বর্ণালী সাহা
১। অনুবাদঘর
“ভালোই”, উত্তরে বলল আবেদা তদ্গত শুকনো গলায়।
আবেদার কাছে তিনি জানতে চেয়েছিলেন ও কেমন আছে। প্রশ্নটা সরাসরি উদ্ধৃত করলে: “তুমি আজকে কেমন আছ?”।
শক্ত চেয়ারে পিঠ রেখে আবেদা কেন যেন চাইলেও আরাম করে বসতে পারছে না। গত দুইদিনের সন্ধ্যা সাতটার সিটিং-এর অভিজ্ঞতায় ওর অবশ্য আস্তে আস্তে অভ্যাসটা হয়ে আসছে। ওর সামনে রাখা মজবুত টিক-উডের টেবিল, যার উপর দুটো পেপারওয়েট, একটা পানির গ্লাসসহ পিরিচ, আর একটা ওষুধ-কোম্পানীর ছাপ্পা মারা কলমদানী ছাড়া আর কিছু নেই। সেই টেবিলের পিছনে বসা বিশেষজ্ঞ তিনি, তাঁর পিছনে বুকশেলফে সার করে দাঁড় করিয়ে রাখা সাইকায়াট্রির ইংরেজি বই। তটস্থ বইগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে যেন শাস্তি পেয়েছে।
ভদ্রমহিলা এর পরের প্রশ্নের অবতারণা করার জন্য গলা-খাঁকারি দেন। আবেদা নড়েচড়ে বসে।
“গতদিন তো বলেছিলে একই দুঃস্বপ্ন প্রতিরাতে দেখছ। তো, গতরাতে কী দেখলে?”
“মনে নেই।”
“ওইরকম রেকারিং ড্রিমস আগে আর কখনো তুমি কিছু নিয়ে দেখেছ?”
আবেদা উত্তর দেয় না। নিজেকে সত্যি সত্যি রোগী মনে না করলে রোগ-নির্ণয়ে সহযোগিতা করা প্রায় অসম্ভব।
দীর্ঘ বিরতির পর ধৈর্যশীল মানুষের মত মাথাটাকে একটু নিচে ঝুঁকিয়ে কিন্তু মুখে কিছু না বলে নীরবে প্রশ্নটির পুনরাবৃত্তি করলেন ভদ্রমহিলা।
আরো দুই সেকেন্ড। মহিলার চোয়াল একটু কাঁপে। আবেদা তাও নিশ্চুপ।
খেলাটা আবেদার ভালো লাগে। ওর টনটনে জেদ আর পরিমিত আত্মবিশ্বাস কি করে মহিলা টের পায় না? আরিফ কি করে সত্যিই ওকে অসুস্থ ভেবে এখানে নিয়ে আসে? অবাধ বীর্যপাতে বাধা পেলে কি উদ্যোগী পুরুষের ভালবাসার ঘাড়ে সিন্দাবাদের ভূতের মত ভর করে বউয়ের অসুস্থতা? আবেদার অভিমান হওয়া উচিত।
ভদ্রমহিলা দৃষ্টি সরান না। নীরব জিজ্ঞাসা জারি থাকে। সপ্রশ্ন দৃষ্টি দীর্ঘক্ষণ বিছিয়ে রাখার ট্রেনিংও পেয়েছেন নাকি মহিলা মেডিক্যাল স্কুলে?
আবেদা তারপরও কিছু বলে না। এমন একটা চেহারা বানিয়ে বসে থাকে যা দেখে যে কেউ নিশ্চিত হবে যে সে স্মৃতি হাতড়ে উত্তর খুঁজে বের করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করছে না।
ধৈর্য আর সহানুভূতিতে মাখামাখি গুরুপাক দৃষ্টিকে এইভাবে শায়েস্তা করতে হয়। আবেদা জানে। অফিসের ইন্টারভিউ বোর্ডে এরকম মাইন্ড গেইমের অভিজ্ঞতা তার হয়েছে। (প্রার্থী হিসেবে নয়; ইন্টারভিউয়ার হিসেবে। হিউম্যান রিসোর্স ডিপার্টমেন্টের কাজই এমন।)
নির্মোহ চোখে-চোখে চেয়ে থাকার স্ট্র্যাটেজিতে কাজ হয়।
ভদ্রমহিলা শায়েস্তা হন। শায়েস্তা হওয়ার প্রথম লক্ষণ হল সূক্ষ্ম অসহিষ্ণুতার প্রকাশ।
“আবেদা, দেখো…আমরা তোমাকে সাহায্য করতে চাইছি।”
“তুমি ছাড়া ‘তোমরা’ কারা?”, বলল আবেদা মনে মনে।
“আবেদা, তুমি সেদিন বলেছিলে প্রায়ই তুমি দেখ একটা হসপিটালের বেডে শুয়ে তুমি একে একে কয়েকশ বাচ্চা জন্ম দিচ্ছ। এই ব্যাপারে ডিটেইলস আলাপও আমাদের হয়েছে। আমি যা জানতে চাইছি, তা হল– অতীতে এমন কিছু স্বপ্ন রিপিটেডলি দেখার কথা তোমার মনে পড়ে কিনা।”
আবেদা খুব বেশি মনোযোগ দিতে পারে না মহিলার প্রশ্নে।
আবেদা কেন যেন গোড়া থেকেই এই ভদ্রমহিলার অফিসঘরে একটা গন্ধ পেত। আজ ও বুঝতে পারছে কিসের গন্ধ। ছোটবয়েসে রিমন’দের ভোজ্য তেলকলের উল্টোদিকের বাড়ির বাইরের ঘরে আলমারি ঠাসা সস্তা নিউজপ্রিন্টের পেপারব্যাক অনুবাদের বই রাখা থাকত। বাইন্ডিংএর সুতা প্রায়-আলগা হয়ে আসা ওয়েস্টার্ন কিংবা রোমান্টিক অনুবাদের বই। কেমন একটা সোঁদা ঘাসপচা গন্ধ আসত ঐ আলমারি থেকে। সার সার অনুবাদের বইগুলো অমায়িকভাবে হাতে হাত ধরে থাকত। বহুদূরের অন্য এক দুনিয়ার গল্প বুকে নিয়েও ওরা কেমন মেকি বন্ধুসুলভ রপ্ত হাসি নিয়ে কাছে আসার ভান করত; বলতে চাইত নরম সুরে, “দেখ দেখ, আমরা ভিনদেশী হয়েও কেমন তোমার নিজের ভাষায় গল্প ফেঁদেছি! তোমার ভাল লাগছে না? আচ্ছা ঐ স্পাই থ্রিলারটাকে ডেকে নামিয়ে দিই, কেমন? ওকে নিশ্চয়ই খুব ভাল লাগবে! ও একটু চটুল হলে কি হবে? দিলটা দরাজ। আচ্ছা প্রাপ্তবয়স্ক ওয়েস্টার্নটা এখনি খুলো না কিন্তু। একটু বড় হলেই দেখবে কেমন অদ্ভূত পেট চিনচিন সারপ্রাইজ দিচ্ছে ও তোমাকে!”। কত কথাই না বলত ওরা। ওদের এত কথার ভিড়ে ওদেরকে খুলে পড়ার ইচ্ছে কোথায় যেন হারিয়ে যেত। শুধু ঐ বিনবিনানি কথার চিরুনির দাঁড়া আঁকড়ে জটপড়া ঝরা-চুলের মত অবাধ্য পেঁচিয়ে থাকত ওদের গায়ের ঘাসপচা সোঁদা গন্ধ।
সেই গন্ধ আর এই ঘরের গন্ধ হুবহু এক! হুবহু একই অনুবাদের বইয়ের গন্ধ। এই গন্ধটা যেন ভদ্রমহিলার হাত-পায়ের ভাপ থেকেই আসছে।
ভদ্রমহিলার প্রতিটি বাক্যেই এমন একটা কিছু আছে যা সম্ভবত ঘরের কোনায় ডাঁই করে রাখা পুরনো অনুবাদের বই ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না। খুব বেশি খুঁজলে বাংলায় ডাব করা এখনকার ডিসকভারি চ্যানেলের ঘ্যানানি ধারাভাষ্যের মধ্যে পাওয়া যেতে পারে। তা না হলে কে কবে বাংলায় জিজ্ঞেস করে “তুমি আজকে কেমন আছ?” কিংবা বলে “আমরা তোমাকে সাহায্য করতে চাইছি!”?
এই যে প্রাণঢালা সহমর্মিতা নিয়ে মহিলা ওর দিকে তাকিয়ে আছে, এই সহমর্মিতাটাও মনে হচ্ছে ইংরেজি থেকে বাংলায় আক্ষরিক অনুবাদ করা। যে অসীম ধৈর্য নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তিনি মনোরোগের গতিপ্রকৃতি ধরার চেষ্টা করেন, সেটাও নিছক অনুবাদ করা ধৈর্য। যে অনুসন্ধিৎসা নিয়ে উনি সওয়াল-জবাব চালান, সেটাও নিরেট কাঁচা অনুবাদ। মহিলার পরনের আসমানি নীল শাড়িটাও একটা অনুবাদ করা শাড়ি। ডানহাতের সোনার চিকন চুড়িজোড়া দেখতেও লাগছে যেন বার বার ঘষে-মেজে অনুবাদ করা। যে পাট-পাট শৃংখলায় উনি রোগীদের ফাইল সাজিয়ে রাখেন, তাতে ডটপেন দিয়ে সযত্নে সাইডনোট লেখেন গোটা গোটা অক্ষরে, ‘টুক’ শব্দ করে পিরিচে আধখালি গ্লাস রাখেন, নতুন করে প্রশ্ন সাজিয়ে নরম কাশি কেশে গলা পরিষ্কার করেন—সব, সব অনুবাদ করা। ছুটির দিনে বাড়িতে বসে তিনি কি কুরুশ কাঁটার কাজ করেন? কিংবা বুয়ার বানানো হালুয়া দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করেন? করলে সেগুলোও টুকটাক অনুবাদ করা।
উনি যে কায়দায় আবেদার আবেগিক গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করবেন, রোগ-নির্ণয় করবেন, বিশ্লেষণ করবেন, ঘুমের ওষুধ দেবেন, আবেদার হাজব্যান্ড আরিফকে ওয়েটিং রুম থেকে ডেকে এনে পাশে বসিয়ে শলাপরামর্শ দেবেন—ওগুলোও সব অনুবাদ করা নিদান।
মনোবিজ্ঞানের অনুবাদ লাগে। গার্হস্থ্য বিজ্ঞানেরও লাগে। কিংবা মনে হয় সব বিজ্ঞানের। অথবা সম্ভবত সব জ্ঞানের। ঈশপের গল্পের লাগে। ধর্মগ্রন্থেরও তো লাগে!
