পিয়াস মজিদের কবিতা ও কবিতা ভাবনা

আগুনের আল্পনা

আমি কোথায়
আমারই অশরীরী আল্পনায়
রোদের তীব্র ছায়া ভেসে যায়।
কত পরি পেরিয়ে
জন্মসনদের খোঁজে
গেছি তোমার মায়ামর্গে;
সেখানে লেখা হয়ে আছে
কবির কফিন;
তার ধূপশব্দ আর ছন্দ।
তারার পাতাল থেকে
যাকে ডুবিয়ে মারে
দিগন্তের নীচুনীল নাব্যতা।।
গনগনে গদ্যকবিতায়ও
তার ভেতর উপচে পড়ে
সুরের সওগাত;
গানের মিনার থেকে
নাচের বাগান–
এক রাক্ষসনন্দন স্বর্গগুলজারের শাপগ্রস্ত
দিশা দেখায়।
নরকের অভিজ্ঞানছাড়া
মরে যাবার দুঃখে
বেঁচে থাকার বনে বনে
তীব্র তরুতীর্থ৷
হাওয়ার হর্ম্যে
কে পায়
শাখার শব্দ, বৃক্ষদুঃখ!
এমনি বহু বুড়ো বটের নীচে
পৃথিবী এক সাপ্তাহিক হাট
কেনাবেচা দরদাম;
লাগবে নাকি
মনের মেঘের গোরস্তান
প্রাণের পইখ?
আর আছে ঘামের গ্রামার।
বাড়ি ফিরলাম,
থলেভর্তি মনোহারি ;
কীইবা আছে–
ইতরসাধারণ অথবা বিশেষ!
প্রেমিকা রত্নের কাদা
অনামিকার আগুন
দাউদাউ দহ
খুঁজে পায়
হাতের ছাইসিক্ত
বাকিসব আঙুল।
পুড়ে গিয়ে বেঁচে যাওয়া
পায়ের পাতায় সমবেত
ফেরারি ফৌজ
নোঙর
বন্দর।
এমন নাটমঞ্চের
কোন অঙ্কে, কোন দৃশ্যে
কুলোয় ঝাড়া হয়
স্বপ্নের স্বায়ু,
ভিক্ষার চালডাল আর
আমাদের আকাড়া আয়ু!

 

কবিতা মূলত

কবিতা এক কালোবর্ণ কুহক। বিষয় ও আঙ্গিক জেনে, ভাষার ওপর দখল নিয়েও এ কুহক চূর্ণ করা যায় বলে মনে হয় না। সারা জীবন কবিতা লিখেও এ কুহকের শেষ দেখা যায় না। অধরা মাধুরী যেন। যিনি কবি, তার উপর সেই কবিতাদেবীর জন্ম-জন্মান্তরের দণ্ডাজ্ঞা। এ দণ্ড থেকে, দায় থেকে তার মুক্তি নেই। রক্তাক্ত ও দণ্ডিত হওয়াই তার নিয়তি। আমি কবিতা লিখি; না লিখে পারি না বলে। নিজেকে নিজের কাছে, কাগজের সাদার কাছে প্রকাশের এমন সহজতম, দুরূহতম পদ্ধতি আর নেই। প্রেম-প্রত্যাখ্যান-দেশ-কাল-পুষ্প-বৃক্ষ-বিহঙ্গ সবই আমার কবিতার প্রেক্ষায় থাকে। বলা যায়, এদের প্ররোচনাই জন্ম দেয় এক একটি শব্দের, লাইনের এবং গোটা একটি কবিতার। যেন এক লঘু-ডানা অরণ্যের পরি।

