বাড়ির পেছনের ডেকে অনেকদিন পর বেরিয়ে খুব আরাম পায় খোকা । করোনা ভাইরাস এর দরুণ আজ প্রায় দু মাস গৃহবন্দী। তার ওপর গত এক সপ্তাহে লাগাতার বৃষ্টি, মেঘলা, আর ঠান্ডা লেগেই ছিল। হাঁটাও হয় নি; বাড়ি থেকে বেরোতেই পারে নি। আজ অবশ্য খুব সুন্দর রোদ উঠেছে। সেই যে একরকম রোদ আছে যা আলতো করে গাছের পাতার কিনারে লেগে চিক চিক করে ওঠে। একটা স্নিগ্ধ আলো, যার স্পর্শে শরীর মন সব হয়ে ওঠে সতেজ, ঠিক সেই রকম রোদ, নরম, মোলায়েম, আরামের রোদ; চোখ বুজে দাঁড়িয়ে বুক ভরা নিঃশ্বাস নেবার মত রোদ । বাড়ির পেছনদিকের ঘন গাছপালার মধ্যে দিয়ে সেই রোদ এসে পড়ছে চোখে মুখে। সারা দিন নানা মিটিং শেষ করে বিকেলে ডেকে বেরিয়ে খুব আরামের একটা “আঃ ” ছেড়ে বুক ভরা নিঃশ্বাস নেয় খোকা। হাত,পা ঝাঁকিয়ে আড়মোড়া ভাঙে। একটা ভিজে, স্যাঁতস্যাঁতে, কর্মময়, ব্যস্ত সপ্তাহের শেষে দু দণ্ড উপভোগ করার মতো সুযোগে ছোট আকারের একটা খুশীও অনুভব করে।
পড়শীদের অবস্থা কতকটা খোকার মতই । বাড়িতে বন্দী ছিল তারাও। আজ অনেক দিন পরে সকলেই বাড়ির বাইরে নানারকম কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ডেকে দাঁড়িয়েই তাদের অনেককে দেখতে পায় খোকা। ওর ডান দিকে দুটো বাড়ি পরে একটা পরিবার কিছুদিন হলো নতুন এসেছে এই পাড়ায়। বাবা কৃষাঙ্গ আর মা চীন দেশীয়। তাদের ভারী মিষ্টি দুই মেয়ে। মাঝে মাঝে তারা ফুটপাথের ওপর সাইকেল চালিয়ে ঘোরে। খোকাদের বাড়ির দিকে উৎসাহী চোখে তাকায়। মাস কয়েক আগে, এক শনিবারের দুপুরে দরজার ঘন্টায় টুংটাং। দরজা খুলতেই দুই বোন কলকল করে ওঠে, “ক্যান ইওর চাইল্ড কাম এন্ড প্লে উইথ মি?” “সরি, আমার মেয়ে তো অনেক বড়, সে অন্য জায়গায় চাকরি করে।” কথাটা শুনে মুখ কাঁচু মাঁচু করে তড়িঘড়ি চলে গেছিলো মেয়ে দুটি। তারপর কয়েকবার খোকা ভেবেছে ওদের সঙ্গে ভাব জমাবে, হাত নেড়ে হেসেছে। ওরা কিন্তু কিরকম গম্ভীর চোখে তাকায়, ভাবটা যেন তোমার বাড়ি কোনো খেলার সাথী নেই তাই তোমার সাথে আড়ি। আজ অবশ্য একটা প্লাস্টিকের পুল’এ জল ভরে ভীষণ আনন্দে খেলা করছে দুই বোন। মাঝে মাঝেই চার বছরের লেসলি আর সাড়ে পাঁচের লিয়ার চিৎকার আর খিল খিল হাসি ছড়িয়ে পড়ছে পাড়াময়।