এই সব ভাবনার মাঝে মহিলা আরো একটা নতুন প্রশ্ন ফেঁদে ফেলেছেন। জানতে চাইছেন আবেদার জীবনে বা অফিসে ইদানিং কোনো ট্রমাটিক বা স্ট্রেসফুল এক্সপেরিয়েন্স হয়েছে কিনা।
উত্তর না পেয়েও ভদ্রমহিলার বাঁকাচাঁদের দেখনহাসিতে কোনো কমতি ঘটে না। নতুন প্রশ্ন রেডি হয়।
“স্বপ্নে কি তুমি কখনো তোমার মা’কে দেখতে পাও? কিংবা চেনা অন্য কাউকে?”। এই প্রথম ভদ্রমহিলার করা কোনো প্রশ্ন আবেদার কাছে অনুবাদের মত লাগল না।
“হুঁ…মা’কে দেখি মনে হয়…মাঝে মাঝে”, মিথ্যা কথা। তাও আবেদা এই প্রশ্নটার উত্তর দিল।
হ্যাঁ…একরাতে দেখেছিল নানাভাইকে। বারান্দার বেড়ার সামনে বসে মুড়িভর্তি একটা বিশাল অ্যালুমিয়ামের বাটিতে রগ-ফোলা হাতটা চুবিয়ে লাগাতার খিস্তি করছেন কাকে যেন। উঠানে কে যেন পানি ছিটিয়ে ঝাড়ু মারছিল গাছকোমরে। স্বপ্নটা আর কোনোদিন ফিরে আসে নি; ঐ একবারই। ঐ একবারের স্বপ্নটা এত স্পষ্ট দগদগে, জীবনের কয়েকশ রেকারিং ড্রিম মিলেও ঐ স্বপ্নের চেয়ে বেশি স্মরণীয় হতে পারবে না কোনোদিন। নানাভাই ওর ছয় বছর বয়সে দেহান্তরিত হন।
নানাভাইকে দেখার কথা মনে হতেই ঘাসপচা অনুবাদ বইয়ের ছ্যাঁতলা-পড়া গন্ধ ছাপিয়ে টাটকা তামাকপোড়া গন্ধ টের পেল আবেদা। সেদিনের স্বপ্নেও নানাভাইয়ের সঙ্গে এসেছিল ক্যাপস্টান সিগারেটের উগ্র গন্ধ। নানাভাইয়ের বুকের ঘন কাঁচাপাকা চুলে লেগে থাকত যে সিগারেটের গন্ধ, নানীর মাথার সুগন্ধী জবাকুসুম তেলের চেয়েও ভাল ছিল সেটা।
নানাভাই মরেছিলেন লাং ক্যান্সারে। “সিগারেটের নেশাই কাল হল”। মা বলেছিল। হয়তো অন্য কোনো কারণও থাকতে পারে সবে পঞ্চাশ পার হওয়া মানুষটার মৃত্যুর পিছনে। কে জানে? অনেক কেঁদেছিল মা। অনেক।
নানাভাই মরার বছর বিশেক পর মায়ের শিথিল মুখে শিশুর নিটোল হাসি দেখেছিল আবেদা। সেদিন আবেদার পীড়াপীড়িতে ওরা মিলে দামী রেস্টোরান্টে খেয়েছিল। সেদিন খেতে গিয়ে খলবল করে আবেদা সবার কাছে আরিফের কথা পেড়েছিল। কারণ সেদিন আবেদা’দের বাড়ির ঠিকানায় একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার এসেছিল। আবেদার নামে। ইংরেজিতে। আন্তরিকভাবে লেখা ছিল চিঠিতে—“কনগ্রাচুলেশনস”।
এইসব চিঠির অনুবাদ লাগে না।
এ-বি-সি-ডি’র গণ্ডি সামান্যই পেরোনো আবেদার মা অনুবাদ ছাড়াই খুশি। কয়েকটা ফটোকপি বানিয়েছিলেন ঐ চিঠির, আর অরিজিন্যালটা সম্ভবত বাঁধিয়ে রাখবেন বলে মনস্থির করেছিলেন।
বহুজাতিক (আসলে ব্রিটিশ বা আমেরিকান) টোব্যাকো কোম্পানির সেই চাকরি করছে আবেদা আজ বছর চারেক ধরে। সবাই জানে জীবনে আর বড় কোনো পরীক্ষায় ওকে বসতে হবে না।
সময়ে সে পরীক্ষার্থী থেকে হয়ে যাবে পরীক্ষা-নিয়ন্তা। সবাই জানে।
সাইকিয়াট্রিস্ট ভদ্রমহিলা কি কখনো ওর সঙ্গে অনুবাদঘরের বাইরে যাবেন? না গেলে উনি কীভাবে বুঝবেন আবেদাকে?
২। মূল
“Thy quiet spirit lulls the lab’ring brain,
Lures back to thought the flights of vacant mirth,
Consoles the mourner, soothes the couch of pain,
And wreathes contentment round the humble hearth;
While savage warriors, soften’d by thy breath,
Unbind the captive, hate had doomed to death.”
৩। দহনচক্র
আবেদার মেয়ে হয়েছে।
তার জন্মের উৎসবে ধুমধাম হবে, এটা তো জানা কথা। আবেদাদের সমাজে সবচেয়ে বড় উৎসব হল নবজাতকের জন্ম-মহোৎসব। জন্মের মোচ্ছব। জন্মেও দেখা যাবে না, এমত স্তরের মোচ্ছব।
জরায়ুর ভার হালকা হয়ে যাবার পর সৃষ্টির আনন্দে আবেদা ঝলমল করছিল তো বটেই, আজ তাতে যোগ হয়েছে সৃষ্টির গর্ব। ওর বাবার তরফের সব আত্মীয়দের মত আবেদাও চায় এবছর ভুট্টা, মরিচ, ক্যাকাও আর তামাকের আবাদটা যেন বাকি সব বছরের চেয়ে একটু বেশি ভরভরন্ত হয়। সবাই জানুক, মেয়ে তার ফেলনা নয়। যে শিশুটির নাম একটু পরেই রাখা হবে, পয়মন্ত হওয়ার দায়িত্ব তাকেও তো কিছুটা নিতে হবে।
কোলের কাছে দড়ির দোলনায় একটা টাটকা তেঁতুলের তেল-চকচকে বীচির মত গুটলি হয়ে শুয়ে আছে ওর মেয়ে। বোজা-চোখের উপর চোখের পাপড়িগুলো কেৎজাল পাখির রঙিন পালকের মত বিছিয়ে রাখা। চোখের মণিটাকে আদরে ঢেকে রেখেছে ঝিল্লীর মত পাতলা তিরতিরে নীলচে চামড়া। মুখের উপর রোদ পড়েছে মেয়ের। আবেদা চেয়ে থাকে।
আবেদা মা হয়েছে। তাই আত্মজার জন্য কলিজার ভিতর-নিংড়ানো সমস্ত রক্ত একটা বিশাল ঢেউতোলা সমুদ্র হয়ে গিয়েছে; আর ঐ মহাসমুদ্রের মধ্যে ওর পুরানো পৃথিবীটা একটা ছোটখাট গোলগাল ফাঁপা তামার বল হয়ে ভাসছে। ভাসছে, ভাসছে…কিন্তু এর মধ্যে কোথাও শিশুটির বাপের চিহ্নমাত্র নেই! পতিপ্রেম নামে যে কোনো আবেগ থাকতে পারে, স্বামীর বিগ্রহের পায়ে একটা বিশ্বস্ত অনুগত নারীদেহ যে মোমের মত গলে গলে নুয়ে পড়তে পারে কোনোদিনও, ওরও যে একটা স্বামী আছে যাকে ও কোনোদিন একটা মোমের মতই ভালবেসেছিল—এই বোধগুলো চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেল যেন এখন এখানে মেয়ের সামনে বসে।
সৃষ্টির গর্ব বুঝি এমনই ধ্বংসমুখী হয়। অন্যসব পুরাতন অনুভূতির সৌধ গুঁড়িয়ে ধ্বংস করে না দিয়ে সেই গর্ব মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। অতীতে চর্চিত মহিম আবেগগুলোকে এই গর্বের পাশে বালকের শিশ্নের মত হাস্যকর লাগতে থাকে। তাই যদি না লাগল, তবে সৃষ্টির আর কী দাম?
