গদ্য: সাঁঝের বেলার নর্তকীরা

মীজান রহমান

একশ বছরের এক বৃদ্ধের সাক্ষাৎকার পড়ছিলাম সেদিন। সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন: ওপারে যাওয়ার সময় হলে বিধাতা আপনাকে কি বলে অভিবাদন জানাবেন মনে হয় আপনার? বৃদ্ধ বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে জবাব দিলেন:  এত দেরি হল কেন তোমার?

এই বৃদ্ধের যখন জন্ম তখন আলবার্ট আইনস্টাইন কলেজের ছাত্র, সিগমাণ্ড ফ্রয়েড মধ্যবয়সে পৌঁচেছেন, তুরস্কে খলিফাদের প্রবল প্রতাপ, মহারানী ভিক্টোরিয়া সূর্যাস্তহীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি, জার্মানীর এডলফ হিটলার দশ বছরের বালক, এবং আমার মরহুম পিতামহ তখনো অবিবাহিত যুবক। এই বৃদ্ধ যে বেঁচে আছেন সেটা যদি আশ্চর্যের না’ও হয়, তিনি যে স্মৃতিশক্তি হারান নি, কথা বলতে পারছেন পরিষ্কার গলায়, এমনকি একটা সুস্থরসবোধও ধারণ করে রেখেছেন, সেটা আমার কাছে পরম বিস্ময়কর মনে হয়েছে। এই ভদ্রলোকের ছেলেমেয়েরা কেউ বেঁচে আছে কি না জানিনা, সম্ভবত তাঁর ছোটবেলার বন্ধুবান্ধবদের কেউ জীবিত নেই, সুতরাং ইহধামে একটু একাকী বোধ করা অস্বাভাবিক নয়।

বৃদ্ধ কাকে বলে? নির্ভর করে কোন্‌ সমাজের কথা বলা হচ্ছে। সমাজ শুধু নয়, সময়ও। পঞ্চাশ বছর আগে যাদের বুড়ো বলা যেত এখন তাদের অনেককেই বুড়ো বলা যাবে না। তারা এখন দৌড়ঝাঁপ করে, বিশ্বভ্রমণ করে, কেউবা সুন্দরী রমনীর পাণিগ্রহণ করে সহাস্যবদনে, সন্তানের পিতা হয়। এমনকি আমাদের দেশেও। পশ্চিমে সরকারিভাবে বার্ধক্য শুরু হয় পঁয়ষট্টিতে। তৃতীয় বিশ্বে তা একেক দেশে একেকরকম। বাংলাদেশে সাতান্ন, আমার জানামতে। এই বয়সে পশ্চিমে কেউ কেউ সংসারী হতে শুরু করেছে মাত্র। ক্যানাডা-আমেরিকায় দেখেছি বুড়োকে বুড়ো বললে মন খারাপ করে। আমাদের দেশের বুড়োকে বুড়ো না বলাটাই খারাপ। আশি পার হলে পশ্চিমার লোকেরা বলে 80-yr young, পূর্বের লোকেরা সাধারণত আশি পার হয় না, হলে অন্যেরা young বা old  কিছুই বলে না, চুপ করে দিন গোণে। আশি পার-হওয়া বুড়োদের আমরা বলি থুত্থুড়ে বুড়ো। নিজের স্মৃতিভ্রম না হলেও আশেপাশের  লোকেদের স্মৃতিভ্রম ঘটতে শুরু করে। অর্থাৎ তাঁর বয়স নিয়ে কেউ আর মাথা ঘামায় না।

