শিল্পের দাবি, শিল্পীর দায়: আহ্‌মেদ লিপু

Values are genuine ‘first movers’ in the Aristotelian sense. From them proceed creative energy, productivity, fashioning, actualisation.
—Hartmann
মূল্যগুলো হলো অ্যারিস্টটলের মতানুরূপ আসল ‘আদি প্রবর্তকসমূহ’। তাদের থেকেই সৃজনীশক্তি, উৎপাদনক্ষমতা, গঠনপ্রণালী ও বাস্তবতার উৎপত্তি।
—হার্টম্যান
Beauty is neither totally dependent upon the person who experiences, nor upon the things experienced, it is neither subjective nor objective, neither the result of purely intellectual activity nor a value inherent in the object, but a relation between the two variables-the human organism and the object.
—Langfeld
সৌন্দর্য সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তিগত অনুভূতির উপর অথবা অনুভূত বস্তুর উপর নির্ভর করে না। এটা ব্যক্তিগত নয় বা বস্তুগত নয়। এটা কেবল চিন্তাজাত কর্মের ফল নয় বা বস্তুজাত মূল্য নয়। এটা হলো পরিবর্তনশীল ব্যক্তি এবং বস্তু এ দুটির সম্পর্ক বা সম্বন্ধ।
—ল্যাঙ্গফিল্ড

বিচিত্র ভাবনা আমরা রেফারেন্স হিসেবে পাই; কারো ভাবনার জগতে Author-রা মৃত, আবার কেউ বলতে চান ‘Every reading is miss reading’। গ্যায়টে উপহাস করে বলেন—Kill the dog, he is a reviewer. বিসর্জনের উৎসর্গপত্রে রবীন্দ্রনাথ, কাব্যতত্ত্বে শামসুর রাহমান কিংবা সমারূঢ়তে জীবনানন্দ দাশ সমালোচককে কী দৃষ্টিতে দেখেছেন তা আর কারো কাছেই অবিদিত নয়।

তবে এটাও বাস্তব, ভলতেয়ারের Philosophical Dictionary দান্তের সাহিত্য বুঝতে আমাদের তেমন কোনো সহায়তাই করবে না, যেমন করবে না বুদ্ধদেব বসুর মতামত মাইকেল মধুসূদনকে বুঝতে। তবে এর বড় ধরনের ব্যত্যয়ও যে নেই তা-ও তো নয়। আবু সয়ীদ আইয়ুবের মতামত রবীন্দ্র চর্চায় নিশ্চিতভাবেই সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

সে যাই হোক, Nothing but Text অনেকটা এই ধারণার আলোকেই আমরা আমাদের আলোচনা-সমালোচনায় প্রবৃত্ত হব। বক্তব্যকে একটি দার্শনিক ভিত্তির উপর স্থাপনের প্রয়াস থাকলেও উপরি কাঠামোতে সচেতনভাবে তেমন কোনো পরিপাট্য সাধনের চেষ্টা থেকে বিরত থাকব।

১.
বেমক্কা কেউ যদি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, আমরা কীভাবে একটি Text-কে কবিতা হিসেবে চিহ্নিত করব? দৃশ্যত অনেকে এতে বিরক্তবোধ করলেও এর তেমন কোনো সদুত্তর তাদের কাছে না-ও থাকতে পারে। প্রথমত, আমরা আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে একটি নির্দিষ্ট ফর্ম দেখেই বলে দিতে পারি এটা কবিতা, এটা প্রবন্ধ ইত্যাদি। পাঠ করার পর আসে তার মূল্য বিচারের প্রসঙ্গ। দ্বিতীয়ত, Text-এ উপস্থাপিত বিষয়বস্তুর বক্তব্যের ধরন, উপস্থাপন-কৌশল, ব্যবহৃত যুক্তির প্রকরণ ইত্যাদি থেকেও আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছাই। বর্তমানে কবিরা ছন্দকে বিসর্জন দিয়ে গদ্য ফর্মের কবিতা লিখতে সচেষ্ট। ফলে, শুধু ফর্ম দেখেই একটি Text-কে কবিতা হিসেবে শনাক্তকরণের দিন শেষই বলা চলে।

