মঈনুস সুলতানের কয়েকটি কবিতা

দৃশ্যকল্পের অভিপ্রায়

কফিখানার সাবুজিক আঙিনাতে আসতেই
আমার করোটিতে নানাবিধ চিত্রের কাকতালীয়ভাবে হয় প্রাদুর্ভাব,
ফতেপুর সিক্রির প্রসিদ্ধ প্রান্তরে পাতা হয় দাবার ছক—
শরীরের সুদর্শন মুদ্রায় হাঁটাচলা করে
কত্থকনৃত্যের কালোয়াতি চোলি পরা জিয়ন্ত গুটি,
গুলমার্গ ভ্যালিতে প্রসন্ন ডানায় ওড়ে শ্বেতশুভ্র বক—
দড়ির কুরছিতে বসে সূর্যদুপুরে দেখি… স্বর্গমন্দিরের খোয়াব,
চন্দ্রতাল সরোবরের নীলাভ সায়রে শত সহস্র সরোজ ওঠে ফুটি।

টিপয়ের পরিসরে ধোঁয়া ওড়ে মৃদু— পেয়ালায় উদ্দীপ্ত কাপাচিনো
তাকলামাকান মরুর বালিয়াড়ি ফুঁড়ে উঁকি দেয় অংকুর—
অর্কিডের অশেষ অঙ্গিকারে,
খুলে ফেলি চামড়ার চপ্পল… স্পর্শে শিহরিত হয় সবুজ তৃণ—
অলীক এক আরশিতে নিজেকে দেখি…তৃষিত…কপর্দকহীন…কাচভঙ্গুর,
হারিয়েছি পথ.. ছিলো না তো কখনো গন্তব্যের সুনির্দিষ্ট শপথ—
ফকিরের আংরাখা পরে ঘুরেছি দ্বারে দ্বারে।

এসে পড়ি— ইনকা সম্প্রদায়ের সূর্যমন্দিরের প্রাঙ্গণে
চৌবাচ্চায় বুজকুড়ি কাটে গুপ্ত ঝোরার তপ্ত নীর,
পাই না জবাব, প্রশ্ন করি বার বার… জানতে চাই প্রাণপণে
দিগন্ত জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে সপ্তবর্ণের বিচূর্ণ আবির,
বুঝতে পারি না রবাহূত দৃশ্যকল্পের আছে কী গূঢ় কোন অভিপ্রায়—
ফের সরে যায় পর্দা… পরিবর্তিত হয় দৃশ্যপট,
অশ্বত্থের জুরি ধরে শতেক শাখামৃগ সজোরে দোল খায়—
সর্ষের স্বর্ণালী অঙ্গনে দানা খুঁটে সবুজ টিয়া— বালুচরে ধূসর নদীতট।

 

লুয়াংপ্রবাং এর ফরাসি কেতার জলসত্র

ম্যামোরি মর্মরিত এক সেইলবোটে এসে নামি
লুয়াংপ্রবাং এর শানবাঁধা ঘাটে,
নীলিমার নন্দনতত্ত্ব যেন-বা মহিমান্বিত হয়েছে আজ
পরিব্রাজক বলাকার প্রবল পাখসাটে;

ভর দুপুরের পতঙ্গপ্রিয় ঝাঁপতালে—
বাতাসে ছুড়ে দেয়া রুদ্রাক্ষের নকশা এক
আঁকা হয়ে আছে নামউ নদীটির সুরতহালে,
ফিরে তাকাই বারেক—
আমার ভেতরে কেবলই তৈরি হতে থাকে ঊর্মিচঞ্চল অনুরণন,
ঝুপ ঝুপিয়ে স্রোতজলে ঝাঁপিয়ে পড়ে আটটি বেলেহাঁস
ভাবি — আবহাওয়া উত্তপ্ত নয় তো আজ তেমন—
না হয় ঘুরে ফিরে.. হাল্কা চালে হৃদয়ে ভরে নেই
ফিরিঙ্গিপানির সৌরভ নিঙড়ানো সুবাতাস;

নির্জন সরণীর শিয়রে এক বৌদ্ধ মন্দির
আধফোটা পদ্মের পরিসরে পদ্মাসনে পূজারি কয়েক,
ধূপধুনোর ধূসরিমা বিমুগ্ধ হয়ে আছে বহতা সমীর
আঙিনায় শুকোতে দেয়া হয়েছে ভূর্জপত্রের পাণ্ডুলিপি,
শিশুশ্রমণেরা সাজিয়ে রাখছে স্বর্ণপত্র
এভিয়ারির জালিতারে ঘেরা জিন্দানে ঝিমোয় জোড়া জলপিপি—
হেঁটে যাই— খানিক দূরে খুঁজে পাই— ফরাসি কেতার জলসত্র।

বলকানো জলে মেশে থোকা থোকা ভেষজ বল্কল
স্টিমবাথের বাষ্পে ভেজা লাওলুম গোত্রের এক নারী—
গামছায় নিছিয়ে নিচ্ছে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জলরঙে আর্দ্র দাগ,
পট্টবস্ত্রে ঢেকেঢুকে শরীরে জোড়া বৃত্তের বিভ্রান্ত ছল
কোথায় যেন দ্রবীভূত হয় বর্ণ— ঝলসে ওঠে বিলোল ফাগ;

