ইউ জী কৃষ্ণমূর্তির সাথে কথোপকথন: ৮

ইউ. জী. কৃষ্ণমূর্তির সাথে কথোপকথন: ১ ।। ইউ. জী. কৃষ্ণমূর্তির সাথে কথোপকথন: ২ ।। ইউ. জী. কৃষ্ণমূর্তির সাথে কথোপকথন: ৩ ।। ইউ. জী. কৃষ্ণমূর্তির সাথে কথোপকথন: ৪।। ইউ. জী. কৃষ্ণমূর্তির সাথে কথোপকথন: ৫ ।। ইউ.জী. কৃষ্ণমূর্তির সাথে কথোপকথন: ৬ ।। ইউ.জী. কৃষ্ণমূর্তির সাথে কথোপকথন: ৭

মানুষের বাইরে কোনো ক্ষমতা নেই

[এটি The Mystique Of Enlightenment গ্রন্থটির No Power Outside of Man পর্বের বাংলা অনুবাদ। মাইশোর, ভারতের HSK প্রফেসরের সাথে তাঁর আলাপচারিতা। ১৯৮০ সালে গৃহীত।]

বাংলা অনুবাদ: নান্নু মাহবুব

শুধু তার ব্যক্তিগত অতীত থেকে নয়, মানুষের দরকার হলো মানবজাতির সমগ্র অতীত থেকে নিজেকে মুক্ত করা। অন্য কথায়, তোমার আগের প্রত্যেকটি মানুষের চিন্তা, অনুভূতি আর অভিজ্ঞতা থেকে তোমার নিজেকে মুক্ত করতে হবে─শুধু তখনই তোমার পক্ষে আপন্ত হওয়া সম্ভব। প্রত্যেকটি মানুষই যে অনন্য, এটা দেখানোই আমার আলাপচারিতার একমাত্র উদ্দেশ্য। সংস্কৃতি বা সভ্যতা বা যা-ই বলো, সর্বক্ষণ সেটা একটা কাঠামোতে আমাদের খাপ খাইয়ে নেবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। মানুষ কোনো মানুষই নয়; আমি বলি সে একটা ‘অনন্য পশু’─এবং যতকাল সে সংস্কৃতির মাধ্যমে ভারগ্রস্ত থাকবে ততকাল সে শুধু একটা অনন্য পশুই থেকে যাবে

…………….

প্রকৃতি মাঝে মাঝে তার নিজস্ব ধরনে মনুষ্য-বিবর্তনের চূড়ান্ত-সৃষ্টি, কোনো ফুলের জন্ম দেয়। আরেকটা মনুষ্যসৃষ্টির মডেল হিসেবে সেটা বিবর্তন প্রক্রিয়ায় ব্যবহার হয় না─সেইজন্যেই আমি বলি এটাই মনুষ্য-বিবর্তনের চূড়ান্ত-সৃষ্টি─যদি সেটা কোনো ফুলের জন্ম দেয়, এই হলো ব্যাপার। ওইরকম একটা ফুলকে কোনো যাদুঘরে রেখে তুমি তার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারো─এ নিয়ে তোমার আর কিছু করার নেই।

…………….

আমার কথা তোমার পছন্দ হবে না, কারণ সেটা সমগ্র ভারতীয় সংস্কৃতি এবং ফ্রয়েডীয় ফেরেববাজির ওপর করে গড়ে ওঠা সমগ্র মনস্তাত্ত্বিক পরিকাঠামোর ভিত্তিটাকেই ধ্বংস করে দেয়। সেইজন্যেই মনোবিদ আর ধর্মীয় লোকজন আমার বিপক্ষে─আমার কথা তাঁদের পছন্দ নয়─যেহেতু ওইসবই তাঁদের রুটিরুজি। ওইসমস্ত সব খেলাই শেষ: আগামী দশ-বিশ বছরের মধ্যেই সমস্ত ধর্মীয় আর মনস্তাত্ত্বিক কারবারটা শেষ হয়ে যাবে।

…………….

 

সাক্ষাৎকারগ্রাহক: স্যার, আজকের দুনিয়ার সঙ্কট সমাধানে ভারত কী ভূমিকা রাখতে পারে?

ইউ জী: যে সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে দুনিয়াটা চলছে, সেই সঙ্কটই নিজের স্বার্থে কিছু একটা উদ্ভাবন করবে। আমার মনে হয় এটা আসবেই, এবং এটা আসবে পশ্চিম থেকে─কোত্থেকে আসবে জানি না, কিন্তু ভারতের কোনো সম্ভাবনা নেই।

পশ্চিমাদের জিজ্ঞাসাটা কি খাঁটি?

খুবই খাঁটি। তারা তাদের মূল্যবোধে সন্দেহ করছে। এখন এটা শুধু একটা দ্রোহ আর প্রতিক্রিয়ার পর্যায়ে আছে কিন্তু তারা উত্তর চায়। তারা খুবই বাস্তববাদী, তারা চায় উত্তর; শুধু প্রতিশ্রুতিতে তারা সন্তুষ্ট নয়।

তো এই মনে হয় পরিস্থিতি─তা নাহলে দেখ মানুষের রক্ষে নেই। তবে মানুষ বিলুপ্ত হবে না; কোনো না কোনোভাবে সে টিকে থাকবে। আমি কোনো নৈরাশ্যের তত্ত্ব প্রচার করছি না─আমি নৈরাশ্যবাদী নই। তবে আমার বিশ্বাস এটা পশ্চিম থেকেই আসবে। কোনোখান থেকে এটা আসতেই হবে, এবং সেই দেশটি ভারত নয়।

তুমি পুরোপুরি নিশ্চিত?

নিশ্চিত, কারণ জীবনের অর্ধেকটা আমি পশ্চিমে কাটিয়েছি─প্রথম অর্ধেক ভারতে, এবং এখন বাকী অর্ধেক পশ্চিমে।

কীভাবে তুমি এই সিদ্ধান্তে এলে? তুমি কি মনে করো না ভারত একধরনের দর্শন বিকশিত করেছে?

এই গতকালই আমি এমার্সন থেকে একটা উদ্ধৃতি দিচ্ছিলাম। খুব কমই আমি কাউকে উদ্ধৃত করি। তিনি একটা কথা বলেছেন দেখ, খুবই লক্ষণীয় কথা, ‘প্রতিবেশীকে যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস করাতে চাও, তাকে দেখতে দাও ঈশ্বর তোমাকে কেমনটি বানাতে পারেন’। প্রীতিই ঈশ্বর, পরমার্থই ঈশ্বর, এইটাই ঈশ্বর, ওইটাই ঈশ্বর, এইসমস্ত বলে কোনো লাভ নেই।

তো এটাই হলো সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয়: জগতটাকে দেখতে দাও ঈশ্বর তোমাকে কেমনটি বানাতে পারেন। ঠিক একইভাবে, তোমার নিজের ঘরটা গোছগাছ করতে হবে। এটা আছে মহাগোলমেলে অবস্থায়─ভারত─কেউই জানে না এটা কোথায় চলেছে। কাজেই, তোমার অধ্যাত্ম ঐতিহ্যে যদি কিছু থেকেই থাকে (এবং আছেও প্রচুর; সেকথা আমি কখনোই অস্বীকার করি না; ভারত মানবজাতির বহু সাধুসন্ত আর পরিত্রাতার জন্ম দিয়েছে), আর সেই ঐতিহ্য যদি তার নিজের ঘর গোছগাছ করতে এই দেশেরই কোনো কাজে না লাগে, কীভাবে তুমি ভাবছো এই দেশটা পৃথিবীর কোনো কাজে লাগবে? সেটা একটা ব্যাপার।

দুই নম্বর হলো: তোমাকে নতুন ভাষা, নতুন বুলি ব্যবহার করতে হবে। নতুন ভাষা, নতুন বুলির কারণেই পশ্চিমারা আগ্রহী, মুগ্ধ, সেইজন্যেই তারা এইসমস্ত জিনিস শেখে আর মনে করে যে তারা ‘কিছু একটা’, যেহেতু তারা এইসমস্ত জিনিস আওড়াতে পারছে─এছাড়া আর কিছু নয়। নতুন একটা ভাষা শিখে তুমি সেই ভাষায় কথা বলা শুরু করলে, তাই তোমার দারুণ ভালো লাগতে লাগলো, কিন্তু মূলত এটা কোনোভাবেই তোমাকে সহায়তা করে না।

তো কীভাবে এই মহান ঐতিহ্য, যা নিয়ে সকল ভারতীয়ের এত গর্ব, প্রথমত এই দেশের কাজে লাগবে? ─সেটাই হলো আমার প্রশ্ন।

কোন অর্থে কাজে লাগা?

প্রথমত অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা তোমার থাকতেই হবে─প্রত্যেককে অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয় দিতেই হবে। এই দেশের দারিদ্রের জন্যে কোনো অজুহাত নেই─ত্রিশ বছর হয়ে গেল আমরা স্বাধীন হয়েছি। কেন এই দেশে এখনো সেই ব্যাপারই চলছে? ─সেটাই আমার মূল প্রশ্ন। এমন নয় যে উত্তরটা আমার জানা। আমার কাছে কোনো উত্তর নেই, আমার কাছে কোনো উত্তর থাকলে আমি এখানে বসে বসে বকবক করতাম না; কিছু না কিছু করতামই। এককভাবে কারোর কিছু করার নেই দেখ, পরিস্থিতিটাই এরকম। সামষ্টিক কর্ম মানেই সমস্যা─আমার দল, আমার পদ্ধতি, আমার কায়দা, ─তোমার দল, তোমার পদ্ধতি, তোমার কায়দা, ─তো এই সমস্ত পদ্ধতিই গিয়ে শেষ হবে যুদ্ধক্ষেত্রে। তাদের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হবে ওই…

দলে টানার চেষ্টায়?

…তাদের রাজনৈতিক অবস্থানে জনগণকে দলে টানার চেষ্টায়। কিন্তু এইসব পদ্ধতিতে কোনোভাবে সমস্যা সমাধান হয় নাই─আমি শুধু সেটাই বলতে চাইছি।

দেশটা নিজেকে রক্ষা করতে পারে না? ঐতিহ্য কোনো কাজে লাগতে পারে না?