কাল রাতে মার সঙ্গে অনেক কথা হচ্ছিল খোকার । কলকাতার সকলেই লকডাউনে ঘরে বসা। একে করোনার সংখ্যা বেড়েই চলেছে তার ওপর আবার পলিটিকাল পার্টিদের কপচানি শুরু হয়ে গেছে। চিফ মিনিস্টার চেঁচাচ্ছে, প্রাইম মিনিস্টার চেঁচাচ্ছে, হোম মিনিস্টার চেঁচাচ্ছে। সকলে মিলে পাবলিকের টুঁটি টিপে ধরেছে, বলছে সোনার বাংলা তৈরী করব । কার বাংলা বেশি চমকাবে সেই নিয়ে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি চলছে। মানুষের পকেটে পয়সা নেই, ইনকাম নেই, কাজ নেই; তাদের চেপে ধরে সোনার বাংলা দেবেই দেবে। মার কাছ থেকে সকলের খবর নিচ্ছিলো খোকা, মামাদের, কাকুদের কথা; ঘরে ঘরে একই খবর, বয়েসী মানুষ সকলেই, নড়বড় করতে করতে কোনরকমে চলছে। কত দিন হয়ে গেছে মামাবাড়ি যায় নি খোকা। সেই মামা বাড়ি, ছোটবেলার গরমের ছুটি, শীতের ছুটি, পুজোর ছুটি, সব ছুটির স্মৃতি ছড়িয়ে আছে সেখানে। ছুটি হবার সাথে সাথেই মামাবাড়ি রওনা, একদম পুরো ছুটি কাটিয়ে ফেরত। কতকটা এখন যেমন কাটছে, চার দিকের জগৎ থেকে আলাদা হয়ে দিনের পর দিন ঘরের জগতে দিন কাটানো। সেটাও ছিল কতকটা সেইরকম, স্কুল, বাবা-মা, স্কুলের কাজ এই সব বাইরের জগৎ ফেলে রেখে মামাবাড়িতে কাটানো।
খোকার বাঁদিকের বাড়িতে থাকে ক্যাথিরা, আজ পঁচিশ বছরের ওপর আছে তারা। ওরাই এ পাড়ায় সব থেকে পুরনো। খোকারা যখন প্রথম এই বাড়িতে আসে তখন ওদের মেয়ে কেইলা ক্লাস থ্রীর ছাত্রী । সেই কেইলা আজ তার নিজের মেয়েকে নিয়ে বাবা-মার বাড়িতে দেখা করতে এসেছে। বাগানের মধ্যে চেয়ার পেতে ক্যাথি গায়ে তোয়ালে ঢেকে বসেছে, কেইলা চুল কেটে দিচ্ছে মা’র। আর নাতনি চুপটি করে দাঁড়িয়ে ঘাড় কাত করে মন দিয়ে দেখছে চুল কাটা । মাঝে মাঝে সামনে গিয়ে দেখছে, আবার ঘুরে গিয়ে পিছন থেকে দেখছে। কেইলা চুল কাটা থামিয়ে মেয়েকে জিগ্গেস করছে কেমন হচ্ছে, মেয়ে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে কোথায় সমান কোথায় অসমান। লম্বা মেপল গাছটার তলায়, রোদ ছায়ার মধ্যে তিন প্রজন্মের রোজকার জীবনের এই সহজ ছবি সুন্দর বিকেলটাকে খোকার জন্য আরও সুন্দর করে দিচ্ছে। দূরে এক বাড়ির গৃহিনী লম্বা হোস পাইপ দিয়ে ডেক ধুচ্ছে। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়া জলের ফোঁটাদের ওপর বিকেলের রোদ পড়ে রামধনুর রং ঝিলিক দিচ্ছে মাঝে মাঝে। শীত-বসন্তের ধুলো বালি ধুয়ে পরিষ্কার করে গ্রীষ্মের ধুলো বালির জায়গা করছে সে, আর সূর্যের আলো তার সোনালী চুলে লেগে চকচক করছে। আগের দিন হলে এই মানুষগুলোই আর একটু কাছাকাছি এসে দু চারটে কথা বলতো হয়তো, কিন্তু এই করোনার বাজারে সকলেই দূরে দূরে । শুধু দূর থেকে হাত নেড়ে অভিবাদন । যখন খোকা, মিতু আর মধুরা হাঁটতে যায় রোজ, দেখে অনেক লোকজন হাঁটছে কিন্তু দূর থেকে দেখতে পেলেই সকলে পাশে সরে যায়; ছ ফুট দূর। মানুষের চোখে মুখে সন্দেহ মাখানো সম্ভ্রম। পাশে সরে যাচ্ছি আবার নজর রাখছি ছ ফুট দূরত্ব আছে তো?