আবেদার আর ওর স্বামীকে ভাল লাগে না। ও বেশ বুঝতে পারে। ভাল লাগার প্রয়োজন যে ফুরিয়েছে, সঙ্গে এটাও বুঝতে পারে। তাই ও নিজেকে অযথা মহাপাতকী মনে করে না। শান্তিমত হাতের আঙ্গুল দিয়ে ছোট্ট মেয়েটার মুখের উপর পড়া রোদের ঝালর সরায়।
আজকের নামকরণ অনুষ্ঠানে শামান ব্যাটা ওর মেয়ের আসল নাম যা-ই রাখুক, ডাকনাম মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে আবেদা। ইশতাহ্ব।
ইশতাহ্ব।
ওর বাবার তো আর কষ্ট করে ভেবে ভেবে মেয়ের নাম বের করার দরকার নেই। অবলীলায় নিজের নামের অংশটুকু জুড়ে দেবে সময় মত, ঠিক যেমন অবলীলায় বীর্যবাহকের সামান্য শ্রমে ইশতাহ্বকে জন্ম দিয়েছে সে।
বদ্ধ আঁতুড়ঘর ছাড়ার পর আজ অনেকদিন পর নিজের বাপের বাড়ির বসতভিটায় ফেরত এসে আবেদার খুব ভাল লাগতে থাকে। ভাল লাগার আরো একটা কারণ হল, এই ঘরের সাথে ওর স্বামীর কোনো স্মৃতি বিজড়িত নেই। এই ঘরের একমাত্র স্মৃতি হয়ে বেঁচে আছে শুধু একটা রাত, যে রাতে ভিতরবাড়ির এই কাদামাটি-লেপা নিশ্ছিদ্র নিরন্ধ্র তালপাতার বেড়া আলতো হাতে ঠেলে সরিয়ে আৎল এসেছিল ওর ঘরে। সদ্য যৌবনাগম হওয়া আৎল। সারা অঙ্গে তামাকের পুরুষালী গন্ধ মাখা চৌদ্দ বছর অতিক্রম করা পুরুষ আৎল। (সেদিনই প্রথম আইনত ধোঁয়া টানার অনুমতি পেয়েছিল সে।)
লুকিয়ে এসেছিল সে। সেই মুহূর্তে তার থাকার কথা ছিল নির্বাসনঘরে। টানা কয়েকদিন উপবাস করার কথা ছিল তার পাণ্ডববর্জিত প্রকোষ্ঠে।
পালিয়ে আসা আৎলকে লাগছিল গ্রামবাসীর তাড়া খাওয়া একটা খেদানো জাগুয়ারের মত। আহা রে!
জলার ধারের জাগুয়ারের মতই ততদিনে তার গজিয়েছে গভীর মাংসল বুক, চওড়া ঘেরের হাত-পা-উরু-বাহু আর ক্ষুধিত হাতের পাঞ্জা।
“সবই তো আছে! লেজটা কই রে তোর? দে দেখি কোথায় লুকায়া রাখছস চোট্টা বিলাই!”, আবেদা সেদিন খিলখিল হেসে বলেছিল আৎলকে।
(জবাবে অশ্লীল রসিকতা ছুঁড়ে দেওয়ার ক্ষমতা আৎলের আছে, এটা তার কোনো শত্রুও বলবে না। কিন্তু ক’দিন আগেও যে নারী তার খেলার সাথী ছিল, তাকে লজ্জা কিসের?)