দেশটা নিজেকে রক্ষা করতে পারে না। দুর্ভাগ্যক্রমে, ঐতিহ্য মনে হয় না লোকেদের কোনো কাজে আসবে।

[শ্রবণগোচর নয়]

আমি সেটাই বলছি। যেমন মনোবিজ্ঞানীরা আজ তাঁদের শক্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছেন─এখন তারা ভারতের দিকে তাকাচ্ছেন। তাঁরা এইসমস্ত সাধু, যোগী, দীক্ষা দেয় যারা, তাঁদের কাছে যাচ্ছেন। তুমি তুরীয় ধ্যানের কথা বলছিলে। তাঁরা সত্যিই আগ্রহী, কিন্তু তাঁরা সেটা পরখ করে দেখতে চান। শুধু কথা নয় দেখ, তাঁরা চান ফল, শুধু কিছু আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা, কিছু আধ্যাত্মিক ফ্যান্টাসি নয়। দুনিয়ার সমস্যার সমাধানে এর একটা প্রয়োগ থাকতে হবে─তাতেই তাঁদের সমস্ত আগ্রহ। তাই আমার বক্তব্য বা আমি যাতে জোর দিচ্ছি তা হলো, তাঁদেরকেই তাঁদের সমস্যার সমাধান দিতে হবে। বিজ্ঞানীদের সমস্যা আছে, প্রযুক্তিবিদদের সমস্যা আছে─তাঁদেরকেই তাঁদের সমস্যার সমাধান দিতে হবে─এক নাম্বার। কাজেই তাঁদের এইসমস্ত সাধুসন্তদের দিকে ফিরে তাকিয়ে কোনো লাভ নেই।

তাঁদেরকে তাঁদের মতো করেই উত্তর খুঁজে বার করতে হবে।

তাঁদের নিজেদের ক্ষেত্রে─তাঁদের সমস্যার সমাধান তাঁদেরকেই দিতে হবে। আমাদের সমাধানে তাঁদের সমস্যার আদৌ কোনো মীমাংসা নেই, শুধু তাঁদের সমস্যার নয়, তোমার নিত্যদিনের সমস্যারও। মানুষ শুধু সমাধানে আগ্রহী, সমস্যার দিকে তাকাতে আগ্রহী নয়। তুমি বলছো এইসমস্ত মহান ঋষি, সাধু আর মানবজাতির পরিত্রাতাদের হাতে আমাদের সমস্যার সমাধান আছে। তাহলে আমরা কেন সেই একই প্রশ্ন করেই চলেছি?

কেন আমরা সেই একই প্রশ্ন করেই চলেছি? সুতরাং ওগুলো কোনো উত্তর নয়। সেগুলো যদি উত্তর হতো, প্রশ্নগুলো সেখানে থাকতোই না। আমরা এখনো প্রশ্ন করেই চলেছি তার মানেই হলো সেগুলো কোনো উত্তর নয়। কাজেই আমাদের সমস্যার ক্ষেত্রে যে যে সমাধানগুলো প্রস্তাব করা হয়েছে সেগুলো কোনো সমাধানই নয়। তা নাহলে কেন সমস্যাগুলো সমস্যা হিসেবে থেকেই যাবে?

কাজেই দায়টা আজ প্রত্যেকের; ভারত রাশিয়া আমেরিকা বা কোনো বিশেষ জাতির নয়। ব্যক্তিকেই দেখ তার উত্তর খুঁজে বার করতে হবে। সেইজন্যে প্রত্যেকটি ব্যক্তিই মানবজাতির পরিত্রাতা─সম্মিলিতভাবে নয়। সে যদি তার প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পায়, বা তার সমস্যার কোনো সমাধান খুঁজে পায়, তখন হয়তো সামগ্রিকভাবে মানবজাতির জন্যে কোনো আশা আছে─যেহেতু আমরা সবাই একসাথে যুক্ত: আমেরিকায় যা ঘটছে সেটা আমাদেরকে প্রভাবিত করছে; এখানে যা ঘটছে সেটাও অন্য সমস্ত দেশকে প্রভাবিত করছে।

সারা বিশ্ব আজ দেখ একবিশ্ব নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে─অন্তত তত্ত্বগতভাবে─কিন্তু কেউই তার সার্বভৌমত্ব ত্যাগ করতে রাজি নয়। সেটা আসলেই অতি জটিল একটা সমস্যা। ইউরোপীয় অর্থনৈতিক গোষ্ঠী─শুধু অর্থনৈতিক কারণেই আজ তারা একত্রিত হয়েছে, আর কোনো কারণে নয়। প্রত্যেক জাতিই এখনো তার সার্বভৌমত্ব জাহির করে যাচ্ছে─অথচ সেই জিনিসটাই দেখ সবার আগে শেষ হওয়া দরকার।

এমনকি আমেরিকা বা রাশিয়ার মতো ওই শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলিও সমস্যা সমাধানে সক্ষম নয়। যেমন ইরান-ইরাক বিরোধের ক্ষেত্রে তারা আসলে কী করছে? তারা শুধু সেখানে তাদের পারমাণবিক যুদ্ধজাহাজ ঢুকিয়ে যাচ্ছে─যার ব্যবহার তারা করতে পারে না। তো এমনকি বিশ্বের আন্দোলন থামানো, বিশ্বের ঘটনাবলি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাও তাদের নেই।

তারাও যদি সেটা না পারে তাহলে ভারত কীভাবে সেটা পারবে বলে তোমার মনে হয়? ইন্দিরা গান্ধী ইরানে একজন দূত পাঠিয়েছেন বলে আমরা গর্ববোধ করতে পারি। তাতে হবেটা কী? অন্য দেশগুলো শুধু ভারতকে ব্যবহার করে। এমন না যে ভারত কাউকে প্রভাবিত করতে পারে─আদৌ না। ভারতের কথা কেউ শোনে না, কারণ ভারত অর্থনীতি, রাজনীতি বা সমরনীতির ক্ষেত্রে কোনো কিছুই করার জায়গায় নেই। এটা এমন একটা পিছিয়ে-পড়া জাতি। আমরা দেখ শুধু শান্তির কথা বলি। ভারত কেন হাইড্রোজেন বোমা ফাটায় না? ─সেটাই আমার প্রশ্ন। তুমি ওই অস্ত্র চালান দেবার অবস্থানে আছো কি নেই সেটা অন্য জিনিস। চীন শক্তিশালী থেকে আরো শক্তিশালী হচ্ছে─তারা এইসমস্ত কথাবার্তা শুনবে না। ভারত─ভারতকে কেউ গ্রাহ্য করে না। এই হলো অবস্থা।

এই যে আমাদের মোহ যে, ভারত থেকে সব গুরুরা গিয়ে দুনিয়াটাকে পাল্টে দিচ্ছেন, সেটা আসলে একটা ফ্যান্টাসি। এই সবকিছুরই ফলাফল আসলে শূন্য। শূন্য! এইসবের আকর্ষণে যাঁরা আসেন তাঁরা আসলে সেইসব লোক নন যাঁরা তাঁদের নিজের দেশের নিয়তি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন─এটা একটা বাস্তবতা।

কিন্তু আমাদের এই সমৃদ্ধ ঐতিহ্য কি জাগতিক সমস্যা সমাধানে কোনো কাজেই লাগতে পারে না?

এটা সেসব সমাধান করতে পারে না, যেহেতু এটা মেকি, যেহেতু এটা মিথ্যা, যেহেতু জনগণের জীবনে এটা কাজ করে না─সেজন্যেই এটা এই দেশের অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে কাজে লাগে নাই। শত শত বছর ধরে আমরা জীবনের একত্ব, জীবনের অখণ্ডতা নিয়ে কথাবার্তা বলেই যাচ্ছি। কীভাবে তুমি এইসমস্ত বস্তি অঞ্চলের ন্যায্যতা দেবে? কীভাবে তুমি এই দেশের দশ কোটি হরিজনের [অর্থাৎ একশো মিলিয়ন অস্পৃশ্য] ন্যায্যতা দেবে? প্লিজ আমার কাছে কোনো উত্তর নেই; আমি শুধু ‘আমাদের ঐতিহ্য মহান-কিছু’─আমাদের এই দাবির অর্থহীনতাটা দেখাচ্ছি।

তার মানে আমরা সেটা কাজে পরিণত করছি না।

আমরা আমাদের মহান প্রথা বা ঐতিহ্য, বা যাই বলো, সেটার আশা বা প্রত্যাশার মান অনুযায়ী জীবনযাপন করি না।

তার অর্থ এই নয় যে আমাদের ঐতিহ্য মিথ্যা বা আমাদের নৈতিক মূল্যবোধ মিথ্যা।

তাতে সান্ত্বনা কোথায়? তাতে হলোটা কী? এটা এরকম বলার মতো, ‘‘আমার দাদু ছিলেন বিরাট বড়লোক, একজন কোটিপতি, যেখানে আমি জানিই না পরের বেলাটা আমার কীভাবে খাবার জুটবে।’’ দাদু একজন কোটিপতি ছিলেন মনে মনে সারাক্ষণ এই কথা বলে লাভ কী? একইভাবে, ভারত জন্ম দিয়েছে মহান মহান সব সাধু, বিশাল বিশাল সব আধ্যাত্মিক মানুষ এবং আজ আমাদের মধ্যে একজনও নেই─দেখ─তো সারাক্ষণ আমাদের ঐতিহ্য এত বিশাল, এত মহান, এইসমস্ত বলে তার গুণগান করে কী হবে? কী লাভ তাতে? সেটা এই দেশের কাজে লাগতে হবে। তো তুমি সেই প্রশ্নটা করছো না কেন? সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে কোথাও একটা গোলমাল আছে। সেটা বলছি এইজন্যে যে: ভারতের সমগ্র সংস্কৃতি অসাধারণ কিছু, মহান কিছু, সবাই এখানে আধ্যাত্মিকতা, ধর্ম, এটা-সেটা নিয়ে কথা বলে, কিন্তু এইসব সত্ত্বেও ভারত শুধু মুষ্টিমেয় কিছু মহান শিক্ষক জন্ম দিয়েছে, এবং তাঁরা তাঁদের মতো আরেকজন শিক্ষক জন্ম দেন নাই।

আমাকে আরেকজন রামানুজাচার্য দেখাও। শুধু একজন রামানুজাচার্য, শুধু একজন শঙ্করাচার্য, শুধু একজন মাধবাচার্য, শুধু একজন বুদ্ধ─তাই না? শুধু একজন মহাবীর। তাঁদের সব ক’জনের মিলিত সংখ্যাটা অঙ্গুলীমেয়।

আমি এইসব গুরুদের নিয়ে ভাবিনা, কারণ এইসব গুরুরা পশ্চিমা যাজকদের মতোই। ভারতে এই স্বাধীনতাটা আছে তাই সবাই তার ক্ষুদে দোকানটা পেতে বসে আর নিজের বিশেষ পণ্যটা বিক্রিবাট্টা করে। সেজন্যেই ভারতে তোমার এত এত গুরু, ঠিক যেমনটি পশ্চিমে যাজকেরা। পশ্চিমে নিয়ন্ত্রিত ধর্মব্যবস্থা ব্যক্তিক বিকাশের সম্ভাবনা নস্যাৎ করে দিয়েছে, সমস্ত ভিন্নমত তারা নস্যাৎ করে দিয়েছে, ভারতে যেমন ব্যক্তির পক্ষে আধ্যাত্মিক শিক্ষক হয়ে বিকশিত হবার সবরকম সম্ভাবনা রয়েছে, তারা সেটা নস্যাৎ করে দিয়েছে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে ভারতে এই ধরনের একটা স্বাধীনতা আছে এবং ভারত বিপুল পরিমাণে এই জিনিস জন্ম দিয়েছে।