দর্শনের যে শাখা শিল্প নিয়ে কাজ করে তা হল মূল্য তত্ত্ব (Axiology) | শিল্পতত্ত্বের দার্শনিক ভিত্তি থাকলেও শিল্প-সাহিত্য এক স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নিয়ে ভাস্বর। পাশ্চাত্য চিন্তায় দর্শনের সঙ্গে জ্ঞানের যোগ সাক্ষাৎ, প্রয়োজনের যোগ পরোক্ষ। প্রাচ্য চিন্তায় উল্টো, দর্শনের সঙ্গে প্রয়োজনের যোগ সাক্ষাৎ, জ্ঞানের যোগ পরোক্ষ। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের মাধ্যমে আমাদের সভ্যতার mode of Intellect-কে প্রতিস্থাপনের প্রয়াস নেওয়া হয়। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব আমাদের শিল্পে-সাহিত্যেও পড়ে।

মানুষ তো শুধুমাত্র দৈহিক প্রয়োজনের জন্যই বাঁচে না, তার মানসিক চাহিদাও প্রবল। এই মানসিক চাহিদা থেকে যে শিল্প-সাহিত্যের উন্মেষ আমাদের উপমহাদেশে ঘটেছিল সেখানে প্রয়োজনই প্রত্যক্ষ প্রভাবকের ভূমিকায় কাজ করেছে, জ্ঞান ছিল গৌণ। অনেকটা বংশ পরম্পরায় গুরু-শিষ্যের মাধ্যমেই তা প্রবাহিত হত অথবা ঘটত বাস্তবের অনিবার্যতা থেকে হঠাৎ স্ফুরণ। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার অনতিকাল পরে এই গণেশ উলটে যেতে শুরু করে। কবিতাপত্র, কল্লোল এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য থেকে নিলেও এই উপমহাদেশের সামষ্টিক জনচেতনার তেমন বাইরে যাননি। কিন্তু এরা রবীন্দ্র-বলয়ের বাইরে যাওয়ার জন্য যে বোদলেয়ারীয় আধুনিকতার সরাসরি আমদানি করলেন সেখানে জ্ঞান চলে এল প্রত্যক্ষে, প্রয়োজন পরোক্ষে। এরই ফলে আমরা দেখেছি প্রকরণনির্ভর, হতাশ, নেতিবাদী এক আধুনিকতাকে।

অবাক করার মতো ঘটনা হচ্ছে, আহমাদ মাযহারের Text পাঠ করার পরে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়—যে দার্শনিক ভিত্তি বা শিল্পদর্শনের ওপরে এদের সৃজন তা Expressionism। তিনি বস্তুগত স্বরূপের ওপর গুরুত্ব না দিয়ে অভ্যন্তরীণ উপলব্ধিকে রূপকল্প বা দৃশ্যকল্পের মাধ্যমে উপস্থাপনে সচেষ্ট হয়েছেন। এই মতবাদের শিল্পধারায় যে সততা ও আবেগ-উৎকর্ষের ঐতিহ্য আছে তা তার সৃষ্টিকর্মে রক্ষিত হয়েছে। উপরন্তু তিনি সহজ কথা সহজে বলতেই প্রয়াসী। যেমন—

তোমার দৃপ্ত বঙ্কিম গ্রীবা
দুঃসাহসিক ভঙ্গিতে ফুটে আছে;
ধন্য তোমার উদ্ধত প্রতিবাদ!
[তোমাকে নিয়ে এলোমেলো ৪, পৃ. ২২]

অথবা,
এ নাকি শুধুই ভ্রান্তি । আমি
বালকস্বভাব মানুষের মতো শুধু
সুন্দর দেখে মুগ্ধ হয়েছি।…
[তোমাকে নিয়ে এলোমেলো ৩, পৃ. ২১]
কিংবা,
পথের শেষ খুঁজতে গিয়ে পেয়েছি অশেষ
সীমা খুঁজতে গিয়ে অসীম;
কূলের সন্ধান করে কেবল দেখা গেল অকূল পাথার!
এত যে ভাষা ভাষা করি শেষ পর্যন্ত তো দেখি ভাষাহীনতাই পরিণতি!
[হিসাব-নিকাশ, পৃ, ৪৩]