ডেকের পেছনের ঘন গাছের জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে ছিল খোকা একমনে। হঠাৎ ডান পাশ থেকে তীব্র ঘেউ ঘেঊ আওয়াজে, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। পুরো পারিবারিক পল্টন নিয়ে ওর ডান পাশের প্রতিবেশী সন মাঠে নেমে পড়েছে। সনকে খোকার খুব পছন্দ। অল্প বয়েসী ছেলে, ওর চেয়ে অন্তত পনেরো বছরের ছোট তো হবেই। খুব করিৎকর্মা । গাড়ির কোম্পানিতে ইঞ্জিনিয়ার; ভারতীয়দের মতো কাগজ কলমের ইঞ্জিনিয়ার নয়, সমস্ত কিছু নিজে হাতে করতে পারে, বাড়ি সারাই, গাড়ি সারাই, সব কিছু। কোনো কিছু খারাপ হলেই খোকা সন এর শরণাপন্ন হয়। উপায় কিছু একটা সবসময় বাতলে দেয় ছেলেটা ।খোকাকে দেখেই এক গাল হেসে হাত নাড়ে সন “হেই ম্যান হাউ ইজ ইট গোয়িং?” হাত নেড়ে “গুড গুড” বলে খোকা । সন এর খুব আদুরে একটা কুকুর, ক্রকার স্প্যানিয়েল, চেরি তার নাম; দেখতে ছোট খাটো হলে কি হবে, তেজ আছে খুব । সন এর তিন ছেলে মেয়ে, আট বছরের আনা, ছ বছরের সারা আর চার বছরের রায়ান। তারা যেরকম খেলার সরঞ্জাম নিয়ে নেমে পড়েছে বাগানে তাতে বোঝা যাচ্ছে যে এতোদিন বন্ধ থাকার ফলে বাচ্চাদের কি কষ্টেই কেটেছে। আজ তারা যেন বাঁধন ছাড়া পায়রা। প্লাস্টিকের নানা রকম বাসন পত্র, বালতি, পুতুল, বেস বল খেলার সরঞ্জাম, কি নেই তাদের সাথে। তাদের হৈ চৈ তে চেরিও উৎসাহে লাফালাফি, চেঁচামেচি কম করছে না।
খোকা হাসে। আনা আর সারা খুব হাত পা নেড়ে রায়ান কে কিছু একটা বোঝাবার চেষ্টা করছে, বালতিটা ওর হাতে দিয়ে কিছু একটা বলছে কিন্তু রায়ান ঘন ঘন মাথা নাড়ে । ওর এক হাতে প্লাস্টিকের বেসবল ব্যাট আর বলটা অন্য হাতে । আনাকে দেখে খোকার খুব নিতুদিদির মতো লাগে।নিতু দিদি খোকার চেয়ে ছ বছরের বড়। মাসতুতো দিদি ওর । খোকার মা-রা দুই বোন।খোকার মামাবাড়ি নিতুরও মামাবাড়ি। কিন্তু বাচ্চা বয়েস থেকে নিতুদিদি মামাবাড়িতে মানুষ।নিতুদিদি আরে চম্পামাসিই ছিল খোকার ছোটবেলার খেলার সাথী, প্রাণের বন্ধু। চম্পা মাসি খোকার মায়ের মাসতুতো বোন। সম্পর্কে মাসি হলেও খোকার চেয়ে মাত্র চার বছরের বড় চম্পা মাসি। মামাবাড়ির পাশেই ছিল চম্পা মাসিদের বাড়ি। ও যখন মামাবাড়িতে থাকতো তখন সকলেরই ছুটি। দুপুর বেলা বাড়ির সকলে যখন খেয়ে নিয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছে তখন একটু বই নিয়ে শুতে হতো সকলকেই । খুব ছোট বয়েসে যখন ভালো করে পড়তে পারে না তখন নিতু দিদি দুপুরে পড়ে দিতো শ্রী স্বপনকুমারের রহস্য গল্প। সেই থেকেই ডিটেক্টিভ গল্প ভালো লাগতো খুব। শ্রীস্বপনকুমার রচিত দীপক চ্যাটার্জী নামের ডিটেক্টিভের গল্পের সিরিজ পাওয়া যেত তখন। সমস্ত গল্পর শুরুতেই সকালের চা আর খবরের কাগজ নিয়ে দীপক আর সহকারী রতনলাল সবে বসেছে এমন সময় টেলিফোন বেজে ওঠা আর থানার ইন্সপেক্টর গুপ্তর ফোন। গল্প গুলো সব শেষ হতো চৌষট্টি পাতায়। সেই গাঁজাখুরি গল্প মনে আছে গোগ্রাসে গিলতো ওরা। এক বছর জন্মদিনে মামাবাড়ির সবাই একটা করে দীপক চ্যাটার্জীর বই দিয়েছিলো, নিতু দিদি, চম্পা মাসি, মামারা, বৌদি। এমন কি কৌশলে দিদিমার কাছ থেকেও একটা আদায় করেছিল খোকা। কে জানে দিদিমা পয়সা পেলো কোথায়? পাড়ার গয়লারা তাদের রোজগারের টাকা জমা রাখতো দিদিমার কাছে, হয়তো সেখান থেকেই। কিংবা কোনো মামাই কিনে দিয়েছিলো দিদার নাম করে। তারপর কয়েক সপ্তাহ চম্পা মাসি, নিতুদিদি আর খোকা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বইগুলো পড়েছিল। সেইবারেই আবিষ্কার করলো, মায়াবিনী কালনাগিনী আর তিন পেয়ালা কফি বইদুটোর গল্প হুবহু এক। নিজের লেখা থেকেই শ্রীস্বপ্নকুমার টুকতেন। তারপর থেকেই টোকা বই খুঁজে বার করা একটা খেলা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, বিশ বছর আগের সাথে আকাশ পথে ড্রাগনের মিল. কিংবা পাঁচ নম্বর ট্রেনের সঙ্গে রাজধানীতে কালনাগিনীর মিল। কে জানে কবে বন্ধ হয়েছিল ওই বইগুলো পড়া? ঠিক মনে পড়লো না খোকার। বিকেল হলেই চম্পা মাসি চলে আসতো । তখন জমে উঠতো নানা রকম খেলা।
এই সব ভাবনার মধ্যে দু চোখের ফ্রেম’এ এখনো ডান পাশের বাড়ির তিন ভাই বোন বন্দী। রায়ান আর ওর দিদিদের কথাবার্তা দূর থেকে আঁচ করতে পারে খোকা। দুই দিদি মিলে রায়ান’কে কিছু একটা করবার কথা বলছে কিন্তু মনে হচ্ছে রায়ান রাজি হবার পাত্র নয়। সারা রাগ করে, কিন্তু আনা একটু অন্য ধাঁচের, রায়ানকে জড়িয়ে ধরে আদর করে দেয় । তাতেই শেষমেশ কাজ হল । হাতের বেসবল ব্যাট ফেলে রেখে প্লাস্টিকের বালতি তুলে নেয় রায়ান। ওদের বাড়ির সামনের দিকে সন তখন জলের কলে লম্বা পাইপ লাগিয়ে নতুন ফুলের চারায় জল দেবার ব্যবস্থা করছে। রায়ান সেখানে বালতি বাড়িয়ে পুরো বালতি ভরে নেয় জলে । তারপর দিদিদের দিকে রওনা হয়। অতটুকু ছেলের জন্য জল ভরা বালতিটা বেশ ভারী। একধারে ঘাড় কাত করে তাড়া তাড়ি চলে ছেলেটা। জল ছলকে ছলকে পড়ে চার দিকে। আর চেরি অমনি বল লোফার মতো লাফিয়ে লাফিয়ে সেই জল মুখে ধরার চেষ্টা চালিয়ে যায় ।