কিন্তু ওই সমস্তকিছু সত্ত্বেও, সমগ্র আবহটা ধর্মীয়─এই বাস্তবতা সত্ত্বেও (শব্দটার অর্থ যা-ই হোক না কেন; তুমি যে ধর্মের কথা বলছো আমার কাছে তা কুসংস্কার ছাড়া আর কিছু নয়; এইসমস্ত উপোস, ভোজ, পরব, আর মন্দিরে যাওয়াটা দেখ ধর্ম নয়।) ওইসব শিক্ষকেরা আরেকটা শিক্ষকের জন্ম দেন নাই। বুদ্ধবাদের কাঠামোর ভেতরে আরেকটা বুদ্ধ হতে পারেন না। ওই চিন্তাধারার কাঠামোর ভেতরে আরেকটা রামানুজাচার্য হতে পারেন না। তাঁরা রেখে গেছেন─হয় তাঁরাই রেখে গেছেন নয়তো তাঁদের অনুগামীরা সৃষ্টি করেছে এইসমস্ত সামান্য, ক্ষুদ্র, ছোট ছোট শিবির; আর তাই এইসমস্ত শিবিরগুলো তোমার ‘ইউ’ মার্কা না ‘ভি’ মার্কা থাকা উচিৎ সারাক্ষণ এই নিয়ে লড়াই করে যাচ্ছে, হাতির ‘ভি’ মার্কা না ‘ইউ’ মার্কা থাকা উচিৎ এই নিয়ে আদালতে লড়াই করে যাচ্ছে। সমস্ত ব্যাপারটা আজ এমনই তুচ্ছতায় নষ্ট হয়ে গেছে, অধঃপতিত হয়ে গেছে।

সুতরাং, ‘‘ভারত কি ওইসমস্ত মানুষদের মতো অসাধারণ জায়ান্ট সৃষ্টি করতে সক্ষম?’’ এই প্রশ্নটাই এই দেশে প্রত্যেকের নিজেকে করা উচিৎ─নাম্বার ওয়ান। নাম্বার টু: তুমি যে ধর্ম, যে ঐতিহ্যের কথা বলছো, সেটা জনগণের জীবনে কাজ করে কিনা? আর তিন নাম্বার প্রশ্ন হলো: এই দেশের অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে সেটা কোনো কাজে লাগবে কিনা? এই সমস্ত ক্ষেত্রেই, এই প্রত্যেকটি প্রশ্নেই, আমার উত্তর হলো, ‘‘না’’।

এই দু’টো জিনিস কি দু’টো ভিন্ন স্তরের ব্যাপার নয়?

না। দুর্ভাগ্যক্রমে জীবনটাকে আমরা জাগতিক আর আধ্যাত্মিক─এই দুইভাগে বিভক্ত করেছি─সেটাই আমাদের সৃষ্ট প্রধানতম এবং বিশালতম পাশ কাটানো। এটা একটাই। জীবনকে তুমি আধ্যাত্মিক আর জাগতিকে বিভক্ত করতে পারবে না। সেখানেই আমাদের গোলমালটা হয়ে গেছে। সুতরাং, পশ্চিমের মতো: শুধু রোববারে তারা সবাই ধার্মিক─রোববারে তারা সবাই চার্চে যাবে, আর সপ্তাহের বাদবাকি দিনগুলোতে তারা হলো দানব।

তোমার কী মনে হয়? এইসমস্ত বইপত্র পড়ে, যান্ত্রিকভাবে এইসমস্ত পুনরাবৃত্তি করে কী লাভ? জনতা পুনরাবৃত্তি করতেই থাকে, করতেই থাকে─এমনকি কী পুনরাবৃত্তি করছে তার অর্থও তারা জানে না। প্রত্যেকদিন সকালে আমি সাধনসঙ্গীত শুনি─এমন না যে আমি এতে আগ্রহী বা এইরকম কিছু; যেহেতু আমি এখানে রয়েছি আর রেডিওটাও রয়েছে, তাই আমি এটা শুনি। ওই সাধনসঙ্গীত আসলে কী? তাঁরা যা গাইছেন তাঁর অর্থ কি তাঁরা জানেন? এটা হলো পোর্নোগ্রাফী, বলতে হচ্ছে বলে আমি দুঃখিত─সত্যিই এটা পোর্নোগ্রাফী। আমি এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে ওইসমস্ত স্তোত্রের রচয়িতারা ছিলেন যৌনতাড়িত লোকজন, তাই তাঁরা এর প্রতিমা বানিয়ে এর ওপর দেবীত্ব আরোপ করেছেন। ওইসব স্তোত্রতে তাঁরা নারীদেহসংস্থানের কোনো অংশই ছাড় দেন নাই। আমি নিন্দামন্দ করছি না।

তুমি ওই সমস্ত জিনিসের মরমি ব্যাখ্যা দিতে পারো─মরমি ব্যাখ্যায় আমি আগ্রহী নই─সেটা শুধু তাঁদের দিক থেকে একটা আড়াল, একটা ঢাকঢাক-গুড়গুড় পন্থা, যাঁরা কিছু মানুষের প্রশ্ন করার প্রবণতা দাবিয়ে রাখতে চান, যে মানুষেরা জানতে চায়, কেন এইসমস্ত ব্যাপারস্যাপার।

একটু আগে এখানে যা বলছিলাম: মন্দিরে ওই ষাঁড়ের উপাসনা, আর শিবের উপাসনা─যোনি লিঙ্গমের কারবার তো জানোই─এসেছে আদিম মানুষ থেকে, যার কাছে তার জানা সর্বোচ্চ ধরনের ভোগ ছিলো যৌনতা। পরে মানুষের অভিজ্ঞতা হয় স্বর্গ, মোক্ষ, এবং অন্য সমস্ত কিছু; কিন্তু শুরুতে যৌনতাই ছিলো সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। এমনকি ক্রুশও একটা লিঙ্গম প্রতীক।

চার্চে রুটি আর সুরা দেওয়া হয়─এর আসল অর্থ কী? আদিমকাল থেকে তারা দেখ এইটা অনুকরণ করে আসছে─কোনো নায়কের মৃত্যু হলে তারা তার মাংস ভক্ষণ করতো আর রক্ত পান করতো এই আশা করে যে এতে করে তারা ওই নায়কের মহান পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারবে। তো সেটাই বংশপরম্পরায় চলে আসছে।

না বুঝেই আমরা ওইসমস্ত সব নির্বোধ জিনিস চালিয়েই যাচ্ছি। আমি কোনো নিন্দামন্দ করছি না কিন্তু তুমি যে ঐতিহ্যের কথা বলছো: সেটা কী আসলেই এই দেশের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে পারে?

রাজনৈতিক সমস্যা আর অর্থনৈতিক সমস্যা চলে একসাথে। সে-দু’টো তুমি আলাদা করতে পারবে না; সে দু’টো একই। এটা একটাই অখণ্ড একত্ব। এই দু’টো জিনিসকে আলাদা করছো কেন? কোনো রাজনৈতিক বিপ্লব ছাড়া কি তোমার পক্ষে দেশটাকে পাল্টানো সম্ভব? আদৌ সম্ভব নয়। আর এই দেশে রাজনৈতিক বিপ্লব আদৌ সম্ভব নয়, কারণ তোমার সংবিধান বলছে, পরিবর্তন─যদি কোনো পরিবর্তন হতেই হয়, সেটা হতে হবে তোমার সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যেই। সেটাই, ক্ষমতায় রয়েছে যে সরকার তার বিরুদ্ধে যেকোনো বিদ্রোহের সম্ভাবনা নস্যাৎ করে দিচ্ছে। সুতরাং কীভাবে তুমি সেটা পাল্টানোর আশা করো? একজন এম.পি. হতে গেলে তোমার কোটি কোটি রুপি থাকতে হবে─তো যেখানে তুমি লক্ষ লক্ষ রুপি ঢালছো, সেখানে টাকাটা তো তোমার বানাতেই হবে। দেশসেবা করার জন্যে তারা সেখানে নেই─আদৌ নয়─কাজেই তাদের দোষারোপ কোরো না।

আমি বলছি এই সমস্ত সামাজিক সমস্যা সরকারকেই বিহিত করতে হবে; এই দুনিয়ায় কোথাও কোনো ব্যক্তিগত বদান্যতার জায়গা নেই। সরকার যদি তার দায়টা পালন না করে, এ সরকারকে প্রত্যাখ্যান করো। বাধ্য করো তাদেরকে এটা করতে। কাজেই তারা এটা না করলে তার জন্যে তুমিই দায়ী। রাজনীতিকদের দুষছো কেন? নিজেকে দোষো।

কিন্তু নির্বাচিত সরকার বিশেষ একটা শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে।

ধনীক শ্রেণীর, ‘‘আমি আমার পাঁচ একর জমির নিশ্চয়তা চাই’’ ─দেখ। আমার কিছুই নেই, সুতরাং আমার কাছে সেটা কোনো ব্যাপার নয়─জমির মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা─এইসব কোনো কিছুই আমাকে স্পর্শ করে না। এমনকি সমাজতন্ত্রীরা ক্ষমতায় এলেও আমার কিছুই হারাবার নেই।

এমন না যে সমাজতন্ত্রীরা সমস্যার সমাধান দিতে পারবে; কেউই সেটা পারবে না, কোনো দলই ভারতের সমস্যার সমাধান করতে পারবে না; শুধু ঈশ্বর, যদি কোনো ঈশ্বর থেকে থাকেন এবং তাও যদি তিনি পারেন। এককভাবে তিনি ভারতের সমস্যা সমাধানে অক্ষম [হাসি]। এটা ভারতের সমস্যার কোনো নৈরাশ্যকর মূল্যায়ন নয়, কিন্তু কীভাবে এটা সম্ভব আমি বুঝতে পারি না। এই দেশের জন্যে আমি কোনো আশা দেখি না। আমি চাই বৈশ্বিক বিষয়ে এই দেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো ভূমিকা রাখুক। ভারত কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারলে আমি ভীষণ আনন্দিত হবো। [হাসি]। এমনকি ঈশ্বরও সেটা ঘটাতে পারেন না। সর্বশক্তিমান, পরমেশ্বর, যদি তেমন কেউ থেকে থাকেন─জানি না তেমন কেউ আছেন কিনা─তিনিও যদি এটা না পারেন, তুমি আমি কী করতে পারি?

