটু চেখে দেখতে পছন্দ করতাম!

আর, দুর্গার মত পপুলার না হলেও কালীর দাম ছিল। কালী মন্দির ছিল বরিশালে দুইটা। দিদিমা জন্মদিনের দিন কালী মন্দিরে নিয়ে যেতেন। শুধু আমি আর দিদিমা যেতাম। দিদিমা’র নিচে বসতে সমস্যা হোতো হাঁটুতে। লিখতে লিখতে হঠাত মনে হোলো, আর কাউকে নিয়ে তিনি জন্মদিনে যেতেন না কালীবাড়ি। ভদ্রমহিলার অনেক উপদ্রবের কেন্দ্রবিন্দু আমি ছিলাম। একা আমাকেই “দাদু যতদিন বেঁচে আছেন, শিখে নে যতটা পারিস” জ্ঞান কানে নিতেই হোতো। ঘটনা কিন্তু সত্য, ভদ্রলোকের অন্য দোষ যাই থাকুক, শিক্ষক তিনি ভালো ছিলেন। অথবা, অসাধারণই ছিলেন।

আর ছিলো, দুটো ঝলমল দিন। এক, দীপাবলিতে সারা বাড়ি মোমবাতি জ্বালানো। তা আবার ঠিক গুনে মোমবাতি হাতে দেওয়া হোতো সব বাচ্চাদের। তখন বরিশালের বাড়িতে সামনে অনেক বড় মাঠ, একেবারের শেষে একটা লোহার গেট। এই পুরো মাঠ আর লোহার গেট ভরে দিতাম আমরা মোমবাতিতে। আর ছিলো দোল। দোলে বড়রা ছোটোদের মাথায় আর ছোটরা বড়দের পায়ে রঙ মাখিয়ে দিতো। তাও প্রথম প্রণাম দিদিমা’কে করার চল ছিলো। আজকে যে দেখি কতশত রঙ, তেমন কিছু না; শুধুই লাল আবীর। স্নিগ্ধতা ছিলো সেই উদযাপনে।

আর ছিলো, নতুন চাল নিয়ে নবান্ন উৎসব। এটা একটা খাবার যেটা আসলে বাংলা কোন নাম আছে কিনা আমি জানি না। চাল বাটা দিয়ে নারিকেলের জল, শাস, অন্যান্য ফল দিয়ে বানানো। ভোররাতে উঠে সব মহিলারা একত্রে চাল বাটতেন। শেষ হলে, খাওয়ার আগে বাড়ির সবচেয়ে বড় (এই ক্ষেত্রে দিদিমা) এর পারমিশন নিতে হোতো। মানে হাতে বাটি নিয়ে জিজ্ঞেস করা, “দিদিমা, খাই?”। এইসব উৎসব কিন্তু যে কেউ আমন্ত্রিত ছিলো যে কোন সময়। বাড়িতে আসলে দরজাও ভেজানো থাকতো না সারাদিন। আর হোলো, ভাদ্র অমাবস্যা রাতে ভাত না খেয়ে চালের রুটি, বুটের ডাল, মাংস এর চল ছিলো। মানুষের অধিক পয়সা থাকা লাগে না সবাইকে নিয়ে চলতে গেলে, এই একটা জিনিস দিদিমা’র কাছে থেকে দেখা।

আর, চৈত্র সংক্রান্তির কয়েকদিন ঘর গোছানোর হুল্লোড় লেগে থাকতো। সারা বাড়ির সব নামিয়ে আবার গুছিয়ে রাখা। বরিশালের বাড়িটা টিনের। উপরের দুটো ঘরের সব নামাতে উঠাতে গিয়ে কত পুরনো কার্ড পেয়েছি কতবার। ভালোই লাগতো এই ঝাড়মোছার কয়েকদিন। পয়লা বৈশাখ ব্যাপারটা জমকালো ছিলো না ঢাকার মত, কিন্তু শান্তি শান্তি একটা ভাব ছিল। দুই টাকা, পাঁচ টাকা পাওয়া বড়দের থেকে প্রণাম করে। চিড়া, দই, কলা মেখে খাওয়া। মেলায় যাওয়া। নাগরদোলা, বাঁশি, মাটির নৌকা। চাহিদাও তো কত কম ছিলো ওইকালে আমাদের।

এক মেসো ছিলেন (আসলে সব অল্পবয়সী নারী ‘মাসি’ ছিলেন, তারপর ওনারা যার পাণিগ্রহণ করেছেন, তারাই মেসো)। নাম তার “সুশীল”। আমার বাবারও এই নাম। তো, উনি ব্যাংক থেকে নতুন দুই টাকার নোট তুলে আনতেন সব বাচ্চাদের জন্য। একটা দুই টাকার নোট, কিন্তু একটা অদ্ভুত ভালোলাগা থাকতো নোটটায়।

আর কী? ওহ, আর বাকি থাকে জন্মদিন। সেটা বেশি একটা পালনের ধারা ছিল না। তবে ছবি তোলা হোতো। আমি ঢাকায় আসা অবধি প্রতি বছর জন্মদিনে আমার একটা ছবি আছে এখনো সংগ্রহে।

বরিশালের বাড়িতে দুই ঈদের দিন আর শবে বরাতের দিন কয়েকজন মামী খাবার নিজে এসে দিয়ে যেতেন। মামী, মানে, তারা প্রতিবেশী। আন্টি একটা শব্দ যেটা ঢাকায় এসে শিখেছি। বরিশালে কেউ কাউকে ইংরেজি শব্দে ডাকতো না। আজকে হঠাত লিখতে গিয়ে মনে হোলো, ওনারা আসলে কেবল কিছু হিন্দু বাড়িতে দিবেন বলেই, ঈদ-উল-আজহার দিনে খাসিও রান্না করতেন। মধ্যবিত্ত পরিবারে এই বাড়তি ঝামেলাটা তারা ভালোবেসে নিতেন। আর অন্য কারো হাতেও কোনোদিন খাবার পাঠাতেন না। দিদিমা, মা, মামীর সাথে তাদের বন্ধুত্বের জোর ছিলো। শবে বরাতের চৌদ্দ রকমের হালুয়া বরিশালে চল ছিলো না। দুই-তিনটিই ছিল, রুটির সাথে খাওয়া হোতো। হাজার রকমের যে হালুয়া হয়, এটা ঢাকায় এসে জেনেছি।

আমি গ্রন্থ পড়া ধর্মস্কলার নই। আজ এই বয়সে এসে, যে কোনও জায়গায় সাম্প্রদায়িকতা দেখলে, সেই জায়গায় আমার অংশ আছে বলে তীব্রভাবে মনে করি না। যুক্তিবোধ আসে পরে, কিন্তু বড় হয়েছি যাদের কোলে, যাদের সাথে, তাদের অসম্মান করে চলতে যে পারে পারুক, আমি চাইনা – আমার নিজস্ব ধর্মগ্রন্থে তাকে নেমকহারামিই বলে। তোমার ধর্ম তোমার থাক।

আমি “সাঁঝ বেলায় আদরের ডাকে কেমন করে মুখ ফিরাই?”

 

অপর্ণা হাওলাদার

জন্ম ২০শে অক্টোবর, ১৯৮৫। ঢাকা শহরের উদয়ন বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও ভিকারুন্নিসা নুন কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স করেন। ২০১১ সাল থেকে উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনে প্রবাসে, ২০১৯ সালে অর্থনীতিতে পিএইচডি শেষ করেন আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয় থেকে। বর্তমানে  আমেরিকার  পিটসবার্গের চ্যাথাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top