দুপুরের ঘুম থেকে উঠে যখন মামাবাড়ির টালির চালের রান্নাঘরে চায়ের জল চাপানো হতো, নিতুদিদি আর চম্পা মাসি তাদের পুতুল আর রান্নার বাসন পত্র নিয়ে খেলাঘর সাজিয়ে বসতো । ভাত, ডাল, চাপানো হতো রান্নার উনুনে, খোকাকে যেতে হতো বাজার করতে; আলু, পটল, মাছ। পুতুলদের জামা বদল হতো, তাদের কথাবার্তা হতো, তাদের বিছানা করা হতো। এই পুতুল খেলা আর ঘর গোছানো খোকার মোটেই পছন্দ ছিল না । তার মন চাইতো ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে উইকেট এর সামনে দাঁড়াতে। কিন্তু বল করার কেউ ছিল না । নিতুদিদি খোকার মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝিয়ে সুজিয়ে রাজি করাতো আর চম্পা মাসি শেষ পর্যন্ত বলতো “তুই বাজার কর তাহলে কাল সকালে আমরা তোর ক্রিকেট খেলার সময় বল করবো”। থলি হাতে মামাবাড়ির রক থেকে নেমে উঠোনের কোনে বাজার যেত খোকা। কাগজ কুচি, কচি পাতা, আনাজের খোসা এই দিয়ে আলু, পটল, মাছ। সন্ধ্যে নামার ঠিক আগে পাড়ায় আসতো ফেরিওয়ালারা । ওদের খেলার জায়গা থেকে রাস্তা দেখা যায়। কখনও টিন -এর বাক্স ভরা সোনপাপড়ি। কোন দিন ঝাল মুড়ি, কিংবা আলুকাবলি। কমলা রঙের ম্যাগনোলিয়া আইসক্রিম কেনা বারণ ছিল, তাই লোভ হতো খুব। কাঠির ওপর বরফ, সেটা কমলা রঙের জল দিয়ে রঙিন। মুখে দিয়ে জল শুষে নিলে একটা কমলা লেবুর স্বাদ পাওয়া যেত। ওগুলো নাকি হসপিটালের রুগী ধোয়া জল দিয়ে বানানো হয়, বলতো বড়োরা। যে দিন আসতো সাড়ে বত্রিশ ভাজা সেদিন ওদের হুড়োহুড়ি একটু বেশি মাত্রায় পড়ে যেত । নিতু আর চম্পা দুজনেই খুব ভালবাসতো সাড়ে বত্রিশ ভাজা। খোকার হাত ধরে দৌড়ে যেত তারা দরজায়। তারপর কি জানি একটা বানিয়ে দিতো পাগড়ি মাথায় লোকটা, এখন একেবারেই মনে পড়েনা খোকার; শুধু নামটা ছাড়া, সাড়ে বত্রিশ ভাজা । মনে আছে একটি পাতলা টিনের সরু চাকতির ওপর চপ জাতীয় একটা জিনিস দিয়ে শুরু হতো সাড়ে বত্রিশ ভাজা। সারা পাড়ার বাচ্চা, বুড়ো সকলেই জড়ো হয়ে যেত সেখানে। এমন কি পাশের বস্তির ছেলেমেয়েরা, বিশ্বনাথ, ভোলা, কণিকা আর তার দিদি, পাড়ার সবার পরিচিত পাগলী পিসিমা, সকলেই জুটে যেত। ফেরিওয়ালার খাবার খেতে খেতে তিন চার তলা বাড়িগুলোর আড়ালে এক সময় টুপ্ করে ডুবে যেত সূর্য আর ঝুপ করে নেমে আসতো সন্ধ্যে। দূরে কোথও একটা দুটো করে শাঁখ বেজে উঠতো। মাঝে মাঝে সেই একই সাথে লোডশেডিং হয়ে যেত আর সারা পাড়া ঢেকে যেত অন্ধকারে। ফেরিওয়ালাদের কুপি আর ঘরে ঘরে মোমবাতি জ্বলে উঠতো আর চম্পামাসিদের বাগানের বেল ফুলের গন্ধে ম ম করত আসন্ন সন্ধ্যেটা।
কি ছিল ওই সাড়ে বত্রিশের মধ্যে? স্বাদটাও মনে নেই । নিতুদিদি বা চম্পামাসির কি মনে আছে? নামটাই বা সাড়ে বত্রিশ কেন? শুধু ওটা ঘিরে সকলের হুড়োহুড়িটাই গেঁথে গেছে স্মৃতিতে। আজকাল টিভিতে তো কতরকম স্ট্রিট ফুড শো হয়, দেশ বিদেশের। পৃথিবীর তাবড় তাবড় শেফ’রা নানা দেশে গিয়ে সেগুলো খায় আর বাহবা দেয়। কখনো মুম্বাইয়ের ভেলপুরি বা পাও ভাজি, কলকাতার ফুচকা, আরও কত কি। কিন্তু সাড়ে বত্রিশ ভাজা কখনো চোখে পড়ে নি।