তো, একদিন বোধহয়… জনগণ দেখ এত দুর্বল যে তারা সমগ্র ব্যাপারটাকে একটা বিস্ফোরণে উড়িয়ে দিতে পারে না। সমগ্র ব্যাপারটা যদি বিস্ফোরিত হতো, বোধহয় সেরকম একটা সম্ভাবনা আছে… এই দেশের সমস্যাটা দেখ, সোনার বারকোশে ভারতকে স্বাধীনতা অর্পণ করা হয়েছিল, যেখানে অন্য সমস্ত দেশকে তাদের স্বাধীনতার জন্যে অসম্ভব কঠিন পরিশ্রম আর লড়াই করতে হয়েছে, স্বাধীনতার জন্যে আত্মাহুতি দিতে হয়েছে─, সেটা সত্যিই একটা সমস্যা। দুঃখের বিষয় যে ভারত শাসন করতো বৃটিশরা; যদি ফরাসিরা বা অন্য কেউ ভারত শাসন করতো, এটা একটা ভিন্ন দেশ হতে পারতো। চীনের ওইসমস্ত সাংঘাতিক সব সামরিক নেতারা ছিলেন; ভারত মাও সে-তুং’এর মতো কোনো নেতা পয়দা করতে পারে না। ভারত কীভাবে মাও সে-তুং’এর মতো একটা লোক পয়দা করবে?

তবে আরেকটা জিনিস, দেখ: কোনো মডেল হিসেবে ওইসব সমাজতান্ত্রিক দেশের দিকে তাকানোর কিছু নেই; ভারতকে তার নিজস্ব স্বদেশী বিপ্লব বিকশিত করতে হবে। মাও সে-তুং এখানে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হবেন; কাজেই ভারতকে একটা স্বদেশী জিনিস জন্ম দিতে হবে (যদি এইভাবে বলি)। কিন্তু ওইরকম ব্যাপারের জন্যে সময় বোধহয় পরিপক্ক হয়ে ওঠে নাই। ভারতে ওইজাতীয় একটা ব্যাপার না ঘটলে দেখ, কোনো সম্ভাবনা নেই, কোনো আশা নেই।

সময়ই দেখ মানুষকে জন্ম দেয়; ওই সময়টায় ভারতে গান্ধীর মতো একটা লোকের দরকার ছিলো, এবং তিনি প্রস্তুত ছিলেন; ইংল্যান্ডের চার্চিলের মতো একটা লোকের দরকার ছিলো, চার্চিল সেখানে ছিলেন; ফ্রান্সের দ গলের মতো একটা লোকের দরকার ছিলো, এবং সেই লোক ছিলেন; জার্মানীর দরকার ছিলো হিটলারের মতো একটা লোকের, এবং সেই লোক ছিলেন। আমি পক্ষ নিচ্ছি বা ওইরকম কিছু নয়─কিন্তু হিটলার একাই দায়ী ছিলেন না: সমগ্র জার্মান জাতি ওই সময়টায় তাঁর পেছনে ছিলো। হিটলারকে দায়ী করলে তোমার প্রত্যেকটি জার্মানকেই দায়ী করতে হয়─হিটলার ছিলেন সময়ের একটা ফসল। যুদ্ধের পরপরই ইংরেজরা চার্চিলকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। ওইটা ছিলো দুর্দান্ত একটা জাতি─ইংরেজরা সত্যিই একটা দুর্দান্ত জাতি ছিলো─তারা জানতো ইংল্যাণ্ডের সমস্যা সমাধানে চার্চিল কোনো কাজে লাগবেন না। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি না গান্ধীর জন্যেই ভারত স্বাধীনতা পেয়েছে। তখন বিশ্ব পরিস্থিতিটাই এমন ছিলো যে বৃটিশকে খুব বন্ধুসুলভ হতেই হতো। এবং একটা বন্ধুসুলভ পন্থায় ভারত থেকে বেরিয়ে যেতে হতো─সেটাই দেখ আমাদের দুর্ভাগ্য, তাই কতকাল এইটা চলবে আমি জানি না।

দেখ, কোনোভাবে আমি ভারতের জন্যে কাজ করছি না, সুতরাং ভারতের সমালোচনা করার কোনো অধিকার আমার নেই। আমরা এখানে বসে আছি তাই ড্রইংরুমের রাজনীতি করছি। কিন্তু ভারতে আমার কাউকে কিছু বলার অধিকার নেই, যেহেতু আমি এখানে কাজ করছি না।

পথ পেলে আমিই সর্বপ্রথম তোমাকে সেটা দেখাবো। আমি কোনো পথ দেখি না। এই ধর্মের পুনর্জাগরণে আমি বিশ্বাস করি না, যেটা আসলে মৃত। এই দেশে তুমি কী পুনরুজ্জীবিত করতে চাও? ─বলো আমাকে। কিছুই পুনরুজ্জীবিত করার নেই। আরো আরো মন্দির বানাবে? কী জন্যে? হাজার হাজার মন্দির রয়েছে। আরেকটা যোগ করতে হবে কেন? তার মানে সেটা শুধু তোমার শ্লাঘার নিমিত্ত, এই দেশের ধর্মীয় কল্যাণের উদ্দেশ্যে নয়। আরেকটা আশ্রম? কীসের জন্যে? বহু বহু আশ্রম রয়েছে। বহু বহু গুরু রয়েছেন।

তো এই মনে হয় পরিস্থিতি। আমরা সবাই এতো অসহায়! আমাদের আশা একদিন হয়তো ভারত ঠিক মানুষটার জন্ম দেবে─কিন্তু অবস্থাটা এখনো পরিপক্ক নয়। কবে সেটা পরিপক্ক হবে আমি জানি না। দুর্ভোগ─ এই দেশের লোকেদের দৃষ্টিভঙ্গি দেখ বড়ই অদ্ভুত। শত শত বছর ধরে ভারত যে অদৃষ্টবাদের চর্চা করে এসেছে─সেটাই এই দেশের আজকের দুঃখজনক অবস্থার জন্যে দায়ী।

ওই সমস্ত ঋষিদের প্রচেষ্টা, যেমন ধরো, সাঁইবাবার মতো লোকজন, তোমার মনে হয় সবই অর্থহীন?

তিনি কী করছেন, স্যার? তিনি কী করছেন? তাঁর দাবি অনুযায়ী তিনি যদি একজন অবতার হয়ে থাকেন আর তিনিও যদি সেটা না পারেন, তাহলে আর কে পারবে? বলো আমাকে। সুতরাং কোথাও কোনো গোলমাল আছে।

তাহলে এই সবই অর্থহীন?

মনে হয় অর্থহীন। তাঁরা কিছুই পারেন না।

তাঁরা দৈব ঘটনা ঘটান। তাঁরা হাওয়া থেকে এটা-সেটা বানান।

তাতে কী লাভ? দৈব ঘটনা দিয়ে কী হবে? সকল দৈবের দৈব, সমগ্র জীবনটাকে পাল্টানোর জন্যে, চিন্তার সমগ্র পন্থাটা পাল্টানোর জন্যে যা দরকার, সেটা কিন্তু তাঁরা পারেন না। পারেন কি?

তথাকথিত জ্ঞানীগুণীসহ বিপুল সংখ্যক লোকজন তাঁর প্রতি আকৃষ্ট।

জ্ঞানীগুণীরাই হলেন সবচে’ মূর্খ, সবচে’ নির্বোধ। [হাসি] ─তাঁরাই সবচে’ সহজসরল। নির্দিষ্ট করে আমি সাঁইবাবার প্রসঙ্গে বলছি না। সাঁইবাবার ব্যাপার আমি কিছুই জানি না। অলৌকিকে আমার কোনো আগ্রহ নেই। তিনি এই দেশের এক নম্বর সাধুবাবা যেহেতু তিনি বিপুল সংখ্যক শ্রোতা টানতে পারেন, হাহ্? কাজেই সেইদিক দিয়ে তিনি এক নাম্বার, তারপর আছেন নাম্বার টু, থ্রি, ফোর, দেখ─কে কতো লোক টানতে পারেন তার ভিত্তিতে আমরা শ্রেণিবিভাগ করছি।

তো, তিনি কী করতে পারেন আমি জানি না। সেটাই হবে সকল দৈবের দৈব─সুইচ ঘড়িই হোক আর HMT ঘড়িই হোক, এইসব ঘড়ি-টড়ির ব্যাপারে আমার কোনো আগ্রহ নেই─কিন্তু সেটাই হবে সকল দৈবের দৈব এবং এই দুনিয়ায় যদি এমন কোনো অবতার থেকে থাকেন যিনি ওই দৈব ঘটাতে পারেন, আমিই তাঁকে সবার আগে নমস্কার করবো, আর কিছু নয়। তিনি এটা পারবেন না। কেউই এটা পারবে না।

অবতার দিয়ে কিছু হবে না; দরকার হলো ব্যক্তি। এটা একটা ব্যক্তিক সমস্যা, কাজেই অবতার দিয়ে কিছু হবে না। প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে একজন ত্রাতা রয়েছেন, এবং সেই ত্রাতা যদি বেরিয়ে আসেন, বিকশিত হন, তখন একটা আশা আছে। কিন্তু সেটা কখন?

উপনিষদের দ্রষ্টারা প্রত্যেকেই বোধহয় স্বতন্ত্রভাবে বিকশিত হয়েছিলেন।

উপনিষদের শিক্ষায় যদি কিছু থাকতো স্যার, বুদ্ধের আসার প্রয়োজন হতো না। তিনি কেন এলেন? তারাই বুদ্ধের মতো একজন মানুষের প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি করলো─উপনিষদের পরে তাঁর আগমন হলো। বেদের জিনিসপত্রের অবস্থা খারাপ হয়ে গেলো বলেই দেখ উপনিষদের ঋষিরা রঙ্গমঞ্চে এসে হাজির হলেন; এবং তাঁরা আবার সমস্ত জিনিসটা তালগোল পাকিয়ে ফেললেন, সেইজন্যেই বুদ্ধ এলেন; তারপর অনেক মানুষই এলেন। এই দেশে বুদ্ধবাদের অবস্থা খারাপ হলো বলেই শঙ্করকে আসতে হলো; আর শঙ্করের অনুসারীরা হুবহু সেই একই কাজ করলো, সুতরাং রামানুজাচার্যের আসার প্রয়োজন হলো─সেই একই ঘটনা─এবং তাঁর পরে এলেন মাধবাচার্য। আজ এইসমস্ত শিক্ষকদের জায়গাটা কোথায়?