বার্ধক্যের প্রাথমিক লক্ষণগুলো দেখা দেবার সাথে সাথে হিতৈষীদের মুখে সান্ত্বনার বাণী উচ্চারিত হতে থাকে:  বয়সটা মানুষের মনে। লক্ষণীয় যে বাণীটা সাধারণত বৃদ্ধদের মুখ থেকে নির্গত হয় না, হয় যাদের চুল পাকে নি বা দাঁত পড়তে শুরু করে নি তাদের মুখ থেকে। আমি বলি বয়সটা আসলে দেহেও নয়, মনেও নয়, বয়স হল ওষুধের বাক্সে। ওই বাক্সটা যখন খালি তখনই আপনার ফুরফুরা যৌবন, পঞ্জিকার বয়স যা’ই হোক। বাক্স যদি ভরা থাকে তাহলে কুড়িই কি বুড়িই কি, সব এক। অঙ্গে যদি ফূর্তি না থাকে বন্ধু অন্তরে তব রহিবে না রস। অর্থাৎ স্বাস্থ্য। মূল কথা হল স্বাস্থ্য, যেটাকে স্থূল বিষয় বলে গণ্য করা হয় যৌবনে। স্বাস্থ্যের সঙ্গে ওষুধের যোগ, ওষুধের সঙ্গে বয়সের। সহজ সমীকরণ। আমি নিজেও এই সমীকরণের অংশ। ধনরত্নের চেয়ে মূল্যবান আমার ওষুধরত্ন। যেখানেই যাই যক্ষের ধনের মত আগলে রাখি এই বাক্সটিকে। অর্থাৎ আমার নিজের সংজ্ঞা অনুযায়ী আমি বৃদ্ধ। এই মুহূর্তে যদি পটল তুলতে হয় আমাকে তাহলে কেউ বলবে না অকালমৃত্যু।  আমার ছেলেরা সেটা মেনে নেবে। নিন্দুকেরা ভাববেন, বুড়োটা গেল শেষ পর্যন্ত।

বার্ধক্য হাসির বিষয় নয়, আবার হাসিরও। যে বুড়ো নিজেকে নিয়ে হাসতে পারে না সে সত্যি সত্যি বুড়ো। আমার এগারো বছরে নাতিটার বেশ সূক্ষ্ম রসবোধ আছে। আমাকে একটা বই উপহার দিয়েছে:  How aging affects belt height. লেখক Dan Reynolds ব্যঙ্গচিত্রের সাহায্যে বুঝাতে চেয়েছেন যে একটা পুরুষের কোমরের বেল্ট থেকেই তার জীবনকাহিনীর মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায়। ছোটবেলায় ছেলেরা হাফপ্যান্ট পরে, বেল্ট থাকে নাভির নিচে। (যদিও আজকাল আমেরিকার কোন কোন শহরের বাঁদর ছেলেরা বেল্টটাকে প্রায় হাঁটুর কাছে নামিয়ে আনছে)। তারপর বয়স যতই বাড়ে বেল্ট ততই উপরে ওঠে। অবস্থা টবস্থা একটু ভালো হলে ঊর্ধ্বগতিটা আরো ত্বরাণ্বিত হয়, কারণ তেলঘিমাংশ খেয়ে খেয়ে তো ভূড়িখানা ঢোলাকার ধারণ করে অচিরেই। শেষে যখন আমার বয়সে (সত্তুরের মাঝামাঝি) দাঁড়ায় তখন বেল্ট ওঠে গলার কাছে। তখন আর শার্ট গেঞ্জি পরবার দরকার হয় না। আমার অনেকটা সে অবস্থা এখন। ভূঁড়িটা এমন কোন বিশালকায় না হলেও বড় পরিবারের বাজারের থলের মত এমন করুণভাবে ঝুলে পড়েছে যে শরীরের নিচের দিকটা একেবারেই দেখতে পারি না। দেখতে হলে আয়নার সাহায্য লাগে।