আনা আর সারা পা ছড়িয়ে বসেছে ওদের বাগানের একটা গাছের তলায় । চার দিকে ছড়ানো নানারকম খেলার সরঞ্জাম। রায়ান যে জল এনেছে সেটা দিয়ে কাদার একটা মন্ড তৈরী করছে তারা। খুব মন দিয়ে কিছু একটা বানাচ্ছে যা এতদূর থেকে বোঝা ভার । রায়ান পাশে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে দেখে কি রকম কাজ চলছে। মাঝে মাঝে দুই বোনের কোনো একজন মুখ তুলে রায়ানকে কিছু একটা বলে। সঙ্গে সঙ্গে লক্ষী ছেলে দৌড়ে গিয়ে জিনিসটা নিয়ে আসে। চেরিও মেতে উঠেছে এই খেলায় । রায়ানের সাথে ছোটাছুটি তার কিছু কম হয় না। সেও লেজ নেড়ে নেড়ে রায়ান’এর পাশে দেখে কি মজাটাই না হচ্ছে। ওদের কাদা মাখা দেখে খোকার মনে পড়লো একবার ঝুলনের সময় মামাবাড়িতে কিরকম ঝুলন সাজিয়েছিল। রান্নাঘরের ধার করা পিঁড়ি ঝুলিয়ে বানানো ছোট্ট দোলনা, যেখানে রাধা-কৃষ্ণ দুলবে । তার পেছনে এক পাহাড়। পুরনো টিনের কৌটোদের নানাভাবে সাজিয়ে তাতে দিদিমার ছেঁড়া থান দিয়ে ঢেকে, কাদা মাটি দিয়ে লেপে পাহাড় তৈরী হলো। পাড়ার মাঠ থেকে ঘাস, পাতা শুকনো ডাল কুড়িয়ে পাহাড়ের ওপর গাছ-পালা। নিতুদিদি, চম্পামাসি আর খোকা অনেক রাত পর্যন্ত সাজিয়েছিল। বাড়িতে যার যা পুতুল ছিল তারা সব জায়গা পেলো সেই পাহাড়ে। কোথাও দাঁড়িয়ে আছে ঘাড় নাড়া সান্তাক্লজ, কোথাও পাহাড় থেকে হেঁটে বের হয়ে আসছে কঙ্কাল, কিংবা শান্তিনিকেতন থেকে কেনা বর-বৌ, বা কালীঘাট থেকে কেনা গণেশ ঠাকুর আর আলখাল্লা পরা নতমুখে চিন্তিত রবীন্দ্রনাথ। পুতুল গুলি একসঙ্গে দেখে আঁচ করা শক্ত ওই পাহাড়ে ঠিক কি হচ্ছে আরে কেনই বা রাধা কৃষ্ণ তার সামনে উপস্থিত। সেও একরকম সাড়ে বত্রিশ ভাজা গোছের হয়েছিল। তবে সেসব তৈরিতে মজা হয়েছিল খুব।
আনা, সারা আর রায়ান সেইরকমই একটি কাদালেপা পাহাড় বানিয়ে তুলেছে ইতিমধ্যে । তার ওপর রাখছে ওদের নানা রকম পুতুল, গলায় স্কার্ফ জড়ানো বার্বি স্কি করছে, রায়ানের কয়েকটা সাঁজোয়া জীপ্ গাড়ি, কোথাও সবুজ ঘাস পাতা দিয়ে ওরা বানিয়েছে ঘন জঙ্গল, তার মাঝে দু চারটে বন্য প্রাণী, প্লাস্টিকের ডাইনোসর। শুধু ঝুলনের দোলনাটাই যা বাকি আছে। হয়তো যীশুকে এনে বসবে। হয়তো খোকা ঝুলনের শাঁখ শুনতে পাবে এবার।