কাজেই আজ হয়তো আবার একজন শিক্ষকের প্রয়োজন─সেটা শুধু ঈশ্বরই জানেন। সেই শিক্ষক আসন্ন কিনা আমি জানি না। আজ আমাদের মধ্যে যে অবতারেরা রয়েছেন তাঁরাও বোধহয় এই দেশটা আর দুনিয়াটা রক্ষা করার জন্যে যে দৈবের প্রয়োজন সেটা ঘটাতে অক্ষম।

তোমার ঈশ্বর ধারণাটা কী? তুমি প্রায়ই বলো যে, ‘শুধু ঈশ্বরই পারেন’।

না, সেটা একটা কথার কথা। [হাসি] মানুষকে ঈশ্বরের হাত থেকে রক্ষা পেতে হবে, সেটা খুবই জরুরী কারণ … তুমি যে অর্থে ‘‘ঈশ্বর’’ কথাটা ব্যবহার করো আমি সেই অর্থে ঈশ্বরের কথা বলছি না; যা কিছু ‘‘ঈশ্বরের’’ প্রতিনিধিত্ব করে, শুধু ঈশ্বর নয়─বরং ওই ঈশ্বর ধারণাটার সাথে সংশ্লিষ্ট সবকিছু─কর্ম, পুনর্জন্ম, পরজন্ম, পরকাল, সমস্তকিছু─সমস্ত কারবারটা, যাকে তুমি ‘‘ভারতের মহান ঐতিহ্য’’ বলো, ওই সমস্তটাই। ভারতের ঐতিহ্য থেকে মানুষের রক্ষা পাওয়া দরকার। শুধু জনতা নয়, দেশটারও ওই ঐতিহ্য থেকে রক্ষা পাওয়া দরকার (বিপ্লবের মাধ্যমে নয়, যেভাবে সমাজতান্ত্রিক দেশে তারা এটা করেছে সেইভাবে নয়, সেটা রাস্তা নয়। কেন আমি জানি না; এটা দেখ খুবই দুরূহ একটা বিষয়) তা নাহলে ব্যক্তির জন্যে কোনো আশা নেই এবং দেশের জন্যেও কোনো আশা নেই।

তাকে ঈশ্বরবিরোধী বা নিরীশ্বরবাদী হতে হবে তা নয়। আমার কাছে ঈশ্বরবাদী [ঈশ্বরে বিশ্বাসী], ঈশ্বরে অবিশ্বাসী এবং যে মধ্যিখানে থাকে─নিজেকে যে ‘‘অজ্ঞেয়বাদী’’ বলে, এরা সবাই একই তরণীর যাত্রী।

ব্যক্তিগতভাবে আমি অনুভব করি মানুষের বাইরে কোনো ক্ষমতা নেই, দেখ─মানুষের বাইরে কোনো ক্ষমতা নেই─বাইরে যে ক্ষমতাই থাকুক সেটা মানুষের ভেতরেই রয়েছে। কাজেই তাই যদি হয়ে থাকে─এবং সেটা আমার কাছে একটা বাস্তবতা─ওই ক্ষমতাটাকে মূর্ত করে কিছু প্রতীক বানিয়ে সেসব উপাসনা করার কিছু নেই, তাই না? সেইজন্যেই আমি বলি যে ঈশ্বর, আজকের মানুষের কাছে ঈশ্বর একটা অবান্তর প্রশ্ন। জানি না আমার কথা পরিষ্কার করতে পেরেছি কিনা।

এমন নয় যে তোমাকে সমস্ত ধর্মীয় বইপুস্তক জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিতে হবে, সমস্ত মন্দিরগুলো ধ্বংস করে ফেলতে হবে। সেটা খুবই মূর্খতা, খুবই হাস্যকর, কারণ মন্দির এবং ধর্মীয় বইপুস্তক যার প্রতিনিধিত্ব করে সেটা মানুষের ভেতরেই রয়েছে, তাই না? ─সেটা বাইরে নয়। কাজেই তামিল রামস্বামি নায়িকর্ যেমনটি করেছিলেন, সমস্ত লাইব্রেরিগুলো জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়ে ধর্মীয় সব বইপুস্তকের একটা বহ্ন্যুৎসব করা, সেরকম করার কিছু নেই─সেটা খুবই মূর্খতা; এটা সেরকম নয়।

সেইজন্যেই আমি বলি যে ঈশ্বর অবান্তর─কারণ মানুষকে তার নিজের সম্পদের ওপরেই আরো বেশি বেশি নির্ভর করতে হবে। তুমি যে ঐতিহ্যের কথা বলছো সেটাই এই আজকের মানুষকে সৃষ্টি করেছে, ওই সবকিছুই তার মধ্যে রয়েছে। কাজেই উপনিষদে কী আছে সেটা নয়… ওইসমস্ত শিক্ষকেরা যা যা ভেবেছেন, তাঁদের যে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, সেসব এই মানুষেরই অংশ। সুতরাং সেটাই একটা নতুন রূপে স্বয়ংপ্রকাশিত হতে হবে, তা নাহলে খুব একটা…

ঈশ্বর নিয়ে কথা বলার আদৌ কোনো মানে দাঁড়ায় না; প্রত্যেকেই একেকজন আস্তিক বা নাস্তিক হয়ে যায় আর যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করতে করতে শেষ হয়। তাদের ওই ইসলামের পুনর্জাগরণের অর্থ কী? এইসমস্ত লোকেরা যে-ইসলামের কথা বলে সেটা কী? তারা নিজেদের মধ্যে, দল-উপদলে কোন্দল করতেই থাকে, ঠিক যেমন ভারতীয়রা নিজেদের মধ্যে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধর্মগোষ্ঠীতে লড়াই করতে থাকে। তো সেইজন্যেই আমি বলি আজকের প্রেক্ষিতে ঈশ্বর অবান্তর, ‘ঈশ্বর’ যার প্রতিনিধিত্ব করেন মানুষের মধ্যে সেটা রয়েছেই─মানুষের বাইরে কোনো ক্ষমতা নেই─এবং সেটা তার নিজস্ব ধরনেই স্বয়ংপ্রকাশিত হতে হবে।

তাহলে তুমি বিবর্তন তত্ত্বে বিশ্বাসী?

ডারউইনের তত্ত্ব আদৌ বিবেচ্য নয় দেখ─তার মূল বক্তব্য─অর্জিত চারিত্র বংশপরম্পরায় সঞ্চারিত হয় না─ভুল প্রমাণিত হয়েছে। হয়তো বিবর্তনের মতো কিছু একটা আছে─হয়তো─কিন্তু ‘‘বিবর্তন’’ বলতে আমরা ঠিক কী বুঝি? সরল জিনিস জটিল হওয়া, তাই না? মানুষ আজ এত জটিল একটা চরিত্র হয়ে গেছে যে তাকে উল্টোদিকে যেতে হচ্ছে। ‘উল্টোদিকে’ বলছি মানে এই নয় যে আমাদেরকে ইনভলূশনে বিশ্বাস করতে হবে। এটা আবার ফিরে গিয়ে পয়লা সাল থেকে শুরু করার ব্যাপার নয়; মানুষ আজ যেখানে দাঁড়িয়ে সেখান থেকেই তাকে শুরু করতে হবে।

কিন্তু আমি জোর দিয়ে বলি যে মানুষের কোনো কর্মস্বাধীনতা নেই। ভারতীয়রা যে অদৃষ্টবাদের চর্চা করে এসেছে এবং এখনও করে চলেছে, আমি তার কথা বলছি না: আমি যখন বলছি মানুষের কোনো কর্মস্বাধীনতা নেই, সেটা বলছি তার নিজেকে পাল্টানোর প্রেক্ষিতে, অতীতের বোঝা থেকে তার নিজেকে মুক্ত করার প্রেক্ষিতে।

যা প্রয়োজন তা হলো, অতীতের বোঝা থেকে, তুমি যে মহান ঐতিহ্যের কথা বলছো সেটা থেকে, ব্যক্তির মুক্ত হওয়া। অতীতের বোঝা থেকে ব্যক্তি নিজেকে মুক্ত করতে না পারলে সে সমস্যার নতুন কোনো সমাধান দিতে পারে না; ওই পুরোনো জিনিসই সে আউড়ে যেতে থাকে… কাজেই এটা ওই ব্যক্তির ওপরেই নির্ভর করে। সমগ্র অতীত থেকে, তুমি যে ঐতিহ্যের কথা বলছো সেটা থেকে তাকে নিজেকে মুক্ত করতে হবে, ─অর্থাৎ যুগের সামষ্টিক প্রজ্ঞা থেকে তাকে বেরিয়ে আসতে হবে─শুধুমাত্র তখনই তার পক্ষে মানুষ আজ যে সমস্যার মুখোমুখি তার সমাধান দেওয়া সম্ভব।

এটা তার হাতে নয়; অতীতের বোঝা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে তার কিছুই করার নেই। সেই অর্থেই আমি বলছি তার কোনো কর্মস্বাধীনতা নেই। তোমার এখানে আসার বা না-আসার স্বাধীনতা আছে, অর্থনীতি, দর্শন বা অন্যকিছু পড়ার বা পাঠদানের স্বাধীনতা আছে─সেটা তোমার একটা সীমিত স্বাধীনতা। কিন্তু বিশ্বের ঘটনাবলি নিয়ন্ত্রণ করার বা অবয়ব দেওয়ার কোনো স্বাধীনতা তোমার নেই─কারোরই সেই ক্ষমতা নেই, কোনো জাতিরই সেই ক্ষমতা নেই।

ভারত তো অসহায়। আমেরিকাও তাই─সবচে’ শক্তিধর, সবচে’ ধনী আর সবচে’ ক্ষমতাশালী রাষ্ট্র আমেরিকা, সেটা অবশ্য আমেরিকা ছিলো; এখন আর সে সেটা নয়। টাইম ম্যাগাজিনও এখন আর আমেরিকার ক্ষেত্রে ওই শব্দগুলি ব্যবহার করে না। রাশিয়া বা আমেরিকার মতো দেশগুলোও যদি বিশ্বের ঘটনাবলি পরিচালনা করা তো দূরের কথা, নিয়ন্ত্রণ করতেই অক্ষম হয়, ভারতের মতো একটা দরিদ্র দেশ কী করতে পারে? কিছুই না।

কাজেই ব্যক্তিই হলো একমাত্র ভরসা। আবার ব্যক্তিও বোধহয় সম্পূর্ণ অসহায় যেহেতু তাকে অতীতের বোঝা থেকে, সমগ্র ঐতিহ্য থেকে, শুধু ভারতের নয়, সমগ্র বিশ্বের ঐতিহ্য থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হবে। তো মানুষের পক্ষে কি ওই বোঝা থেকে নিজেকে মুক্ত করা সম্ভব? ব্যক্তিগতভাবে তার আদৌ কোনো স্বাধীনতা আছে বলে মনে হয় না। তার কোনো কর্মস্বাধীনতা নেই দেখ─সেটাই সবচে’ জটিল সমস্যা। কিন্তু তারপরও ব্যক্তিতেই আশা─যদি কোনো ভাগ্যে, কোনো অদ্ভুত দৈবে…

তোমার এই দু’টো কথা স্ববিরোধী মনে হচ্ছে─তুমি বলছো মানুষের বাইরে কোনো ক্ষমতা নেই…

সেটাই আমরা যে ঈশ্বরের কথা বলছি সেটাকে অবান্তর করে দিচ্ছে─যে অর্থে তুমি ঈশ্বর কথাটা ব্যবহার করো। মানুষের বাইরে কোনো ক্ষমতা নেই। অতীতের গুরুভারের কারণে সেই ক্ষমতা নিজেকে প্রকাশ করতে অক্ষম; একবার সে যখন অতীতের গুরুভার থেকে মুক্ত হচ্ছে, তখন সেখানে যা রয়েছে, ওই বিস্ময়কর ক্ষমতা, স্বয়ংপ্রকাশিত হচ্ছে। ওই অর্থে দেখ কোনো স্ববিরোধীতা নেই।

সে কি ঘটনাবলি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম?