শাস্ত্রে বলে জন্মমৃত্যু আল্লার হাতে। আমি বলি, শুধু জন্মমৃত্যু কেন সবই আল্লার হাতে। পাপপুণ্য, সত্যমিথ্যা, তা’ও তো আল্লারই হাতে। ‘আল্লার হাত’ নিয়ে একটা মজার গল্প আছে। সেটা অন্যত্র উল্লেখ করেছিলাম বিধায় তার পুনরাবৃত্তি থেকে বিরত রইলাম। পবিত্র কোরান যতটুকু পড়েছি তাতে মনে হয় নি যে আল্লাতা’লা হালকা রস বা হাসিঠাট্টা খুব একটা পছন্দ করেন। সুতরাং সেপথ মাড়াব না আজকে। আমার বক্তব্য হল যে আমি এমন একটা বয়সে পৌঁচেছি যে আমার আর নতুন কিছু দেখবার নেই। মোটামুটি সবই দেখা হয়ে গেছে। আমার জীবন শুরু হয়েছিল নির্বাক ছবির যুগে, শেষ হতে চলেছে Imax, Digital আর Virtual Realityর যুগে। আমার স্ত্রী খুব সখ করে কতগুলো জিনিস কিনেছিল যার সবই এখন জাদুঘরে জায়গা পাওয়ার যোগ্য। যেমন Clairtone HiFi, Singer Sewing Machine (Minisize), Remington Typewriter, Pressure Cooker, Bone China বাসন, (আজকাল কি Made In China ছাড়া আর কোনরকম চায়না মেলে বাজারে?), একটি মার্বেলের কফিটেবিল। শুনেছি এগুলো আজকাল Collector’s Item হিসেবে বিক্রি হতে পারে। আমাদের বাড়িতে প্রাচীন জিনিসগুলোর মধ্যে কেবল একটাই আছে যার প্রতি Collector দের কোন আগ্রহ থাকবার কথা নয়–আমি নিজে। সেদিক থেকে জীবজগতের চেয়ে জড়জগতেরই মূল্য বেশি। তাতে আমার দুঃখ নেই, কারণ আমার অস্থিমজ্জাও তো একদিন জড়জগতেরই অন্তর্গত হয়ে উঠবে। জীব আর জড়তে মৌলিক তফাৎ তো বেশি নয়। সবই পদার্থ। ভিন্ন রূপ মাত্র।

সম্প্রতি একটা বইতে পড়লাম যে প্রাচীন ভারতীয় দর্শন অনুযায়ী সময় এবং সৃষ্টি একমাত্রিক সরলরেখা নয়, বৃত্তাকার। সৃষ্টির বৃত্তটা আমি অল্পবিস্তর অনুধাবন করতে পারি, কিন্তু সময়ের বৃত্তটাই আমাকে ধাঁধায় ফেলে দেয়। বিজ্ঞান বলে সময় একমুখি– One-way সড়কের মত, যার মাথাটা শুধু একটা দিকই নির্দেশ করে, সম্মুখ। পশ্চাৎ থেকে যার যাত্রা, এবং যার গন্তব্য অন্তহীন সম্মুখ। কিন্তু হিন্দু ও বৌদ্ধ দর্শন অনুযায়ী সময় একরোখা ঠিকই তবে সরল নয়, বঙ্কিম। ঘুরে ঘুরে পুরনো বিন্দুতেই ফিরে আসে। এই বৃত্তের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে তাদের পুনর্জন্মতত্ত্ব। আমি ওসব বুঝি না, তবে ঘোরাটা বুঝি। পুনর্জন্মের ঘোরা নয়, এজন্মের ঘোরা। আমি বুঝি যে বয়স হলে অনেকে শৈশবে ফিরে যায়। শিশুদের মতো অবুঝ হয়, আত্মনির্ভরতা হারিয়ে অসহায় হয়। মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়, স্মৃতি মুছে যায়, প্রেম প্রীতি সুখ দুঃখ বোধ আকাঙ্ক্ষা সব একাকার হয়ে কঠিন পাথরে পরিণত হয়। সবচেয়ে বড় লাঞ্ছনা হল অনেক বৃদ্ধকে শিশুদের মত অন্তর্বাস পরতে হয়। শিশুরা পরে নিয়ন্ত্রণের বয়স হয় নি বলে, বুড়োরা পরে নিয়ন্ত্রণের বয়স পার হয়ে যাবার বিড়ম্বনাতে। পশ্চিমের বাজারে একটির নাম Diaper, আরেকটির Depends, যদিও দুয়ের ব্যবহারে কোনও মৌলিক তফাৎ ‌নেই। এই অবস্থাটিই যদি হয় সত্যিকার বার্ধক্যের লক্ষণ তাহলে কোনও বৃদ্ধের জন্যে আমি শতায়ু কামনা করব না। আমার বিচারে তারা শুধু বৃদ্ধ নন, তারা মৃত্যুপথযাত্রী কুব্জপ্রাণ জীর্ণদেহ ছায়ার শরীর। তারা শিকারি সময়ের শরবিদ্ধ জীব ছাড়া কিছু নয়, যাদের গোটা অস্তিত্ব কেবল একটি নিঃশ্বাসের আকাঙ্ক্ষায় নিবেদিত– শেষ নিঃশ্বাস। এই জরাজীর্ণ বার্ধক্যের কথা আজকে বলব না আমি। বলব মানসিক, আত্মিক ও  সাংস্কৃতিক বার্ধক্যের কথা। বলব সেই দুর্বার দুর্জয় প্রাণশক্তির কথা যা দিয়ে আমরা দূর করতে পারি সেই দীনতাকে, জয় করতে পারি সেই জীর্ণতাকে।