শিল্প আসলে অনেক রকম। এর স্বরূপ সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেতে হলে যে দার্শনিক ভিত্তির ওপর নির্দিষ্ট শিল্পকর্ম কিংবা শিল্প-আন্দোলন দাঁড়িয়ে আছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত অবগত থাকা প্রয়োজন। ম্যানারিজম থেকে শুরু করে পোস্ট-মডার্নিজম পর্যন্ত পাশ্চাত্যের জ্ঞানভিত্তিক বিভিন্ন শিল্প-আন্দোলনের দার্শনিক ভিত্তি ও প্রেক্ষাপট সম্পর্কে সম্যক অবহিত না থাকলে এদের রস আস্বাদন, হৃদয়ঙ্গম অনেকটাই অসম্ভব। ক্ষেত্রবিশেষে কেউ একটি বিশেষ শিল্প-দর্শন বা শিল্প-আন্দোলনের প্রতি অনুরক্ত থাকলে কিংবা নিজেকে একটি বা কয়েকটি মতাদর্শিক শিল্প-আন্দোলনের রসাস্বাদনের উপযোগী করে তুলতে পারলেও অন্য শিল্প-আন্দোলন বা শিল্পকর্ম সম্পর্কে বিরূপ মনোভাবাপন্ন হতে পারেন। এমনকি একটি বা দুটি প্রকাশগত প্রকরণের ভিন্নতার জন্যও এরূপ ঘটতে পারে। যেমন: বর্তমানে যারা প্রতীকাশ্রয়ী জটিলীকরণের মাধ্যমে শিল্প সৃজনে প্রয়াসী তারা কিংবা তাদের শিল্পকর্মের রসগ্রাহী ভোক্তারা তুলনামূলক সহজ-সরল ভাবে সৃজিত শিল্প অপছন্দ করতেই পারে। তাই বলে যদি সে শিল্পকর্মগুলো যে মতাদর্শিক শিল্পভিত্তির রুচির ওপর গড়ে উঠেছে তা প্রতিপাদন করে তাহলে শিল্প হিসেবে তা মোটেই ব্যর্থ নয়। তবে শিল্পের রাজনীতিতে এর ব্যত্যয় ঘটবার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। আর সমসাময়িক বিভিন্ন শিল্প-আন্দোলনের অনুসারীদের পারস্পরিক সম্পর্কের স্বরূপ বুঝতে নিশ্চয়ই অনুমান বিশারদ হতে হয় না।

২.
তাত্ত্বিক মতে, Text হচ্ছে এমনকিছু যা লেখকের সঙ্গে পাঠকের সংযোগ ঘটায়। পাঠঅভিজ্ঞতা থেকে পাঠক তার প্রয়োজনের নিরিখে (শ্রেণিকরণের সুবিধার্থে) একে বিভিন্ন নামে সংজ্ঞায়িত করতেই পারেন। তবে পাঠক কবিতা বলে যাকে সচরাচর অভিহিত করে, এর স্রষ্টা বোধের যে স্তরে থেকে এর উৎসারণ করেন পাঠক যদি সেই বোধের কাছাকাছি পৌঁছতে না পারেন তাহলে শব্দের সম্ভাবনা ও শক্তি অপচয়িত হয়। কবির স্ব-বয়ানে যদি কবিতার প্রেক্ষাপট প্রস্ফুটিত হয়, তাহলে কবিতায় ব্যবহৃত শব্দের শক্তি ও সম্ভাবনার তেমন কোনো অপচয়ের সুযোগই থাকে না—বিশেষত সুবেদী পাঠকের নিকট। আমাদের আলোচ্য Textটিতে এই বিশেষ সুবিধাটি আছে!

সাহিত্যিকের একটি বড় সুবিধা হচ্ছে তিনি ঘটনার কিংবা বিষয়ের বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে প্রকাশের সুযোগ পান যা অন্য কোনো মাধ্যমে (নৈর্ব্যক্তিক জ্ঞানের চর্চায়) পাওয়া যায় না। আমাদের আলোচ্য Textটিতে লেখকের অন্যান্য মানবিক গুণাবলির সঙ্গে সঙ্গে বিনয়ও একটি গুণ হিসেবে দৃশ্যমান। এই বিশেষ মানবিক গুণটি বর্তমান সময়ের শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে বেশ দুর্লভ। তবে তাঁর বিনয় ‘বিনয় ব্যাধিতে’ পরিণত না হলেই উত্তম! নইলে যার কবিতা ‘শামসুর রাহমানের মনোনীত কবিতা’ হিসেবে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ছাপা হয়, শিবনারায়ণ রায় যাঁকে জানান তাঁর কবিতা ভালো লেগেছে, একবিংশ’র মতো কবিতা প্রয়াসী কাগজে যাঁর কবিতা ১৯৮৬ সালে ছাপা হয়, যাঁর কবিতা অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক সম্পাদিত লোকায়ততে প্রকাশিত হয়, তাছাড়াও অনিন্দ্য, কিছুধ্বনিতে যিনি কবিতা লিখেছেন, তাঁর সাহিত্যিক সতীর্থরাও তাঁর কবিতা পছন্দ করেছেন (সর্বসত্তানিমগ্ন সাহিত্যিক আবদুল মান্নান সৈয়দ, পৃ. ৩৫) তিনিই কিনা বলেন—