না, ঘটনাবলি নিয়ন্ত্রণ নয়, ঘটনাবলি নিয়ন্ত্রণ বা পরিচালনের প্রচেষ্টাটাই সে বাদ দেয়।

সে কি শুধুই স্রোতে ভেসে চলে?

ঘটনার স্রোতে ভেসে চলে। তোমাকে আমাকে কেউ জগতটা রক্ষা করার আজ্ঞা দেয় নাই। কে আমাদের আজ্ঞা দিয়েছে, হ্যা? শত শত বছর ধরে জগতটা চলে আসছে। বহু বহু মানুষ এসেছে আর গেছে। এটা তার মতোই চলে আসছে।

সুতরাং সমস্ত সমস্যা থেকে সে মুক্ত─শুধু তার নিজের সমস্যা থেকে নয়, জগতের সমস্যা থেকেও। এবং যদি ওই ব্যক্তির কোনোভাবে কোনো প্রভাব থাকে তো থাকলো; না থাকে তো… এটা দেখ এমন একটা কিছু যা পরিমাপ করার কোনো উপায় নেই।

সেটাই কি মানুষের আদর্শ দশা?

পশু পরিণত হচ্ছে একটা ফুলে, দেখ। সেটাই বোধহয় উদ্দেশ্য─ যদি প্রকৃতিতে আদৌ কোনো উদ্দেশ্য থেকে থাকে, আমি জানি না। সেখানে অসংখ্য ফুল─ তাকিয়ে দেখ! প্রত্যেকটি ফুলই তার নিজস্ব ধরনে অনন্য। ওইরকম ফুল সৃষ্টি করাটাই (আমি কোনো নিশ্চায়ক বক্তব্য দিতে পারি না), ওইরকম মনুষ্যফুল সৃষ্টি করাটাই বোধহয় প্রকৃতির উদ্দেশ্য।

আমাদের আছে শুধু গুটিকয়েক ফুল, এক আঙুলে তুমি যেটা গুণতে পারো: ইদানিংকালে রমণ মহর্ষি, শ্রীরামকৃষ্ণ, আরো কেউ কেউ। আজ আমাদের মধ্যে যেসব দাবিদার রয়েছেন, গুরুরা রয়েছেন─আমি তাঁদের কথা বলছি না। বিস্ময়কর হলো─ওই যে লোকটা তিরুভান্নামালাইয়ে বসে থাকেন─পশ্চিমে তাঁর প্রভাব এই সমস্ত গুরুদের তুলনায় অনেক বেশি─সেটা খুবই আশ্চর্যের, তাই না? মানুষের সমগ্র চেতনার ওপর তাঁর প্রভাব বিস্ময়কর─অথচ কোনো এক কোণে ওই লোকটি পড়ে থাকেন, বুঝছো তো?

আমি প্যারিসের এক শিল্পপতির ওখানে গেলাম। ধর্মীয় ব্যাপারে তাঁর কোনো আগ্রহ নেই, ভারতের ব্যাপারে তো নয়ই; তিনি একজন ভারতবিদ্বেষী। [হাসি] তো দেখি সেখানে তাঁর ছবি─ ‘‘তোমার কাছে এই ছবি কেন?’’ তিনি বললেন, ‘‘এই মুখটা আমার ভালো লাগে। তাঁর সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। তাঁর বইপত্র পড়তেও আমি আগ্রহী নই। ছবিটা ভালো লাগে তাই রেখে দিয়েছি। তাঁর আর কোনো কিছুতেই আমার আগ্রহ নেই।’’

এইরকম কোনো মানুষই হয়তো নিজেকে এবং ধরিত্রীকে সহায়তা করতে পারেন (‘পারেনই’ আমি বলতে পারি না)। হয়তো।

আরেকটা প্রশ্ন… কীভাবে বলবো, স্থূলভাবেই বলি। আমি একটা চরম মূর্খ…

চরম স্থূলভাবে তুমি সেটা বলতে পারো। তুমি অত মূর্খ নও; তারা তো বলে তুমিই সবচেয়ে জ্ঞানী লোক। যিনি রামানুজাচার্যের জীবনী লিখেছেন, তিনি স্থূল হতে পারেন না।

এখানে আমি মাঝে মাঝে আমাদের অধ্যাপককে খোঁচাই। যিনি অদ্বৈতের একজন প্রবক্তা। ‘‘দর্শনের কথা যদি বলো রামানুজের অবস্থান তুমি ছাড়িয়ে যেতে পারবে না [প্রতিষ্ঠিত অদ্বৈতবাদ]। সেখানেই এটা শেষ। অদ্বৈতবাদ এমন একটা কিছু যা নিয়ে তুমি কথা বলতে পারবে না…. কার্যত এর কোনো অস্তিত্বই নেই। সেটাই হলো সীমা।’’ আমি রামানুজাচার্যের সপক্ষে বা শঙ্করাচার্যের বিপক্ষে নই। দর্শনের একজন ছাত্র হিসেবে আমি যা বুঝি। দর্শনশাস্ত্র আমি পড়েছি─রামানুজাচার্য লোকটার বাইরে তুমি যেতে পারবে না। তুমি হয়তো আমার সাথে একমত হবে না। দার্শনিক অবস্থানের দিক দিয়ে দেখলে, রামানুজাচার্যের অবস্থানটা হলো সীমা, চরম। আর-সবাই? হয়তো…. যদি অদ্বৈত কোনো অবস্থান থেকেই থাকে, সেটা নিয়ে কথা বলার কিছু নেই। এবং সেটা এই দুনিয়ার কোনো কিছু পাল্টাতে ব্যবহার করা যায় না।

মানুষের আদর্শ এই স্থিতি…

প্রথমবারের মতো মানুষ মানুষ হয়ে ওঠে─ এবং সেটা সম্ভব শুধুমাত্র যখন সে, আমরা যে ঐতিহ্যের কথা বলছি সেই ঐতিহ্যের গুরুভার থেকে, সামগ্রিকভাবে মানুষের ঐতিহ্য (পূর্ব বা পশ্চিমের ঐতিহ্য নয়, পূর্ব-পশ্চিম বলে কিছু নেই) থেকে, নিজেকে মুক্ত করে। শুধু তখনই সে একজন ব্যক্তি হয়ে ওঠে। প্রথমবারের মতো সে একজন ব্যক্তি হয়ে ওঠে─আমি সেই ব্যক্তির কথাই বলছি।

মানুষের চেতনার ওপর ওই ব্যক্তির নিশ্চিত একটা প্রভাব থাকবে, কারণ এই চেতনায় যখন কিছু একটা ঘটে সেটা [সমগ্রকে] প্রভাবিত করে, হয়তো খুবই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পর্যায়ে। কাজেই এটা হলো একটা রূপক: কোনো পুকুরে একটা পাথর ছুঁড়লে বৃত্তীয় তরঙ্গ চালু হয়ে যায়। অবিকল একইভাবে, খুবই ধীরে ধীরে─এটা এমন একটা কিছু কোনো কিছু দিয়েই যা মাপা যায় না।

সুতরাং, সেটাই হয়তো মানুষের একমাত্র ভরসা─প্রথমবারের মতো ওইরকম একজন মানুষ ব্যক্তি হয়ে ওঠে─অন্যথায় সে শুধুই একটা পশু। এবং ঐতিহ্যের কারণে সে শুধু একটা পশুই থেকে যায়, যেহেতু প্রকৃতির দিক থেকে দেখলে ঐতিহ্য অযোগ্যের টিকে থাকাটা সম্ভব করেছে; অন্যথায় বহু আগেই প্রকৃতি তাদেরকে বাতিল করে দিতো। অযোগ্যদের টিকে থাকাটাই সম্ভব হয়েছে─যোগ্যতমদের নয় (হাসি), বরং ওই অযোগ্যদেরই টিকে থাকা─এবং ধর্মই সেটার জন্যে দায়ী। এই হলো আমার বক্তব্য। তুমি নাও মানতে পারো। তুমি মানতে পারবে না।

তার মানে এই নিখুঁত মানুষ…

সে কোনো নিখুঁত মানুষ নয়, সে কোনো আদর্শ মানুষও নয়─সে অন্যদের জন্যে কোনো মডেল হতে পারে না।

তাঁর কথা কীভাবে বলবে?

সে একজন ব্যক্তিমানুষ। সে একজন মানুষ হয়ে ওঠে, সে তার সমস্ত পশুস্বভাব থেকে মুক্ত হয়ে যায়। পশুরা অনুসরণ করে, পশুরা নেতা তৈরি করে─এবং এখনো দেখ মানুষের ভেতরে পশুস্বভাব রয়েই গেছে─সেই কারণেই সে একজন নেতা, একজন প্রধান সৃষ্টি করে, এবং তাকে অনুসরণ করতে থাকে।

সে কি একটা মহামানবজাতীয় কিছু?

সে একটা ফুলের মতো স্যার। এটা একটা ফুলের মতো। এবং প্রত্যেকটি ফুলই অনন্য।

তাঁর দশাটাই কি সেই সহজ স্থিতি, যে সহজ স্থিতির কথা তুমি প্রায়ই বলে থাকো?

তুমি তুমিই হচ্ছো। দেখ, সমগ্র মানবজাতির ঐতিহ্যের ওপর তোমার নির্ভরতাটাই ছিলো ভুল, এবং এই সংস্কৃতি, তা সে প্রাচ্যেরই হোক আর পাশ্চাত্যেরই হোক, তার ওপর তোমার নির্ভরতা, সেটাই তোমার আজকের এই অবস্থার জন্যে দায়ী, ─এই অভিঘাত, স্পষ্ট এই উপলব্ধিটা তোমাকে একটা অশনির মতো ধাক্কা দেয়। সবার জন্যেই এটা প্রযোজ্য, যেহেতু জাতি আসলে ব্যক্তিরই সম্প্রসারণ, এবং জগতটা হলো বিভিন্ন জাতিরই সম্প্রসারণ। অতীতের ভার থেকে তুমি মুক্ত এবং প্রথমবারের মতো তুমি একজন ব্যক্তি হচ্ছো।

এই দুইটা ফুলের মধ্যে কোনো সম্পর্কই নেই, কাজেই মাঝে মাঝে প্রকৃতি যে অনন্য ফুল জন্ম দিয়েছে সেই ফুলগুলো তুলনা বা প্রতিতুলনা করার কোনো মানে হয় না। তাদের নিজস্ব ধরনেই তাদের কিছু প্রভাব থাকবে, যদিও সমগ্র ব্যাপারটা গিয়ে শেষ হয় কিছু ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর নিজেদের ভেতরকার দ্বন্দ্বকলহের মধ্যে দিয়ে, আর কিছু না। এই জিনিস চলছে তো চলছেই। কে এই দুনিয়াটা রক্ষার আজ্ঞাপ্রাপ্ত?

এটা কি একটা ফুলেরই রাজ্য নয়?