যৌবনে আমার অনেক বদভ্যাস ছিল। তার মধ্যে একটি ছিল যে আমি বুড়োদের নিয়ে খুব হাসিঠাট্টা করতাম। সৌভাগ্যবশতঃ আমার সেই বদভ্যাসটি এখনো আছে। বুড়োদের নিয়ে আমি এখনও হাসিমস্করা করি। সৌভাগ্য বললাম এজন্যে যে আমার হাসবার ক্ষমতাটি এতকাল পরেও একেবারে লোপ পায়নি, এবং হাসির বিষয়কে এখনো হাসিরই মনে হয় আমার কাছে, বিষাদের নয়। আমরা বুড়োরা একটা জিনিসকে বড় ভয় পাই। সে জিনিসটির নাম হল নতুন। নতুন যন্ত্র দেখলে আমরা বাচ্চাদের মতো কোনায় গিয়ে লুকাই, নতুন মানুষ দেখলে আমরা কুকড়ে থাকি, নতুন রাস্তা দেখলে পুরনো রাস্তা খুঁজি। আমার সমসাময়িকদের মাঝে একজন কি দুজন ছাড়া কাউকেই আমি কম্পিউটারের সামনে সহজভাবে বসতে দেখি নি। দেখি নি কাউকে দু’হাতের আঙুল একসাথে ব্যবহার করতে। আমরা সবাই এক আঙুলের টাইপিস্ট। সমসাময়িকদের কাউকে দেখি নি দোকানে গিয়ে নগদ টাকা না দিয়ে প্লাস্টিক কার্ড ব্যবহার করতে। দেখি নি কাউকে পরিচিত সরু পথ ছেড়ে নতুন প্রশস্ত রাজপথে গাড়ি চালাতে। আমার সমসাময়িকদের কারো মুখে শুনলাম না নতুন যুগের ছেলেমেয়েদের নিয়ে ভালো কিছু বলতে। তাদের জগৎ, সেই ছোটবেলাকার সম্মোহিনী জগৎ, যে জগতে কোন পাপ ছিল না, কলুষ ছিল না, ছিল না কোনও যৌন উগ্রতা, নষ্ট নৈতিকতা, ভ্রষ্ট চরিত্র। তাদের জগৎ সবসময়ই বিশুদ্ধ নির্মল, শুচিশুভ্র, নিষ্পাপ নিঃষ্কলঙ্ক। আমার সমসাময়িকদের অর্ধেক দিন কাটে পুরনো দিনের জয়গান গেয়ে, বাকি অর্ধেক কাটে নতুন দিনের নস্যাৎ করে। আমরা নিজেদের বিগত যৌবনকে যতটা বন্দনা করি, আজকের নবাগত যৌবনকে ঠিক ততটাই করি গঞ্জনা। নিজেদের মূল্যবোধ ছাড়া আর কোনো মূল্যবোধকে মূল্যবান মনে করি না। প্রবীণের সঙ্গে নবীনের যে সংঘাত ঘটে এসেছে যুগে যুগে ঘরে ঘরে, তার মূল কারণটাই এখানে।

