রাইনুসুকে আকুতাগাওয়ার দুটি ছোটগল্প

[রাইনুসুকে আকুতাগাওয়া (১৮৯২-১৯২৭) একজন বিখ্যাত জাপানি লেখক। তাকে জাপানি ছোটগল্পের জনক বলা হয়।  লেখালেখির ক্ষেত্রে তার বৈশ্বিক চিন্তাভাবনা চোখে পড়ার মত। জাপানি সংস্কৃতিকে সাহিত্যের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে তিনি ছিলেন বদ্ধপরিকর। ১৯২৭ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন তিনি। সেনজো এবং আঁতুড়ঘর তার দুটি ভিন্নস্বাদের গল্প।]

 

সেনজো*

বহু বছর আগে চীনদেশের শহরতলিতে এক ছাত্র রাষ্ট্রীয় পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য একা বসবাস করছিল। প্রতিদিন সে জানালার পাশে বসে পড়ত আর অবসর সময়টা তার সমসাময়িক অন্য মানুষদের মতই উঠানের মাঝখানে থাকা পিচ গাছের ফুলের দিকে তাকিয়ে ভাবতে ভাবতেই পার করে দিত। তার বাড়ির সামনের দিকে একটি বাড়িই কেবল দেখা যেত। সেখানে সে এক অপূর্ব সুন্দরী মেয়েকে প্রতিদিন ঘরোয়া কাজ করতে দেখত আর মনে মনে ভাবত যে মেয়েটি কে। মেয়েটিও সম্ভবত একাই থাকত। শহরের কেউ মেয়েটি বা তার পরিবার সম্পর্কে, এমনকি তারা কোত্থেকে এসেছে সে ব্যাপারেও কিছুই জানত না।

পুরো একটা দিন পড়ার পর, বসন্তের এক পড়ন্ত বিকেলে, ছাত্রটি ঘর ছেড়ে উঠোনে এসে দাঁড়াল, শরীরের আড়মোড়া ভাঙার জন্য। ঠিক তখনি বাগানের পাখির ডাকের সাথে সাথে সামনের বাড়িটি থেকে এক ক্ষিপ্ত চিৎকার ভেসে এল। বীরত্ব দেখাবার এটাই সুযোগ মনে করে ছাত্রটি গেট দিয়ে দ্রুতবেগে বেরিয়ে নায়কের মত দৌড়ে চলল মেয়েটির বাড়ির রাস্তার পথ ধরে। সেখানে সে তার প্রতিবেশিনীর দেখা পেল, একটা পরীর মত মেয়ে। মেয়েটি বেঞ্চের ওপর বসা এক দশাসই চেহারার চুল পেকে যাওয়া কাঠুরেকে ঝাঁকি দিচ্ছিল এবং লোকটির মাথার পেছনে চড় মারছিল। মেয়েটির ভ্রু রাগে তীক্ষ্ণ হয়ে কুঁচকে যাচ্ছিল। কাঠুরেটি আকারে মেয়েটির প্রায় দ্বিগুণ হয়েও তার সামনে এমন নম্র আর কাঁচুমাচু হয়ে বসে ছিল যেন মেয়েটি কোন দৈত্য। আশ্চর্য হয়ে ছেলেটি দৌড়ে গিয়ে মেয়েটির হাত চেপে ধরল।

“ওনাকে মারছ কেন? তোমার লজ্জা হওয়া উচিত, একজন বৃদ্ধ মানুষ সে।”
“বৃদ্ধ?! হুহ! এই মন্দবুদ্ধিটা আমার চেয়েও ছোট, একটা বাচ্চাই বলা চলে।”
“তুমি মিথ্যে বলছ।”
“না বলছিনা। আমি ওর মা, তুমি দেখতে পাচ্ছনা?”
ছাত্রটি ভয় পেয়ে গেল। মেয়েটির হাত ছেড়ে দিয়ে সে এবার তার মুখের দিকে ভালো করে তাকাল। তার প্রতিবেশিনী কাছে থেকেও ঠিক ততটাই সুন্দর যতটা দূর থেকে। যদিও সে খেয়াল করল যে মেয়েটির চেহারায় এক ব্যতিক্রমী লালিত্য আছে আর সে চোখের পাতা ফেলছেনা।
“হ্যাঁ, আমার এই ছেলেটি অকর্মা।” মেয়েটি কটমট করে বলল। “একটা লজ্জা, ঝামেলা তৈরি করাই ওর একমাত্র কাজ। কোন কথা শোনেনা আর স্বার্থপরও। বয়স কম হলেও ওর আরও বেশি বুদ্ধি রাখা উচিত।”
“কিন্তু ওর বয়স কত? ওকে দেখলে মনে হয় ওর সত্তরের ঘরে বয়স, কমপক্ষে। যদি ও তোমার ছেলে হয়, তাহলে তোমার বয়স কত?”
“আমার বয়স তিন হাজার ছয়শ বছর।”