কিন্তু প্রত্যেকটি ফুলেরই তার নিজস্ব সুগন্ধ রয়েছে। যা নিয়ে আমরা খুব গর্বিত, সেই মনুষ্য-ঐতিহ্যের প্রতিবন্ধকতাটা না থাকলে, আমরা হয়তো এইরকম আরো অনেক ফুলই পেতে পারতাম। এইভাবে এটা [মনুষ্য-ঐতিহ্য] প্রকৃতি যা করতে পারতো সেটা ধ্বংস করে দিয়েছে… (এমন নয় যে আমি প্রকৃতির পন্থা, বিবর্তনের উদ্দেশ্য, বা ওইজাতীয় কোনো কিছু ব্যাখ্যা করছি বা বোঝার চেষ্টা করছি, হয়তো বিবর্তন বলেই কিছু নেই)। সংস্কৃতির প্রতিবন্ধকতাটা না থাকলে প্রকৃতি হয়তো আরো অনেক ফুলের জন্ম দিতে পারতো─কাজেই এইটা মানুষের নিজস্ব ধরনে মুক্ত হবার ক্ষেত্রে একটা অন্তরায় হয়ে গেছে। তার জটিলতার জন্যে দেখ এই সংস্কৃতি জিনিসটাই দায়ী।

কাজেই, ওই ফুলটার─মানবজাতির জন্যে ওই ফুলটার কী মূল্য আছে? কী মূল্য? তুমি সেটার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারো, সেটাকে ভালোবাসতে পারো, সেটা নিয়ে কবিতা লিখতে পারো, সেটার ছবি আঁকতে পারো, সেটা পিষে ফেলতে পারো, সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারো, সেটা তোমার গরুকে দিয়ে খাওয়াতে পারো─কিন্তু তারপরও সেটা সেখানে রয়েছেই। সমাজের এর কোনো প্রয়োজনই নেই, কিন্তু এটা রয়েছে।

সংস্কৃতির প্রতিবন্ধকতাটা না থাকলে, জগতটা আরো অনেক ফুলেরই জন্ম দিতে পারতো, যা নিয়ে তোমার এতো গর্ব শুধু সেই গোলাপ নয়, বিভিন্ন ধরনের বিভিন্ন রকমের ফুল। সবকিছু তুমি একই জিনিস বানিয়ে ফেলতে চাও। কী কারণে? প্রকৃতি যেখানে মাঝে মাঝেই নানারকম ফুলের জন্ম দিতে পারতো, যে ফুলের প্রত্যেকটিই তার নিজস্ব ধরনে অনন্য, প্রত্যেকটিই তার নিজস্ব ধরনে সুন্দর। এই সংস্কৃতি সেই সম্ভাবনা ধ্বংস করে দিয়েছে, মানুষের ওপরে যার একটা নাগপাশ রয়েছে, যা তাকে সমগ্র অতীতের গুরুভার থেকে মুক্ত হতে বাধা দিচ্ছে।

এই সহজ স্থিতি কি একটা প্রকৃত মানুষের মতো?

হ্যাঁ, সে আর অন্য কেউ হতে চাইছে না; সে যা সে তাই।

তোমার উনপঞ্চাশ বছর বয়সে তুমি এটা অর্জন করেছো?

এই অভিঘাত, এই অশনি, আমাকে চূড়ান্ত শক্তিতে ধাক্কা দিচ্ছে, সবকিছু বিধ্বস্ত করে দিচ্ছে, আমার দেহের প্রত্যেকটি কোষ এবং গ্রন্থি বিস্ফোরিত হয়ে গেছে─বোধহয় সমস্ত রসায়নটাই পাল্টে গেছে। সেটা সাক্ষ্য দেবার মতো কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ বা চিকিৎসক নেই, কিন্তু আমি কারো কৌতূহল মেটাতেও আগ্রহী নই, কারণ আমি এইটা বিক্রিবাট্টা করছি না, ফুল-টুল সংগ্রহ করে কীভাবে এই পরিবর্তনটা ঘটাতে হয় তাদেরকে সেই শিক্ষাও দিচ্ছি না। এটা এমন একটা কিছু যা তুমি তোমার কোনো সংকল্প বা প্রচেষ্টায় ঘটাতে পারবে না; এটা শুধু ঘটে। আমি বলি এটা কারণরহিত। কী এর উদ্দেশ্য আমি সত্যিই জানি না, কিন্তু এটা দেখ কিছু একটা।

কোনো রূপান্তর ঘটে কি?

দেহের সমস্ত রসায়নটা পাল্টে যায়, কাজেই সেটা তার নিজস্ব ধরনে কাজ করতে শুরু করে। তার মানে যা-কিছু সংস্কৃতির দ্বারা বিষগ্রস্ত (শব্দটা আমি ভেবেচিন্তেই প্রয়োগ করছি) এবং কলুষিত, মনুষ্যদেহটা থেকে সেটা সম্পূর্ণ দূরীভূত হয়ে যায়। তোমার মনুষ্যদেহ থেকে এটা সম্পূর্ণ দূরীভূত হয়ে যায়, এবং তখন ওই চেতনা বা প্রাণ (বা যা-ই বলো) স্বয়ংপ্রকাশিত হয় এবং খুব স্বাভাবিক একটা পন্থায় ক্রিয়া করতে থাকে। সমস্ত জিনিসটাই তোমার মনুষ্যদেহ থেকে সম্পূর্ণ দূরীভূত হতে হবে; তা নাহলে, ঈশ্বরে বিশ্বাস না করলে তুমি হয়ে যাচ্ছো একটা নাস্তিক, তারপর লোকজনকে নাস্তিক্যে দীক্ষা দিচ্ছো, নসিহৎ করছো, ধর্মান্তরিত করছো। কিন্তু এই ব্যক্তি কোনো নাস্তিকও নয়, আস্তিকও নয়, সে কোনো অজ্ঞেয়বাদীও নয়; সে যা সে তাই।

মনুষ্য-উত্তরাধিকারের মাধ্যমে যে গতিময়তার সৃষ্টি হয়েছে, যেটা তোমাকে তোমার থেকে আলাদা কিছু বানানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে, সেইটা শেষ হয়ে যাচ্ছে, সুতরাং তুমি যা সেটাই তার নিজস্ব ধরনে স্বয়ংপ্রকাশিত হতে শুরু করছে, আর কিছু নয়; মানুষের বা সমগ্র মানবসমাজের অতীত দ্বারা সে আর অবরুদ্ধ নয়, প্রতিবন্ধী নয়, ভারগ্রস্ত নয়। কাজেই ওইরকম একজন মানুষের সমাজের কোনো প্রয়োজন নেই; পক্ষান্তরে সে হয়ে যাচ্ছে একটা হুমকি।

প্রয়োজনীয় হওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না?

আদৌ না। সে মনে করে না সে মনোনীত, জগতের সংস্কারসাধন করার জন্যে কোনো শক্তি দ্বারা মনোনীত। সে মনে করে না যে সে কোনো পরিত্রাতা, কোনো মুক্ত মানুষ বা কোনো বোধিপ্রাপ্ত মানুষ।

হ্যাঁ, সে-ই মানবজাতির পরিত্রাতা, এই কথা বলামাত্রই সে একটা প্রথাকেই প্রতিষ্ঠা করে।

সুতরাং যখনই তাঁর অনুগামীরা তাঁকে কোনো প্রথায় খাপ খাইয়ে নেয়, তখনই আরেকজনের পক্ষে সেই প্রথা ভেঙে বেরিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তাটাও চলে আসে─ এই হলো ব্যাপার।

বিবেকানন্দ যখন রামকৃষ্ণকে প্রশ্ন করেছিলেন তিনি দেখেছেন কিনা, তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘‘হ্যাঁ, দেখেছি,’’ সেইকথা বলে তিনি কী বুঝাতে চেয়েছিলেন?

তাঁকেই তোমার জিজ্ঞেস করতে হবে। আমি বলতে পারবো না। আমি জানি না একথা বলে কী তিনি বুঝিয়েছিলেন। কিন্তু আমি তোমাকে ব্যাখ্যা করেছি…

হয়তো একটা নির্দিষ্ট কাঠামোর ভেতরে সমস্ত ধারণারই একটা প্রাসঙ্গিকতা আছে। এখন তিনি এর বাইরে, এবং ওই সবই এখন অপ্রাসঙ্গিক, তাই তিনি আর উত্তর দেবার ধার ধারেন না।

রামকৃষ্ণ, শঙ্কর বা বুদ্ধের বক্তব্য নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই।

ওই সমস্তই তুমি বাতিল করে দিচ্ছো ?

ওই শব্দটা বোলো না। সেটা আমার মনুষ্যদেহ থেকে সম্পূর্ণ দূরীভূত হয়ে গেছে; এমন না যে আমি এটা বাতিল করে দিয়েছি বা ওইরকম কিছু। এটা শুধু আমার সমগ্র মনুষ্যদেহটা থেকে দূরীভূত হয়ে গেছে, সুতরাং আমি যা-ই বলি না কেন তার টিকে থাকা না-থাকা সেই কথার ওপরেই নির্ভর করে; এর কোনো ধরনের কোনো কর্তার সমর্থনের দরকার হয় না। সেইজন্যেই ওইরকম একজন মানুষ সমাজের জন্যে একটা হুমকি। প্রথার জন্যে সে একটা হুমকি হয়ে যায় যেহেতু ঐতিহ্যের সমস্ত ভিত্তিটাকেই সে ধ্বংস করে দেয়।

তুমি সাত পর্বত, সাত দিনের কথা বলে থাকো…

সাত সংখ্যাটা বা সাতদিন ধরে আমার যা ঘটেছিলো তার কোনো গুরুত্ব নেই, আদৌ কোনো গুরুত্ব নেই। ওইসমস্ত হলো গুপ্ততত্ত্বের ব্যাপার। গুপ্ততত্ত্ব কিছুই না। ওইসবের কোনো অর্থ নেই।

প্রায়ই আমার বন্ধুদের আমি যা বলে থাকি, মানুষকে মোক্ষ দিতে, বক্তৃতা দিতে আমি ভারতে আসি না; আমি এখানে আসি নেহাৎ ব্যক্তিগত একটা কারণে─ইউরোপের প্রচণ্ড শৈত্য থেকে বাঁচার জন্যে─এবং এখানে খরচখরচাও কম। লোকজনের সাথে আমার কথাবার্তা নৈমিত্তিক মাত্র─সত্যিই তাই─তা নাহলে আমি কোনো মঞ্চের ওপরে উঠে বসতাম। মঞ্চের ওপরে ওঠার কী আছে? আমি আগ্রহী নই। আমার কোনো বাণী দেবার নেই।

যে-কেউই এই সহজ স্থিতি অর্জন করতে পারে, অথচ এটা তার হাতে নয়?