আমার সমসাময়িক বৃদ্ধরা বর্তমান যুগের অবক্ষয়ের কথা ভেবে নিজেরাই ক্ষয় হয়ে যাচ্ছেন। এমন কোনো বিষয় নেই বর্তমান জগতে যাতে তারা নৈতিক বা আত্মিক অবক্ষয় দেখেন না। পোশাক আশাক থেকে শুরু করে আহারবিহার চলনবলন আচার আচরণ কোনকিছুই তাদের ভালো লাগে না। ত্রিশ চল্লিশ বছর আগে ইংরেজির Gay শব্দটির অর্থ ছিল হাসিখুশি, আনন্দোচ্ছল। স্কুলে থাকাকালে আমি প্রায়ই ব্যবহার করতাম শব্দটি। এখন ‘গে’ শোনামাত্র আমাদের গায়ের রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে যায়। এযুগের ‘গে’র সঙ্গে হাসিখুশির কোন সম্পর্ক নেই, আছে শরমের সম্পর্ক। গে মানে, ছিঃ, উচ্চারণ করতেও জিভে আটকায়। পশ্চিমে এখন তাদেরই জয়জয়কার। তারা রাস্তায় প্যারেড করে, গে-দিবস পালন করে, গে নেতারা ভোটে পাশ করে সংসদে যায়। কোন কোন দেশে গে আর লেজবিয়ানদের বিবাহ ব্যবস্থাটি আইনের স্বীকৃতি পেয়েছে। আমাদের মতো হার্টের রোগী, রক্তচাপগ্রস্ত বুড়োদের মনের অবস্থা কল্পনা করুন একবার। একেতো শরমে মরার কথা, তার ওপর জাতধর্ম সবই জলাঞ্জলি। অথচ দেখুন আধুনিক বিজ্ঞানের প্রতি চোখকান খোলা রেখে একটু যদি ভাববার চেষ্টা করতাম তাহলে হয়তো বুঝতে পারতাম যে আমরা যাকে যুগ যুগ ধরে চারিত্রিক বিকৃতি বলে গণ্য করে এসেছি আসলে তা বিকৃতি না হয়ে প্রাকৃতিক জৈবপ্রকৃতিও হতে পারে। চোখকান খোলা থাকলে আমরা দেখতে পেতাম যে জীবজগতের স্বাভাবিক প্রকৃতি প্রজননশীলতা হলেও প্রজননবিমুখ সমকাম প্রবণতার ঘটনাও নেহাত নগণ্য নয়। মানবসমাজে এ-প্রবণতা যে গোড়া থেকেই ছিল তার প্রমাণ তো ধর্মগ্রন্থগুলোই। তা নাহলে সব ধর্মেই এর বিরুদ্ধে এত হুঁশিয়ার বাণী থাকবে কেন। ধর্মের যুগে প্রকৃতির অনেক্ রহস্যই ছিল জ্ঞানের বাইরে, তাই সমকামকে দণ্ডণীয় অপরাধ বলে গণ্য করতে কারো বিবেকে বাধেনি। আজকের বিজ্ঞানযুগে সেসব বিব্রতকর তথ্য একে একে উদ্ঘাটিত হতে শুরু করেছে। নতুন যুগের বিজ্ঞানমনস্ক, মুক্তবুদ্ধির ছেলেমেয়েরা সেটাকে সহজেই গ্রহণ করতে পারছে, যা আমার যুগের লোকেরা পারছে না। এবং পারছে না বলে নিজেরা তিলে তিলে ভুগছে, জ্বলছে, ক্ষয় হচ্ছে।