আমি টের পাই যে কবিতা আমার হয় না, …
[পৃ. ১১]
আমি কবি নই। যৌবনে দু-একটা কবিতা লেখার চেষ্টা করেনি সামান্য লেখাপড়া
করেছে এমন বাঙালি পাওয়াই বরং দুষ্কর হবে। আমিও তেমনি বাঙালিস্বভাবের
একজন মানুষ। কবিতা লেখার কিছু বালখিল্য চেষ্টা একদা আমিও করেছিলাম।…
[পৃ. ১৩]
কবিতা লেখার ব্যাপারে যে নিষ্ঠা ও লিপ্ততা থাকলেও নিজেকে কবি বলে দাবি
করা যায় তা আমার নেই। তবে আশির দশকে ছোটদের জন্য কবিতা, গল্প বা
গদ্য রচনার পাশাপাশি বড়দের জন্যও কবিতা লেখার কিছু চেষ্টা আমিও
করেছিলাম।
[পৃ. ৭]

এটা বাস্তব, পাঠকের সরাসরি মূল Text পড়ে সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই যৌক্তিক। কে-কী বলল, কোথায় কার লেখা প্রকাশিত হল এটা মুখ্য বিবেচনার বিষয় হতে পারে না। তবে পরের মুখে ঝাল খাওয়ার প্রবণতা বাঙালির সহজে যাবে বলেও মনে হয় না।

নাকি তাঁর এই (আপাত) স্ব-অবদমনের পেছনে সাহিত্যে-রাজনীতির কোন প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা আছে? অনিন্দ্যের তৃতীয় সংখ্যা, জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৯৮৫-তে, ‘কবিতা উৎপাদন নয় সৃষ্টি চাই’ শিরোনামে তিনি একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। কাগজটির একই সংখ্যায় কবিতা বিষয়ক একটি ইস্তেহার পত্রস্থ হয়, এমনকি তিনজন কবির কবিতা নিয়ে একটি আলোচনাও। দৃশ্যত এই ইস্তেহার ও কবিতালোচনার সঙ্গে একটি গোষ্ঠী-কাগজের উন্মেষে-সম্পর্ক জড়িত। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, অনিন্দ্যর পরবর্তী তিন-চার সংখ্যায় তিনি অনুপস্থিত। জুলাই ১৯৮৮ সংখ্যায় একটি গল্পগ্রন্থের আলোচনা নিয়ে তিনি পুনঃআবির্ভূত হন। এই দীর্ঘ বিরতিতে তিনি কবিতা ভাবনাকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেছেন এমন কোনো দৃষ্টান্ত আমরা পাই না, না তাঁর প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থে কিংবা আমাদের আলোচা Text-এ উল্লিখিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকা যেখানে তাঁর লেখা পত্রস্থ হয়েছে সেখানে। আপাতদৃষ্টিতে তাঁর কবিতা চিন্তার সঙ্গে ইস্তেহারের বর্ণিত ভাবনার দ্বন্দ্ব Creation বনাম Construction-এর। আরোও পেছনে কার্যকারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, জ্ঞান পরোক্ষে থাকবে না প্রত্যক্ষে এই নিয়ে বাহাস; দর্শনের প্রাচ্যমুড়ের সঙ্গে পাশ্চাত্যমুডের দ্বন্দ্ব। সুনির্দিষ্ট করে বললে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রতিষ্ঠা, পাশ্চাত্যের শিল্প-দর্শনের প্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারের সফলতা ইত্যাদি বিবেচনা নিয়ে Expressionism-এর সঙ্গে modernism (বুদ্ধদেব বসু কর্তৃক আমদানিকৃত, বোদলেয়ারীয়) এর দ্বন্দ্ব। সম্ভবত এরই ফলে আমাদের আলোচ্য Text-এর শিরোনামে কবিতাগুলো শব্দের আগে ‘উপেক্ষিত’ শব্দটি যুক্ত হয়েছে।

