মাহমুদ দারবীশের কবিতা

nnnনির্বাসন: পায়রার ঠোঁট থেকে পায়রার ঠোঁটে বিস্তৃত বর্ণমালা
অনুবাদ: তাপস গায়েন

প্যালেস্টাইনের গ্যালিলীতে জন্ম নিয়ে কবি মাহমুদ দারবীশ (১৯৪২-২০০৮) নির্বাসনকে যেমন জেনেছেন পৌরাণিক সত্যে এবং ঐতিহাসিক সত্যে, কিন্তু আরও অধিক জেনেছেন ব্যক্তিগত জীবনযাপনের সত্যে । ছয় বছর বয়সে ইস্রাইলি সৈন্যদের হাত থেকে প্রাণ রক্ষার্থে মাতা-পিতার হাত ধরে তিনি যাবেন লেবাননে । ইস্রাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরে তিনি ফিরে আসবেন ইস্রাইলে, এবং নিজেকে জানবেন নিজ গৃহে পরবাসী হিসেবে । শিক্ষা এবং জীবন-জীবিকার তাগিদে ঘুরে ফিরবেন মস্কো, কায়রো, বৈরুত, আম্মান, গ্রীস, সাইপ্রাস, তুনিসিয়া, প্যারিস, এবং আরও অনেক দেশ এবং নগরী । আমরা জানি, এই কবির জীবন এবং তাঁর কাব্য প্যালেস্টাইন জনগনের মুক্তি আন্দোলনের সমার্থক হয়ে উঠেছিল এবং তাঁর মৃত্যুতে দুইদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করেছে প্যালেস্টাইনের মুক্তিকামী মানুষেরা । কবি দারবীশের প্রথম জীবনের কবিতায় প্যালেস্টাইনের উদ্বাস্তু মানুষের ভূমি রূপান্তরিত হয়ে উঠেছিল অনধিগম্য প্রেমিকার জন্য এক অনিঃশেষ ক্রন্দন । মানব-মুক্তি-আন্দোলনের এই কবি তাঁর কবিতায় সৃজনশীলতা খুঁজে ফিরবেন আমেরিকার রেড-ইণ্ডিয়ানদের কবিতার বিদ্রোহী সত্তাকে মান্য করে ; প্রাক-ইসলামী পৌরাণিক আখ্যানের মধ্যে দেবী আনাত এবং অন্য দেবীদের ভালোবাসা এবং জীবনের সত্যকে অনুভবে এনে । তাঁর ভালোবাসার ধন যেমন নারী এবং তাঁর জন্মভূমি ; এটি যেমন তাঁর নিজের এবং অন্যের প্রতিকৃতি, ঠিক সেই অর্থে কিংবা আরও গভীরতর অর্থে তাঁর কবিতা এবং গদ্য হয়ে উঠবে তাঁর সাহিত্য এবং জীবনের অন্তিম অন্বেষণ ।

অসামান্য প্রতিভাবান এবং বিচিত্রগামী এই কবির বিপুল সাহিত্য ভাণ্ডার (কবিতা এবং গদ্য মিলিয়ে প্রায় ত্রিশটি বই, যা বাইশটিরও অধিক ভাষায় ভাষান্তরিত হয়েছে) থেকে মাত্র দুইটি কবিতা ভাষান্তর করতে অক্ষম চেষ্টা করেছি মাত্র, যা এখানে সন্নিবেশিত হয়েছে । – তাপস গায়েন
নির্বাসনহীন, আমি কে ?

নদীতীরে এক আগন্তুক, নদীর মতোই… এই জল
তোমার নামে আমাকে বাঁধে । না যুদ্ধ না শান্তি
বহুদূর দেশ থেকে কিছুই আমাকে ফিরিয়ে আনে না
আমার তালবৃক্ষের সন্নিকটে । কিছুই আমাকে যায় না নিয়ে
গস্পেলের গভীরে ।…ভাটার তীর থেকে কিছুই নয় উদ্ভাসিত,
কিছুই নয় স্ফুলিঙ্গময়, ইউফ্রেতিস এবং নাইলের মধ্যবর্তী প্রবাহে ।
কিছুই করে না আমাকে প্রলুদ্ধ ফেরো’র নৌকা থেকে অবরোহণে ।
আমাকে বহন করে না কিছুই কিংবা কিছুই উদ্বুদ্ধ করে না
কোন্‌ এক চিন্তাকে ধারণ করতেঃ না আকাঙ্ক্ষা না প্রতিশ্রুতি ।
কি করব আমি ? দ্বীপান্তর এবং দীর্ঘ রাত যা জলের দিকে তাকিয়ে থাকে,
এই ব্যতীত আমি কি করব ?