এখনো মনে আছে আবেদার। আৎলের উপনয়নের রাত ছিল তখন। উৎসবের ঘটা ঠিকমত মজে নি তখনো।
বাইরের উঠানে পাড়ার লোকের মাতাল নাচের হল্লা চলছিল। প্রায়-বিগতযাম প্রহরে জেনিপা’র রসে চুবানো কুচকুচে কালো নকশা-আঁকা আৎলের শরীরকে মধ্যমণি করে ওরা দু’জন সেই রাতে আসল যুবক-যুবতী হয়েছিল।
নিজের উপনয়নের কথা, সত্যি বলতে, আবেদার ভাল মনেও নেই। রীতি অনুসারে বারো বছর বয়সেই ওর উপনয়ন হয়েছিল, প্রথম রজোদর্শনের কিছুদিন পর। সমবয়সী ছেলে বিধায় আৎলেরটা হয়েছিল তার বছর দুয়েক পরে, ওর চৌদ্দতে পা দেয়ার দিন। আবেদা জানে, শিশু জন্মদানের গর্বের অনুরূপ গর্ব আবেদার যদি জীবনে কোনোদিন হয়ে থাকে, তো সেটা হয়েছিল আৎলের যৌবনপ্রাপ্তির দিনে— আৎলের উপনয়ন উৎসবে।
টানা একপ্রহর তামাকের উষ্ণ ধোঁয়ায় স্নান করিয়ে পরিশুদ্ধ করা হয়েছিল সেদিন আৎলকে।
ওদের গুচ্ছগ্রামের বুড়ো শামান পুরোহিত মন্ত্রতন্ত্র পড়েছিল সেদিন অনর্গল। সারা অঙ্গে দামী পালকের পরিচ্ছদ। এত দামী যে কাছে যেতে সাহসে কুলোয় না। আবেদার চেয়ে একটু ছোট শিশুরা প্রার্থনাঘরের একটু দূরে দাঁড়িয়ে ভিড় করে দেখছিল। বুড়োর কালচে ঠোঁট বেয়ে বিড়বিড় করে নামছিল দুনিয়ার ফতোয়া; আর একটু ক্লান্ত হয়ে পড়লেই বুড়ো তার ঝোলা থেকে শুকনো তামাকপাতা বের করে তাতে খানিকটা ছাই ডলে গুলি পাকিয়ে নিজের মাড়ির নিচে গুঁজে দিচ্ছিল। বুড়ো সম্মোহক ফতোয়া দিয়ে নির্ঘাত তৈরি করে যাচ্ছিল একের পর এক চিত্রকল্প। ক্ষুধার্ত ইমিশ কুমীর আর শয়তান ইগুইয়ানা হাঁ করে আছে; কংকালের ফাঁপা মুণ্ডু থেকে উঁকি মারছে বিষধর সাপ; জলপ্রপাতের বুকের পথ বেয়ে হাঁটার পিচ্ছিল কোটর পাহারা দিচ্ছে শূল-হাতে কবন্ধ আত্মা– ধরলেই মুণ্ডু কেড়ে নেবে; এদের চোখে ধুলা দিয়ে এদের শরীর ফেঁড়ে সাঁই করে ঈগলের মত উড়তে হবে আৎলকে অনিশ্চিত আকাশের চূড়ায়। ভাবতে যদি ভয় হয়, যদি পেট মোচড়ায়, তো আৎলের এখনো নাক টিপলে দুধ গলে। আৎল কোনো পুরুষই নয়। নেহাত কোমরে লাল সুতার ঘুনসি বাঁধা শিশু।
অনুষ্ঠানের মধ্যে আৎলকে চুরি করে করে দেখেছিল আবেদা সেদিন। আকাশের দেবতার মত সুন্দর লাগছিল ছেলেটাকে। তাঁতে বোনা মেটে বাদামী সাধারণ সুতির কাছার সঙ্গে নীবিবন্ধে ঝুলানো নীলচে পুঁতির সামান্য আভরণ না থাকলেও ওর কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হত না। একটু পর পর শামানের ফুঁক দেওয়া ধোঁয়ার আবরণ ভেদ করে ওর মুখটা দেখা যাচ্ছিল। সঙ্গে ওর ঠোঁটের মাঝ বরাবর গেঁথে রাখা হাড়ের গয়নাটাকে অল্প অল্প কাঁপতে দেখা যাচ্ছিল। ও- ও কি মন্ত্র পড়ছিল শামানের সাথে সাথে?
আত্মারা ওকে কী বলছিল কে জানে?
আবেদা শুধু মাছের চোখ মেলে চেয়ে ছিল ঐ ধোঁয়ার জটার দিকে। আর আকুল হয়ে ভাবছিল প্রতিবার ধোঁয়া সরে গিয়ে আৎলের মুখ ভেসে ওঠার জন্য ক্ষণেকের যে অপেক্ষা, তার চেয়ে সুন্দর কোনো অপেক্ষাই নয়।
যুবতী আবেদা কৈশোরের ওপারে বসে ছিল আৎলের জন্য।
বয়ঃসন্ধি আর বয়ঃপ্রাপ্তির মধ্যে শুধু চিকন ধোঁয়ার পর্দার তফাত।
ঐ পর্দাটুকুকে আবেদা আজও প্রেম বলে মানে।
আত্মাদেরকে সাধাসাধি সেদিন আবেদাও করেছিল। চোখ খুলেই ও প্রার্থনা করছিল যেন আকাশ-ভাসিয়ে ঝড় উঠলেও ওই ধোঁয়ার আস্তরটা সরে না যায়। ধোঁয়াটুকু সরে গেলেই যেন সব অপেক্ষা ব্যর্থ হয়ে যাবে। ধোঁয়াটুকু সরে গেলেই যেন সব প্রেম নিভে যাবে। ধোঁয়াটুকু সরে গেলেই যেন আৎল হারিয়ে যাবে আজীবনের জন্য। কিংবা যুবা হওয়ার বদলে সুড়ুত করে হয়ে যাবে কোমরে লাল ঘুনসি বাঁধা বামন-শিশু।
সেই তামাকের ধোঁয়া অবশ্য বহুদিন ধরে সরে-সরে মিলিয়ে গিয়েই আবার ফিরে-ফিরে আসতে কসুর করে নি। খিদে পেয়ে মার-খাওয়া বেহায়া বাচ্চা যেমন মায়ের পায়ে পায়ে ঘোরে, সেরকম প্রতি দুপুরে বার-বাড়ির দাওয়া থেকে ধোঁয়া এসে আবেদার কানের কাছে ঘ্যান-ঘ্যান করেছে। পাশের বাড়ির বা হয়তো ওদেরই বাড়ির কেউ সুখটান টানছিল পেটের খিদে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য।