৩.
আমাদের আলোচ্য Text-এর লেখক নিমগ্ন সাহিত্যিক, নিবেদিতপ্রাণ সাহিত্যকর্মী। সাহিত্যের বিচিত্র অনুষঙ্গ—কবিতা, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য, সমালোচনা সাহিত্য, অনুবাদ সাহিত্য, সম্পাদনা ইত্যাদিতে তাঁর বিহার। এটা একই সঙ্গে তাঁর শক্তিশালী ও দুর্বল দিক। দুর্বল দিক এইজন্য যে, এতসব অনুষঙ্গের মধ্যে যে কোনো একটিতে তাঁর Authority পরিষ্কারভাবে প্রস্ফুটিত নয়। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের সম্ভাব্য প্রায় সকল অনুষঙ্গের চর্চা করলেও কবিতায় তাঁর Authority এতটাই প্রস্ফুটিত যে, তিনি ‘কবিগুরু’ বলে সাধারণ্যে অভিহিত। নির্মলেন্দু গুণের গদ্যের ভলিউম পদ্যের চাইতে বেশি হলেও তিনি সর্বসাধারণে কবি বলেই পরিগণিত। কিন্তু আমাদের আলোচ্য Text-এর লেখকের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেনি। তবে অধুনা সম্পাদক, সমালোচক হিসেবে তাঁর পরিচিতি বাড়ছে। তিনি বইয়ের জগৎ নামে একটি সাহিত্য সমালোচনা প্রয়াসী কাগজ সম্পাদনা করছেন। নির্মোহভাবে দেখলে এর সাহিত্যিক অবদানকে আমলে নিতেই হয়।

তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে আলোচ্য Text-টির শেষ কবিতাটিতে তাঁর সমালোচক সত্তার, সাহিত্যিক দূরদর্শিতার প্রমাণ মেলে। আলোচনার সুবিধার্থে পুরো কবিতাটিই তুলে ধরছি—

আপনি এক অনন্য আত্মপ্রেমিক
আত্মপ্রেমই হচ্ছে প্রেমের সত্যরূপ।
আমাকে যদি কেউ তাই প্রেমের সত্যরূপের উপমা দিতে বলে
আমি আপনার কথা বলব।

আত্মপ্রেম যদি কারও প্রেরণা হয়ে থাকে
তবে তা আপনারই!
আপনি বলেছেন,
‘বিশাল বিস্তীর্ণ এই পৃথিবীতে
বাগানের সবুজ ঘাসের কোনও মানে নেই,
পাখির গানের কোনও মানে নেই,
আকাশের সুনীল শূন্যের কোনও মানে নেই,
আপনার সৃষ্টি, আপনার কাছে যা আর এক ‘প্রকৃতি’
তাই তারও কোন মানে নেই!
অনন্ত রহস্যময়তায় ভরা আপনার ‘প্রকৃতি’র
রহস্য ভেদ করা অসম্ভব ব্যাপার এক;
যাবতীয় অর্থময়তা আছে শুধুমাত্র
আত্মপ্রেমে আপনার!

আপনার এই অনন্ত মহান আত্মপ্রেম
আপনাকে কখনও অনুপ্রাণিত করে,
কখনও কখনও বেদনাহত করে,
আবার কখনও হিংস্র ব্যাঘ্রের মতো
ক্রোধকেও পরিণত করে একটি মহান সৃষ্টিশীল শিল্পে।

আপনি আত্মপ্রেমে মগ্ন হতে হতে
আত্মপ্রেমে আরও বেশি আস্থাশীল হতে হতে
আত্মপ্রেম-ঋদ্ধ হতে হতে
আপনার নিজস্ব পার্থিব অস্তিত্বকে
নিঃসাড় করে দিয়ে একসময়ে নিজেকেই অতিক্রম করে চলে যান।
ঠিক তখনই আপনার মহান আত্মপ্রেম,
আপনার মহাপ্রতাপশালী আত্মপ্রেম,
আপনার পরাবাস্তববাদী আত্মপ্রেম,
আপনারই নিষ্ঠুর হন্তারক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।

আর নিহত আপনি তখনই
আপনার ‘প্রকৃতি’ থেকে বিযুক্ত হয়ে
মৃত লাশের মতো পতিত এবং অর্থময় হয়ে ওঠেন।
[কোন এক আত্মপ্রেমিকের প্রতি, পৃ. ৪০]