মালবেরীর রেণুকায় প্রস্তুত পুরাকালীন কাগজের মতো
মনে হয়— সহিষ্ণু সম্ভাবনাময়— তার রেশমি মনন—
বঙ্কিম শরীরে আরশিতে সে সেরে নিচ্ছে সামান্য প্রসাধন,
বিস্ফোরিত হবে কী মেঘমালা আজ —
দিগন্ত ছাপিয়ে নামবে বুঝি-বা বিপুল বর্ষণ।

 

গন্তব্যের নিশানা

মেঘের সফেদ কর্দমে বুজে গেছে আকাশগঙ্গা
সুরাইয়া নক্ষত্র নিচয় ঢলে পড়েছে বামে,
লালবাগের বারুণী থেকে বাড়ি ফিরি আমি
রজনীর মধ্যযামে,
দেখি—
আমার ভদ্রাসনের আসবাবপত্র.. একি!
খাট পালঙ্ক বিবর্তিত হচ্ছে ডালপালা তরুবরে,
যে নারীকে ভালোবাসি— তার চন্দন চর্চিত দেহ থেকে
খুলে সুবর্ণ জেওরাত ফিরে যাচ্ছে খনির গহ্বরে!

দেখতে দেখতে— গরিবালয়ের ইটগুলো উড়ে গিয়ে
মেশে রূপশালী ধানের জমিনে,
বাস্তুহারা দুজন এ ঘোর দুর্দিনে,
আমাদের গতর থেকে বস্ত্রাদি ফিরে যায়
কার্পাসের খাস মহলে,
দাঁড়িয়ে গাছতলায় শরম নিবারণ করি
জোড়া হাতের বল্কলে;

গুলির দাগ লেগে আছে তার হৃৎপিণ্ডের সীমানায়
রক্তাক্ত মাংসের আঁশে বোনা হরিণ এক
দাঁড়িয়ে আঙিনায়
মায়াবী চোখ তুলে বলে—
চিত্রল যে ছাল ঝুলিয়ে ছিলে শৌখিনতার ছলে,
দাও ফেরত,
অরণ্যের আদি আকৃতিতে ঘুরে বেড়ানো নিয়েছি যে শপথ।

বেজায় বিপন্ন সময়— কোন পথে যাই
গন্তব্যের নিশানা সহজে খুঁজে না পাই,
করোটিতে ঝেঁপে আসে কুয়াশা নিবিড় মিলাঙ্কলি,
দাঁড়িয়ে সামনে ছল ছল চোখে নিরাবরণ
আদিরূপে আমার চন্দ্রাবলী।

 

মর্মমূলে নীরব বর্ণের সমাহার

গন্ধরাজের ঝোপে নিথর হয়ে পড়ে আছে
ডানাভাঙা দাঁড়কাক,
গাছের কাটা কাণ্ডটিকে দেখায় জীবাশ্মের মতো
আঙ্গুলে আমি গুনি তার বৃত্তাকার আঁক;
বিকাল গাড়িয়ে যাচ্ছে তাই
ঢুকে পড়ি অবশেষে ঘরে,
কামরাগুলো শূন্য— কেউ তো নেই
যে কথা বলবো অন্তরঙ্গ স্বরে।
জানালায় দেখি— পাপড়ি মুদে ঝিমচ্ছে সূর্যমুখী,
ওপারে গেলো সে বিগত বর্ষায়
ফ্রেমে বাঁধা সাদা-কালো ছবিতে হাসে ছোট্ট খুকি;

সময় হয়ে এলো— গোছাতে হয় সব কিছু
কিচেনে এসে বন্ধ করি গ্যাসের নীলাভ চুলা,
তালা দেই সিন্ধুকে—
জানালার পাল্লা যেন না থাকে খোলা;
উঠে আসি ছাদে— খানিক দূরে
ভেঁপু বাজিয়ে লঞ্চ যাচ্ছে ছেড়ে ঘাট,
এ নৌযানে যাত্রী হবো না কখনো আর
গোধূলিতে ছেয়ে যায় আমার রাজ্যপাট
মোছে মর্মমূলে আজ নীরব বর্ণের সমাহার।

 

মঈনুস সুলতান

জন্ম সিলেট জেলার ফুলবাড়ি গ্রামে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভারসিটি অব ম্যাসাচুসেটস থেকে আন্তর্জাতিক শিক্ষা বিষয়ে ডক্টরেট করেন। বছর পাঁচেক কাজ করেন লাওসে-একটি উন্নয়ন সংস্থার কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ হিসাবে। খণ্ড-কালীন অধ্যাপক ছিলেন ইউনিভারসিটি অব ম্যাসাচুসেটস এবং স্কুল অব হিউম্যান সার্ভিসেস এর। কনসালটেন্ট হিসাবে জিম্বাবুয়ে, আফগানিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, মোজাম্বিক, মেসিডোনিয়া ও কিরগিজস্তান প্রভৃতি দেশে কাজ করেন অনেক বছর।

ইবোলা সংকটের সময় লেখক ডেমোক্রেসি এন্ড হিউম্যান রাইটস নামে একটি ফান্ডিং কর্মসূচির সমন্বয়কারী হিসাবে সিয়েরা লিওনের ফ্রিটাউনে কাজ করেন। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাভানা শহরে বাস করছেন। ব্যক্তিগত জীবনে প্রাচীন মুদ্রা, সূচিশিল্প, পাণ্ডুলিপি, ফসিল ও পুরানো মানচিত্র সংগ্রহের নেশা আছে।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top