মনমরা সন্ধ্যায় পাকঘরের জানালা দিয়ে কতদিন ধোঁয়া এসে আবেদার মান ভাঙ্গিয়েছে! দিনের কাজ সেরে ওর বাবা হয়তো তখন তার ট্যারা চোখের মণি দুটোকে দূরে কোথাও নিবদ্ধ করে ঝোলা চোয়ালগুলোকে টান-টান করে তামাক খাচ্ছিল ভুট্টার খোলায় পেঁচিয়ে।
বাসররাতে বর আসারও আগে শামানের হাতে করে আবেদার কাছে এসেছে ধোঁয়া; সাগ্নিক ব্রাহ্মণ হয়ে ওর শুষ্ক যোনিকে পরিশুদ্ধ আর উর্বরা করতে। জমির শস্যের মত ওকে ফলবতী করতে।
বছর-বছর জমিতে চারা বুনবার আগে মহাউদ্যোগে গ্রামের চাষীরা মাঙ্গলিক তামাক জ্বালিয়েছে; অনাগত শিশুর হাসির মত মাইল-কে-মাইল ছড়িয়ে গিয়েছে সেই ধোঁয়া উদার আকাশে।
দেবতার পায়ে বলি চড়ানোর সময় দিগন্ত আচ্ছন্ন করে দিয়েছে ধোঁয়া। খড়্গনাসা দেবদূতের মত আসমান থেকে মতিচ্ছন্ন শিকারী যূথকে বুঝিয়েছে — ঈশ্বর যেহেতু নিজেই ধূমপায়ী, জীবনে একমাত্র ধোঁয়াই ঐশী।
ধোঁয়া দহন থেকে উঠে এসে সৃজন ঘটিয়েছে। মিলন ঘটিয়েছে। ফলন ঘটিয়েছে।
আবেদা তাই আজন্ম শিখেছে যে ধোঁয়াকে বিশ্বাস করতে হয়। গলবস্ত্র প্রণিপাত করতে হয়।
আৎল মরার পর যখনই বাতাসে তামাকপাতা পোড়ানোর গন্ধ ভেসে এসেছে, আবেদা মনে সান্ত্বনা পেয়েছে। আজন্ম মেনে আসা যেকোনো বিশ্বাস সত্য বলে প্রমাণিত হলে মানুষ যে সান্ত্বনা পায়, সেই সান্ত্বনা। দেব-দানো-আত্মা-ঈশ্বরকে কস্মিনকালেও চোখে না-দেখা ধর্মপ্রাণ মানুষ অজন্মার পরের সনে দৈবে ভুট্টাক্ষেতভরা সবুজ-হলুদ দেখে যে সান্ত্বনা পায়, সেই সান্ত্বনা।
আবেদার সন্তান ইশতাহ্বও আজ বাঁধা পড়ে যাবে ধোঁয়ার সাথে। জন্মে, বাল্যে, কৈশোরে, যৌবনে; একলা, সদলে; ফলনে, অজন্মায়; জীবন থেকে মৃত্যুর পূর্ণচক্রে।
শামানের ডাকের অপেক্ষায় আবেদা বসে থাকে।
তখনো কলম্বাসের নাম শোনেনি কেউ। আরিফকে নিশ্চয়ই পাড়ার সবাই আৎল নামে চিনত।
(আবেদার মনে নেই ওর নিজের নাম কী ছিল সেই সময়।)
৪। লাস্য নাকি তাণ্ডব
আবেদার খুব খুব ইচ্ছা করে আরিফের সাথে আগের মত প্রেম করতে। আবেদার এটাও খুব ইচ্ছা যে আরিফ জানুক ওর আগের মত প্রেম করার ইচ্ছার কথা। কিন্তু আরিফ কি আর জানে?
(আরিফ সম্ভবত শুধু জানে যে দুই মাস ধরে সে দাম্পত্যসঙ্গ বিবর্জিত। আর আবেদার স্বেচ্ছা-স্বীকারোক্তি থেকে খানিকটা জানে জন্মদান বিষয়ে ওর প্যারানইয়ার কথা।)
আরিফও তাহলে ঐ সাইকায়াট্রিস্টের মত অনুবাদঘরের বাসিন্দা? ভাবতে কান্না পায় আবেদার। ঠোঁট ফুলে চোখ ভাসিয়ে কান্না আসে।
ওদের পথ অজান্তেই দুই ভাগ হয়ে গিয়েছিল একদিন। কোনদিন যেন? যতদূর মনে পড়ে, কোনো এক সম্পন্ন আনন্দের দিনে। চাকরির প্রথম দিন? যেদিন দুজনে একসাথে হাত ধরে সার-সার তামাক-ফ্যাক্টরির বেষ্টনি পার হয়ে প্রথম চাকরিতে যোগ দিয়েছিল? (একই অফিসের দুই ডিপার্টমেন্ট। একে যদি পূর্ণতা না বলে তবে জীবনে পূর্ণতা নামে কিছু নেই। দুজনই ভেবেছিল কি?)। না না, প্রথম দিন না। সম্ভবত অন্য কোনো দিন। নাকি একসাথে হাত ধরে ঐ পথ পার হয় নি ওরা কোনোদিন? পুরোটাই স্বপ্নে দেখেছে আবেদা?
চাকরির প্রথম দিন আর কী কী ঘটেছিল? সেই ধনী বেদুইনের মত দেখতে গুঁফো লোকটা, যে কিনা ওর বসেরও বস, যার মধ্যে অনুবাদঘরের স্বাভাবিক ভণ্ডামি নেই, পরিষ্কার বলেছিল, “ওয়েলকাম ফোক্স! দিস ইস আ হাইলি কভেটেড, হিউজলি ডিম্যান্ডিং, অ্যান্ড আনবিলিভ্যাবলি প্রেস্টিজিয়াস ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি প্রোগ্রাম দ্যাট ইউ হ্যাভ বিন এনরোলড্ ইনটু।”। ধরা-ছোঁয়ার বাইরের এই লোকটা মুগ্ধ শ্রোতাদের প্রতিবছর বলে তাকে ‘স্যার’ না ডেকে ‘ভাই’ ডাকতে। হ্যাঁ, এইতো আবেদার স্পষ্ট মনে আছে!