আমার এক প্রিয় বন্ধু আছেন যিনি বর্তমান যুগের আরেক প্রকার ‘বিকৃতি’ নিয়ে মহাচিন্তিত। সেটা হল ব্যাকরণ– বাংলা-ইংরেজি দুটোই। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের লেখাজোকা দেখামাত্র তাঁর রক্তচাপ বেড়ে যায়। ওদের বানানবিকৃতির ওপরই তাঁর সবচেয়ে বেশি রাগ। আজকালকার ছেলেমেয়েদের অনেকেই I কে i, You কে u, Are কে r, wait কে 8, for কে 4, to কে 2 লেখে। বাংলার অবস্থা তত শোচনীয় নয়, সম্ভবত বাংলা কিবোর্ড এখনও চালু হয় নি বলে। কিন্তু বন্ধুর মতে বিকৃতির বিষ সেখানেও ঢুকেছে। যে যেভাবে পারছে সেভাবেই লিখছে। চরম অরাজকতা। একজন লিখছে স আরেকজন লিখছে ষ, আরো একজন শ। আর ই-কার ঈ-কারে তালগোল পাকিয়ে দেওয়া তো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। উ-কার আর ঊ-কারের একই দশা। ন আর ণ এর ঝগড়া কি বন্ধ হবে কোনোদিন? আমার বন্ধুটি হলেন বাংলা বানানের দারোগাবাবু। সে তুলনায় আমি নেহাতই চৌকিদার। তিনি ণ তে ন দেখলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন, আমি ‘আণ্ডা’ কে মাঝে মাঝে ‘আন্ডা’ বানিয়ে ফেলি। তিনি যত্রতত্র সংকটের ‘আভাষ’ দেখেন, আমি তার সামান্য ‘আভাস’ পেয়ে হই তটস্থ। বানানের ব্যাপারে আমিও যথেষ্ট সচেতন, তবুও তাঁকে তুষ্ট করা শক্ত। আমার মতে এগুলো যুগের বিকার। সব যুগেই ঘটেছে, ভবিষ্যতেও ঘটবে। আমরা যেন ভুলে না যাই যে বানান জিনিসটা মানুষেরই তৈরি। যুগের সঙ্গে মানুষ বদলায়, এবং মানুষের সঙ্গে বানান বদলাবে, তাতে আশ্চর্য, ক্ষুব্ধ, বা উদ্বিগ্ন হবার কারণ নেই। ইংরেজির আদিগুরু সেক্সপিয়র যে বানান বা শব্দশৈলী ব্যবহার করতেন এখনকার ইংরেজি তা নয়। বাংলায় বিদ্যাসাগরীয় যুগ অনেক আগেই পার হয়ে গেছে। যুগের চলমানতাকে মেনে নিলেই শান্তি। ভাষাই বলুন আর আচারই বলুন, বিকার যা ঘটে ক্ষণে ক্ষণে তা নিজেকে শুধরে নেয়। পশ্চিমে তার বহু উদাহরণ আমি নিজে দেখেছি। ‘৬০ এর উন্মাদনা ‘৭০ এ ছিল না। ‘৯০ এর বাড়াবাড়ি নতুন শতাব্দীতে এসে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে খানিক। পরিবর্তনই হল সর্বযুগের সর্বস্বীকৃত সত্য। সব পরিবর্তনই হয়তো হিতকর নয়, যদিও হিতাহিতের সংজ্ঞাটিও পরিবর্তনসাপেক্ষ। এই বিষয়গুলো নতুন যুগের ছেলেমেয়েরা যতটা বোঝে, আমরা বুড়োরা ততটা বুঝিনা। সংসারের অধিকাংশ বৃদ্ধই রক্ষণশীল। অবশ্য রক্ষণশীল মানুষ মাত্রই বুড়ো নয়। জন্মতেই রক্ষণশীল এমন মানুষের সংখ্যাই বোধ হয় আনুপাতিকভাবে বেশি। আমি তাদের বলি জন্মবৃদ্ধ।

আমি নিজে জন্মবৃদ্ধ কিনা তার বিচার স্বভাবতই আমার নয়। আমার বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে অনেকেই জানি যৌবনে বিদ্রোহী ছিল, প্রৌঢ়ত্বে রক্ষণশীল, বার্ধক্যে একেবারেই প্রাচীনপন্থী। দুয়েকজন আছে যারা স্কুলবয়স থেকেই বাম রাজনীতি করত, রীতিমত বিপ্লবী ছিল একসময়, জেলটেলও খেটেছিল, এখন তারা হয়ে গেছে শশ্রুগুম্ফসুশোভিত হুজুর-মওলানা-হাজী। আমার গতিটা ঠিক তার বিপরীত। যৌবনেই আমি বরং ছিলাম রক্ষণশীল, সাতে নেই পাঁচে নেই গোছের ভীরু বাঙালি। তারপর দেশবিদেশ ঘুরে শুরু হল আমার আভ্যন্তরীণ পরিবর্তন। পুরনো বাক্সপ্যাটরা এখন প্রায় নেই বললেই চলে। মন কতটা খুলেছে সেটা শুধু মনের মানুষেরাই জানবে, কিন্তু চিন্তার দরজাটি আমি সবসময়ই খোলা রাখবার চেষ্টা করি।