একটি সাহিত্যিক ঘটনা-পরম্পরায় ‘ক্রোধান্বিত বিরাগের’ বশবর্তী হয়ে তিনি কবিতাটি লিখেছিলেন, ১৯৮৬ সনে। এখানে তরুণ কবির বিচারিক প্রয়াসের সঙ্গে সঙ্গে ‘বিনয়াবনত নন্দন’ দৃশ্যমান। সময় পরিক্রমায় তাঁর বক্তব্যের যথার্থতা প্রমাণিত হয়েছে। আবদুল মান্নান সৈয়দকে উপলক্ষ করে কবিতাটি রচিত।

8.
আহমাদ মাযহারের কবিতার নির্মোহ মূল্যায়নে বলতে হয়, তিনি শিল্পের বেদিতে যে মুখোশ পরেছেন তা ভেদ করে মুখাবয়ব অনেকাংশে দৃশ্যমান। এটি যে শিল্প-দর্শনের ভিত্তিতে তাঁর এই সৃজন প্রয়াস এর সঙ্গে অনেকাংশে অসঙ্গতিপূর্ণ। তাঁর প্রকাশ-উন্মুখতা আমাদেরকে রোমান্টিক মনস্তত্ত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়। যদিও তাঁর এই রোমান্টিকতা কল্পনার যথেচ্ছাচারে পর্যবসিত হয়নি; বরং অনেকটাই ক্লাসিকের অনুশাসনে পরিশীলিত।

আলোচ্য Text-এর শিল্পদর্শন হিসেবে তিনি যে শিল্প-আন্দোলনকে ভিত্তিভূমি হিসেবে বেছে নিয়েছেন তা যথেষ্ট বাস্তবজনোচিত কিনা সে প্রশ্ন থেকেই যায়। কেননা এক্সপ্রেশনিজম-এর (১৯০৩-১৯২৮) পরে কিউবিজম (১৯০৮-১৯১৮), ফিউচারিজম (১৯০৯-১৯২৯), দাদাইজম (১৯০৩-১৯২৩), সাররিয়ালিজম (১৯২৪-১৯৪০), অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজম (১৯৪০-১৯৬০), পপ আর্ট (১৯৬৫-১৯৭৫), মিনিমালিজম ও কনসেপচুয়ালিজম (১৯৬০-১৯৭০), পোস্ট কনসেপচুয়াল আর্ট (১৯৬৮-১৯৮০) ইত্যাদি শিল্প-আন্দোলন ইউরোপে দানা বেঁধেছিল। আর তাঁর সমসাময়িক প্রায় সকল সাহিত্যিক-বন্ধু মেতেছিলেন প্রকরণনির্ভর আধুনিকতায়। যদিও তাঁর দুএকটি কবিতায় (‘অনন্ত দীর্ঘ সে যেন হয়’, ‘অমল সংগীত’, ‘বেদনার অমলকথন’) চৈতন্যনির্ভর আধুনিকতার সামান্য ছোঁয়া আছে। তবে সেটা তেমনভাবে দাঁড়িয়েছে কিনা সেটা একটা প্রশ্ন।

তিনি Metaphor তৈরি কিংবা ব্যবহারে খুব একটা সফল একথা জোরের সঙ্গে বলা যায় না, যেমন বলা যায় না তিনি পুরোপুরি রোমান্টিক মনস্তত্ত্বের। তবে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, শিল্পী হিসেবে তিনি শিল্পের দায় মেটাতে সচেষ্ট হয়েছেন। কতটা সফলতা-সার্থকতার সঙ্গে তা করেছেন সে বিষয়ে আমরা অনুসন্ধানে ব্রতী হতেই পারি।

ব্যবহৃত গ্রন্থপঞ্জি:
১. অনিন্দ্য, সাহিত্য ত্রৈমাসিক, জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৯৮৫।
২. অনিন্দ্য, সাহিত্য ত্রৈমাসিক, জুলাই ১৯৮৮।
৩. An Examination of Logical Positivism, Weinberg, The Journal of Philosophy (January-march 1976)
৪. Philosophy and Logical syntax, Carnap, London 1936
৫. Logical Syntax of Language, Do, 1937
৬. আধুনিক বাংলা কবিতা, সম্পাদনা: আবু সয়ীদ আইয়ুব, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা ১৯৯৯।

 

আহমেদ লিপু

আগ্রহের বিষয় দর্শন। প্রকাশিত বই: ব্য়ক্তিকতায় নৈর্ব্যক্তিক (২০১১), দর্শন (২০১৭), ব্যক্ত : বিবিধ ফেনোমেনার দ্বান্দ্বিক পর্যালোচনা (২০১৮), যুগলসন্ধি: মুলধারা-বিকল্পধারা (২০১৯)

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top