ছাত্রটি বুঝতে পারল যে তার প্রতিবেশিনী মানুষ নয়, একজন সেনজো। মুহূর্তেই তার চোখের সামনে বিরক্তমুখে সে অদৃশ্য হয়ে গেল আর পেছনে বসন্তের স্বচ্ছ সূর্যাস্তের সাথে ফেলে গেল পাকা চুলের কাঠুরেটিকে।

*সেনজো: এক ধরনের বিশেষ সেনিন বা জাপানি ভাষায় মহিলা জ্বীন।

 

আঁতুড়ঘর

এক লোক তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর আঁতুড়ঘরের জন্য নদীর ধার থেকে নলখাগড়া ছেঁটে এনে ছাউনি বুনছিল। যখন ঘর তৈরি হয়ে গেল, সে তার স্ত্রীকে সেখানে রেখে নদীর ধারে ফিরে এল। সে নলখাগড়ার বনে হাঁটু গেড়ে বসে অপেক্ষা করতে লাগল এবং দেবী আমাতেরসুর কাছে মা ও সন্তানের সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করতে লাগল। সূর্যাস্তের সময় তার স্ত্রী তার সামনে এসে বলল, “সাত দিন পর ফিরে এসো, তারপরেই তোমায় আমি আমাদের সন্তানকে দেখাব।”

লোকটি তার সন্তানকে সেই মুহূর্তেই দেখার জন্য উদ্গ্রীব ছিল কিন্তু সন্তানের মায়ের কথায় রাজি হলো। রাতে সে নিঃসঙ্গ এবং ক্ষুধার্ত বোধ করায় ডিঙি খুলে দাঁড় বেয়ে গ্রামে ফিরে এল।

ঘরে ফিরে সাতদিন অপেক্ষা করার চিন্তামাত্রই অত্যাচার মনে হতে লাগল তার। তার একটি মালা ছিল যেটায় সাতটি রত্ন গাঁথা ছিল। মনকে প্রবোধ দেয়ার জন্য সে ঠিক করল প্রতিদিনের শেষে সে একটি করে রত্ন মালা থেকে খুলে ফেলবে এবং এভাবেই সময় কাটাবে। সূর্য উঠল, অস্তও গেল, তখন সে একটি রত্ন বের করে অন্য একটি মালায় গেঁথে রাখল। এভাবে দিন যেতে লাগল।

ষষ্ঠ দিনে সে আর ধৈর্য রাখতে পারল না। রাতের বেলা সে নদীতে ডিঙি বেয়ে ওপারে গেল। নলখাগড়ার বনে ডিঙি বেঁধে সে কুঁড়ের দিকে চলল। ঘরটা এত নিরিবিলি ছিল যেন প্রাণহীন । শুধুমাত্র শরতের প্রাণবন্ত নলখাগড়ার ঘ্রাণ ছাদ থেকে তার নাকে ভেসে আসছিল। ভেতরে না ঢুকে হালকাভাবে লোকটি অন্ধকারে দরজা খুলল। ঘরের একপাশে খড়ের বিছানায় সে একটা হালকা ঘষাঘষির আওয়াজ শুনতে পেল। সে দেখার জন্য তার মাথাটা ভেতরে ঢোকাল। তার স্ত্রী সেখানে ছিল না, তাই লোকটি ঢুকল এবং যত আস্তে সে দরজা খুলেছিল তার থেকেও আস্তে বিছানার কাছে গিয়ে দাড়াল। সেখানে সে এমন এক রক্ত হিম করা চিৎকার দিল যা নলখাগড়ার বন কাঁপিয়ে গ্রাম অব্দি পৌঁছে গেল। তার এহেন প্রতিক্রিয়ার কারণ যৌক্তিক ছিল। তার স্ত্রী জন্ম দিয়েছিল সাতটি দাঁড়াশ সাপকে।

সাপগুলোকে দেখে ওই বাবার যেমন লেগেছিল, নিজের হাতের লেখা দেখলে আমারও ঠিক তেমনই লাগে।

 

দিলশাদ চৌধুরী

জন্ম ১৯৯৯ সালের ২৭ এপ্রিল, বরিশালে। প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেছেন বরিশালেই। বর্তমানে পড়াশোনা করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগে সম্মান তৃতীয় বর্ষে। বাংলা সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ ছোটবেলা থেকেই কিন্তু বিশ্বসাহিত্যের চাবিকাঠির সন্ধান পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায়। কাজ করছেন অণুগল্প, ছোটগল্প এবং অনুবাদ নিয়ে। লেখালেখি নিয়েই ভবিষ্যতে এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা।

Facebook Comments

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top