লোকটা যে উদ্যোগে স্যুট দিয়ে বুক ঢাকে, তার সমান উদ্যোগে মুখ না-ঢেকে বলেছিল যে ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি’দের আগামী চার বছর বাচ্চা ফোটানো চলবে না। “ইউ গার্লস আর ইউনিক। স্পেশাল। ইররিপ্লেসেবল। আ লং ম্যাটার্নিটি লিভ উইল হার্ম ইয়োর ক্যারিয়ার ইন ওয়েজ ইউ ক্যানট ইম্যাজিন”, বলেছিল লোকটা সেদিকে তাকিয়ে যেদিকে আবেদার সঙ্গে কখনো-সিগারেট-না-ছোঁয়া ভদ্রঘরের মেয়েগুলো আনবাড়ির কবুতরের মত দ্বিধা নিয়ে একসাথে জটলা পাকিয়ে ছিল। হিতোপদেশ না হুঁশিয়ারি— বেশি দ্বিধার উদ্রেক করে কোনটা?
আবেদার শুধু বার বার মনে পড়ে অফিসে ঢোকার আর বের হবার সময় গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে গলা উঁচিয়ে তামাক ভাজার আর্দ্র গন্ধ নিত ও। নানাভাইয়ের গন্ধ। অপরাধীর মত সাবধানে চুরি করে সেই গন্ধ ফুসফুসে ভরত সে। এত সাবধানে, যাতে ওর ফুসফুস নিজেও সেটা টের না পায়। শেষ কবে যেন নিয়েছিল সেই গন্ধ? চাকরির প্রথম মাসে?
স্কুলে যাওয়ার সময় নিমতলির রাস্তার মোড়ে একটা বিশ্রী সচিত্র সাইনবোর্ড ঝোলানো দেখেছিল আবেদা একদিন। সেটা যেন কবে দেখেছিল? নানাভাই মারা যাওয়ার পাঁচ-ছয় বছর পর কি? সেটায় পরিষ্কার লেখা ছিলঃ “বিড়ি-সিগারেট না কিনে শিশুদের জন্য দুধ কলা ডিম কিনুন”; লেখার সাথে ভয়াল চিত্র ছিল দুইপাটি পচন-ধরা বিকৃত মাড়ির। সেই সাইনবোর্ডটা কি এখনো আছে?
চোখ বন্ধ করেও আবেদা ঐ কুৎসিত রঙিন ছবির তাড়া খেয়েছে অনেকদিন। কতদিন? অনেকদিন আবেদা দুধ-কলা-ডিম খেয়েছে গুলিয়ে ওঠা শরীরের বিরুদ্ধে জোর করে। কতদিন? আবেদা এখন জানে, সিগারেট-বিষয়ে অনুরাগ-বিরাগ তৈরি হওয়ার কোনো কারণ ঐ সাইনবোর্ডে ছিল না। অন্তত ওর জন্য ছিল না। কার জন্য ছিল? উঁচু পাঁচিলের বেষ্টনির ভেতর সার-সার কলের চাকা তাহলে কার জন্য ঘোরে অষ্টপ্রহর?
দুধ-কলা-ডিম কবে থেকে তার আবার সয়ে গেল, এমনকি ভাল লাগতে লাগল? যখন ধীরে ধীরে সবাই শিখিয়ে দিল যে নানাভাইয়ের গায়ের তামাক-তামাক গন্ধকে একটা খারাপ, অসুস্থ গন্ধ ভাবতে হয়? মৃত্যুর গন্ধের মত অচ্ছ্যুৎ ভাবতে হয়?
তখন টিভির পর্দায় ঘনঘন এসেছিল কানে স্টেথোস্কোপ ঝোলানো আর টেবিলে নেমপ্লেইট বসানো ডাক্তাররা। ছেলেভুলানো ছড়ার মত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ‘ধূমপান বিষপান’ শ্লোগান। আবেদাও ভুলেছিল সে বয়সে। আর ভুলেছিল বিষপায়ী নীলকণ্ঠ নানাকে।
ঠিক কতদিন লেগেছিল ওর, নানাভাইকে ঝেড়ে ফেলতে?
আবার কোনদিন সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ঠিকই মেনে নিল যে নানাভাইয়ের ক্ষয়-ধরা ফুসফুসের প্রায়শ্চিত্ত করা জরুরি নয়? যেদিন অনুবাদের ধার-না-ধারা ইংরেজি চিঠি নিয়ে মা আদিখ্যেতা করল? যেদিন রেস্টোরান্টের অস্বস্তিকর ছুরি-কাঁটা হাতে নিয়ে হাসি-হাসি সবাই আরিফের কথা শুনল ওর মুখে? নাকি যেদিন সবাই স্বীকৃতি দিল সমস্বরে? যেদিন দু’পক্ষ মিলে খেজুর খেল? সেদিনই কি?
তাহলে কিসের প্রায়শ্চিত্ত করতে তাকে এই চার-চারটা বছর ধরে প্লাস্টিক-নিরুদ্ধ অশ্লীল সঙ্গম করতে হচ্ছে?
এই বকেয়া প্রশ্ন তাকে আজকাল নিত্য কুরে কুরে খায়।
যতই কুরে কুরে খায়, ওর মাথায় ঘটনাপরম্পরা ততই গুলিয়ে যায়।
এই প্রশ্নের পাছে কোনো অকাট্য সদুত্তর থেকে থাকে, এই ভয়ে সে স্বাভাবিক হাসে, কাঁদে, ব্যাগ গোছায়, নখ কাটে। এই ভয়ে সে তার বসের-বস সেই ধনী বেদুইন গুঁফো শামানের নির্দেশিত পথ চলায় ব্যত্যয় ঘটানোর দুঃসাহসও করে না। এই ভয়ে নয়টা-পাঁচটা কাটিয়ে দেয় যন্ত্রবৎ। এই ভয়ে রাতের বেলা বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে।
এই ধর্মের রীতিনীতি সজ্ঞানে বুঝতে পারে না আবেদা কিছুতেই। গুঁফো পুরোহিত পরিষ্কার বোঝাতে পারেন নি।
যে নতুন ধর্মে ওর ফলবতী হওয়া নিষেধ, যে ধর্মে দীক্ষার পর একটা মিস্ড পিরিয়ড দেখার অনুমতি তার মিলবে না সহজে, সেই নতুন ধর্ম কি ওকে আজীবন ঋতুমতী রাখবে?