জল
আমাকে বাঁধে
তোমার নামে…
কিছুই আমাকে যায় না নিয়ে আমার স্বপ্নের প্রজাপতি থেকে
আমার বাস্তবতায়ঃ না ধূলো না আগুন । সমরকন্দের গোলাপ ব্যতীত
আমি কি করব ? নাট্যশালা, যা তার উজ্জ্বল পাথর দিয়ে গায়ককে করে বর্ণিল,
তা দিয়ে আমি কি করব ? বহুদূরের বাতাসে আমাদের শরীরের ভর
আমাদের আবাসগৃহের মতোই ভরহীন ।
মেঘ থেকে উদ্ভুত বিচিত্র প্রাণীর আমরা হয়েছি দুই বন্ধু…এবং
স্বাতন্ত্র্যের ভূমির মাধ্যাকর্ষণ থেকে স্খলিত আমরা এখন । আমরা কি করব…
দ্বীপান্তর ছাড়া আমরা কি করব, এবং দীর্ঘরাত যা
তাকিয়ে থাকে জলের দিকে ?

তোমার নামে
জল
আমাকে বাঁধে…
তুমি ছাড়া আমার কিছুই অবশিষ্ট নেই, এবং আমিহীন তোমার
কোনো অবশেষ নেই, আগন্তুক ম্যাসাজ দিচ্ছে আগন্তুকের উরুতেঃ
হে আমার আগন্তুক ! দুই পৌরাণিক আখ্যানের মধ্যে যে আচ্ছন্নতা
এবং আমাদের জন্য যে শান্ত অবশেষ তা দিয়ে আমরা কি করব ?
কিছুই আমাদের বহন করে নাঃ না গৃহ না পথ ।
এই পথ কি সবসময় এই রকমই ছিল ? শুরুতেই কি এই ছিল
না কি আমাদের স্বপ্ন মঙ্গোলদের ঘোড়াদের ভীড়ে পেয়ে গেছে এই
ঘোটকী এবং স্বপ্নে ঘটেছে তার বিনিময় ?
এবং আমরা কি করব ?
কি করব আমরা
এই দ্বীপান্তর ছাড়া ?

 

এই আকাশের পশ্চাতে আছে আমার আকাশ

আমার প্রত্যাবর্তনের নিমিত্তে এই আকাশের পিছনে আছে আমার আকাশ,
কিন্তু এইক্ষণে আমি ঔজ্জ্বল্য দান করছি এই ধাতবখণ্ডে, এবং এক ঘণ্টার জন্য
যে আছি, তাই পূর্বেই দেখে নিচ্ছি অদৃশ্যমানকে ।
আমি জানি দ্বিতীয়বারের জন্য সময় আমার সহায়ক হয়ে উঠবে না, এবং আমি
আমার ব্যানার থেকে পাখি হয়ে নেমে আসব না কোনো বাগানের বৃক্ষে ।
আমি ঝেড়ে ফেলব আমার দেহের ত্বক এবং আমার ভাষা থেকে জাত
কিছু শব্দ যা ভালবাসার দ্যোতক তা
লোরকার কবিতায় অধিষ্ঠান পেয়ে বসবাস করবে আমার গৃহে
এবং দেখবে আমি যা দেখেছি বেদুঈন চাঁদে ।
আমি আমেণ্ড-ট্রি থেকে তুলো হয়ে বেরিয়ে
ভাসছি সাগরের ফেনা হয়ে
একজন আগন্তুক চলে যাচ্ছে সাতশ বছরের অশ্ব নিয়ে ।
আগন্তুক যিনি চলে যাচ্ছেন এদিক দিয়ে, আগন্তুক তিনি চলে যাবেন
অন্যদিক দিয়ে ; আমিও আমার সময়ের ভাঁজ থেকে কিছুক্ষণের জন্য
আগন্তুক হয়ে ঘুরে ফিরব সিরিয়া এবং আন্দালুস ।
এই পৃথিবী আমার আকাশ নয়, তবু এই আকাশই আমার বিকাল এবং
এই চাবি আমার, এই মিনার আমার, এই প্রদীপ আমার, এবং
আমিও আমার !
আমি দুই ইডেনের আদম, দুবারই হারিয়েছি ইডেনকে ।
আমাকে বহিষ্কার কর, ধীরে
হত্যা করো আমাকে, ধীরে
এই জলপাই গাছের নীচে
কবি লোরকার সাথে…
নিউইয়র্ক, মে ১৪-১৬, ২০১৪

 

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top