ক্যালিফোর্নিয়ায় ছেলের বাড়িতে বেড়াতে এসে এবার এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হল আমার। ছোট ছেলেও এসেছিল যোগ দিতে। অনেকদিন পর দুই ছেলেকে একসাথে পেলাম। সেটিও এক অভিজ্ঞতা বটে। তবে আসল অভিজ্ঞতাটি অন্যরকম। বৌমা সোফিয়া কাউকে না জানিয়ে এক ইরানী রেস্টুরেন্টে একটা টেবিল বুক করে ফেলল তিনজনের জন্যে– বাপ আর দুই ছেলে। আইডিয়াটা চমৎকার। এ যেন নিজের অতীতের সঙ্গে ডেটিংয়ে বের হওয়া। পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগে আমরা তিনটিতে মিলে ঠিক এমনি করে নানা জায়গায় গিয়েছি– খেলার মাঠ, বার্ষিক মেলা, মুভি, স্কেটিং রিঙ্ক। অনেক অনেকদিন হল তিন বাপে ছেলেতে একসাথে মিলে কিছু করি নি। রেস্টুরেন্টে গিয়ে একটেবিলে বসে খাওয়া, আমার বয়সে এক বিরাট ভাগ্য। তবে সোফিয়ার পেটে আরো এক কূটবুদ্ধি ছিল। রেস্টুরেন্টটাতে প্রতি সপ্তাহে দু’রাত বেলিডান্সের আয়োজন হয়– শুক্র ও শনিবার। এবং আমাদের বুকিংটা ছিল শুক্রবার। ব্যাপারটা বুঝতেই পারছেন। আমি এবং আমার দু’টি প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে। এবং আমাদের সামনে উন্মুক্তউদর একটি জলজ্যান্ত যুবতী কোমর দুলিয়ে নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে নৃত্য পরিবেশন করছে। দৃশ্যটা কল্পনা করুন। আমি, একটি রক্ষণশীল বাঙালি মুসলিম পরিবারের বর্ষীয়ান পিতামহ। আমার হাতে থাকা উচিত পবিত্র কোরাণের মহান বাণীখচিত ঐশী জপমালা। নারীদেহের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশের সঙ্গে আমার চর্মচক্ষুর মিলন ঘটলে একশ হাজারবার তৌবা পড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করার কথা আমার। সেজায়গায় আমার চোখের সামনে দণ্ডায়মান জাহান্নামের এক কুহকিনী নারী, যার অর্ধ অনাবৃত দেহের লীলাময় হাস্যমদিরাতে সয়লাব হয়ে যাচ্ছি আমি আপন ঔরশজাত দুই পুত্র সমভিব্যাহারে, কাল্পনিক দৃশ্যটা মনের ভেতরে নাট্যরূপ ধারণ করে পরম কৌতুকের বিষয় হয়ে উঠল।