ঠিক শাঁখের আওয়াজ নয় তবে একটা খুব চেনা সুর বেজে ওঠে। গ্রীষ্মের দিনের এই সুর সারা পাড়ায় খুব চেনা। আইসক্রিম ট্রাক এসে গেছে। করোনার বন্দীদশায় গ্রীষ্মের শুরুতে এটা বন্ধ ছিল। এই কিছুদিন হলো আইসক্রিম ট্রাক আসা চালু হয়েছে। বাড়ি বাড়ি বাগানে খেলতে থাকা বাচ্চাদের জন্য ওই সুর একেবারে ম্যাজিক এর মতো কাজ করে । দুই দিদি সব ফেলে রায়ানের দু হাত দুজনে ধরে এক ছুটে ধেয়ে যায় রাস্তার দিকে। ঘেউ ঘেউ করতে করতে দৌড়ায় চেরি। ডেকের ধারে ঝুঁকে খোকা দেখে ওদের হইচই। এই আইসক্রিমওয়ালার মাথায়ও পাগড়ি। ভদ্রলোক শিখ, পাড়ার সকলেই চেনে গুরবিন্দর সিংকে। আরও অনেক বাচ্চারা জড়ো হয়েছে ট্রাকের চার ধারে। আনারা ছাড়াও লিয়া-লেসলি, রাস্তার উল্টোদিক থেকে দু ভাই জনি আর সানি, কিছু দূর থেকে হেঁটে এসেছে কার্তিক আর ওর ছোট বোন। বেশ কয়েকজন বাবা-মাও পৌঁছে গেছে। গাড়ি থামিয়ে নেমে এসেছে কেউ কেউ। ট্রাকটা ঘিরে রীতিমতো একটা হৈচৈ পড়ে গেছে। নিজের অজান্তে খোকাও কখন পৌঁছে যায় ওদের মাঝে। সকলের চোখ মুখ সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, শিশুদের আনন্দ কেমন দেখতে হয় সেটা নতুন করে খুঁজে নেয়। এক সময় হাত বাড়িয়ে একটা আইসক্রিম ও কিনতে হয়।
আলতো, মোলায়েম, আরামের রোদটা এতক্ষনে আরও নরম হয়ে উঠেছে, যেন স্বপ্নের গাছপাতার মাঝে একটা ক্যালেন্ডারের সূর্যাস্ত। ছবিটা আরও অনেক ছবি ভাসিয়ে তোলে খোকার চোখে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শহরতলীতে আইসক্রিমে মাখা সূর্যাস্ত, ভেনিস শহরের অলিগলির জঙ্গলে মদিরা ভেজা সূর্যাস্ত, বেইজিংয়ে মানুষের জঙ্গলে পীকিং ডাকের মত ঝলসানো সূর্যাস্ত, কালীঘাটে মামাবাড়ির পাড়ায় সাড়ে বত্রিশ ভাজার সূর্যাস্ত। পুরনো, সাদা কালো ছবিগুলো আবছা আলোছায়া থেকে হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠতে চায় আর পথের স্বাদ আর গন্ধ ম ম করে ওঠে। সন্ধ্যার মুখে একটা চেনা ফুলের সুন্দর মিষ্টি গন্ধও যেন নাকে এসে লাগে। ডেকের দরজা খুলে আইসক্রিম চাটতে চাটতে আস্তে আস্তে বসবার ঘরে ফিরে আসে খোকা। সোজা পৌঁছে যায় টেবিলে রাখা ল্যাপটপটার সামনে। সাড়ে বত্রিশ ভাজার রেসিপিটা খুঁজে বার করতেই হবে। গুগুলে পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই। হারিয়ে যাওয়া সব কিছুই আজকাল খুঁজে পাওয়া যায় ওখানে।
শুভ্র দাস
১৯৮৫ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস। গত পাঁচিশ বছর আছেন ডেট্রয়ট শহরে । পেশায় মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং -এর প্রফেসর। জন্ম ও ছোটবেলা কেটেছে কদমতলা, হাওড়ায়। পড়াশোনা খড়্গপুর আই. আই. টি. ও আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। নেশার মধ্যে ছবি তোলা ও ছবি আঁকা, লেখা লেখি, ঘুরে বেড়ানো, নাটক ও পলিটিক্স । বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক পরিবর্তন আনার কাজে বিশেষ ভাবে জড়িত।