এই নতুন ধর্মেরও ঈশ্বর যদি স্বয়ং তামাকপোড়া ধোঁয়া হন, তবে কেন তিনি সৃজন ঘটান না? মিলন ঘটান না? ফলন ঘটান না?
নানাভাইয়ের গন্ধ আসলে ভাল নাকি খারাপ? খারাপ নাকি ভাল?
এই নতুন ধর্মে প্রশ্ন করা পাপ নাকি পুণ্য? প্রশ্নকারী কি লক্ষ্মীছাড়া? নাকি অবিশ্বাসী?
কিন্তু এত এত প্রশ্নের নিরুচ্চার যন্ত্রণায় ওর যে প্রচণ্ড কষ্ট হয়। আরিফ যদি বুঝত!
ওর যে সারাক্ষণ মনে হয় বাঁকাচাঁদের দেখনহাসি দিয়ে কেউ তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ধর্মান্তরিত করেছিল; সরল প্রাণে সে সেই প্ররোচনায় মজেছিল। পুরনো বিশ্বাস অবলীলায় খুইয়েছিল। আর এখন তাকে চমকপ্রদ ব্রেকিং নিউজের মত নতুন করে জানানো হচ্ছে যে এই নতুন ধর্মের ঈশ্বর আসলে সম্ভবত একটা অস্তিত্বহীন সৃষ্টিছাড়া ফাঁকি।
ওর যে সারাক্ষণ মনে হয় ওর সব হারিয়ে গেল। খুপরি-খুপরি অনুবাদঘর ওর সর্বস্ব নিয়ে নিল।
একাধিকবার সন্দেহে ঋদ্ধ হয়ে একাধিক ধর্মে যে দীক্ষা পেয়েছে, তার সন্দেহের জারকরসে ঈশ্বর যে কবে ফুটে বাষ্প হয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেছেন তার খবর কে রাখে?
কোনো সাইকায়াট্রিস্টের সাধ্য কি এই সমস্যাকে মিটিয়ে দেয়? ব্যাধির আরোগ্য হয়। সন্দেহের হয় কি?
অথচ কী অন্যায়! যে কর্মযোগের যুক্তিহীন ধর্মে আবেদা ঝলসাচ্ছে, সেই একই কর্মমন্ত্রে আরিফ একটা পরিণত যুবক ঈগল হয়ে আকাশে ডানা মেলছে দ্রুত; সমানে উপরে উঠছে সাঁই সাঁই করে। একসময়ের লাজুক মুখচোরা নিজেতে-গুটানো আরিফকে এখন কেউ আটকাতে পারবে কি?
বালক থেকে যুবকে উত্তরণের উপনয়ন-তীর্থ হয়ে রইল যা আরিফের কাছে, সেই একই তীর্থ কেন আবেদাকে ঠকাল? কেন গুঁফো পুরোহিত দীক্ষা দেওয়ার নামে ওর হাতে তুলে দিলেন বিষাক্ত শরের মত কতগুলো প্রশ্নচিহ্ন? বয়ঃসন্ধির সারল্যে যৌবনকে নিশ্চিন্তে আঁকড়ে-ধরা নিষ্পাপ আৎলকে দেখে কেন গর্বের বদলে হিংসায় জ্বলে আবেদা এখন? এই দহন নিয়ে কীভাবে সে আগের মত ভালবাসবে আৎলকে?
এত দহন! এত দহন! এই দহনের পর ধোঁয়া হয়েও কি শান্তি আছে?
কালচে ঠোঁটের শামানের মত দৃশ্যকল্প গড়ে নিজেকে নিজেই সম্মোহন করে আবেদা। তাকে ধোঁয়া ডাকে। ধোঁয়া ঘিরে আসে। ঝাপসা ধোঁয়া। চণ্ড ধোঁয়া। জট-পাকানো ধোঁয়া। উড়ালি-বিড়ালি ধোঁয়া। আথালি-পাথালি ধোঁয়া। আবেদার নিজের স্নায়ু জ্বলে-পুড়ে ধোঁয়া উঠছে-নামছে। আর নিজের দহনের ধোঁয়ায় নিজেই ডুবে যায় সে।
ধোঁয়া ওড়ানো কালবৈশাখীর পূর্বাভাস আবেদা নিজের মগজের ভেতর বিপ-বিপ অ্যালার্মের মত শুনতে পায়। আবেদা বুঝে উঠতে পারে না সে এখন কোথায় বসে আছে। চৌকিতে বসে মন্ত্রপাঠক শামানের মত বিড়বিড়িয়ে খিস্তি করা নানাভাইয়ের কোলে? অফিসের স্মোকিং লাউঞ্জে? নাকি সাইকায়াট্রিস্ট নিশাত আরার চেম্বারে? নাকি প্রস্ফুটিত গর্ভফুলের বাগানে? নাকি প্রসবকক্ষের পেশাদার ধাত্রীর তত্ত্বাবধানে? নাকি শিশু-কোলে উৎসবের ডাকের অপেক্ষায়? নাকি নিজের শৈশবকে হেলায় হারানোর উপনয়ন উৎসবে?
সে কি সৃষ্টির ধ্বংস দেখতে দাঁড়িয়ে আছে?
ধ্বংসের পরে আবার সৃষ্টি এলে কী করবে সে? ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে তো? নাকি ততক্ষণে ধোঁয়াকণায় মিশে যাবে তার সর্বাঙ্গ?