রেস্টুরেন্টের নাম ‘বাইজান’। খাবার দাবার বেশ ভালই লাগল। আরো ভাল লাগল তাদের ভদ্র, নম্র, মার্জিত ব্যবহার। মেয়েগুলির হাসিখুশি চেহারাতে অতিথিদের মন কেড়ে নেবার আন্তরিক প্রচেষ্টা কারো দৃষ্টি এড়ায় নি। আমাদের বাংলাদেশী রেস্টুরেন্টগুলোর কাষ্ঠপুত্তলিকাসম পরিচারকদের শীতল গাম্ভীর্যের সঙ্গে তুলনা করে মনটা খারাপ হয়ে গেল একটু। একটি সুসজ্জিত সুদর্শন ইরানী-আমেরিকান ছেলে আমাদের মেনু দিয়ে গেল। একটি মেয়ে নিয়ে এল এপেটাইজারের গোলাকার থালাখানি। আমরা অর্ডার দিলাম। খাওয়াদাওয়ার মাঝখানে সজোরে বাদ্য বেজে উঠল নেপথ্যে। এল পাখোয়াজের শব্দ, বীণার ঝঙ্কার, ঘুঙুরের দৃপ্ত ঝঞ্ঝনা। বাদ্যের তালে তালে আমরা চলে গেলাম ফেরদৌস আর মির্জা গালিবের স্বপ্নরাজ্যে। নর্তকী এল স্বর্ণরৌপ্য চুমকিখচিত বিচিত্র পোশাকে, ঘূর্ণিতে ঘূর্ণিতে আবর্তিত হতে হতে। আমার মনে পড়ল পঞ্চাশ বছর আগেকার অনুরূপ আরেকটি দৃশ্যের কথা। সুয়েজ খাল যেখানে মিলেছে ভূমধ্যসাগরে সেই নীল জলের ধারে স্বপ্নিল বন্দর পোর্ট সায়িদ। বিলতগামী জাহাজের আনাড়ি যাত্রী আমি, নবলব্ধ পাকিস্তানী বন্ধুদের মন্ত্রণাতে নাইটক্লাবে ঢুকেছি বেলিডান্স দেখব বলে। আমার জীবনের প্রথম ও শেষ নাইটক্লাব। তার পঞ্চাশ বছর পর আমারই পরম আদরের পুত্রবধূর চতুর চক্রান্তে দ্বিতীয়বার সেই নর্তকীর মুখোমুখি হুওয়া। কত অদ্ভুত চিন্তা সমুদ্রগামী জাহাজের মতোই বিপুল ঢেউয়ের ওপর দোল খেয়ে গেল। ‘৫৬ সালের নর্তকী আমার সদ্যমুক্তিপ্রাপ্ত তরুণ শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। আজকে আমার গায়ে সেই আগুন নেই, আছে শুধু তার বিবর্ণ ভস্মটুকু। আজকে আমি শতাব্দীর স্মৃতি আর ক্লান্তি বয়ে এক বন্দর থেকে আরেক বন্দরে যাচ্ছি নৈশবিহারের সন্ধানে নয়, নৈশনিদ্রার খোঁজে। আমার ছেলেরা ছবি তুলল, সেই নাচিয়ে মেয়েটিকে কাছে দাঁড় করিয়ে। মেয়েটি হাসল, আমিও হাসলাম। একদিন যা ছিল গাঢ় নিঃশ্বাসের বাষ্প দিয়ে মোড়া আজকে তাই হয়েছে নির্জলা কৌতুকের বস্তু। জীবনের সকল রূঢ় পরিহাস, সকল নিমগ্ন বিড়ম্বনা, বিপুল আমোদের বিষয় হয়ে দাঁড়ালো আমার কাছে। আমার বয়সের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা অনেকটা সেরকমই হাসিঠাট্টার। ও আমাকে নিয়ে হাসে, আমি বয়সকে মুখ ভেংচিয়ে হাসি। একে অন্যের প্রতিপক্ষ ও প্রতিবিম্ব, একই সাথে। ‘৫৬ সালে মেয়েটির গায়ের চামড়াই কেবল দেখতে পেরেছিলাম আমি, যেমন করে আজকের এই মেয়েটি হয়তো দেখছে আমার দুমড়ানো মোচড়ানো চামড়া। চামড়া ভেদ করে অন্তরে ঢুকবার ক্ষমতা যে কেন বিধাতা দেন না আমাদের অন্তের সন্নিকটে পৌঁছানোর আগে, জানি না।

আমাকে অনেকে অভিনন্দন জানায় বয়সটাকে মোটামুটি পোষ মানাতে পারছি বলে। আসলে কি জানেন? পোষটোষ কিছু নয়, সবই ভাগ্য। যদিও ভাগ্য বলে কোনো জিনিসের অস্তিত্ব আমি মানি না। ভাগ্যকে আমি বলি অঙ্কের প্রবাবিলিটি। অর্থাৎ বয়সের ব্যাপারে আমার নিজের কোনও কৃতিত্ব নেই, কৃতিত্ব হল প্রবাবিলিটি শাস্ত্রের। তবে একটা কথা আমি জানি। বুড়ো হলেই যে নিজেকে বুড়ো ভাবতে হবে তার কোনোও অর্থ নেই। সেদিক থেকে বার্ধক্যটা আসলেই মানসিক। বৃদ্ধ আমি তাকেই বলি যার মনে, শীতঋতুর প্রথম তুষারপাতের পর, আনন্দে আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে কারো প্রতি তুষারের বল ছোড়ার অদম্য স্পৃহা জেগে ওঠে না। বৃদ্ধ আমি তাকেই বলি যার ইচ্ছা হয় না বৃষ্টির শব্দ শুনে জানালায় গিয়ে দাঁড়াতে। বৃদ্ধ হল সেই ব্যক্তি যে সমুদ্রতীরের বালুতটে খালিপায়ে হাঁটতে চায় না, বা ছোটদের মতো ঝিনুক কুড়ানোর পাগলামিতে মেতে ওঠে না। বৃদ্ধ হল সেই হতভাগ্য যে ইরানী রেস্টুরেন্টের নর্তকী দেখে চোখ বুঁজে থাকে পরকালের ভয়ে।

ফ্রিমন্ট, ক্যালিফোর্নিয়া
ডিসেম্বর ১৯, ২০০৬,
মুক্তিসন ৩৫

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top