এটা তার হাতে নয়; এটা কারো হাতেই নয়। কিন্তু তোমার শতকরা এক হাজার ভাগ নিশ্চয়তা রয়েছে, এই কারণে নয় যে এটা তোমার কোনো বিশেষাধিকার বা কোনো কিছুর দ্বারা তুমি বিশেষভাবে মনোনীত; এটা তোমার ভেতরেই রয়েছে। মানুষের বাইরে কোনো ক্ষমতা নেই─একথা বলে আমি সেটাই বুঝাই। তোমার ভেতরে ওই একই ক্ষমতা, ওই একই প্রাণ কাজ করে যাচ্ছে। তুমি যে সংস্কৃতির কথা বলছো সেটাই একে দাবিয়ে রাখছে। কিছু একটা নিজেকে প্রকাশ করতে চাইছে, এবং সংস্কৃতি সেটাকে দাবিয়ে রাখছে। একবার যখন এটা সংস্কৃতিকে বাতিল করে দিচ্ছে, তখন এটা তার নিজস্ব পন্থায় স্বয়ংপ্রকাশিত হচ্ছে।

যাঁরা এই রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গেছেন তাঁদের কোনো অভিন্ন বৈশিষ্ট্য আছে?

সেই প্রশ্ন এখানে আসেনা। আমি যদি নিজেকে কোনো সাধুর সাথে তুলনা করি, সেটা হবে আমার দুর্ভাগ্য। আমাদের কোনো অভিন্ন সঙ্ঘ বা ভ্রাতৃসঙ্ঘ বা ওইজাতীয় কিছু নেই। একটা গোলাপ, একটা ড্যাফোডিল বা একটা ঘাসফুলের ভেতরে অভিন্নতাটা কোথায়? প্রত্যেকটিই এর নিজস্ব ধরনে অনন্যরূপে সুন্দর। প্রত্যেকটিরই তার নিজস্ব সৌন্দর্য রয়েছে। সেটা তোমার পছন্দ কি পছন্দ নয় সেটা অন্য কথা।

অনন্যতাই কি এই রূপান্তরের অভিব্যক্তি?

না, ওই ব্যক্তি মনে করে না যে সে অনন্য।

না। কিন্তু অন্যদের কাছে?

হয়তো। সেটার অভিব্যক্তিটা দেখ অনন্য হতে বাধ্য। যখন তোমার এইরকম একটা ব্যাপার ঘটে, একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন পন্থায় তুমি তোমার নিজস্ব অনন্যতা ব্যক্ত করতে শুরু করো। কীভাবে এটা নিজেকে ব্যক্ত করবে, তুমি সেটা জানো না এবং আমি সেটা জানি না।

বিজ্ঞানীদের সম্পর্কে তোমার ধারণা কী? তুমি এরকম বলেছো: আইনস্টাইন মানবজাতির প্রতি গুরুতর একটা অবিচার করেছেন।

তোমার কি মনে হয় না তিনিই সবচেয়ে বড় অনিষ্ট─পারমাণবিক বোমার জন্যে দায়ী?

তিনি শুধু বলেছিলেন বস্তু এবং শক্তি আন্তঃপরিবর্তনীয়।

তারই ফলাফল হলো পারমাণবিক বোমা। যখন আমেরিকার এই অস্ত্র চালিয়ে যাওয়া উচিৎ হবে কি না এই প্রশ্ন উঠলো, তিনি বলেছিলেন, ‘‘হ্যাঁ, কর। অবশ্যই কর। তুমি না করলে জার্মানী এটা করবে।’’ আইনস্টাইন না হয়ে অন্য কেউ হলেও হয়তো সেটাই করতেন।

তাঁর কোনো উপায় ছিলো না; দুটো শয়তানের মধ্যে তাঁর একটাকে বেছে নিতেই হতো।

না। দুটো শয়তানের মধ্যে যদি তুমি কম শয়তানটাকে বেছে নাও, শেষ পর্যন্ত সেটা শয়তানি ছাড়া আর কিছু নয়। আজ আমাদের সেটাই ঘটেছে।

এমন নয় যে তাঁকে আমি এক নাম্বার শত্রু  গণ্য করি। ফ্রয়েডকেও আমি বিংশ শতাব্দীর একজন প্রধান প্রবঞ্চক বলে গণ্য করি কারণ তিনি এমন কিছু তত্ত্বের কথা বলেছিলেন যার আদৌ কোনো ভিত্তি নেই। সুতরাং তিনি হলেন বিংশ শতাব্দীর একজন ফেরেববাজ। কিন্তু সেটা [তত্ত্বটা] আজকের মানুষের কাছে একটা অপভাষায় পরিণত হয়েছে: সবাই-ই সেটা ব্যবহার করে। তো ওই অর্থে; এমন না যে আমি এইসব লোকেদের মানবতার শত্রু  বা ওইজাতীয় কিছু মনে করি।

এই পরিবর্তন─একেই কি তুমি ‘দুর্দৈব’ বলো?

তথাকথিত এই বোধি, আত্মদর্শন, ঈশ্বরদর্শন বা যা-ই বলো (ওইসব শব্দ ব্যবহার করাটা আমার পছন্দ নয়), এগুলিকে মানুষ সাধারণত স্বর্গীয় কিছু একটা বলে কল্পনা করে, মনে করে যে এতে করে সে স্থায়ীভাবে সুখী হতে পারবে, সর্বক্ষণ থাকতে পারবে স্বর্গীয় একটা দশায়─ওইসব লোকেদের নিয়ে তাদের এই রকমই প্রতিরূপ রয়েছে। কিন্তু যখন কোনো মানুষের এইজাতীয় কোনো জিনিস ঘটে, সে উপলব্ধি করে যে ওইরকম জিনিসের কোনো প্রকৃত ভিত্তি নেই। সুতরাং যে এটাকে একটা স্থায়ী সুখ, স্থায়ী স্বর্গ, স্থায়ী এটা-সেটা বলে কল্পনা করছে, তার দিক দিয়ে দেখলে এটা একটা ‘দুর্দৈব’, যেহেতু সে এমন একটা কিছু আশা করছে যার সাথে প্রকৃত ঘটনার কোনো সম্পর্কই নেই। সেটা নিয়ে তোমার যে প্রতিরূপ রয়েছে আর প্রকৃত যে অবস্থাটা, তার মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। কাজেই যে-লোকটা ভাবছে স্থায়ী কিছু একটা হতে চলেছে, তার ক্ষেত্রে এটা একটা দুর্দৈব─সেই অর্থেই আমি এই শব্দটা ব্যবহার করি। সেইজন্যে প্রায়ই আমি লোকজনকে বলে থাকি, ‘‘এর কোনো স্পর্শও যদি আমি তোমাকে দিতে পারতাম, তুমি এর ধারে-কাছেও ঘেঁষতে না।’’ তুমি এত্থেকে ছুটে পালাতে কারণ তুমি যা চাইছো এটা তা নয়। তুমি যা চাও তার দেখ কোনো অস্তিত্বই নেই।

কাজেই পরের প্রশ্নটা হলো: কেন এইসমস্ত সাধুরা এটাকে ‘‘স্থায়ী স্বর্গ,’’ ‘‘অনন্ত জীবন,’’ এটা-সেটা বলে থাকেন? আমি ওইসবে মোটেও আগ্রহী নই। কিন্তু সেটা নিয়ে তোমার যে প্রতিরূপ রয়েছে, তার সাথে আমি যে জিনিসটার কথা বলছি, সহজ স্থিতি, তার কোনো সম্পর্কই নেই। সুতরাং কেউ বোধিপ্রাপ্ত কি বোধিপ্রাপ্ত নয় তাতে আমার কোনো আগ্রহ নেই, কারণ বোধি বলেই আদৌ কিছু নেই।

তুমি যা বলছো সেক্ষেত্রে এই প্রশ্ন খানিকটা অবান্তর হতে পারে, তোমার কোনো বাণী আছে?

কার জন্যে?

যে-কারো জন্যে, সবার জন্যে।

আমার কোনো বাণী নেই স্যার─মানবজাতির জন্যে আমার কোনো বাণী নেই। লোকজন জানতে চায়, ‘‘কী ঘোড়ার ডিম করতে তুমি সারাক্ষণ বকেই যাচ্ছো?’’ আমি যখন বলছিই আমি কাউকে সহায়তা করতে পারি না, ‘‘কী ঘোড়ার ডিম করতে তুমি এখানে আসো?’’ (আমি তোমাকে বলছি না।)

আমি এই ‘ফুলের’ কারবার করতে চাই না…সেটাই এই ফুলটার সুগন্ধ। ওইরকম একজন লোক কোনো গুহায় ফিরে গিয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে না; তাকে এই জগতের মধ্যিখানেই বসবাস করতে হয়; তার কোথাও যাবার জায়গা নেই। সেটাই ওই বিশেষ ফুলটার সুগন্ধ─তুমি জানো না সেটা কী।

তুমি ওই ফুলের গন্ধটা চেনো না─তোমার চেনার কোনো উপায় নেই─সেইজন্যেই তুমি এইরকম তুলনা করছো: ‘‘এই ফুলের গন্ধটা ওই ফুলের মতো। এই ফুলটা দেখতে ওই ফুলটার মতো।’’ তুমি শুধু এ-ই করছো দেখ। যখন তুমি আর সেটা করবে না─ওই ফুলটাকে বুঝার চেষ্টা করবে না, অচেনা ওই গন্ধটাকে বুঝার চেষ্টা করবে না─তখনই সেখানে আরেকটা ফুল দেখা দেবে; সেটা ওই ফুলটার নকল কোনো ফুল নয়, তোমার খুব প্রিয় সেই গোলাপ বা ড্যাফোডিলও নয়। ‘একটি ড্যাফোডিল গাঁথা’ (‘‘An Ode to the Daffodils’’), কে যেন লিখেছিলো! বা গোলাপ… গোলাপ কেন এতো গুরুত্ব পেল? কারণ সবারই সেটা পছন্দ। কিন্তু ওই ঘাসফুলটা গোলাপের চেয়ে বেশি সুন্দর। যখনই তুমি এই তুলনাটা বাদ দিচ্ছো, ওই ফুলটা কী, ওই সুগন্ধটা কী, সেটা বুঝার চেষ্টা এবং কল্পনা করার চেষ্টাটাও বাদ দিচ্ছো, তখনই সেখানে নতুন একটা ফুল দেখা দিচ্ছে, যার সাথে আমাদের চারপাশের যাবতীয় ফুলের কোনো সম্পর্কই নেই।

থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার। ঘণ্টাখানেক আগের মানুষটার তুলনায় আমি এখন একজন পরিবর্তিত মানুষ।

 

 

…………….
১. রামানুজাচার্য: বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ প্রচারক সুপ্রসিদ্ধ প্রাচীন বৈদান্তিক।
২. ইনভলূশন: involution; অভ্যন্তরীণভাবে জটিল কোনো কিছু।
৩. অদ্বৈত: শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদ; ব্রহ্ম ব্যতীত দ্বিতীয় কিছু নেই, ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, জগৎ মিথ্যা─শঙ্করাচার্য-প্রতিষ্ঠিত এই দার্শনিক মত। অদ্বৈত অর্থ দ্বিতীয়ত্বহীন অর্থাৎ জীব ও ব্রহ্ম ভেদশূন্য।

[অনুবাদের স্বত্ব সংরক্ষিত]

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top