গরলভরা গান গাইতে পারে একমাত্র কবি। বিষ-সুরের স্বত্ব তারই, রক্তাক্ত হবার জন্য যে প্রতীক্ষা করতে জানে। মৃত্যুরে লভে অমৃত করি। কবি। দু’ অক্ষরের শব্দ, এক শব্দ থেকে আরেক শব্দের মাঝামাঝি ভূমধ্যসাগর, আগ্নেয়গিরি, কুসুম কিংবা কর্দমের ডাঁই। বোবার স্বরে কবি বলে যে অন্ধরাই সঠিক পথ চেনে, শ্রবণ বধির করে সে টের পায় শত শত শূকরের চিৎকার, শত শত শূকরীর প্রসববেদনা, সহস্র সমাধির শ্বাস, উপমা, রূপক, উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প, ছন্দ, ছন্দহীনতা এভাবে পৃথিবীর এই আদিমতম রসায়নে পড়ে পান্না হয় সবুজ। পুরুরবা হয় যযাতি, যযাতি হয় পুররবা। রাত্রি ভোর হয়ে যায় বন্দির বন্দনায়। যীশুর মত গামলায় যুগপৎ জন্ম আর মৃত্যু ঘটে স্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যতের। এদের কাউকে কেঁদেও পাওয়া যায় না বর্ষার অজস্র জলধারে। কবিতা। হেরেমে বন্দি রাজকন্যা, কিন্তু কেমন গেরস্ত-মেয়ের মত কয় ‘কবুল, কবুল’! কবিতা। হলুদ নদীতে চন্দ্রের আলিঙ্গন। বাতাসে কীসের গন্ধ আর ফুলের হাহাকার। সোনালি তারাদের সানন্দ শহীদান। স্বর্গ সহজলভ্য, কিন্তু জীবৎকালে নরকে ঋতু যাপনের অভিজ্ঞতা কেবল কবিরই। উদ্যাপন করে সে এলিজির অনুপম আনন্দ। ছোট্ট ঘাসফুলের জন্যে সে মরে যেতে পারে। কখনোবা সামান্য মাছকে ঈর্ষা করে শুধায় ‘মাছ তুমি চলেছ কোথায়?’ অথচ কবির সমস্ত গন্তব্যে তালা ঝুলছে, তবু হে মাধবী, তবু হে দ্বিধা, ব্যর্থতা জিন্দাবাদ। পেয়ে গেলেই তো ফুরিয়ে গেল। জলকে ভয় তার, তাই সতত তৃষ্ণা অন্বেষী। কবিতা। ভাঙা দেউল, বাসি বেলপাতা, অসুরের আরাধনা। সারা শীতকালজুড়ে একটিও ঝরাপাতা নেই, শুধু হেমন্তক্বাসিদায় ভরা মাঠ। রাহুর শ্রী জাজ্বল্য, বাকি কিছু ধূসর-বাসর। সমস্ত সিডার বৃক্ষ পতিত হইয়াছে। আমরা আবার তাহা নতুন করিয়া রোপণ করিব। বাইবেল এমত বলিলেও আমাদের রক্তে নিরন্তর পতনের প্ররোচনা। কবিতা। উড়ন্ত বিহঙ্গের পতিত কাকলি, মালঞ্চের শত্রু; কিছু দিকভ্রষ্ট ফুল, তোমরা যে যার সিঁড়ি পেয়ে গেছে, উপরে ওঠার, বাঁয়ে কিংবা ডানে যাবার, একলা কবি বিভ্রান্তির রাজসভায়। এইমাত্র তার অভিজ্ঞান হলো যে কবিতা মূলত সর্বনাশপন্থিদের আখড়া।

 

 

পিয়াস মজিদ

পিয়াস মজিদ সমকালীন বাংলা কবিতায় অন্যতম তরুণ কবি। কবিতার পাশাপাশি গদ্যেও পারদর্শী। সাহিত্যের নানা শাখায় ইতোমধ্যেই নিজের মেধা-মননের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর জন্ম ১৯৮৪ সালের ২১ ডিসেম্বর, চট্টগ্রামে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে কাজ করছেন বাংলা একাডেমিতে।
কবিতার ও অন্যান বই: নাচপ্রতিমার লাশ, মারবেল ফলের মওসুম, গোধুলিগুচ্ছ, কুয়াশা ক্যাফে, নিঝুম মল্লার, প্রেমপিয়ানু, ক্ষুধা ও রেস্তোরাঁর প্রতিবেশী, নক্ষত্রের নিশ্বাস, বসন্ত কোকিলের কর্তব্য, গোলাপের নহবত। এছাড়াও তার রয়েছে বেশ কয়েকটি গদ্য, সাক্ষাৎকার ও গবেষণাবই।

পুরস্কার ও সম্মাননা: এইচএসবিসি-কালি ও কলম পুরস্কার ২০১২, কলকাতার আদম লিটল ম্যাগাজিন প্রদত্ত তরুণ কবি সম্মাননা ২০১৬, সিটি-আনন্দ আলো পুরস্কার ২০১৬, শ্রীপুর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার ২০১৬, দাঁড়াবার জায়গা সাহিত্য পুরস্কার ২০১৭, কলকাতা। ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার ২০১৮, ইতিকথা সাহিত্য সম্মাননা ২০১৯।
এছাড়াও, ২০১৫-তে আমন্ত্রিত হয়ে অংশ নিয়েছেন চীনে অনুষ্ঠিত চীন-দক্ষিণ এশিয়া-দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া লেখক সম্মেলনে।

Facebook Comments

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top